বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো নয় মাস ধরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বহুমুখী গভীর ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ভেতর থেকে শুরু করে ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পর্যন্ত এই চক্রান্তের জাল বিস্তৃত ছিল। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপথগামী এবং ধ্বংস করার লক্ষ্যে পরিচালিত এসব ষড়যন্ত্র সমের্ক দেশে-বিদেশে প্রকাশিত গ্রন্থ থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এখন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এসব তথ্য নিয়ে বাংলাদেশে কখনো তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। কেন হয়নি, তা কিছুটা বিস্ময়কর বৈকি।

স্বাধীনতার দাবি বাদ দিয়ে একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের জন্য ‘স্বায়ত্তশাসন’ বা ‘আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের’ প্রস্তাব নিয়ে ’৭১ সালে অস্থায়ী সরকারের একাংশকে কেন্দ্র করে তত্কালীন মার্কিন প্রশাসনের প্রধান দুই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বহুমুখী রাজনৈতিক-কূটনৈতিক তত্পরতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী, বিশেষভাবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিপথগামী করতে মার্কিন প্রশাসনের গোপন ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায় নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের দি হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে (প্রকাশ : ১৯৭৯ সাল)। এই বিশাল গ্রন্থের ৭৬ পৃষ্ঠার ‘কনটাক্টস উইথ দ্য বাংলাদেশ এক্সাইলস’ পরিচ্ছেদে ’৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমের্ক মার্কিন প্রশাসন এবং তাদের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়।

নিউইয়র্কে প্রকাশিত ও বহুল আলোচিত মার্কিন সাংবাদিকের দি প্রাইস অব পাওয়ার : কিসিঞ্জার ইন দি নিক্সন হোয়াইট হাউস (প্রকাশ : ১৯৮৩ সাল) গ্রন্থে সে সময়কালের মার্কিন প্রশাসন, বিশেষভাবে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকার তথ্যবহুল আলোচনা রয়েছে। এই দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছাড়াও প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন কর্তৃক প্রকাশিত মার্কিন প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোর পূর্ণ বিবরণ, ‘কার্নেগি পেপার্স’ এবং লরেন্স লিফত্সুলজের বড় নিবন্ধ ‘মার্ডার অব মুজিব’ প্রভৃতি সূত্র থেকেও একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মার্কিন প্রশাসনের বিভিন্ন তত্পরতার খবর পাওয়া যায়। এ এম এ মুহিতের অ্যামেরিকান রেসপন্স টু বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার (প্রকাশ : ১৯৯৬ সাল) থেকে আমরা কিছু তথ্য পেতে পারি। বিশেষ করে সে সময়ে ড. কিসিঞ্জারের সহযোগী ক্রিস্টোফার ভ্যান হোলেনের ‘দি টিল্ট পলিসি রিভিজিটেড’ (এশিয়ান সার্ভে, এপ্রিল ১৯৮০) নামের বড় নিবন্ধটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এ ক্ষেত্রে। এই নিবন্ধে একাত্তরে পাকিস্তানের সমর্থনকারী মার্কিন প্রশাসনের বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী নীতি ও কার্যকলাপ সমের্ক অনেক তথ্য রয়েছে।

ইয়াহিয়া সরকারের মন্ত্রী (১৯৬৯-৭১) অধ্যাপক জি ডব্লিউ চৌধুরীর ১৯৯৩ সালে ঢাকায় পুনর্মুদ্রিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ দি লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান (প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৪ সাল) থেকেও একাত্তরের, বিশেষ করে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কালে মার্কিন প্রশাসনের যোগসাজশে পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের তত্পরতার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। আর ১৯৮৬ সালে ঢাকায় প্রকাশিত মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ (প্রকাশ : ১৯৮৬) থেকে আমরা মুজিবনগর সরকারের একাংশের সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতা ছাড়াও সে সময়ের আরো অনেক চক্রান্তের কথা জানতে পারি।

কী ষড়যন্ত্র ছিল?

ড. কিসিঞ্জারের লেখা থেকে জানা যায়, একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে মার্কিন পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত ছিল-স্থগিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান, এই অধিবেশনের আগে বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহ্বান এবং একটি নতুন নির্বাচন ইত্যাদি। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিত্বে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাধিক্যের কথাও ছিল। মার্কিনিদের প্রচেষ্টার পর ইয়াহিয়া খান শেষ পর্যন্ত তথাকথিত ‘একটি রাজনৈতিক সমাধানের’ লক্ষ্যে প্রদত্ত তাদের কার্যপদ্ধতি ও সময়সূচি মেনে নিয়েছিলেন বলে কিসিঞ্জার সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই ‘পূর্ব পাকিস্তান’ সমস্যার একটি ‘রাজনৈতিক সমাধান’ করা। সে জন্য পাকিস্তান সরকারকে কতগুলো উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করানোর জন্য তারা সচেষ্ট ছিল। এর মধ্যে ছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রিলিফ তত্পরতাকে আন্তর্জাতিকীকরণ, বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের (যাদের বিরুদ্ধে কোনো ‘সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ’ নেই) জন্য সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নরের স্থলে একজন বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ প্রভৃতি। এভাবেই বাঙালি জনগণকে এবং বিশ্ববাসীকে বোঝানোর চেষ্টা চলছিল যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ‘পূর্ব পাকিস্তান সংকটের’ একটা ‘রাজনৈতিক সমাধান’ চায়।

১৯৭১ সালের নভেম্বরে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী যখন ওয়াশিংটন সফরে গিয়েছিলেন তখন তাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করে তারা কয়েকটি কাজ করিয়েছেন। এগুলো হলো-পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক গভর্নর নিয়োগ, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, মুজিবকে ফাঁসি না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি এবং কিছু বাঙালি নেতার সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলোচনা করার আগ্রহ প্রভৃতি। মিসেস গান্ধীকে এই মর্মে আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে ইয়াহিয়ার সুসঙ্ষ্ট (সময়সীমা নিয়ে) পরিকল্পনা রয়েছে-১৯৭২ সালের মার্চ মাসের মধ্যে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং তার অল্প কিছুদিন পরে স্বাধীনতা দেওয়া হবে।

আসলে, আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, মুক্তিযুদ্ধের সেই সময় মার্কিন প্রশাসন ও পাকিস্তানি সামরিক গোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতার লক্ষ্যকে বিপথগামী করা এবং সময়ক্ষেপণ করা। মার্কিন প্রশাসনের এই আশ্বাস যে কত ভ্রান্ত ছিল, সেটা আমরা জি ডব্লিউ চৌধুরীর ভাষ্য থেকে জানতে পারি।

ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ

মার্কিন পরিকল্পনাকে কার্যকর করার লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকারের একাংশের সঙ্গে বাঙালি নেতাদের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অত্যন্ত গোপনে। কিসিঞ্জারের বই থেকে কলকাতার মার্কিন প্রতিনিধির সঙ্গে প্রবাসী বাঙালি নেতাদের যোগাযোগ সমের্ক মোটামুটি বিস্তারিত বিবরণ জানা যায়। এতে দেখা যায়, একাত্তরের ৩০ জুলাই আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও প্রবাসী সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কুমিল্লার সাংসদ জহিরুল কাইয়ুম কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ করেন। এই যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের অনুমতি নিয়ে কিসিঞ্জার সম্মতি প্রদান করেন।

কিসিঞ্জারের ভাষ্য অনুযায়ী ১৪ আগস্ট জনাব কাইয়ুম মার্কিন কনস্যুলেটকে জানান যে, পাকিস্তান সরকার যদি আওয়ামী লীগের ছয় দফা মেনে নেয় তাহলে ‘তারা পূর্ণ স্বাধীনতার নিচে নেমে এসেও’ সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে।

এ পর্যায়ে মার্কিন প্রশাসন ইয়াহিয়া খানকে কলকাতার যোগাযোগের কথা জানায়। ইয়াহিয়া খান এই যোগাযোগকে ‘অভিনন্দিত’ করেন এবং তাকে এ ব্যাপারে ‘অবগত রাখার’ অনুরোধ জানান। যোগাযোগ আরো অগ্রসর হলে মার্কিন কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত ’৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেটের রাজনৈতিক অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন এবং বাঙালি জনগণের ‘আকাঙ্ক্ষা’ পূরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের কথা বলেন। বৈঠকটি হয়েছিল কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর বাসভবনে। এই বৈঠকের পরও ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। আমরা লরেন্স লিফত্সুলজের লেখা থেকে জানতে পারি, সে সময় খন্দকার মোশতাকের এসব তত্পরতার সঙ্গে মাহবুব আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুর যুক্ত ছিলেন। এসব তত্পরতা চলেছিল প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের অগোচরে।

কিসিঞ্জারের বইতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগীদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদের যোগাযোগ এবং ষড়যন্ত্রের আরো বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। একাত্তরের অক্টোবরে-নভেম্বরে এই ষড়যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে গেলে তা আর বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

কলকাতা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি তত্কালীন মার্কিন প্রশাসন নভেম্বরের শেষভাগে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া সরকার এবং তথাকথিত আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করেছিলেন। পাকিস্তান সেনা শাসকদের পছন্দের দুই নির্বাচিত এমএনএ নূরুল ইসলাম এবং এস বি জামান ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটের সহায়তায় ইসলামাবাদে পৌঁছান। তারা ২৩ নভেম্বরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। পরের দিন তারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করে ইয়াহিয়ার সঙ্গে তাদের আলোচনা অবহিত করেন। তারাও জহিরুল কাইয়ুমের মতোই ছয় দফার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধান এবং অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। এ রকম প্রস্তাবের প্রতি পাকিস্তান সরকারের সমর্থন থাকলে তারা কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী সরকারের সঙ্গেও কথা বলতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছিলেন।

২০০০ সালে ঢাকার পুস্তকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এনায়েতুর রহীম এবং জয়সী এল রহমানের বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার অ্যান্ড দি নিক্সন হোয়াইট হাউস ১৯৭১-এ নূরুল ইসলাম ও এস বি জামানের ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতা সমের্ক আরো তথ্য রয়েছে।

পাকিস্তানি মনোভাব কী ছিল?

জি ডব্লিউ চৌধুরী তার দি লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান গ্রন্থে লিখেছেন, ওই সময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর মনোভাব ছিল বাঙালিদের প্রতি খুবই বিদ্বেষমূলক। তাদের মনোভাব ছিল অনেকটা এ রকম যে রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে কথাবার্তা হবে কিন্তু তার আগে অবশ্যই বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। বেশির ভাগ জেনারেলই মনে করেছিলেন, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে’। সুতরাং বাঙালিদের আর কোনো ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। বিচারপতি কর্নেলিয়াসকে পূর্ব পাকিস্তানকে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার বিধান রেখে সংবিধান তৈরি করতে বলা হয়েছিল। প্রস্তাবিত সংবিধানে একজন বাঙালি ভাইস প্রেসিডেন্ট রাখার কথা বলা হয়েছিল, যিনি ঢাকায় অবস্থান করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চর্চা করবেন। এই বইয়ে আরো বলা হয়েছে, শেখ মুজিবের সঙ্গে তার আইনজীবী এ কে ব্রোহির মাধ্যমে আলোচনা শুরু করা হয়েছিল। আবার তারই মধ্যে একটি সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়। জি ডব্লিউ চৌধুরী আমেরিকার পরামর্শে একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে কলকাতায় প্রবাসী সরকারের কোনো কোনো সদস্যের সঙ্গে আলোচনার কথাও উল্লেখ করেছেন। তাজউদ্দীনকে বাদ দিয়ে এই আলোচনা চলছিল প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে।

স্বাধীনতা ছাড়াই আপস সমঝোতা?

মার্কিন সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসন একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট কমিটিতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকের কথা উল্লেখ করে এ তথ্য প্রকাশ করেছেন যে কিসিঞ্জার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কলকাতায় আমরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর পর্যন্ত কম করে হলেও আটবার যোগাযোগ হয়।’ কিসিঞ্জার আরো জানান, ‘আমরা ইয়াহিয়া খানকে কলকাতার বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার কথা বলি।’

লরেন্স লিফত্সুলজ লিখেছেন, ‘কার্নেগি পেপার্স’-এর তথ্য অনুসারে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ সিআইএ, জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একান্ত বিশ্বস্তদের দিয়েই এই তত্পরতা পরিচালনা করে। তাদের মতে, ওয়াশিংটনের সরকারি পর্যায়ে মাত্র ছয়জনের জানামতে এই গোপন যোগাযোগের কাজ চলে। আর কলকাতায় মার্কিন কনস্যুলেটের রাজনৈতিক অফিসার জর্জ গ্রিফিন এতে যুক্ত ছিলেন।

‘কার্নেগি পেপার্স’ অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার দিন-তারিখ ঠিক হয়েছিল একাত্তরের অক্টোবরে। সে সময় অস্থায়ী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেখানে অবস্থানকালেই এককভাবে এবং কারো সঙ্গে আলোচনা ব্যতীত পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়াই একটি আপস-সমঝোতার কথা খন্দকার মোশতাক ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ‘কার্নেগি পেপার্স’ অনুযায়ী এই গোপন ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পেয়ে গেলে খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

লরেন্স লিফত্সুলজ ১৯৭৬ সালের জুন মাসে ঢাকায় খন্দকার মোশতাককে মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিনিদের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তা তিনি স্বীকার করেন। তবে মার্কিনিদের সঙ্গে কী সমঝোতা হয়েছিল তিনি তা বলেননি। খন্দকার মোশতাক এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘আপনি যদি তা জানতে চান তাহলে নিক্সনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন। আমি কিছু বলব না।’

মঈদুল হাসানের মূলধারা ’৭১ গ্রন্থে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কনস্যুলেট সদস্যরা পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ’৭১ সালের সেপ্টেম্বরে এ সমের্ক প্রবাসী সরকারের কাছে জানতে চাইলে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই স্বীকার করেন, এ ধরনের যোগাযোগের খবর তারাও পেয়েছেন। এ নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে দুজন জাতীয় পরিষদ সদস্যের দেখা করার কথা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট স্বীকার করেন।

মঈদুল হাসানের গ্রন্থ থেকে মাহবুবুল আলম চাষীর তত্পরতা সমের্ক আরো জানা যায়, নভেম্বরে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে দায়িত্বচ্যুত হয়েও চাষী ১৩ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তার সঙ্গে দেখা করেন। সে বিবৃতির মূল কথা ছিল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্যে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হলে বাংলাদেশ সরকার তত্ক্ষণাত্ এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবে। সৈয়দ নজরুল সে বিবৃতিতে সই দেননি এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি তাজউদ্দীনকে অবহিত করেন। মাহবুব আলম চাষীর এ প্রচেষ্টার পেছনে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিস্থিতিকে চূড়ান্ত পর্যায়ে পুরো পাল্টে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ষড়যন্ত্রের পুরো ইতিহাস প্রকাশ হোক

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগীদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়েছিল। একাত্তরের বিজয়ের আগে তাকে কিছুটা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছিল মাত্র, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং স্বাধীনতার পরও খন্দকার মোশতাক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে থেকে যান, শুধু তার মন্ত্রণালয় বদল হয়েছিল। আর সরকার ও দলের উচ্চপদে থেকেই খন্দকার মোশতাক ও তার সহযোগীরা তাদের ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখতে পেরেছিল। শেষ পর্যন্ত খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করে ক্ষমতায় পরিবর্তন আনা হয়। সেদিনও তার পাশে ছিল তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষী।

’৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র চলেছিল তার পুরো ঘটনা কেন প্রকাশ করা হয়নি, কেন এ সমের্ক কোনো তদন্ত হয়নি-এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন। যাদের দায়িত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি, সেই আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকার এ সমের্ক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তাও বিদেশী সূত্র থেকে। খন্দকার মোশতাক ছাড়াও নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে প্রবাসী সরকারকে কেন্দ্র করে আরো যেসব দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র চলেছিল, সেগুলো নিয়েও তেমন কোনো আলোচনা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত এই খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

একইভাবে ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনাকারী এমএনএ নূরুল ইসলামকে প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃবৃন্দ এইসব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত সমের্ক কোনো কথাও বলেনি। বরং তাদের অনেককে মন্ত্রী করা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং ক্ষমতার পটপরিবর্তনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল।

স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তাতে বিজয়ের ৩৩ বছর হয়ে গেলেও আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে মহান এই অধ্যায়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যেমন রচিত হওয়া উচিত, তার সঙ্গে সঙ্গে তেমনই এর বিরুদ্ধে সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক তত্পরতাও প্রকাশিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত