বিজ্ঞাপন
default-image

আমি তখন ওয়ারী থাকি। সঙ্গে থাকে আমার পরিবার আর এক ভাই। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। ২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনীর ভয়াবহতায় চারদিকে আতঙ্ক। নিজেও আতঙ্কে আছি। বিশেষ করে যখনই শুনতে পাই সংখ্যালঘুদের পেলেই পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাওয়ার মানেই ফিরে না আসা।

সেদিন ছিল ১ এপ্রিল। বাসায় বসে আছি। এমন সময় খবর এল পাকবাহিনী পুরো বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আতঙ্কে জমে গেলাম। হায়, এখন কী হবে! বুঝি পুরো পরিবার নিয়েই মরতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই দরজায় টোকা। স্ত্রী-সন্তানরা ইতিমধ্যেই কান্না জুড়ে দিয়েছে। দরজা খুলতে দেরি হচ্ছে দেখে বাইরে থেকে দরজায় লাথি পরতে শুরু করল। এক পর্যায়ে দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পরল সৈন্যরা। ক্যাপ্টেন র্যাঙ্কের দলনেতা বলল, ‘তোমারা নাম ক্যায়া হ্যায়?’ আমি বললাম, ‘মেরা নাম দত্তা হ্যায়।’ সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে পাকবাহিনী আমাকে ঘিরে ধরল। ‘তুম দত্তা, তুমি ফিলিম মে কাম করতা হ্যায়?’ ‘হ্যাঁ’ সুচক জবাব দিতেই তারা আমাকে নিয়ে তাদের গাড়িতে তুলল। সঙ্গে আমার ভাই ও বাসায় আসা এক অতিথি। তিনজনকে ট্রাকের মেঝেতে বসিয়ে তাদের ক্যামেঙ্ নিয়ে গেল। বুকের মধ্যে ভয়ের দ্রিম দ্রিম শব্দ পাচ্ছিলাম। আমি নিশ্চিত আর জীবিত ফেরা হবে না। কত স্বপ্ন, কত ছবি, সেগুলো আর কখনো পূরণ হবে না।

তখন বঙ্গভবন ছিল পাকবাহিনীর ক্যামঙ্। শুনেছি ওখানে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের আর জীবিত ফেরার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ভাগ্যকে বিধাতার হাতে সঁপে দিলাম। আমাদের তিনজনকে সরাসরি বঙ্গভবন ক্যামেঙ্ নিয়ে যাওয়া হলো। ক্যামেঙ্ নিয়ে একটা রুমে ঢোকানো হলো। দেখলাম আমাদের মতো আরো অনেক হতভাগা সেখানে পড়ে আছে। তারা আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলো, বলল, ‘আপনাকেও ধরে এনেছে!’

কিছুক্ষণ পর রুমের দরজা খুলে একজন সেন্ট্রি এসে বলল, ‘সুভাষ দত্তা কৌন হ্যায়?’ বুঝলাম মরণের ডাক চলে এসেছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে এলাম। সেন্ট্রি একটা কক্ষ দেখিয়ে ভেতরে যাওয়ার নির্দেশ দিল। ভেতরে ঢুকে দেখলাম, একজন অফিসার বসে আছেন। তিনি আমাকে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ জেরা করার পর সেন্ট্রিকে ডেকে আগের রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক অন্তত এ যাত্রা বাঁচা গেল। রুমে ফিরে আসতেই সবাই বেশ অবাক। এরপর রুমে বসে টেনশনে সময় পার করতে লাগলাম।

সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সৈন্য এসে কয়েকজনকে নিয়ে গেল। বলতে গেলে জোর করে। যাওয়ার আগে তারা করুণ স্বরে সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। যারা ছিলাম, তারা মোটামুটি নিশ্চিত যেকোনো সময় আমাদেরও এভাবেই নিয়ে যাবে। সৈন্যরা যাওয়ার পরই চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেউ কোনো কথা বলতে পারছি না। সবার নিয়তিই ভাগ্যের হাতে সঁপে দিয়েছি। কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ। তারপর আবার সবকিছু চুপচাপ। সবাই বুঝতে পারছি, একটু আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হতভাগ্য লোকগুলোর ভাগ্যেই জুটেছে গুলিগুলো।

কিছুক্ষণ পর আবার বুটের আওয়াজ। সবাই ভয়ে একেবারে জড়োসড়ো। দরজা খুলে একজন সৈন্য জিজ্ঞেস করল, ‘সুভাষ দত্তা কৌন হ্যায়।’

এবার আমি নিশ্চিত, আর রক্ষে নেই। বাইরে বেরিয়ে দেখি সকালে যে ক্যাপ্টেন আমাকে বাসা থেকে ধরে এনেছিল, তিনিই বসা। তার সামনে বসতেই ক্যাপ্টেন বললেন, ‘লুক মিঃ দত্তা, ইউ আর অ্যান এক্টর। নট ওনলি অ্যান অ্যাক্টর, ইউ আর এ গুড অ্যাক্টর।’ এরপর তিনি যা বললেন তা শুনে নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ক্যাপ্টেন সাহেব আমাকে বললেন, ‘সো হ্যাম তোমকো ছোড় দিয়া’। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে বঙ্গভবনের গেট পার হতে হতে ভাবলাম, নির্ঘাত পেছন থেকে গুলি করে আমাদের মারবে।

কয়েক কদম যাওয়ার পর হঠাত্ ক্যাপ্টেন সাহেবের চিত্কার ‘হল্ট’। আমরা দাঁড়িয়ে পড়লাম। না, আর বাঁচার আশা নেই। এতক্ষণ নিশ্চয় এরা আমাদের সঙ্গে মশকরা করছিল। ক্যাপ্টেন আমাদের সামনে এসে উর্দুতে বললেন, এখন তো কার্ফ্যু শুরু হয়ে গেছে, কীভাবে যাবেন? তিনি ইশারা করতেই একটা জিপ পাশে এসে দাঁড়াল। তিনি আমাদের জিপে উঠে বসতে বললেন। আমরা নিচে বসতেই ক্যাপ্টেন সাহেব আমার হাত ধরে তার পাশের সিটে বসালেন। সেই গাড়িতে করে ওয়ারীর বাসায় আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন সাহেব বললেন, ‘আপনি শিল্পী মানুষ, দেশের সমঙ্দ এবং একজন সম্মানিত ব্যক্তি। আপনি কোনো বিপদে পড়লে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেবেন।’ সেদিন তার কথা শুনে আমি ক্যাপ্টেনের প্রতি কৃতজ্ঞতায় নুয়ে পড়েছিলাম।

এমনি করে কেটে যেতে লাগল দিন। একদিন এলাকার কিছু ছেলে খবর দিল বিহারিরা আমাকে ধরতে আসছে। ভয়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু কেউ আমাদের আশ্রয় দিতে চাইল না। ভাবখানা ‘ওরে বাবা, সুভাষ দত্তকে জায়গা দিয়ে বিপদে পড়ব’ কেউ কেউ তো মুখের ওপরই দরজা বন্ধ করে দিল। যা হোক, একজন দয়াপরবশ হয়ে তার গোয়াল ঘরে জায়গা দিল। এদিকে বিহারি ছেলেরা আমাদের গরু খোঁজা খুঁজছে। ভয়ে, ক্ষুধায় আমরা দিশেহারা। হঠাত্ করে আমার সেই ক্যাপ্টেনের কথা মনে পড়ল। একটা চিঠি লিখে একজনকে দিয়ে তার কাছে পাঠালাম। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব সৈন্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। আমার আত্মা পানি পেল। তিনি গোয়ালঘর থেকে আমাদের বের করে আবার আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিলেন আর স্থানীয় বিহারি-রাজাকারদের ডেকে বললেন, ‘সুভাষ দত্তের যদি কিছু হয় তবে কাউকে ছাড়া হবে না।’ এরপর থেকে ভয়ে আর ঘর থেকে বের হতাম না। এভাবেই ঘরে বন্দিজীবন কাটাতে লাগলাম।

এভাবেই কাটল পুরো এপ্রিল মাস। কিছুদিন পর ক্যাপ্টেন সাহেব খবর পাঠালেন, বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন তিনি, এর কিছু হলে আর ঠেকাতে পারবেন না। আমি যেন এখান থেকে সরে পড়ি। কারণ আমার নাম পাকবাহিনীর লিস্টে আছে। বাঁচতে চাইলে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়াই ভালো। এরপর ওয়ারীতে থাকা আর নিরাপদ ভাবতে পারলাম না।

মে মাসের দিকে পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিলাম। প্রথমেই আমি করলাম কি আমার সাধের মোচটা ছেটে ফেললাম। একটা ছেড়া জামা পড়লাম। যাওয়াটা খুব সহজ ছিল না। ঢাকা থেকে অনেক কষ্টে দাউদকান্দিতে পৌঁছালাম। কিছুই চিনি না। অনেকেই সন্দেহের চোখে আমাকে দেখতে লাগল। যা হোক, কীভাবে ভারত পৌঁছাব কিছুই জানি না। অসহায় বোধ করতে লাগলাম। এর মধ্যেই খবর পেলাম পাকবাহিনী টহল দিচ্ছে। আতঙ্কে জমে যাওয়ার অবস্থা। হঠাত্ করে চেয়ে দেখি একটি ছেলে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার তাকানো দেখে ভয় ধরে গেল। ছেলেটি কাছে এসে বলল, ‘আপনাকে কিন্তু আমি চিনি। আপনি সুভাষ দত্ত না?’

কয় কী ভিন গাঁয়ে আবার এ কোন বিপদে পড়লাম! তাকে বললাম, ‘না, আমি সুভাষ দত্ত না।’ ছেলেটি আমাকে অভয় দিয়ে বলল, ‘এখন তো আপনি বর্ডার পার হতে পারবেন না। পাকসেনারা নদীতে পাহারা দিচ্ছে।

আপনি আমার সঙ্গে বাসায় চলেন, সকাল বেলা আমি আপনাকে বর্ডার পার করে দিব।’ ছেলেটি আরো জানাল, তার বাবা নাকি আমার খুব ভক্ত। আমাকে পেলে খুব খুশি হবে।

কী করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দ্বিধায় আছি, ছেলেটির সঙ্গে যাব কি না। আশপাশে পরিচিত কেউ নেই যার বাসায় উঠব। আবার চিন্তাও করছি, ছেলেটি যদি রাজাকার বা ইনফর্মার হয়! আমাকে যদি পাকিস্তানিদের হাতে ধরিয়ে দেয়! এদিকে আবার রাতও হয়ে আসছে। যা হোক, অনেক ভেবেচিন্তে ছেলেটার সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে একসময় তার বাসায় উপস্থিত হলাম। ছেলেটির বাবা তখন উঠানে বসে কাজ করছিলেন। ছেলের সঙ্গে শহুরে একজনকে ঢুকতে দেখে তিনি কিছুটা চমকে গেলেন। ছেলেটি তার বাবার সামনে গিয়ে বলল, ‘বাবা দেখ, কাকে ধরে এনেছি।’ মুহূর্তে লোকটি আমাকে চিনে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কথা বলে বুঝলাম, তিনি আমার অসম্ভব ভক্ত। যাক, রাতে তার বাসায় থেকে গেলাম। ভোরে আমরা বের হয়ে একটা নৌকা ভাড়া করে আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিলাম।

নানা বাধা পেরিয়ে আগরতলায় ঢুকলাম। আগরতলায় হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী। হাতে খুব টাকা-পয়সা নেই।

যে ছেলেটা আমাকে আগরতলায় পৌঁছে দিয়েছে, সে এবার আমার কাছে চলে যাওয়ার অনুমতি চাইল। আমি বললাম, ‘ভাই, তুমি তো আমার অনেক উপকার করলে, এবার একটা শেষ উপকার করো।’ তাকে একটা চিঠি দিয়ে বললাম, ‘এখানে ঠিকানা লেখা আছে, তুমি কষ্ট করে ঢাকায় এই ঠিকানায় গিয়ে আমার পরিবারকে বলবে, আমি নিরাপদে আছি।’ ছেলেটি চিঠি ও ঠিকানা নিয়ে চলে গেল।

এর ঠিক দুদিন পর একজন এসে বলল, ‘বউদিকে দেখলাম পাশের হেটেলে।’ তাকে বললাম, ‘ভাই, এই বিপদের দিনে এইসব ঠাট্টা মশকারা ভালো লাগে না।’ তারপরও যখন দেখলাম সে সিরিয়াস তখন ওই হোটেলের দিকে ছুটলাম। সেখানে দাউদকান্দির সেই ছেলেটির সঙ্গে দেখা। তাকে দেখে তো আমি অবাক, ‘তুমি যাওনি?’ সে মুচকি হেসে বলল, ‘আপনাকেই খুঁজছিলাম। আপনার স্ত্রী-সন্তান আপনার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে।’ সে আমাকে নিয়ে কিছু দূর যেতেই সবাইকে দেখতে পেলাম। তাদের দেখে তো আমি ভীষণ অবাক! পরে শুনলাম, ছেলেটি আমার ঠিকানা অনুসারে বাসায় গিয়ে সবাইকে আগরতলা নিয়ে এসেছে। মাত্র দু দিনে এই অসম্ভব কাজটি করেছে সে। যদিও আমি শুধু খবর দিতে বলেছিলাম, কিন্তু ছেলেটি নিজ উদ্যোগে তাদের এখানে নিয়ে আসে। সত্যিই, সেই ছেলেটি আমাকে আজীবন কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ করে ফেলল।

তারপরের কাহিনী ভিন্ন। সময়ের স্রোতে কলকাতায় নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে এক হয়ে গেল অস্তিত্বের সংগ্রাম। সে গল্পু না হয় অন্য একদিন বলা যাবে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত