বিজ্ঞাপন

১৯৭১। বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। হানাদার বাহিনীর অত্যাচার আর নিপীড়নে অবরুদ্ধ দেশবাসী।

অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসাসহ জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর অভাব চারপাশে, ক্রমাগত তা প্রকট থেকে প্রকটতর হচ্ছে। দুর্গত মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো।

নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় হানাদার বাহিনী। ফলে বাড়ছে জনদুর্ভোগ।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ভেতরে ভিন্নধারায় ত্রাণকার্য চালানোর উদ্যোগ নেন লন্ডনের বাসিন্দা রজার মুডি।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমার্ধে তিনি একটি অভিযানের পরিকল্পনা করেন, নাম—‘অপারেশন ওমেগা’।

দুটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই অভিযানের পরিকল্পনা করেন তিনি। প্রথমত, দুর্দশাগ্রস্ত বাংলাদেশিদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি পশ্চিমা জনসাধারণ ও সরকারগুলোর নজরে আনা।

রজার মুডি ছিলেন একাধারে সমাজসেবী, সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও পিস নিউজ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক।

১৬ এপ্রিল রজার মুডি অপারেশন ওমেগার জন্য জনবল সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি দেন পিস নিউজ পত্রিকায়:

‘লন্ডনবাসীদের ছোট একটি দল পূর্ব বাংলায় ত্রাণসামগ্রীসহ অভিযানের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করছে।...শারীরিকভাবে সক্ষম এবং ব্যক্তিগত বন্ধনে আবদ্ধ নন, এমন সম্ভাবনাময় স্বেচ্ছাসেবীদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিস নিউজ-এর রজার মুডিকে লেখার অনুরোধ করা হলো (দয়া করে ফোন করবেন না)।’

default-image

রজার মুডির ডাকে যুক্তরাজ্যের আটজন ও যুক্তরাষ্ট্রের তিন অধিবাসী সাড়া দেন। এই ১১ জনকে নিয়েই মে মাসে গড়ে ওঠে অপারেশন ওমেগার মূল দল।

তাঁদের মধ্যে চারজন ছিলেন নারী। লন্ডনের ৩ কেলডোনিয়ন রোডে স্থাপন করা হয় অপারেশন ওমেগার সদর দপ্তর ।

১ জুলাই ওমেগার চার সদস্য ত্রাণসামগ্রীসহ একটি কে-৯ অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে লন্ডন থেকে সড়কপথে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দেন।

কুয়েত পৌঁছানোর পর অ্যাম্বুলেন্সটি নৌপথে মুম্বাই পাঠিয়ে দিয়ে বিমানে কলকাতা এসে নামেন তাঁরা।

ওমেগার বাকি সদস্যরা বিমানযোগে ভারতে পৌঁছান আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে।

১১ জুলাই ওমেগা সদস্য বেনার্ড রিভার কলকাতায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হোসেন আলীর সঙ্গে দেখা করেন।

বেনার্ড হাইকমিশনারকে বলেন, ওমেগার সদস্যরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বেশ প্রচারণা আর আড়ম্বরের সঙ্গে সীমান্ত থেকে মহাসড়ক ধরে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন।

তিনি আরও বলেন, এই অভিযান আগস্ট মাসেই শুরু করার পরিকল্পনা করেছেন তাঁরা।

বেনার্ড দাবি করেন, তাঁদের বিষয়টি ভারতীয় প্রবীণ গান্ধীবাদী রাজনীতিবিদ জয়প্রকাশ নারায়ণের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব টি এন কাউল ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব পি এন হাকসারকে জানানো হয়েছে। তাঁরা এ বিষয়ে কোনো আপত্তি করেননি।

৩০ জুলাই লন্ডন থেকে অপারেশন ওমেগার প্রচারপত্র প্রকাশ পায়। প্রচারপত্রে এই অভিযানের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কাজের পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়।

সেখানে বলা হয়েছিল, তাঁরা তাঁদের অভিপ্রায় পাকিস্তান সরকারকে অবহিত করেছেন।

শিগগিরই সারা বিশ্বকেও অবহিত করবেন। তবে তাঁদের কাজের জন্য তাঁরা কারও অনুমতি প্রার্থনা করবেন না।

কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, প্রথম দল দুটি গাড়িভর্তি ত্রাণসহ সীমান্ত অতিক্রম করবে।

কোনো কারণে প্রথম দল তাদের কাজে বাধাগ্রস্ত হলে দ্বিতীয় দল এগিয়ে আসবে তাদের সাহায্যের জন্য। আর যোগাযোগ ও সহায়তার জন্য সীমান্তে একজন এবং কলকাতায় একজন ওমেগা সদস্য উপস্থিত থাকবেন।

প্রয়োজনে তাঁদের মাধ্যমে লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন তাঁরা।

’৭১ সালে ভারতীয় বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশ পায়। এর মধ্যে দৈনিক যুগান্তর-এর ভূমিকা ছিল অসামান্য।

৮ আগস্ট যুগান্তর লেখে: ‘অপারেশন ওমেগা কোনো সামরিক কোড নয়। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকা—এই তিন মহাদেশের একদল অহিংস সত্যাগ্রহী যে অভিনব অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন, তারই সংক্ষিপ্ত নাম “অপারেশন ওমেগা”।...অভিযাত্রীদের অগ্রদূতরা ইতিমধ্যেই নয়াদিল্লি ও কলকাতায় সমবেত হয়েছেন এবং অভিযানের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করেছেন।’

ওমেগা দলের সদস্যরা কলকাতায় সংবাদ সম্মেলন করেন ১৩ আগস্ট। দলনেতা রজার মুডি ও সদস্য দানিয়েল গ্রোটা বক্তব্য রাখেন এ সম্মেলনে। তাঁরা বলেন, ১৭ আগস্ট তাঁদের ৮ সদস্য নিরস্ত্র অবস্থায় ত্রাণ বোঝাই দুটি ল্যান্ডরোভার গাড়িতে করে বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন।

১৭ আগস্ট সকালে শুরু হয় ওমেগা সদস্যদের অভিযান। অভিযান শুরুর সংবাদও প্রকাশ পায় যুগান্তর-এ বিস্তারিতভাবে: ‘খাদ্য, বস্ত্র ইত্যাদি সাহায্য দ্রব্য নিয়ে ওমেগার আট সদস্যবিশিষ্ট সত্যাগ্রহী দলটি দুটি বিশেষ ধরনের “স্টেশন ওয়াগন’’ গাড়ি বোঝাই করে পেট্রাপল দিয়ে যশোর রোড ধরে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেন বেলা ১২টা বেজে দশ মিনিটের সময়।

গান্ধী পিস ফাউন্ডেশনের সদস্যবৃন্দ এবং বহু নরনারী এই সীমান্তে উপস্থিত থেকে মানবতাবাদী আন্তর্জাতিক সত্যাগ্রহী দলকে অভিনন্দিত করেন।...বেনাপোল অতিক্রম করে যশোর রোড বরাবর সত্যাগ্রহীরা এগিয়ে চলতে থাকলে পাক সৈন্যের একটা দল এসে ওঁদের বাধা দেয়।

সৈন্যদের সঙ্গে সত্যাগ্রহীদের তর্ক শুরু হয়।...পাক সৈন্যরা সত্যগ্রাহীদের পথ আটক করলে তাঁরা ভারত সীমান্ত থেকে পাঁচ শ মিটার দূরে যশোর রোডের ওপর অবস্থান করতে থাকেন।’

মুক্তিযুদ্ধকালে মোট নয়টি অভিযান পরিচালনা করেছিল অপারেশন ওমেগা; এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর '৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিল এই দলটি

পরদিন ওমেগা সদস্য ক্রিস্টিনা প্রাটের কাছ থেকে জানা যায় এর পরের ঘটনা। কলকাতায় ফিরে তিনি বলেন, সীমান্তে পাকিস্তানি সেনারা গতি রোধ করলে তাঁরা সেখানেই বসে পড়ে সত্যাগ্রহ শুরু করেন। রাত সাড়ে নয়টায় একজন ব্রিগেডিয়ার বেআইনিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যান তাঁদের। গ্রেপ্তারের পর প্রথমে তাঁদের বেনাপোল সীমান্ত ফাঁড়িতে নিয়ে ভোর পর্যন্ত জেরা করা হয়। জেরা শেষে নেওয়া হয় যশোর সেনা ছাউনিতে।

পরে ১৮ আগস্ট দুপুরে ত্রাণসামগ্রী, গাড়িসহ বেনাপোল সীমান্তে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের। এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সতর্ক করে তাঁদের বলে যে আবার বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাঁদের শাস্তি দেওয়া হবে।

ওমেগা সদস্যরাও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিশ্চিত করেন, ত্রাণসামগ্রী নিয়ে আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করবেন তাঁরা। বেলা দুইটায় তাঁরা ভারতে ফিরে আসেন।

সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ওমেগা সদস্যরা তাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান ১৯ আগস্ট। বলেন যে অভিযান তাঁরা অব্যাহত রাখবেন এবং সহসাই প্রকাশ করবেন তাঁদের পরবর্তী অভিযানের পরিকল্পনা।

১ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে আরও চার ওমেগা সদস্য একটি রোলস রয়েস অ্যাম্বুলেন্সসহ কলকাতার উদ্দেশে রওনা হন। আগের মতোই তাঁরা কুয়েত পর্যন্ত সড়কপথে এসে সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সটি নৌপথে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা বিমানযোগে কলকাতা আসেন।

৪ সেপ্টেম্বরের যুগান্তর থেকে জানা যায়, ৫ সেপ্টেম্বর ওমেগা সদস্যরা বাংলাদেশে তাঁদের দ্বিতীয় অভিযান পরিচালনা করবেন।

৫ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা ১০ মিনিট। পেট্রাপোল দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করেন ওমেগার চার সদস্য। এ দলে ছিলেন বেন ক্রো, জেসি নিওয়েল, ক্রিস প্যাট ও ডেন ডিউ। সাদিপুর এলাকায় পাক সৈন্যরা তাঁদের আটক করে এবং রঘুনাথপুর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।

একই দিন ওমেগার অপর একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং প্রতীকী ত্রাণকার্য চালিয়ে কলকাতায় ফেরত আসেন। এই দল মোট ৮০০ জনের কাছে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেন।

৮ সেপ্টেম্বর ঢাকাস্থ যুক্তরাজ্যের সহকারী হাইকমিশনারের বরাত দিয়ে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশের দায়ে ওমেগার চার সদস্যকে যশোর জেলে আটক রাখা হয়েছে।

ওমেগার দলনেতা রজার মুডি কলকাতায় বলেন, ওমেগা সদস্যদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ৯ সেপ্টেম্বর তাঁরা লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেছেন। তিনি আরও জানান, শীঘ্রই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানি দূতাবাসসমূহেও প্রতিবাদ জানানো হবে।

ওমেগা সদস্যরা অনশন শুরু করলে আটকের পাঁচ দিন পর তাঁদের বিচার শুরু হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর বিবিসি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কূটনৈতিক তৎপরতায় ১০ দিন আটক থাকার পর চার ওমেগা সদস্য জেল থেকে ছাড়া পান।

তাঁদের সরাসরি লন্ডন পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিচারের আগে যুক্তরাজ্যের ঢাকাস্থ ডেপুটি হাইকমিশনের কূটনীতিকেরা ওমেগা সদস্যদের দোষ স্বীকারের পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁরা আদালতে দোষ স্বীকারের পরিবর্তে আদালতকেই অস্বীকার করেন।

এ বিষয়ে গ্রেপ্তার হওয়া বেন ক্রো পরবর্তী সময়ে বলেছিলেন, ‘বিচারক মুচকি হাসলেন এবং আমরা যা বলেছি তা দোষের ওজর হিসেবে গ্রহণ করে পরে আর কোনো জেরা না করেই শাস্তির ঘোষণা দেন—আরও কয়েক ঘণ্টা আটক ও ভারতে না পাঠিয়ে সরাসরি স্বদেশ পাঠানোর আদেশ দেন।’

উল্লেখ্য, ৫ সেপ্টেম্বর গোপনে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল ওমেগা দল। শুধু তাই নয়, গোপনে তাঁরা ত্রাণ বিতরণেও অংশ নেয়।

১৮ সেপ্টেম্বর। অপারেশন ওমেগা থেকে জানানো হয়, যত বাধাই আসুক, অপারেশন ওমেগা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাবে। আগের ব্যর্থতাগুলো পর্যালোচনা করে ওমেগা সদস্যরা তাঁদের কার্যপদ্ধতিতে কিছুটা পরিবর্তনও আনেন এ সময়। তাঁরা সাড়ম্বরে সীমান্ত পার না হয়ে গোপনে বাংলাদেশে প্রবেশ করে ত্রাণ বিতরণের পরিকল্পনা করেন, অনেকটা ৫ সেপ্টেম্বরের ‘গোপন’ পদ্ধতির অনুসরণই করতে চাইলেন তাঁরা।

পাকিস্তানি বাহিনীর নজর এড়িয়ে ওমেগা সদস্য গর্ডন স্লাভেন ও এলেন কনেট নৌকাভর্তি ত্রাণসামগ্রীসহ নদীপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন ৩ অক্টোবর। প্রায় কুড়ি মাইল ভেতরের একটি গির্জায় এক রাতের জন্য আশ্রয় নেন তাঁরা। পরদিন সকালে সেখান থেকে আটক করে তাঁদের যশোর কারাগারে পাঠায় পাকিস্তানি সেনারা।

এবার আবারও সরব হলেন ওমেগা সদস্যরা। আটকের প্রতিবাদে ৮ অক্টোবর তাঁরা প্রতিবাদ জানালেন লন্ডনে, পাকিস্তান হাইকমিশন কার্যালয়ের সামনে। যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার, ডার্বি ও অন্যান্য শহরেও একই ধরনের প্রতিবাদ হলো।

তবে ১১ অক্টোবর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেল, ওমেগা সদস্য গর্ডন স্লাভেন ও এলেন কনেটকে বেআইনিভাবে সীমান্ত অতিক্রমের জন্য বিনাশ্রমে দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এরপর দুজনকে যশোর জেলে আটক রাখা হয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর শহর মুক্ত হলে কারাগারে আটক দুই ওমেগা সদস্যও মুক্তি পান।

এই ওমেগা সদস্যরা অক্টোবর-পরবর্তী সময়ে যশোর, খুলনা ও ফরিদপুর এলাকায় ত্রাণকার্য চালিয়েছিলেন। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত অপারেশন ওমেগার কর্মকাণ্ডের সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। কিন্তু নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেলে তাদের কার্যক্রমের সংবাদ হয় চাপা পড়ে নতুবা তাদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বলা দরকার, কারাগার থেকে মুক্তির পর এলেন কনেট একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশে মোট নয়টি অভিযান পরিচালনা করেছিল অপারেশন ওমেগা; এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ’৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিল এই দলটি।

ত্রাণ কর্মসূচি চালানোর জন্য টাকা কীভাবে জোগাড় করেছিল তারা? যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ বা বেসরকারি উৎস থেকে এসেছিল তহবিল। এর বেশির ভাগ অনুদান আর প্রশাসনিক সাহায্য এসেছিল যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের কাছ থেকে।

যখন প্রায় সব বড় বড় ত্রাণ সংস্থা বাংলাদেশিদের দুর্দশায় স্তব্ধ, ওমেগা সদস্যরা তখন এগিয়ে এলেন তাঁদের ক্ষুদ্র সাহায্য নিয়ে। শত বাধা. হুমকি, ভয়ভীতি ও গ্রেপ্তার—এসবের পরও তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশ করে ত্রাণ তৎপরতা চালিয়েছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত। অপারেশন ওমেগার কর্মকাণ্ডের কারণে যুদ্ধকালে আমাদের আরেকটি লাভ হয়েছিল—ওমেগার ভিন্নধর্মী অহিংস অভিযানের সংবাদ বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনেও সাহায্য করে।

পুনশ্চ: স্বাধীনতার পর ২০১৩ সালের অক্টোবরে আবার বাংলাদেশে এসেছিলেন ওমেগা দলের অন্যতম সদস্য এলেন কনেট। ৫ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে ’৭১-এ অপারেশন ওমেগার ত্রাণ তৎপরতা ও নিজের কারাবাসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন তিনি ।

মুহাম্মদ লুৎফুল হক: গবেষক।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত।