দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের মতো পূর্বের বাংলাভাষী অঞ্চল বহুবার বিদেশীদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। আর্য, মৌর্য, চালুক্য, তিব্বতী, চোল, সেন, তুর্কি, পাঠান, মোগল, অহোম, মগ, পর্তুগীজ, ইংরেজ ইত্যাদি নানাজাতের আগ্রাসী হানাদারদের হামলায় বিপর্যস্ত হয় বাংলাদেশ। আগ্রাসী শক্তির অনেকেই কিয়ত্কাল অবস্থান করে নিজ দেশে বা গৃহরাজ্যে ফিরে যায়। ২৩ জুন ১৭৫৭ যখন ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করে তখন সুবা বাংলা একটি সমৃদ্ধ দেশ ছিল। ১৪/১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ইংরেজরা যখন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করল তখন বাংলাদেশ একটা ছন্নছাড়া, দরিদ্র ও বিভক্ত দেশে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
ফরাসি বিপ্লবের জয়ধ্বনি সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার ওপর ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম তার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় এসেছে অনেক দেরি করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় মরাঠা ও শিখদের মধ্যে যে ঐক্যের বন্ধন ছিল তেমন অন্য জাতি বা সমঙ্রদায়ের মধ্যে ছিল না। বাংলাভাষী অঞ্চলে সমষ্টি চেতনার চেয়ে ব্যক্তি চেতনা ছিল বড়। রাষ্ট্রচেতনা আরো কম। ভৌগোলিক পরিবেশ ও বিচ্ছিন্ন গ্রাম-বসতির কারণে এখানে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সব সময় ছিল দুর্বল। ওপর কাঠামো তৈরির তেমন প্রয়োজন দেখা দেয়নি এবং গোষ্ঠীবদ্ধতার দাবিও ছিল নগণ্য।
ইংরেজ অধিকার ও আধিপত্য সুবাবাংলায় সীমাবদ্ধ থাকলে এ অঞ্চলে জাতীয়তাবাদ কী আকার ধারণ করত, তা আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইউরোপীয় সাম্রাজ্যিক শক্তির উপনিবেশগুলোর দিকে তাকালে কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে। পশ্চিম য়ুরোপীয় সভ্যতার অব্যাহত সমঙ্রসারণ এবং তার প্রভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এক বর্ণাঢ্য পৌত্তলিকতায় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে! কালক্রমে যখন ইংরেজ শাসন আসমুদ্রহিমাচল প্রসারিত হলো, তখন উনিশ শতকের শেষার্ধে উদীয়মান মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের প্রচেষ্টায় এক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হলো। নতুন চেতনায় ভারতমাতা বনাম বঙ্গজননী জাতীয় কোনো বিবাদ ছিল না। মুসলমানরাও সর্বভারতীয় পশ্চাদপটে চিন্তা করত, বিশ্ব ইসলাম বা নিখিল ইসলামের আকর্ষণ থাকলেও। ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতার কথা কেউ উচ্চারণ করেননি। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিয়ে চায়’-রাজপুতের মুখে মোগলের বিরুদ্ধে এক সুললিত আর্তনাদ।
বহুধাবিভক্ত বাঙালিদের সমের্ক বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘ইংরেজ এক জাতি, বাঙ্গালীরা বহু জাতি। বাস্তবিক এক্ষণে যাহাদিগকে আমরা বাঙ্গালী বলি, তাহাদিগের মধ্যে চারি প্রকার বাঙ্গালী পাই। এক আর্য, দ্বিতীয় অনার্য হিন্দু, তৃতীয় আর্যানার্য হিন্দু, আর তিনের পর এক চতুর্থ জাতি বাঙ্গালী মুসলমান। চারিভাগ পরসঙ্র হইতে পৃথক থাকে।’
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অপরিণত অবস্থা সমের্ক রবীন্দ্রনাথের মনে বরাবরই একটা দুর্ভাবনা ছিল। ১৯০৮ সালে ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘যে দেশে একটি মহাজাতি গড়িয়া উঠে নাই, সে দেশ স্বাধীন হইতেই পারে না। স্বাধীনতা কাহার স্বাধীনতা? ভারতবর্ষে বাঙালি যদি স্বাধীন হয় তবে দাক্ষিণাত্যের নায়ের জাতি নিজেকে স্বাধীন বলিয়া গণ্য করিবে না।’
১৯২৩ সালে ৩রা মার্চ কাশীতে অনুষ্ঠিত উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বাঙালি জাতীয়তা সমের্ক রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাঙালিকে নেশন বলা যায় না। কেননা বাঙালি এখনো আপন রাষ্ট্রীয় ভাগ্যবিধাতা হয়ে ওঠেনি। অপর দিকে সামাজিক ধর্ম-সমঙ্রদায়গত ঐক্যের মধ্যেও বিশেষ দেশের অধিবাসী আত্মপরিচয় দিতে পারে; যেমন, বলতে পারে, আমরা হিন্দু বা মুসলমান। কিন্তু বলা বাহুল্য, এ সম্বন্ধেও বাংলায় অনৈক্য রয়েছে। তেমনি বর্ণভেদ হিসাবে যে জাতি, সেখানেও বাংলায় ভেদের অন্ত নেই। তার পরে বিজ্ঞানবাদ-অনুসারে বংশগত যে জাতি, তার নির্ণয় করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিকেরা মানুষের দৈর্ঘ্য, বর্ণ, নাকের উচ্চতা, মাথার বেড় প্রভৃতি নানা বৈচিত্র্যের মাপজোখ করে সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম বিচার নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। সে হিসাবে আমরা বাঙালিরা যে কোন বংশে জন্মেছি, পণ্ডিতের মত নিয়ে তা ভাবতে গেলে দিশেহারা হয়ে যেতে হবে।’
এক জাপানির সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্কার সমের্ক ১৯৩৫ সালের ১৩ জুলাই রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি জাপানে থাকতে একজন জাপানী আমাকে বলেছিল, রাষ্ট্রবিপ্লবের আর্ট তোমাদের নয়, ওটাকে তোমরা হূদয়ের উপভোগ্য করে তুলেছ, সিদ্ধি লাভের জন্য যে তেজকে যে সংকল্পকে গোপনে আত্মসাত্ করে রাখতে হয় গোড়া থেকেই তাকে ভাবাবেগের তাড়নায় বাইরের দিকে উিক্ষপ্ত বিক্ষিপ্ত করে দাও।’
পাকিস্তান আমলে বাংলাভাষা সম্বন্ধে শাসকমহলে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতের ঐক্যবাদী মহলও বাংলাভাষা চর্চার ব্যাপারে অনুরূপভাবে উদ্বিগ্ন হয়। উপরোক্ত কাশীতে অনুষ্ঠিত উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাল্যকালে এমন আলোচনাও আমি শুনেছি যে, বাঙালি যে বঙ্গভাষার চর্চার মন দিয়েছে এতে করে ভারতীয় ঐক্যের অন্তরায় সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, ভাষার শক্তি বাড়তে থাকলে তার দৃঢ় বন্ধনকে শিথিল করা কঠিন হয়।...আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য।’
যখন ভারতীয় মাতৃক্রোড়ের জন্য হিন্দির সুপারিশ করা হয় তখন হিন্দিবিরোধী অভিমত প্রকাশ করার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা হলেও রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় ঐক্যের স্বার্থে কোনো সাড়া দেননি।
১৩৪৬ সালে ‘মহাজাতি সদন’-এ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমার বিশ্বাস য়ুরোপীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষে সর্বপ্রথমে বাংলাদেশের অন্তঃকরণ গভীরভাবে সর্ঙ্শ করেছিল, নানা দিক থেকে বিচলিত করেছিল তার মন।...নবযুগের সাড়া দিতে বাংলাদেশ প্রথম হতেই জড়তা দেখায়নি-বাংলাদেশের এই গৌরব এবং এই তার সত্য পরিচয়। এ কথা কারো অগোচর নেই যে, একদা রাষ্ট্র-মুক্তিসাধনার সর্বপ্রথম কেন্দ্রস্থল ছিল এই বাংলাদেশ এবং যে দুর্যোগের দিনে এই প্রদেশের নেতারা কারাপ্রাচীরের নেপথ্যে ছিলেন তখন তরুণের দল দেশের অপমান দূর করবার জন্যে বধবন্ধনের মুখে যেমন নির্বিচারের ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের অন্য কোন প্রদেশে কখনোই এরকম ঘটে নি।...
‘আমরা বাংলাজাতির যে শক্তির প্রতিষ্ঠা করবার সংকল্প করেছি তা সেই রাষ্ট্রশক্তি নয়, যে শক্তি শত্রু মিত্র সকলের প্রতি সংশয়-কণ্টকিত।... অতীতের মহত্ স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের বিপুল প্রত্যাশা এখানে আমাদের প্রত্যক্ষ হোক। বাংলাদেশের যে আত্মিক মহিমা নিয়তপরিণতির পথে নবযুগের নবপ্রভাতের দিকে চলেছে, অনুকূল ভাগ্য যাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং প্রতিকূলতা যার নির্ভীক সর্ঙ্ধাকে দুর্গম পথে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করছে, সেই তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ব।’
নিজেদেরকে ‘বাংলাজাতি’ বলে উল্লেখ করলেও রবীন্দ্রনাথ কখনো কল্পনাতেও ভারত হতে বিচ্ছিন্ন, স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলা জাতির কথা চিন্তা করেননি। উক্ত ‘মহাজাতি সদনে’ রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বাংলার যে জাগ্রত হূদয় মন আপন বুদ্ধির ও বিদ্যার সমস্ত সমঙ্দ ভারতবর্ষের মহাবেদীতলে উত্সর্গ করবে বলেই ইতিহাসবিধাতার কাছে দীক্ষিত হয়েছে, তার সেই মনীষিতাকে এখানে আমরা অভ্যর্থনা করি। আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক-এই কল্যাণ-ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণচিত্ততার ঊর্ধ্বে আপন জয়ধ্বজা যেন উড্ডীন রাখে। এখান থেকে এই প্রার্থনামন্ত্র যুগে যুগে উচ্ছ্বসিত হতে থাক্-
বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা,
সত্য হউক-সত্য হউক-সত্য হউক হে ভগবান!
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন,
এক হউক-এক হউক-এক হউক হে ভগবান!
সেই সঙ্গে এ কথা যোগ করা হোক-বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক, বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক, ভারতের মুক্তি সাধনায় বাঙালি স্বৈরবুদ্ধিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনো কারণেই নিজেকে অকৃতার্থ যেন না করে।’
নজরুল ইসলাম ১৩৪৯ সালের ৩রা বৈশাখ ‘বাঙালির বাঙলা’য় বাংলার শক্তি ও সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করে জয়ধ্বনি তোলেন ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক!’ তিনি আশা করেন, ‘বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হবে-বাঙালির বাংলা সেদিন অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।’ ‘জয় বাংলা’ বললেও নজরুলের ‘ভারত-লক্ষ্মী’ বা ‘ভারত জননী’র প্রতি আনুগত্য ছিল অান। তাঁর স্বপ্ন-‘ভারত মহাভারত হবে’ এবং যেদিন পীড়িত মানুষের প্রতিকারে প্রাণে সাড়া জাগবে, ‘মহা-মানুষের সেদিন সৃষ্টি হবে।’
সমাজসংস্কার, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার ও চাকরির বাটোয়ারা নিয়ে বাঙালি চিন্তানায়করা যা-ই চিন্তা করে থাকুন না কেন, বা বাঙালির স্বার্থের জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয়ে মিলে যা-ই আলোচনা করে থাকুন না কেন, একটি স্বাধীন বাঙালি রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা কেউ কোনো দিন কল্পনা করেনি।
এ শতকের ত্রিশ দশকে ভারতের মুসলমান সমঙ্রদায় এক স্বতন্ত্র আবাসভূমির কথা চিন্তা করতে শুরু করে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর পূর্ব য়ুরোপে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণভিত্তিক যে সীমানা নির্ধারণ ও ভাগ-বাটোয়ারা হয় তার একটা প্রভাব ছিল সেই স্বদেশভূমির দাবিতে।
বাংলা ভাষার জন্য আমরা বিদেশীদের কাছে বহুদিন ধরে বাঙালি বলে পরিচিত। সেই ভাষার প্রতি মমত্ববোধে এক ভাষাকেন্দ্রিক ভাসাভাসা জাতীয় চেতনার সৃষ্টি হলেও তা পুষ্টি লাভ করতে পারেনি, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা প্রমথ চৌধুরীদের মতো কেউ কেউ স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করলেও। প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘বাঙালির প্রেটিয়টিজম’-এ বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রশ্নে বৃহত্ ভারতের ভূমিকাকে সাম্রাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করে উল্লেখ করেন যে, ইউরোপের কোনো জাতির সঙ্গে অপর জাতির সে-প্রভেদ নেই, আমাদের এক জাতির সঙ্গে অপর জাতির যে-প্রভেদ আছে।
১৯২৭ সালে সরাসরি স্বতন্ত্র বাঙালি রাষ্ট্র গঠনের কথা না বলে এয়াকুব আলী চৌধুরী প্রশ্ন করেন, ‘ভৌগোলিক সীমা, ভাষা, আবহাওয়া ও আহার পরিচ্ছদের বিভিন্নতায় ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রমণ্ডল গড়িয়া উঠিয়াছে।...সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও রাজ্য গঠনের এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কি শুধু ভারতবর্ষে বিফল বলিয়া প্রমাণিত হইবে?
‘সোনার বাংলা’, ‘ভারততীর্থ’ ও ‘জনগণমন-অধিনায়ক’-এর কবির মনে বাংলা বনাম ভারত জাতীয় কোনো প্রশ্নের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না।
জাতীয়তাবাদী লেখক এস. ওয়াজেদ আলী-শেখ ওয়াজেদ আলী-তাঁর ভবিষ্যতের বাঙালি (১৯৪২) গ্রন্থে স্বতন্ত্র বা স্বাধীন বাংলার ধারণার সবচেয়ে কাছাকাছি কিছু বক্তব্য রাখেন। বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমানের মিলনে এক জাতি গড়ে তোলা যায় কি না, সে সমের্ক আলোচনা করলেও তিনি ভারত থেকে সমঙ্ূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা তেমন জোর দিয়ে বলেননি। তাঁর কথা, ‘সমস্ত ভারতবর্ষে এক সম্মিলিত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান গঠন করার দরকার;...এইভাবে অগ্রসর হলে, ভারতের ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা সাম্রাজ্যের শক্তি, আর জাতীয় জীবনে সুখ-শান্তি, নৈতিক বল ও আত্মিক প্রেরণা-উভয়বিধ সুবিধাই লাভ করতে পারব। একের মধ্যে বহুত্ব, আর বহুর মধ্যে একত্ব-এই উভয়বিধ মঙ্গলের সমাবেশে আমাদের জাতীয় জীবন অভিনব ঐশ্বর্য লাভ করবে।’
তিনি এক সাবধান বাণী উচ্চারণ করে বলেন, ‘সমস্ত ভারতবর্ষকে এক অখণ্ড কেন্দ্রীয় শাসনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস শেষ পর্যন্ত অসন্তোষ এবং ব্যর্থতাই এনে দেবে। কেননা, সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে ভাষার ঐক্য নাই, কৃষ্টির ঐক্য নাই, স্বার্থের ঐক্য নাই, ধর্ম এবং গোষ্ঠীর ঐক্যও নাই।’
ওয়াজেদ আলী তাঁর বক্তব্যের ব্যাখ্যায় আরো বলেন, ‘ভূগোল, ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি বিভিন্ন দৃষ্টিকেন্দ্র থেকে বিচার করলে, ভারতবর্ষে স্বাভাবিক কয়েকটি ভৌগোলিক বিভাগ দেখতে পাওয়া যায়। যথা-বঙ্গদেশ, হিন্দুস্থান, পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্থান, সিন্ধুদেশ, মহারাষ্ট্র-দেশ ইত্যাদি। এইসব ভূখণ্ডের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব কৃষ্টি, নিজস্ব ইতিহাস, নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা আছে। এই ভূখণ্ডগুলির নিজ নিজ বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য করলে, এদের প্রদেশ না বলে এক একটি রাষ্ট্র বা উপরাষ্ট্র বললেই সঙ্গত হয়। ভারতের ভবিষ্যত্ রাষ্ট্রতন্ত্রে এই বিভিন্ন উপরাষ্ট্রগুলির বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণশীল এক একটি রাজ্যের (উড়সরহরড়হ) অধিকার দেওয়া দরকার-অবশ্য তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহের সমের্ক। আর ভারত-রক্ষার জন্য এবং বৈদেশিক শক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি চালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রের সৃষ্টি করা দরকার। এই পথে গেলেই আমরা ভারতবর্ষে স্থায়ী এবং বর্তমান জীবনের বাস্তব প্রয়োজনের উপযোগী রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রবর্তন করতে পারব।’
ওয়াজেদ আলী বাঙালির ভাষাগত ঐক্য ও কুলগত ঐক্যের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘এখানে দ্রাবিড়, আর্য, মোঙ্গল, সেমিটিক প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির শত শত বত্সরের সংমিশ্রণের ফলে অভিনব অথচ সুনির্দিষ্ট এক জাতির উদ্ভব হয়েছে, যাকে আধুনিক বাঙালি জাতি বলা যেতে পারে। আর সেই বাঙালি জাতির এমন কতকগুলি সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য আছে যে-জন্য ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোক থেকে সহজেই তাদের পৃথক করে নেওয়া যেতে পারে। যথা-বাঙালি শান্তিপ্রিয়; যুদ্ধ-বিগ্রহ, মারামারি-কাটাকাটি সে ভালবাসে না। বাঙালি বুদ্ধিমান, ভাবপ্রবণ-সঙ্গীত, সাহিত্য, কলাবিদ্যা প্রভৃতিকে অন্তরের সঙ্গে সে ভালবাসে; ধর্মের বিষয়ে সে উদার মত পোষণ করে; গোঁড়ামি সে মোটেই পছন্দ করে না। বিদেশের আমদানি করা কৃত্রিম উত্তেজনা কখনও কখনও বাঙালির মনে ধর্মের গোঁড়ামির সৃষ্টি করে বটে, কিন্তু সে মনোভাব বেশি দিন স্থায়ী হয় না। কেননা, ধর্ম বিষয়ে সঙ্কীর্ণতা বাঙালির প্রকৃতিবিরুদ্ধ। নূতনের প্রতি একটা স্বাভাবিক ভালবাসা বাঙালি তার অন্তরে পোষণ করে। নূতন ভাব, নূতন প্রথা, নূতন আদর্শকে নূতন বলেই সে বর্জন করে না, পক্ষান্তরে যাচাই করে নূতনের মূল্য নিরূপণ করতে চায়। কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে ভাবের চর্চাই বাঙালির বেশি প্রিয়। সুযোগ এবং সুবিধা পেলেই সে কাজকর্ম ছেড়ে ভাবের চর্চায় বিভোর হয়ে যায়।
নাগরিক জীবনের চেয়ে বাঙালি পল্লিজীবন ও স্বভাব-সৌন্দর্যকে বেশি পছন্দ করে। বাংলার ইতিহাস ধর্মের উত্কট দ্বন্দ্বে কলঙ্কিত নয়। বাংলার হিন্দু ও মুসলমান সহজে এবং স্বচ্ছন্দে পাশাপাশি বাস করে। আর গত হাজার বত্সরের ইতিহাস তাদের মধ্যে এক নিবিড় আত্মীয়তা এবং ঐক্য স্থাপন করেছে। তাদের এক জাতি বলতে এখন আর দ্বিধা বোধ হয় না। বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সমস্যা এক। আর বাঙালির অর্থনৈতিক স্বার্থ ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকের অর্থনেতিক স্বার্থ থেকেও ভিন্ন। প্রকৃতি দেবীই স্বার্থের এই বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন। হিন্দু এবং মুসলমান-এই দুই প্রধান ধর্মসমঙ্রদায়ের লোকসংখ্যা এবং প্রভাব-প্রতিপত্তি এ দেশে প্রায় সমান-সমান। তাই এক সমঙ্রদায়ের উপর অন্য সমঙ্রদায়ের প্রভুত্বের সমস্যা প্রকৃতপক্ষে এ দেশে উঠে না। তারপর ইউরোপীয় সভ্যতার সঙ্গে দীর্ঘ এবং ঘনিষ্ঠ সংস্রবের ফলে বাংলাদেশে এমন এক কৃষ্টি এসে দেখা দিয়েছে, যার দৃষ্টি স্বভাবতই ভবিষ্যতের দিকে এবং বিশ্বমানবতার দিকে। পশ্চাতমুখী সামঙ্রদায়িক কৃষ্টি সব ক্ষেত্রেই পিছে হটে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ভাব (উবসড়পত্ধঃরপ ংঢ়রত্রঃ) ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেক বেশি গভীর এবং ব্যাপক। ভারতের রাজনীতিক্ষেত্রে বাঙালিই গণতান্ত্রিকতা এবং জাতীয়তাবাদের প্রধান এবং বিশ্বস্ত সমর্থক।’
ওয়াজেদ আলী মনে করেন, ‘প্রকৃতি দেবী-নিত্য নূতনের সৃষ্টিতেই যাঁর প্রধান আনন্দ-ভারতের এই পূর্ব ভূখণ্ডে নূতন এক জাতির, নূতন এক সভ্যতার, নূতন এক জীবনধারার, নূতন এক কৃষ্টির, নূতন এক আদর্শের সৃষ্টিপ্রয়াসে নিরত আছেন। অতীতের বিভিন্ন উপকরণের অভিনব সংযোগে বাঙালির জীবন নিয়ে তিনি এক নূতন শিল্প-নিদর্শনের সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেছেন। যাদের সাহায্যে তিনি এই নূতন রূপ-রচনায় রত আছেন, সে জাতি এখনও তার ভবিষ্যত্ গৌরবের বিষয়ে অবহিত হয়নি বটে, তবু মানুষ যেমন ভবিষ্যত সৌভাগ্যের আভাস তার অবচেতনায় পেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠে, অথচ সে উল্লাসের কারণ সঙ্ষ্ট বুঝতে পারে না-এই বাঙালি জাতিও তেমনি ভবিষ্যত গৌরবের অসঙ্ষ্ট ইঙ্গিত তার অবচেতনায় পেয়ে এক অব্যক্ত আনন্দানুভূতি অনুভব করছে, নূতন কিছুর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে, অভিনব কিছুর সন্ধানে দিশেহারা হয়ে ফিরছে; অথচ কেন যে এমন হচ্ছে তা ঠিক তারা বুঝতে পারছে না।’
এক বড় ভাবাবেগে উদ্দীপ্ত হয়ে ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘সেই শুভ দিন যখন আসবে তখন বাঙালি কেবল ভারতবর্ষের নয়, কেবল প্রাচ্য-ভূখণ্ডের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর পথপ্রদর্শক হবে-সত্য, সুন্দর, শুভ জীবনপথের। বাঙালি এখন সেই মহামানবের প্রতীক্ষায় আছে যিনি তাকে এই গৌরবময় জীবনের সন্ধান দেবেন-ভগীরথের মতো এই বাংলায় ভাবগঙ্গার সঙ্গম সুসঙ্ষ্ট করে তুলবেন।’
এস ওয়াজেদ আলী তাঁর ভবিষ্যতের বাঙালিতে যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন তার এক দীর্ঘ উদ্ধৃতির প্রতি আমি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব : ‘আমি এক শতাব্দী পরবর্তী যে বঙ্গদেশের স্বপ্ন দেখি, তা বর্তমানের ধূলি-ধূসরিত, বন-জঙ্গল-আগাছা-সমাকীর্ণ, শ্রীহীন, সৌন্দর্যভ্রষ্ট ঘর-বাড়িতে ভরা, হতগৌরব নদ-নদীর খাতের দাগে কলঙ্কিত বঙ্গদেশ নয়। আমি শতাব্দী-পরের যে বাঙালি জাতির স্বপ্ন দেখি সে বর্তমানের ক্ষীণকায়, মাংসপেশীহীন, রোগ-বিশীর্ণ, অনশনক্লিষ্ট, গতশ্রী, আনন্দহীন, প্রেরণাহীন, কলহপ্রিয় বাঙালি পুরুষের নয়। আমি যে বাঙালি জাতির ছবি দেখি সে বর্তমানের ভারাতুর, লজ্জা-কাতর স্বাস্থ্যহীন, শ্রীহীন, সৌষ্ঠবহীন, খর্বাকৃতি, শীর্ণকায় বাঙালি নারীর নয়। আমি যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বপ্ন দেখি, তাতে কেরানি-সৃষ্টির আগ্রহ নাই; গোঁড়া হিন্দু, গোঁড়া মুসলমান সৃজনের উত্কট প্রয়াসও নাই-অতীতের প্রাণহীন দেহগুলি সাজিয়ে রাখবার জাদুঘর সে প্রতিষ্ঠান নয়। আমি ভবিষ্যতের যে রাজনীতির স্বপ্ন দেখি তাতে চাকুরির ভাগ-বাটোয়ারার কলহ নাই; স্বার্থসর্বস্ব, কুচক্রী, ভণ্ড তপস্বীদের অভিনন্দনেরও ব্যবস্থা নাই। আমি ভবিষ্যতের যে সাহিত্যের কল্পনা করি সে সাহিত্য শুধু অতীতকে নিয়ে কুহক রচনা নয়, নিজেদের তুচ্ছতাকে ঢাকবার জন্য কাল্পনিক অতীতের অশোভন অতিরঞ্জন নয়। আমি যে নাগরিকের কল্পনা করি তার জীবন সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, তুচ্ছতার যুপকাষ্ঠে বৃহত্তর স্বার্থের অমর স্বত্বাধিকারীকে বলিদানের জন্য নয়। আমি সমঙ্ূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর জীবনাদর্শের, সমঙ্ূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর সাধনার, সমঙ্ূর্ণ ভিন্ন শ্রেণীর কামনার সুখস্বপ্ন দেখি। আমার সে স্বপ্ন কি, এখন তাই বলি।
আমি যে ভবিষ্যত্ বঙ্গদেশের কল্পনা করি, তাতে বর্তমানের মজানদীর এবং শুষ্ক খালের খাতে প্রচুর জলপ্রবাহের অশ্রান্ত কলধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাদের বক্ষের ক্ষীরধারায় সমস্ত দেশ ফুলে-ফলে-শস্যে অপূর্ব শ্রী ধারণ করেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাংলার প্রত্যেক পল্লীতে এবং প্রত্যেক জনপদে তার নিজস্ব নদী অথবা খাল আছে, যাদের সাহায্যে উদ্বৃত্ত বর্ষার জল অবাধে সাগর-পথে প্রবাহিত হচ্ছে-বর্তমানের মতো সে জল ম্যালেরিয়ার মশার সূতিকাগারের সৃষ্টি করছে না। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে প্রত্যেক গৃহস্থের বাড়ি গৃহশিল্পের আলিপনার সুন্দর এক একটি নিদর্শন হয়ে বিরাজ করছে, বর্তমানের মতো গৃহ-সৌন্দর্য-পিপাসুর মনে নিত্য সে নূতন যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে না। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে প্রত্যেক গ্রামের নিজস্ব বাগান, নিজস্ব খেলার মাঠ, নিজস্ব পাঠাগার, নিজস্ব ক্লাব বা ইন্সটিটিউট আছে। আর গ্রামবাসীরা সেইসব প্রতিষ্ঠানে পরসঙ্র সহযোগিতায় নিত্য নূতন আনন্দের সন্ধান পাচ্ছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে প্রশস্ত সুগঠিত রাজপথ দেশের প্রত্যেকটি গ্রামের সঙ্গে প্রত্যেকটি গ্রামকে, প্রত্যেকটি নগরের সঙ্গে প্রত্যেকটি নগরকে সুলগ্ন রেখেছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি তাতে বাংলার গৃহপালিত পশুপক্ষীর শ্রী এবং সৌন্দর্য বাংলার গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার মাংশপেশীবহুল, সুঠাম, বলিষ্ঠদেহ বাঙালি বৈদেশিকের বিস্ময় উত্পাদন করছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তাতে বাঙালি নারীর স্বাস্থ্য এবং সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর প্রশংসার বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের কল্পনা করি, তার বিদ্যানিকেতগুলির স্থাপত্য-সৌন্দর্য, তাদের উদ্যানের শোভা, তাদের বেষ্টনীর মনোহারিত্ব মানুষের মনকে সৌন্দর্যের অপরূপ জগতের সন্ধান দিচ্ছে। আর সেইসব প্রতিষ্ঠানের আচার্য এবং ছাত্রদের পরসেরর স্নেহ এবং প্রীতি নাগরিকদের আদর্শ হয়ে উঠেছে; তাদের সত্য-শ্রেয়-সুন্দরের সাধনা বিশ্বের অনুকরণীয় গৌরবের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি তাতে হিন্দু তার ধর্মের অন্তর্নিহিত সনাতন সত্যের সন্ধান পেয়েছে, মুসলমান তার ধর্মে অন্তর্নিহিত শাশ্বত সত্যের সন্ধান পেয়েছে; আর উভয়েই মর্মে মর্মে বুঝেছে যে, যেখানে সত্য সেখানে দ্বন্দ্ব নাই; যেখানে সুন্দর সেখানে দ্বেষ-হিংসা নাই; যেখানে শ্রেয় সেখানে সঙ্কীর্ণতা নাই, কার্পণ্য নাই; আলোকের পথে অন্তহীন একাগ্র অভিযানই সকলের ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তাতে জ্ঞানসমৃদ্ধ, ভাবসমেদর গরীয়ান বাঙালি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব, দেশ-শাসনের ভার, নেতৃত্বের অধিকার উত্তম-বুদ্ধিবিশিষ্ট যোগ্যতমের উপর অতি সহজভাবেই ন্যস্ত করছে-নির্বাচনের অপ্রিয়তা ও স্বার্থান্ধতা সেখানে মুছে গেছে। আমি যে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, তার সাহিত্য থেকে ফাঁকা আড়ম্বর আর ভাবের দৈন্য চিরতরে বিদায় গ্রহণ করেছে। সত্য-শ্রেয়-সুন্দরের নিত্য নূতন অনুভূতিতে সে সাহিত্য নিত্য-নূতন পথ রচনা করছে।’
ওয়াজেদ আলী ‘জাতীয় জাগরণ’ প্রবন্ধে বলেন, ‘আমরা যদি সত্যই নিজেদের প্রথমে ভারতবাসী তথা বাঙালি আর তারপর হিন্দু সমঙ্রদায়ভুক্ত কিংবা মুসলমান সমঙ্রদায়ভুক্ত রূপে ভাবতে শিখি এবং সেই ভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করতে শিখি এবং কথা ও কাজের দ্বারা সে আদর্শকে প্রচারিত এবং প্রতিষ্ঠিত করতে ঐকান্তিকভাবে যত্নবান হই, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই কালোপযোগী আদর্শই ভারতবর্ষে সেই একতা এবং আত্মীয়তাবোধের সৃষ্টি করবে যার ফলে দেশময় প্রেমের প্রবাহ হইবে এবং বর্তমানের সব অভাব, সব প্রয়োজন পরিপূরিত হবে।’
ওয়াজেদ আলীর উক্ত স্বপ্নদর্শন আমাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ (আমার এক স্বপ্ন) শীর্ষক বক্তৃতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওয়াজেদ আলীর ভবিষ্যতের বাঙালি প্রথম মুদ্রিত হয় ১৯৪২ সালে, তখন ১৯৪৭ সালের বঙ্গভঙ্গকে প্রতিহত করার জন্য সার্বভৌম অখণ্ড বঙ্গের কথা কেউ চিন্তা করেনি।
বাঙালি কবি, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদরা এক অনুপম ভাবাবেগে বাঙালির যে শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যাখ্যান করেন তার মধ্যে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের তেমন কোনো স্বপ্ন ছিল না। তাঁদের বড় স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশে এক মহামানবের জন্ম হবে, যিনি ভারতকে নেতৃত্ব দেবেন। তাঁদের সেই স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের মুসলমান মধ্যবিত্তের উত্থান বিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। পাকিস্তান কল্পনার মধ্যে বাংলা ও আসাম নিয়ে যে চারণভূমির কথা বলা হয়, তা সেই সমঙ্রদায়কে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশের মুসলমানদের ভোটের জোরেই পাকিস্তানের জন্ম।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শরত্চন্দ্র বসুর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রস্তাব প্রথম থেকে নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তাঁদের এ ব্যাপারে মতৈক্যও ছিল না। গান্ধী, বাংলার ছোট লাট বা ভারতের বড় লাটের কাছ থেকে বড় আপত্তি না এলেও বিভক্ত ভারতের অখণ্ডতা সমের্ক এ প্রস্তাবের জন্য ভারতীয় শীর্ষ নেতাদের বড় দুর্ভাবনা ছিল। কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীর দাঙ্গার পরিবেশে সার্বভৌম অখণ্ড বাংলার পরিকল্পনা হিন্দু ও মুসলমান কেউই স্বীকার করে নিল না। ১৯৪৭ সালের আগেই বঙ্গপ্রদেশের হূদয় দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বৃহত্তর বঙ্গের প্রতি বাঙালিদের তেমন দরদ ও টান ছিল না। বঙ্গপ্রদেশের উল্লেখযোগ্য হিন্দু বুদ্ধিজীবী ও সমাজপতিরা বঙ্গপ্রদেশের বিভক্তির জন্য সেক্রেটারি অব স্টেটের কাছে তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময় দক্ষিণপন্থিদের মধ্য থেকে ‘রাষ্ট্র-ভাসানো বাংলা চাই না’ বলে একটা ্পোগান উঠেছিল। কিন্তু সেই আন্দোলনের সময় ‘বাংলা ভাষা রাষ্ট্র চাই’-এমন ্পোগান বা দাবি উত্থাপিত হয়নি।
বাংলাদেশের জনগণ সমের্ক পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিদের অবজ্ঞা, অবহেলা ও অসম্মানজনক ব্যবহার এ দেশের তরুণদের মনে প্রথমে হতাশা, পরে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধের বীজ বপন করে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার ভৌগোলিক ব্যবধানের জন্য রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব যেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তেমনি তার বিদ্যমানতা সমের্ক উভয় অংশের মনে সন্দেহ দেখা দেয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের দুই দশকের মধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাব্যতা সমের্ক গভীরভাবে আলোচিত হতে থাকে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। বাংলাদেশের তরুণদেরকে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের জন্য তাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণোদিত করতে হয়েছে।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানের যেসব উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের তেমন কোনো যোগ-সমর্ঙ্ক ছিল না। অবাঙালি আমলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজশে দেশের নীতি নির্ধারিত হতো। ইসলামি সৌভ্রাতৃত্বের আকর্ষণে বায়োজ্যেষ্ঠরা পাকিস্তানের প্রতি যে আনুগত্য প্রকাশ করত, তার প্রতি নতুন প্রজন্ম দ্রুত বিশ্বাস হারায়। আরবি হরফে বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টা, নজরুল প্রক্ষালন ও রবীন্দ্রসঙ্গীত বর্জনের পাকিস্তানি অপচেষ্টার ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সব সমর্ঙ্ক ছিন্ন করার কথা এ দেশের তরুণদের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করে। ১৯৪৭ সালের মৃতবত্সা অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার কথা বাদ দিলে দেখা যায়, বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলার স্বাধীনতার কথা সংগোপনে উচ্চারিত হচ্ছে। ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলার লক্ষ্যে তরুণ ছাত্ররা উদ্বুদ্ধ হয়। তাদের মুখপত্র বিপ্লবী বাংলার বেশ প্রভাব ছিল।
১৪ অক্টোবর, ১৯৫৫ পূর্ববাংলার যে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ হয় তাকে অস্বীকার করে এ দেশের সেই অতি পুরাতন নাম ‘বাংলাদেশ’কে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা পারের ছেলেরা নতুন করে আবিষ্কার করল। ১৯৫৯-৬০-এ পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৩২ শতাংশের বেশি। উন্নয়ন দশকের বদৌলতে ১৯৬৯-৭০-এ সেই বৈষম্য প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬১ শতাংশে দাঁড়াল। দুই অর্থনীতি বা ছয় দফা কর্মপন্থায় এই বৈষম্য দূর করার কোনো সম্ভাবনা না দেখে ছাত্ররা ‘ছয় দফা নয়, এক দফা এক দফা!’ বলে ্পোগান দেয়। জাগো জাগো বাঙালি জাগো! বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো! ইত্যাদি ্পোগানে তখন বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস মুখরিত। ২ মার্চ, ১৯৭১ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবনারায়ণ দাস কর্তৃক পরিকল্পিত ও অঙ্কিত বাংলাদেশের পতাকা তোলেন।
‘অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার’-একটি সংক্ষিপ্ত অক্ষর সমষ্টিকে ধারণ করে ‘অপূর্ব সংসদ’ নামক একটি সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক অধ্যাপক ড. আহমদ শরীফ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুহম্মদ আব্দুল হাই, কবি সুফিয়া কামাল ও সাহিত্যিক শওকত ওসমানের কাছ থেকে পরামর্শ ও উপদেশ পায়। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন ও মওলানা ভাসানীসহ কেউ কেউ অপূর্ব সংসদ সমের্ক অবহিত ছিলেন। ওই সংসদের তৃতীয় ইশতেহার ইতিহাসের ধারায় বাঙালি ড. আহমদ শরীফ রচনা করেন। সেই ইশতেহারের উপসংহারে বলা হয়, ‘যে অর্থনৈতিক কারণে হিন্দুবিদ্বেষ জেগেছিল এবং ধর্ম, সংস্কৃতি ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের জিকির তুলে আর্থিক সুবিধার জন্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত; আজ আবার সেই অর্থনৈতিক কারণে অর্থাত্ শোষণের ফলেই বাঙালি স্থানিক, ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিতে স্বাধীনতা দাবি করবে এই তো স্বাভাবিক। অন্তত ইতিহাস তো তা-ই বলে।’
পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত জনগণের অবোধ্য ফারসি ভাষায় রচিত হয়। তরুণদের প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি নতুন করে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
‘অপূর্ব সংসদ’-এর তরুণ সদস্যরা দেশে-বিদেশে ‘ইস্ট পাকিস্তান ফরএভার’ বলে এমন দেশপ্রেমের কথা অতি সংগোপনে প্রচার করেন। ‘ইস্ট পাকিস্তান ফর ইস্ট পাকিস্তান, উইথড্র অক্যুপেশন ট্রূপস ফ্রম ইস্ট পাকিস্তান’ বা ‘ফর ইস্ট পাকিস্তান ফুল অটোনমি অর ফ্রিডম : ফ্রিডম’-এ ধরনের ব্যানার হাতে করে ষাটের দশকের শেষার্ধে লন্ডনে কিছু তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শোভাযাত্রা করেন। ৭ এপ্রিল ১৯৬৯ সালে লন্ডনের দৈনিক টাইমস-এ সেই সব ব্যানারসহ শোভাযাত্রার এক আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়।
অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ঐতিহাসিক ডক্টর হাবিবুল্লাহ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত্ করে কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা স্বাধিকার দাবি করছি বটে, কিন্তু আমাদের আসল লক্ষ্য স্বাধীনতা।’ অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, ‘খবরদার, ও কথা মুখে আনবেন না। পাকিস্তানি সেনা ভীষণ অত্যাচার করবে।’
লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউসের এক বৈঠকে কিছু তরুণ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার কথা উত্তোলন করলে তিনি ভীতচকিত হয়ে বলেন, ‘তাহলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে।’ একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ভাঙনে রক্ত প্রবাহিত হওয়ারই কথা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে আমার যে আলোচনা হয় এবং সমঙ্রতি সেই ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে যে তথ্যাদি প্রকাশ পাচ্ছে তার থেকে মনে হয় না পাকিস্তান সরকারের অভিযোগ সমঙ্ূর্ণ বানোয়াট ছিল। সার্জেন্ট জহুরুল হক নাকি পাকিস্তানদ্রোহিতার অভিযোগের উত্তরে ‘অপরাধ-স্বীকার’ করতে চেয়েছিলেন। দেশের লোক আগরতলা ষড়যন্ত্র বিশ্বাস করেনি। তবে অনেকে ভেবেছিলেন, এমন ষড়যন্ত্র হয়ে থাকলে ভালোই হয়েছে।
৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ লাহোরে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সংবাদপত্রে এই শাসনতান্ত্রিক প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও পার্লামেন্টারি দপ্তরের মন্ত্রী আবদুল হাই চৌধুরী ছয় দফাকে ‘দেশদ্রোহিতার নামান্তর’ বলে অভিহিত করেন। প্রাদেশিক কাউন্সিল মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম ও এমএনএ খাজা খায়রুদ্দিন এক সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফাকে ‘বিপজ্জনক’ বলে মন্তব্য করেন। ১০ মার্চ ১৯৬৬ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হুমকি দিয়ে বলেন, ‘ছয় দফার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ চাপাচাপি করলে অস্ত্রের ভাষায় জবাব দেয়া হবে এবং দেশে গৃহযুদ্ধ হয়ে যাবে।’
২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ ছাত্র ইউনিয়নের আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি সামরিক হেফাজতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা সামরিক সদস্যদের হামলায় নিহত হন। দেশে এক গণঅভ্যুত্থানসম পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করা হয়।
১২ নভেম্বর ১৯৭০ সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে ১০ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে। ত্রাণকার্যে কেন্দ্রীয় সরকার যে অনীহা প্রকাশ করে সেই আবহাওয়ায় ২৮ নভেম্বর ১৯৭০ শেখ মুজিব বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ মারা গেছে। স্বাধিকার অর্জনের জন্য বাংলার আরো ১০ লাখ প্রাণ দেবে।’ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক অবিসংবাদী দেশনায়ক হিসেবে সকলের আনুগত্য অর্জন করেন।
৭ মার্চ শেখ মুজিব ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা অব্যাহত থাকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। ইতিমধ্যে ২৩ মার্চ থেকে দেশের সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হতে শুরু করে। ২৫ মার্চ ভুট্টো বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে, তাকে আর প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন বলা চলে না। ওদের দাবি তো স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশি, প্রায় সার্বভৌমত্বের কাছাকাছি।’ ২৬ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের ফলে অতি দ্রুত বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার জন্য অস্ত্রধারণ বাংলাদেশের জন্য একটি অনন্য ঘটনা। বাংলাভাষার মণিকোঠায় যে-স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন সংগোপনে লালিত এতদিন হয়ে এসেছিল তা ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সার্থকতা লাভ করল। ধর্মের ওপর নির্ভর করে পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিস্তানের জন্ম। আর ভাষার ওপর ভর করে সেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। নতুন বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তানের ভৌগোলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ। যে আত্মসমঙ্রসারণের দ্বারা একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম চালিত হয় তা উল্লেখযোগ্যভাবে আত্মরক্ষামূলক এবং এক স্বাতন্ত্র্যের স্বকীয় সীমানায় আত্মসন্তুষ্ট। সেখানে অমুক্ত বাংলা বা ইবহমধষধ রত্ত্রফবহঃধ জাতীয় কোনো ভাবনা নেই। গত এক শ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে নানা মোড় ফিরে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি চমকপ্রদ ঘটনা বটে।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত