বিজ্ঞাপন
default-image

সাঁই সাঁই করে মেঘের সিঁড়ি নামতে লাগল। নিকষ পুঞ্জীভূত কুয়াশাগুচ্ছ ফুলের মতো ছড়িয়ে ছিল সিঁড়িটির সর্বত্র।

এর কিছু পরেই খুনটা ঘটল।

যেন-বা মিহি তুলোর শয্যা। সিঁড়ি দিয়ে আহ্লাদী কায়দায় একটি দেহ গড়াতে গড়াতে বিছানায় শুয়ে থাকা ব্রাদার রেজার বাহুমূলে তলিয়ে গেল। শীৎকারের চূড়ান্তে বধূ মালাইকার মুখটা স্পষ্ট হয়।

স্বপ্ন দেখছিল সে। রোগটা হঠাৎই তাকে গ্রাস করতে থাকল। তীব্র ঘৃণা আর বুকের হু হু কান্নার মধ্যে যেন অনন্ত থেকে সে বের করল ছুরি। পৈশাচিক শক্তিতে ব্রাদার রেজাকে ভূপাতিত করে মোরব্বার মধ্যে কাঁটা বিদ্ধ করার মতো মালাইকাকে ছুরির পর ছুরির ঘায়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। স্পষ্ট দেখেছে সে, ব্রাদার রেজার ঘরে ছিল একটি ছবি—হ্যাঁ, সেই ধবল সিঁড়ির ছবিসর্বস্ব পোস্টারের ঘরটা ব্রাদার রেজার ঘরেই ছিল।

দরজায় দাঁড়ালেন বাবা।

দিনের চক্করে শুকনো বাতাসের মতো ওড়ে সে। পাক খায় পার্কের নির্জন হাওয়ায়।

বাবা সব রক্ত সব চিহ্ন ধুয়ে তাকে পুরোপুরি নির্দোষ প্রমাণের জন্য বললেন, ‘সাবধান! মুখ খুলবে না এ ব্যাপারে।’

বধূ মালাইকা অতি নিঃশব্দে এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

‘রাজকন্যা চুল খোলো গো চুল খোলো...’—মাচার ওপরে বন্দী মালাইকাকে নিচ থেকে ডাকত সে। ‘আমি অধম রাজপুত্র তোমার চুলের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে তোমাকে রাক্ষসীমুক্ত করব।’ মনে মনে সে ভাবে। আর ভাবে, যখন সে দেখেছিল মালাইকাকে গ্রামের দিঘির ঘাটে, ওর রূপ থেকে সূর্যের তাপে ঘি গলে পড়ছিল যেন।

এরপর যা হয়, দরিদ্র ঘরের সুন্দরী কন্যা মালাইকা...পাত্র অপ্রকৃতিস্থ জেনেও মালাইকার পরিবার মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে দিয়ে দিল। তখন অবশ্য মালাইকার নাম মালাইকা নয়, খুকি।

যাক সেসব, এখন তার মনে পড়ছে ফুলশয্যার কথা। অদ্ভুত এক বর্ণিল উজ্জ্বলতায় ফুলশয্যায় স্ত্রীর মুখ দেখে সে দেহের অচেনা তরঙ্গে বিহ্বল হয়ে কাঁপছিল শুধু। মালাইকা মাঝরাত অবধি লজ্জাবতী থেকে ভূলুণ্ঠিত মনের অবস্থার মাঝে নিজেকে দাঁড় করিয়ে ঋষি শৃঙ্গের কৌমার্য ঘোচাতে এগিয়ে এসেছিল।

সেই শৈশবে তাকে আগলে রাখত তার মা। এরপর কাছের কেউ, তার প্রাণের বলতে মালাইকাকেই পেল সে—তার সব সময়ের, সবকিছুর সহচরী, সঙ্গী।

নিজের ঘরে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম...আসমানের দিকের নিষ্প্রভ আলোয় ধাই ধাই চোখে তাকিয়ে ভাবে সে।

পাশে বধূ মালাইকা ছিল না।

কাঁচা ঘুমভাঙা চোখে হাঁটতে হাঁটতে এদিক-ওদিক খুঁজে কী বুঝে আমি ব্রাদার রেজার ভেজানো দরজায় টান দিতেই দেখি সেই অত্যাশ্চর্য সিঁড়ি। ধবল সিঁড়ির ছবিসর্বস্ব সেই পোস্টারের ঘরটা।

টুকরো স্মৃতিগুলো মনে ঢেউ তোলে তার। গুমরানো কান্নায় বুক ফাটি ফাটি করে। চক্ষু যুগল জ্বালা করে শুধু। জল আসে না।

‘তুই পারলি খুকি...তুই পারলি...?’—অস্ফুট স্বরে বলে সে।

বাবাই ছেলের বউয়ের নাম দিয়েছিলেন বধূ মালাইকা। সবার সামনে বউকে এ নামেই ডাকত সে। কেবল খুব একান্তে উচ্চারণ করত খুকি—দু-অক্ষরের এ নামটি।

স্মৃতির ভেতর ভাসে অনেক কিছু। দিন-রাত্রির অসহ্য বিছানায় একাকী তড়পায় সে। আশৈশব, আজীবন তার কোনো বন্ধু নেই। জগৎ নেই।

পড়াশোনা যত দূর করতে পেরেছে, বাড়িতে টিচারের কাছেই। ক্লাস ফাইভে মায়ের মৃত্যুর পর থেকে শুরু হলো অসুস্থতা—তার মনে হয়, কোনো ছায়া যেন গ্রাস করতে শুরু করেছে তাকে।

তখন থেকেই একটা নিস্পৃহ মনের আয়া দিন-রাত তার দেখাশোনায় লিপ্ত ছিল।

তবে চোখের সামনে প্রায়ই সে দেখতে পেত সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত মায়ের দেহ...। ঝুলন্ত মায়ের দু–পা জড়িয়ে ধরে ভয়ে বুক–ফাটা কষ্টে সে কেঁদে চলেছে। আর এ দৃশ্য দেখামাত্রই ভাঙতে শুরু করত ঘরের সব জিনিসপত্র।

তারপর ধমকে আদরে একসময় তাকে আমূল কবজা করে নিত আয়া। এভাবেই চলছিল। বিয়ের পর এল মালাইকা।

মায়ের পর মালাইকাই তাকে স্নেহ-আদরে খাবার তুলে দিত মুখে। আর সে-ই, সেই মেয়েটিই কি না...!

পরক্ষণেই ফণা তোলে অন্য খুনি...পালিয়ে যাওয়া ব্রাদার রেজার কল্লা কাটার জন্য সে পইপই চক্ষু বিস্তার করে এদিক-ওদিক।

ডাক্তার তাকে ওষুধ বাড়িয়ে দেয়। কাউন্সিলরের কথোপকথনে অসহিষ্ণু বোধ করে সে।

‘আপনার স্ত্রী কোথায়?’

‘জানি না।’

‘তাকে মনে পড়ে না আপনার?’

ভ্রু কুঞ্চিত করে একটু ঝুঁকে ফিসফিস কণ্ঠে সে বলে কাউন্সিলরকে, ‘সঙ্গম শেষে যে প্রাণী স্বামীকে খেয়ে ফেলে, জাতে ওই প্রাণী ছিল মালাইকা...মা...ক...ড়...সা। ...উল্টো আমি তাকে গিলে ফেলেছি।’

বিস্মিত কাউন্সিলর প্রশ্ন করেন, ‘কবে? কীভাবে?’

‘এক ফেব্রুয়ারি। মালাইকা বলছিল ওটা ছিল আমাদের বিবাহবার্ষিকীর রাত... আর ওই রাতেই কি না...’

কথা বলতে বলতে চোয়াল আর মুঠি শক্ত হয়ে ওঠে তার। তিরিক্ষি চোখে কাউন্সিলরকে বলে, ‘আপনি যান তো, অসহ্য!’

হৃদয়ের সাঁকোয় অহর্নিশ ফড়িংয়ের মতো লাফায় বধূ মালাইকা। তার ঘুম আসে না।

ছাদে উঠে সটান রোদ্দুরে শুয়ে থাকে পিঠ ঠেকিয়ে। ক্লান্তিতে ঘুম নেমে আসে চোখে। যেন বা স্বপ্নে দেখে সে, বাবার ঘরে শোনা যায় হিহি হাসির বৃষ্টিমল্লার...।

দরজার ভাঁজফাঁকে চোখ রেখে দেখে একটা ডানাকাটা পরি অত্যাশ্চর্য এক লাল শাড়িতে নিজের যৌবন কিঞ্চিৎ ঢেকে গড়িয়ে পড়ছে। বাবার মুখ পানে তাকিয়ে ওই পরির মুখ লাস্যময়, ‘কেন আমি তোমার এ বাড়িতে থাকতে পারি না? আমি তোমার বিয়ে করা স্ত্রী...।’

‘না!’ সশব্দে সামনে দাঁড়ায় সে, ‘আমার বাবার স্ত্রী একজনই। তিনি মারা গেছেন। আপনি বেরিয়ে যান।’

‘অসভ্য ছেলে! যাও, বেরিয়ে যাও...।’ চিৎকার করে ওঠেন বাবা।

তার হাত-পা নিথর হয়ে আসে। বাবা অমানবিক নির্যাতন করতেন মায়ের ওপর। দেখে সে ভয় পেত। শৈশবে ভেতরে ঢুকে যাওয়া সেই ভয় থেকে আর বেরোতে পারেনি সে।

বেরিয়ে আসতে আসতে শোনে বাবার কণ্ঠ। পরিকে বাবা বলছেন, ‘লক্ষ্মী, বোঝো না কেন, তোমার বাবা আমার রাজনৈতিক বন্ধু। সামনে ইলেকশন। এখন বিয়েটা প্রকাশ হলে...।’

ছাদ থেকে একটা নির্ভার দেহ নিয়ে নামতে থাকে সে। ভাবে, এই যে বাবার সঙ্গে ডানাকাটা পরির দৃশ্য, ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিল; কিন্তু নিজের ঘরে যেতে যেতে আবার তার কানে আসে বাবার গলা। আয়াকে ফের বলছেন বাবা, ‘ওকে একটু সামলে রাখতে পারো না? যার-তার সামনে যখন-তখন এসে চিৎকার করে।’

বাবা তার স্বপ্নের কথা জানলেন কী করে?—সে ভাবে।

ডাক্তার ওষুধ দেয়। সেগুলো গিলে দু-হাতে মাথা চেপে ধরে, ‘আমার যে কী হচ্ছে হঠাৎ—স্বপ্ন আর বাস্তব গুলিয়ে ফেলছি।’

ডাক্তারের চোখের বাতি ছপ করে জ্বলে ওঠে, ‘এটা তুমি বুঝতে পারো?’

‘কী জানি!’ অবশ দেহে নেতিয়ে পড়তে পড়তে সে বলে, ‘মোরা আর জনমে হংস মিথুন ছিলাম...।’ তার মনে পড়ে, একবার গ্রামে গিয়ে চাঁদ রাত্রিতে সে আর খুকি শুয়ে ছিল কলার ভেলায়। দিঘিতে থই থই করছিল স্রোত...হু হু পূর্ণিমায় ভেসে যাচ্ছিল চারপাশ। পুরো গ্রামে যেন বা পূর্ণিমার খই ফুটছিল। সর্বাঙ্গে তখন তার অদ্ভুত রোমাঞ্চ। ছিল মোহময় নৈঃশব্দ্য। সেই নৈঃশব্দ্যে মস্ত চাঁদটা প্রগাঢ় মধু ঢেলে তাদের ভিজিয়ে একশা করলে বিমূঢ় হয়ে শুয়ে থাকা খুকির কানে ফিসফিস করেছিল সে, ‘বউ...।’

আলতো কেঁপে জড়ানো কণ্ঠে বলেছিল খুকি, ‘আবার ডাকো।’সে রাতে দুজনে যেন বা কলার ভেলা নয়, মহা পূর্ণিমার জলে কখনো ডুব কখনো চিতসাঁতার দিয়ে মৎস্যকুমার-কুমারীর মতো এগিয়ে গিয়েছিল মহা অনন্তের দিকে।

এই কথাগুলোই বিকেলে সে বলল আয়াকে, ‘আমি না স্বপ্নে কলার ভেলায় করে চাঁদরাতে...’

‘এইডা কী কন? এইডা স্বপ্ন অইল কীভাবে? বউরে নিয়া হাচাই তো আপনি গেছিলেন। দিঘির পাড়ে আমি ছিলাম পাহারায়।’

স্ত্রীকে স্মরণ করে দেহের মধ্যে জমতে থাকা কিছু রোমাঞ্চ কিছু বিষমিশ্রিত রক্ত ক্রমেই জল হয়ে যেতে থাকে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে হাতচাপা দিয়ে ফোনে ডাক্তারের কথা শুনে ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে সে। স্নায়ুর বিভ্রমে চেতনায় উল্টিপাল্টি লেগে গেছে। তবে বাবার পায়ের শব্দে শোয়া থেকে আবার সন্তর্পণে উঠে বসে। সাধারণত বাবা যা করেন না তা-ই করলেন। বসলেন ছেলের বিছানায়।

‘কাউন্সিলরকে তুমি কী বলেছ?’ বিছানায় বসে বললেন তিনি।

‘কী বলেছি?’

‘তুমি মাকড়সা গিলে ফেলেছ...তুমি তাকে ওই হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিত দিতে চাইছিলে কেন?’

‘আমি তো কিছু বলিনি, যদিও আপনি বলেছিলেন কাউন্সিলরকে কিছু না লুকাতে।’

‘এই ব্যাপারটা নিজের কাছেও লুকাবে।’

বাবার এমন কঠিন বাক্যের পর ঘরে প্রগাঢ় নীরবতা নেমে আসে।

‘তুমি বধূ মালাইকাকে খুন করেছ কেন?’

এই প্রথম ছেলেকে কিছুটা বিপর্যস্ত দেখেই যেন বা প্রশ্নটি করলেন বাবা।

‘ব্রাদার রেজাকে কোথায় লুকিয়েছ?’ পিতার সামনে এবার হিস হিস করে ওঠে সে, ‘মালাইকাকে সরল-সহজ পেয়ে সে...যাক, ব্রাদার রেজা—আমার ভাই, তাকে আমি ভূমণ্ডল খুঁজে বের করে কেটে ফালাফালা করব।’

‘তুমি এসব কী বলছ!’ বাবার কণ্ঠের বিস্ময় আছড়ে পড়ে সমস্ত ঘরে, ‘সে তো এক মাস আগেই লন্ডন গেল। তুমি-আমি দুজনই তাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে গেলাম। তোমাকে সে কত ভালোবাসে...।’

‘ওটা তো আমার স্বপ্ন ছিল।’

‘কোনটা?’

‘এয়ারপোর্টের ব্যাপারটা।’

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে কিছু একটা আঁচ করে বাবা গেলেন পাশের ঘরে। একটা খবর কাগজ হাতে ফিরে এসে মেলে ধরলেন তার সামনে, ‘এই যে দেখো রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে পুরস্কার নিচ্ছে তোমার ভাই। ছবির পাশে এই যে দেখো তারিখ—১ ফেব্রুয়ারি। তার ১৫ দিন আগেই সে চলে গেছে।’

যেন মহাকাশে অনন্ত রাত নেমে আসে। রাতের নির্জন রাস্তায় হু হু শীতল বাতাসে ভাসতে ভাসতে সে হিসাব কষে...তার পাশে শুয়ে ছিল বধূ মালাইকা। সেদিন রাতে প্রচণ্ড কাশি হয়েছিল তার। এরপর তার কানে ধ্বনিত হলো, ‘তুমার ঘুমের প্রবলেম হইতাছে? আমি তাহলে অন্য ঘরে, রেজা ভাইয়ের ঘরে গিয়ে ঘুমায়।’

একটি কড়ইগাছ চিতা হরিণের মতো আসমানকে বিচিত্র করে দাঁড়িয়ে আছে।

ধপাস বসে পড়ে সে ফের মেলাতে চেষ্টা করে হিসাব, কলার ভেলা স্বপ্ন ছিল না, এয়ারপোর্ট স্বপ্ন ছিল না...আরও আরও কিছু...

শীতে চামড়ার রোমকূপ শিরশির করে। ধড়ফড় করে বুক, হ্যাঁ, বধূ মালাইকা সেদিন একাকী শুয়ে ছিল ভাইয়ের ঘরে...হাঁপাতে হাঁপাতে কয়েক মুহূর্ত পার করে সে, তবে ব্রাদার রেজার সঙ্গে শয্যাদৃশ্য? ওই রাতে তবে ওইটুকু দৃশ্যই স্বপ্ন ছিল? ও গড!

ঘুপচি আবছায়া গলি ধরে এখন সে যেন বালক। গুমরে উঠছে। কাঁদছে। আর তার করুণ চোখের ভেতর জোছনার শাড়ি পরে হাসতে হাসতে উড়ন্ত হাত নাড়ছে বধূ মালাইকা।

পুলিশ স্টেশনের সামনে একটা রেলিং নয়, মায়ের দু–পাও যেন নয়—বধূ মালাইকার চরণ আগলে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে সে।

নাসরীন জাহান: কথাশিল্পী।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৫ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত