বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটির সমের্ক যে বিতর্ক তা শেষ হবার নয়। তবু ভালো আমরা সকলের মিলে ২৬ মার্চই স্বাধীনতা দিবস পালন করি।

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা নিজেদের সমন্বয়ে একটি গণপরিষদ গঠন করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটিকে সুদৃঢ়ভাবে অনুমোদন করেন এবং একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক আদেশের বলে দেশের অস্থায়ী সংবিধান প্রসঙ্গে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করা হয়।

প্রজাতন্ত্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের গণপরিষদ আদেশ, ১৯৭২-এর অধীনে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ একটি নতুন গণপরিষদ গঠিত হয়। সংবিধান প্রস্তুত ও খসড়া তৈরির উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের জনগণ সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করে সমবেতভাবে গ্রহণ করে। সংবিধানের প্রস্তাবনায় সঙ্ষ্ট ভাষায় অঙ্গীকার করা হয় : ‘...আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা-যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।’

আমাদের সংবিধানের শব্দ, বাক্যাংশ এবং ধারণাগুলো অন্যান্য দেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল থেকে ঋণ করা হয়। নয় মাসে সংবিধান রচনা সমাধা করার জন্য আমরা মাঝেমধ্যে অহঙ্কার করি। চার মাসের কম সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচিত হয়। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করলে দেশে শাসনতন্ত্রের কাঠামো সত্বর সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজটা ভালোই হয়েছিল। তার চেয়ে বড় কথা এই যে, মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো আধুনিক সাংবিধানিক ধারণাসমূহকে আমাদের আইনি সংস্কৃতির মধ্যে আত্তীকৃত করা হয়। এটা ছিল এক বিরাট পদক্ষেপ।

আমাদের দেশের আইনের কাঠামোয় নানান ধরনের পলি পড়েছে। ১৯৭২ সালের পর সংবিধান কথাটা চালু হয়েছে। আগে সংবিধানকে শাসনতন্ত্র বলা হতো। শিক্ষিত সমাজে সংবিধান নিয়ে নানা বাহাস হয়েছে। সংবিধানের চেয়ে আইনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের পরিচয়টা নিবিড়। এমনকি বকলমের লোকও আইনের ধকল বোঝে, কিন্তু তার পক্ষে সংবিধানের দায়-দায়িত্ব বা তার প্রতি আনুগত্যের কথা সম্যকভাবে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। শিক্ষিত লোকেরাই পারে না।

আমাদের বদ্বীপ দেশটির মতো আমাদের সংবিধানের ভাগ্যেও নানা ধরনের শিকস্তি ও স্বস্থলপয়োস্তি ঘটেছে। সামরিক শাসনামলে সংবিধানের অনেক অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয় এবং চতুর্থ তফসিলের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয় : ১৯৭৭ সালের ঘোষণা আদেশ নং ১ অনুযায়ী সংশোধনীর ক্ষেত্রে ইংরেজি পাঠটি প্রাধান্য পাবে। সংবিধান যখন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে কার্যকর থাকে এবং যখন সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে সংবিধানকে কার্যকর থাকতে দেওয়া হয়নি-এই উভয় সময়েই সংবিধানের সুদূরপ্রসারী ও মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। এক বন্ধুর ও কুটিল যন্ত্রণাদায়ক পথ পরিক্রমায় সংবিধান এখন পর্যন্ত ১৩ বার সংশোধন করা হয়েছে। কিছু কিছু সংশোধনী আনা হয় নিদারুণ সঙ্কটকালে, ধারাবাহিকতা রক্ষার অজুহাতে।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী পাস করা হয়। এ সমের্ক তত্কালীন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে বলেন, ‘চতুর্থ সংশোধনীতে নানা দিক থেকে সংবিধানের এমন পরিবর্তন করা হয় যে, তা আর চেনা যায় না এবং বহুদলভিত্তিক সংসদীয় সরকারের জায়গায় রাতারাতি একটি একদলভিত্তিক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কায়েম হয়।

সঙ্ঘ বা সমিতি গঠন করার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, সরকারি দল ছাড়া আর সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয় এবং যেসব সংসদ সদস্য এ দলে যোগদান করতে অস্বীকার করেন, জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা তাঁদের সদস্যপদ হারান। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ভীষণভাবে খর্ব করা হয়; বিচারকদের অপসারণ প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছাধীন করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়; অধস্তন আদালতসমূহের নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধান এবং অধস্তন আদালতসমূহের ওপর সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিয়ে সে ক্ষমতা সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই পরিবর্তন এতই প্রচণ্ড ও আকস্মিক ছিল যে, মিত্ররা স্তম্ভিত হয়। স্বাধীনতার শত্রুরা তাদের প্রতিশোধ চরিতার্থ করে এবং সমালোচকরা উল্লসিত হয়ে বলেন, ‘গণতন্ত্রের ক্ষতিসাধন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তি দ্বারাই হোক বা অগণতান্ত্রিক পন্থায় বা সামরিক অভ্যুত্থানের দ্বারাই ঘটুক একই কথা।’

১৯৭৭ সালের ২৩ এপ্রিল ১নং ঘোষণা আদেশ ১৯৭৭ দ্বারা প্রস্তাবনার শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ এবং প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ শব্দগুলো সন্নিবেশিত হয়। ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ শব্দগুলোর স্থলে ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটা তুলে দিয়ে ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দটির একটি অর্থ দেওয়া হয়।

নাগরিকত্বের নামকরণ ‘বাঙালি’ থেকে ‘বাংলাদেশী’ করা হয়। সরকারের সবচেয়ে কম বিপজ্জনক অংশ বিচার বিভাগ সমির্কত বিধানগুলো ২১টি বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তন করা হয়েছে।

১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ড একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থানের সম্মুখীন হয়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে দু-দু’বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালে সংবিধান বাতিল করা হয়নি। ১৯৮২ সালে সংবিধান স্থগিত করা হয়েছিল। এই ধরনের সেনা স্বৈরতন্ত্রে পুরাতন আইনি কাঠামোকে সমঙ্ূর্ণ বাতিল বা ধ্বংস না করার জন্য তা সাময়িক বিচ্যুতি হিসেবে বিবেচিত হয় যখন সাংবিধানিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধার ঘটে।

বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেন, সামরিক আইন ‘একটি সংবিধানবহির্ভূত কর্মকাণ্ড। এটি একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা, একটি স্বল্পকালীন আয়োজন। কেবলমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন প্রয়োজন মেটায়। এ যখন বিদায় নেয়, তখন দায়মুক্তির জন্য সাধারণত একে তার অতীতের ক্রিয়াকর্ম আইনসিদ্ধ করতে হয় একটি অনুচ্চারিত স্বীকারোক্তি করে যে, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় এর হস্তক্ষেপ একটি ভ্রষ্টাচার এবং একে মার্জনা করা প্রয়োজন। তবে বিদায়কালে সামরিক আইন অযোগ্যতার কোনো ছাপ পেছনে ফেলে রেখে যায় না। এটা যতদিন টিকে থাকে ততদিন, কিন্তু বিদায়ের পর এ দেশের সাধারণ আইনকানুনের ওপর কোনো ছায়া ফেলে না।’

একজন বিদেশী পর্যবেক্ষক, জেমস নোভাক, বলেন, ‘আইন ও ন্যায়বিচারের প্রতি শ্রদ্ধা বাংলাদেশের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য বলে প্রতীয়মান হয়। এ জাতীয় আস্থার পিছনে একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা মূর্ত হয়ে ওঠে যা এ দেশের গঠনপ্রকৃতি অনেকটাই উদ্ভাসিত করে। বিফলতা সত্ত্বেও এশিয়ার যেকোনো জায়গার চেয়ে এখানে মানুষ আদালতের ওপর বেশি আস্থাশীল, কেননা এখানে একটা ন্যায়বিচারের চেতনা বিদ্যমান রয়েছে।’—বাংলাদেশ : রিফ্লেকশনস্ অন ওয়াটার (১৯৯৩)

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা বাংলাদেশের মাটিতে কতবার উচ্চারিত হয়েছে এবং বাংলাভাষায় কতবার তা লিখিত হয়েছে তার শুমার করতে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। আইনের শাসন সমের্ক মোদ্দা কথাটা হচ্ছে, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করে তাকে স্বায়ত্ত স্বাতন্ত্র্য দেওয়া দরকার। ১৯৫৪ সালের ২১ দফার ১৫ দফায় ছিল এ সমের্ক একটি অঙ্গীকার। ওই অঙ্গীকার বহুবার ব্যক্ত ও পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে ১৯৫৭ সালের ৩৬নং আইনটি পাস করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত দুই পঙিক্তর একটি নোটিফিকেশন দিয়ে আইনটি জারি করার তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। পাকিস্তানের ল’ কমিশন (১৯৬৯-৭০) এবং বাংলাদেশের ল’ কমিটি (১৯৭৬) উক্ত আইনটি অনুসরণ করার জন্য সুপারিশ করে। এ পর্যন্ত কোনো সরকার সেই আইনটি কার্যকর করেনি। সেই আইনটির গুরুত্ব সমের্ক ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নকারী গণপরিষদের দ্বিধাহীন থাকা উচিত ছিল। গণপরিষদ বিষয়টি রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতির ২২ অনুচ্ছেদে সংবলিত করে।

সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’

এ সমের্ক ৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘(২) এই ভাগে বর্ণিত নীতিসমূহ বাংলাদেশ-পরিচালনার মূলসূত্র হইবে, আইন প্রণয়নকালে রাষ্ট্র তাহা প্রয়োগ করিবেন, এই সংবিধান ও বাংলাদেশের অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাহা নির্দেশক হইবে এবং তাহা রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হইবে, তবে এই সকল নীতি আদালতের মাধ্যমে বলবেযাগ্য হইবে না।’

আইনের শাসন সমের্ক যে গড়িমসির ঐতিহ্য জন্মকালে শুরু হয় তা এখনো বিরাজ করছে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট স্বউদ্যোগে মাসদার হোসেনের মামলায় ১৯৯৯ সালের নভেম্বর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে একটি ১২ দফা বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেন। আদালতের নির্দেশ এখনো কার্যকর হয়নি। এসব কর্মকাণ্ডের পটভূমিতে সংবিধানের প্রতি একটা সহজ আনুগত্য কেমন করে সৃষ্টি হবে?

যখন সরকারের পরামর্শে আদালত অবমাননাকারী আমলাকে মার্জনা করা হয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে শাস্তি বাড়ানো হবে না কেন রুল ইস্যু করে এবং সেই ব্যাপারটির শুনানির আগেই দণ্ডপ্রাপ্তকে সব অভিযোগ থেকে মার্জনা করা হয় এবং যখন মাদকপাচার অপরাধে দণ্ডিত শক্তিধর রাষ্ট্রের নাগরিককে তড়িঘড়ি অশোভন দ্রুততায় মার্জনা করা হয় তখন সাধারণ মানুষের মনে আইনের প্রতি ভক্তি বা সংবিধানের প্রতি আনুগত্যবোধ কেমন করে দৃঢ়মূল হবে?

৩০ জুলাই ১৯৯২ সালের কুদরত-ই-ইলাহি পনির বনাম বাংলাদেশ ৪৪ ডিএলআর (এডি) ৩১৯ মামলায় বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ বেঞ্চ বলেন, ‘সংবিধানের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব সংক্রান্ত ৯ অনুচ্ছেদের আলোকে নির্বাচনের মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের পরিবর্তন করে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে ৫৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ যথাশীঘ্রই নিতে হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই যেন এ সময় এখন থেকে ৬ মাসের অধিক না হয়।’ এ নির্দেশ সরকার এখনো পালন করেনি।

দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিজস্ব আর্থিক ও ক্ষমতার সাশ্রয় পর্যাপ্ত নয় বলেই সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানায় অন্তর্ভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের সহায়তা করিবেন।’

গত ত্রিশ বছরে এই অনুচ্ছেদের প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং তার লঙ্ঘন ঘটেছে তার মধ্যে মাত্র দুটো বিষয়ে আমি উল্লেখ করলাম।

সংসদের ৩০০ সদস্যের মধ্যে ৬০ জনে কোরাম হওয়ার কথা। সেখানে কোরাম অভাবে বহু সময় বিনষ্ট হয়। এই অঘটন প্রতিটি নির্বাচিত সরকারের সময় ঘটেছে। সংসদপ্রধানের অনুরোধ-উপরোধ বা নির্দেশনার কেউ তোয়াক্কা করে না। দল বেঁধে সংসদের পদ থেকে পদত্যাগ করা, সংসদে ঠিকমতো উপস্থিত না থাকা, কথায় কথায় সংসদ থেকে গাত্রোত্থান ও প্রস্থান, কালো পতাকা উড়িয়ে পাসকৃত আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং সংসদ সদস্যের দায়-দায়িত্ব ও দেয় সমের্ক গাফিলতি এবং আত্মসম্ভ্রম ও আত্মসম্মানের এমন অভাব পরিলক্ষিত হয় যে সংবিধানের প্রতি আনুগত্য সমের্ক যেকোনো আলোচনা বাজে, বাতিল ও ফালতু মনে হওয়াই স্বাভাবিক।

যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাকিনর্বাচনী কর্মসূচির অঙ্গীকার অতি সহজে পরিত্যাগ করে থাকে এবং তার জন্য জনসাধারণের কাছ থেকে তেমন ধিক্কারও পায় না সেখানে আনুগত্যভঙ্গের প্রশ্ন তেমন মারাত্মক হয়ে দেখায় না।

সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধানের প্রাধান্য সমের্ক সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘৭(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।

(২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসামঞ্জস্য হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।”

সংবিধান ও আইন মান্য করা আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্যতম মূলনীতি। এ প্রসঙ্গে নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য সমের্ক ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে :

“২১(১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সমিত্ত রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।

(২) সকল সময়ের জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।”

উপরোক্ত কর্তব্য লঙ্ঘন করার জন্য সংবিধানে কোনো শাস্তির বিধান নেই। ওই কর্তব্য লঙ্ঘন করলে যদি দেশে কোনো আইন লঙ্ঘন করা হয় এবং সেই আইনে কোনো শাস্তির বিধান থাকলে সংবিধান লঙ্ঘন সেই মতো শাস্তিযোগ্য বিবেচিত হতে পারে।

সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টা, সিঙ্কার, ডেপুটি সিঙ্কার, প্রধান বিচারপতি, অন্যান্য বিচারপতি সকলেই শপথ বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন, ‘আমি সংবিধানের রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব।’

কেবল সংসদ সদস্য অনুরূপ শপথ বা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেন না। তাই সংসদ সদস্য সংবিধানের বিধানমতো সংবিধান সংশোধনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। শপথ ভঙ্গের জন্য দেশে এ পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি এবং কোনো মামলায় সরাসরি সংবিধান ভঙ্গের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি।

আমেরিকার গণতন্ত্র সমের্ক মন্তব্য করতে গিয়ে ১৮৩৫ সালে আলেক্সিস দ্য তোকভিল তাঁর ডিমক্রাসি ইন অ্যামেরিকা গ্রন্থে বলেন, ‘অন্য জাতিগুলোর চেয়ে বেশি বিদগ্ধ হওয়ার মধ্যেই আমেরিকানদের বিরাট গুণ তা-ই নয় বরং নিজেদের ভুলগুলো শোধরানোর ক্ষমতাই তাদের আসল গুণ।’

গুণ।’ তিনি আরো বলেন, ‘যখন গণতন্ত্র জ্ঞান ও সভ্যতায় এক অনুকূল পর্যায়ে পৌঁছায় তখন তা অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে। কোনো কোনো জাতির প্রথম পাঠ এতই দূষিত এবং তাদের চরিত্রে আবেগ, অজ্ঞতা ও সকল বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা এমন অদ্ভুতভাবে মিশ্রিত যে, তারা তাদের নিজেদের দুর্গতির কারণ নিরূপণ করতে সক্ষম হয় না এবং এমন ব্যাধির শিকার হয়, যার সমের্ক তাদের কোনো ধারণাই নাই।’ আমাদের স্বাধীনতার এক উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিশ্রুতিভঙ্গের বেদনায় পরিকীর্ণ। আমাদের অতীতের একটি তাত্পর্যপূর্ণ অধ্যায়কে ‘রক্তের উত্তরাধিকার’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সাংবিধানিকতাবাদ, সংসদীয় গণতন্ত্র, প্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকার এবং আইনের শাসন সমের্ক যেসব অঙ্গীকার করেছি আমরা তা মান্য করিনি। অতি সামান্য কিছু আমূল পরিবর্তনবাদী ছাড়া নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের মতো শ্রমসাধ্য দায়িত্ব নেওয়ার কারো ইচ্ছা নেই।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, জেনারেল, বিচারক যাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতায় গিয়েছেন বা ক্ষমতায় যাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি, তাঁরা সবাই সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষার নামে সংবিধান সংশোধন করে তাঁদের কর্মকাণ্ডকে জায়েজ করেছেন।

সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলীকে কার্যকর করার জন্য একটা বিধান দেওয়া হয়। এই বিধানকে এলিভেটর সুটকেশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। অসাংবিধানিক মধ্যবর্তীকালের সব কর্মকাণ্ডকে বৈধ করে এক ধরনের দায়মুক্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। সামরিক শাসনের সঙ্গে সাংবিধানিক তত্ত্বের মেলবন্ধনে বাংলাদেশী মুনশিদের এ এক অনুপম অবদান। এ আমাদের নিন্দিত রাক্ষসবিবাহের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই ধরনের বিবাহে কন্যাকে অপহরণ করে বর বলপ্রয়োগে তাকে বিবাহ করতে বাধ্য করা হতো।

অষ্টম সংশোধনীর মামলায় কৌঁসুলিরা আদালতকে সংবিধান রক্ষার ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকের গুরুদায়িত্বের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়। বলা হয়, “ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারক শপথ নেবার সময় সংবিধান “রক্ষা” করার কথা বলেন। আর আমাদের সুপ্রিম কোর্টের বিচারক সংবিধান “রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান” করার শপথ নেন। দুই দেশের শপথের ভাষার পার্থক্যের ওপর জোর দিয়ে নিবেদন করা হয় যে, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের দায়িত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে সুকঠিন। আমি সেসময় বলেছিলাম, ‘ “রক্ষণ সমর্থন ও নিরাপত্তাবিধান” এই তিন শব্দের চেয়ে “রক্ষা” শব্দটির তাত্পর্য বা গুরুভার মোটেও কম নয়।” উভয় ক্ষেত্রেই দায়ভার একই। আদালত সেই ভার বহন করে তরোয়াল-তহবিল ছাড়াই। সমাজের তরোয়াল রয়েছে নির্বাহী শক্তির হাতে, জাতির তহবিলের তদারকি রয়েছে সংসদের হাতে। আদালত এ কাজ করতে পারেন, কারণ সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আদালতের রায় ও আদেশ মান্য করার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য আদালতকে প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তা করার কথা। যখন সংবিধানকে স্থগিত করা হয় বা বেআইনের অধীন করা হয় তখন আদালত প্রজাতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে একজন বিচারকের সামনে দুটো পথ খোলা থাকে—হয় পদত্যাগ করা নতুবা নিজের পদে জেঁকে বসে থাকা। যে বিচারক আইনের সমাবেশ ক্ষমতার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন নি, তিনি কর্তব্যকর্ম ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে তাঁর কর্মের স্বাধীনতার সাময়িক বঞ্চনাকে মেনে নিতেও পারেন।

বলাবাহুল্য, সংবিধান ছাড়া আদালতের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা থাকে না। সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে নাগরিকদের ওপর সংবিধান ও আইন মান্য করা, শৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা এবং জাতীয় সমিত্ত রক্ষা করার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, সেই দায়িত্ব পালনে নাগরিকদের অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করে সংবিধানের ভবিষ্যত।’

এ প্রসঙ্গে জেফারসনের সেই কথাগুলো উল্লেখ্য : ‘যদিও আবেগ আর বিভ্রমের মুহূর্তে লিখিত সংবিধান লঙ্ঘিত হতে পারে, তবু লিখিত সংবিধানসমূহ এমন এক পাঠ যোগায় যার দিকে সচেতন লোকেরা আবার সমবেত হয়ে জনগণকে ডাক দিতে পারে; লিখিত সংবিধান জনগণের রাজনৈতিক মতাদর্শও সুনির্ধারিত করে দেয়।’

একটি সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রে সংবিধান ধ্রুবতারার মতো। বাংলাদেশে আমাদের স্বভাবগুণে সেই ধ্রুবতারা সারাক্ষণ স্থান পরিবর্তন করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্র, একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি, সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন-এ রকম ভাঙাগড়ায় নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় সমাজ দিগ্ভ্রান্ত। গুণধর রাজনীতিকরা দেশের মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন এবং নিজেদের জীবন নিয়েও ছিনিমিনি খেলে খরচ হয়ে গেছেন। নক্ষত্রাদির আইনের লঙ্ঘন করে যদি ধ্রুবতারা তার উদয়, অবস্থান ও অবসানের অবস্থান নির্ধারণ করত তা হলে সারা বিশ্বে নাবিক-বণিক-বিজ্ঞানীদের কী দুরবস্থাই না হয়ে যেত।

আমরা সংবিধান প্রবর্তনার ত্রিশ বছর পূর্তি পালন করিনি। আমাদের দেশে দিবস পালিত হয় ব্রত উদযাপনের মতো। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্ম-মৃত্যু এবং বিশিষ্ট ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করে আমরা নানান দিবস পালন করে থাকি।

এই প্রসঙ্গে আমাকে আমার এক বিদেশী বন্ধু ভর্ত্সনার কণ্ঠে বললেন, ‘এ কী রকম, আপনারা সংবিধানের ত্রিশ বছর পূর্তি উদযাপন করলেন না!’ আমি বলতে পারতাম, ‘সংবিধানের প্রতি আমাদের তেমন আনুগত্য বা মমত্ব নেই।’ আমি বললাম, ‘বিজয় দিবস ও সংবিধান প্রবর্তনের দিবস এক অঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য হয়তো আমাদের খেয়াল ছিল না।’ অবিশ্বাসে এক জোড়া সুন্দর চোখ শুধু অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। আমি ভাবলাম, না করা বা হওয়ার চেয়ে দেরিতে করা বা হওয়া ভালো। আমি স্বাধীনতা দিবসে সংবিধানের কথা বলে না হয় অকালবোধন করব।

আমাদের সাংবিধানিক অভিজ্ঞতায় মুষড়ে পড়ার কিছু নেই। জয়ের ক্ষয় নেই। বিশ্বের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লিখিত সংবিধান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সেই সংবিধানের সূত্রপাতটা শুভলক্ষণ হিসেবে সমসাময়িকের চোখে বিবেচিত হয়নি। সংবিধানের দলিলটাও তাঁদের কাছে আহামরি কিছু মনে হয়নি। বেশির ভাগ প্রতিনিধির কাছে মনে হয়েছিল তাঁরা জোড়াতালি দিয়ে একটা মূল্যহীন সোলে দলিল তৈরি করেছেন। আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন একে একটা দুর্বল এবং অসার কাঠামো বলে বর্ণনা করেছিলেন। সংবিধানের সবচেয়ে বড় সমর্থকরা ভেবেছিলেন যে এটি দুর্বল রাষ্ট্র-সম্মিলনটিকে কয়েক বছর টিকিয়ে রাখতে পারলে পরে ভালো কিছু একটা করা যাবে। সংবিধানটি টিকে গেছে। এটা তার সৌভাগ্যই বলতেই হবে। আমি আশা করি আমাদের স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়নি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিরূপে সংবিধানটির প্রাধান্য রক্ষা এবং রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধানকে আমাদের পবিত্র কর্তব্য ভেবে সদাজাগ্রত হয়ে আমাদের কাজ করে যেতে হবে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত