বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশে শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন এ দেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক এবং সাধারণ জনতা। তাদের সঙ্গে যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ইপিআরে কর্মরত বাঙালি সেনা এবং পুলিশ-আনসার-মুজাহিদরা। পরে পর্যায়ক্রমে যোগ দেন পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাঙালি সদস্যরাসহ অন্যান্য নানা পেশার মানুষ। সবার সম্মিলনে এটা ছিল সত্যিকারের এক জনযুদ্ধ।

পাকিস্তান বিমানবাহিনী, পিআইএ এবং পূর্ব পাকিস্তান উদ্ভিদ সংরক্ষণ বিভাগে কর্মরত বাঙালি বৈমানিকসহ বিমান প্রকৌশলী, এয়ারম্যান ও টেকনিশিয়ান যে যেভাবে পেরেছেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তারা মুক্তিযুদ্ধকে নানাভাবে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন।

জুলাই-আগস্ট মাসের দিকে মুক্তিযুদ্ধ সুসংগঠিত রূপ পায়। এ সময় বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজস্ব একটা বিমানবাহিনী গঠনে সক্রিয় হয়। এর ধারাবাহিকতায় কিছুদিন পর ভারত সরকার তিনটি বেসামরিক বিমান মুক্তিবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে। তিনটি বিমানের একটি ছিল ডিসি-৩ বা ডাকোটা, একটি অটার এবং অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টার। এগুলো সামরিক বিমানে রূপান্তর করা হয়।

ডাকোটা বিমানকে পাঁচ হাজার পাউন্ড বোমা বহনক্ষম করা হয়। বোমাগুলো রাখার ব্যবস্থা করা হয় বিমানটির পেটবরাবর। ক্ষুদ্রকায় অটার বিমানটির দুই ডানায় সাতটি করে রকেট লঞ্চার সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া ছিল মেশিনগান ও ২৫ পাউন্ড ওজনের ১০টি বোমা বহনের উপযোগী একটি মঞ্চ। বোমাগুলো নিক্ষেপের জন্য একজন ক্রুর সহায়তার প্রয়োজন হতো। অ্যালুয়েট-৩ হেলিকপ্টারটিতে সংযুক্ত করা হয়েছিল একটি ৩০৩ ব্রাউনিং মেশিনগান এবং দুটি রকেট নিক্ষেপক। সাতটি করে মোট ১৪টি রকেট এটা থেকে নিক্ষেপ করা যেত। শত্রুর গুলি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এর পেটবরাবর পাটাতনে প্রায় এক ইঞ্চি পুরু (২৫ মিলি) লোহার পাত লাগানো হয়েছিল।

মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনী বাস্তব রূপলাভ করে ২৮ সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বিমানবাহিনীকে কিলোফ্লাইট নামে অভিহিত করার। নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর তিনটি ব্রিগেডের মতো এ কে খন্দকারের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে এই নামকরণ করা হয়।

ভারতের নাগাল্যান্ড প্রদেশের (বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট জেলার নিকটবর্তী) ডিমাপুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি প্রশিক্ষণস্থল হিসেবে নির্বাচন করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে বৈমানিকদের প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে ডিমাপুরে নেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন আকরাম আহমদ (বীর উত্তম), ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন আহমদ (বীর উত্তম) সবার আগে পৌঁছান। এরপর একে একে সেখানে স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ (বীর উত্তম, পরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান ও এয়ার ভাইস মার্শাল) এবং আমিসহ অন্যরা যোগ দিই। ডিমাপুর বিমানঘাঁটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না। তবে কাজ চালানোর মতো অবস্থায় আনতে খুব একটা সময়ও লাগেনি।

ঘন বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ পাহাড়ি এ অঞ্চল ছিল অত্যন্ত দুর্গম। আমাদের প্রশিক্ষণ লোকচক্ষুর অন্তরালে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হতে এটা সহায়ক হয়। এখানকার বন এতই ঘন ছিল যে প্যারাস্যুটের সাহায্যে বিমান থেকে কোনো বৈমানিক লাফিয়ে পড়লেও তার পক্ষে মাটিতে পড়া ছিল অসম্ভব, তাকে গাছের ডালেই ঝুলে থাকতে হতো।

প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্য বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বৈমানিকদের সেখানে জড়ো করা হতে থাকে। অনেকে বিভিন্ন রণাঙ্গনে স্থলযুদ্ধে জড়িত ছিলেন। বাস্তব কারণে ও সময়স্বল্পতার কারণে সবাইকে ডিমাপুরে সমবেত করা সম্ভব হয়নি। সুলতান মাহমুদকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার। তিনিই প্রশিক্ষণের মূল সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। কয়েকবার মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এ কে খন্দকারও (বীর উত্তম, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান ও এয়ার ভাইস মার্শাল) কলকাতা থেকে এসে প্রশিক্ষণ দেন।

তিন ধরনের তিনটি উড়োজাহাজ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নয়জন বৈমানিককে তিন ভাগে বিভক্ত করে শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রত্যেক দলে তিনজন। ডিসি-৩ বা ডাকোটার জন্য নির্বাচন করা হয় ক্যাপ্টেন আবদুল খালেক (বীর প্রতীক), ক্যাপ্টেন কাজী আবদুস সাত্তার (বীর প্রতীক, আলমগীর সাত্তার নামে পরিচিত) ও ক্যাপ্টেন আবদুল মুকিতকে (বীর প্রতীক)। অটার বিমানের জন্য নির্বাচিত হন আকরাম আহমেদ, শরফুদ্দিন আহমেদ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসুল আলম (বীর উত্তম)। আর হেলিকপ্টারের জন্য মনোনীত তিনজন সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট অফিসার বদরুল আলম (বীর উত্তম) ও আমি। প্রথমে আমাকে ডাকোটা বিমানের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। ১০-১২ দিন পর আমাকে হেলিকপ্টারে স্থানান্তর করা হয়। লোকবলের স্বল্পতার কারণেই এই পরিবর্তন। সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম হেলিকপ্টারের চালক হিসেবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন। কাজেই তাঁদের আর হেলিকপ্টার উড্ডয়নের জন্য নতুন করে তেমন কিছু শেখার ছিল না। কিন্তু আমার জন্য বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ নতুন। এ জন্য আমাকে অবশ্য খুব বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি, কারণ হেলিকপ্টারের চেয়ে অনেক বেশি কষ্টকর ও দুরূহ বিমান চালনা।

প্রশিক্ষণশেষে সবাই অপেক্ষা করতে থাকি অভিযানে যাওয়ার প্রত্যাশায়। কে কোন অভিযান পরিচালনা করবেন, সেটাও স্থির করা হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় অটার বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির তেলের ডিপো, হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তেলের ডিপো আর ডাকোটার সাহায্যে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে আক্রমণ পরিচালনার। পরে অবশ্য ডাকোটার সাহায্যে আক্রমণ পরিচালনা বাতিল করা হয়। এ জন্য আবদুল মুকিত ও আবদুস সাত্তার অত্যন্ত হতাশ হন।

প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ৩ নভেম্বর আক্রমণ করার। পরে তা পিছিয়ে ২৮ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়। অবশ্য ভারত সরকারের সবুজ সংকেত না পাওয়ায় ২৮ নভেম্বরের আক্রমণ পরিকল্পনা শেষ মুহূর্তে স্থগিত করা হয়। পাঁচ দিন পিছিয়ে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৩ ডিসেম্বর। ঘটনাক্রমে তারিখটি আবার ভারত-পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুরও দিন হয়ে যায়।

২ ডিসেম্বর মধ্যরাতে (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ৩ ডিসেম্বর) মুক্তিবাহিনীর বৈমানিক মুক্তিযোদ্ধারা বিমানের সাহায্যে প্রথম পাকিস্তানিদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আক্রমণ শুরু করেন। এ তারিখটা তাই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটা দিন। অটারের সাহায্যে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপো ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে ESSO বার্মার তেলের ডিপোতে আক্রমণ পরিচালিত হয়। দুটি অভিযানই ছিল শতভাগ সফল।

অটার বিমানের সাহায্যে চট্টগ্রামের আক্রমণ পরিচালনা করেন শামসুল আলম ও আকরাম আহমেদ। আক্রমণ করার পর পাকিস্তানিদের তরফ থেকে পাল্টা আক্রমণ না আসায় তাঁরা আরও তিনবার আক্রমণ করে অটারে থাকা সব রকেট নিঃশেষ করেন। নির্বিঘ্নেই তাঁরা ঘাঁটিতে ফিরে আসতে সক্ষম হন। হেলিকপ্টারের সাহায্যে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলের তৈলাধারে আক্রমণ করেছিলেন সুলতান মাহমুদ ও বদরুল আলম। তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন ভারতের তেলিয়ামুরা থেকে। প্রথম আক্রমণে আমি ছিলাম না।

আমার আক্রমণ পরিচালনার সুযোগ হয় ৬ ডিসেম্বর। এদিন হেলিকপ্টারের সাহায্যে বদরুল আলম ও আমি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে চারটি অভিযান পরিচালনা করি। আক্রমণ চারটি করা হয় সিলেট, মৌলভীবাজার ও কুশিয়ারা নদীর লক্ষ্যবস্তুতে। শেরপুর ও সাদিপুরের দুটি ফেরি ছিল কুশিয়ারা নদীর লক্ষ্যবস্তু।

৮ ডিসেম্বর হেলিকপ্টারের সাহায্যে আমরা সিলেট সার্কিট হাউসসহ বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ পরিচালনা করি। আমাদের আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। আমাদের এ আক্রমণের প্রসঙ্গ আছে পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে। তিনি লিখেছেন: ‘সম্ভবত পর্যবেক্ষণের জন্য হেলিকপ্টার দুটি সার্কিট হাউস ও কিন সেতুর ওপর দিয়ে উড়ে যায়। হঠাত্ করেই একটি হেলিকপ্টার থেকে সার্কিট হাউস চত্বরে একটি বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বোমাটি সার্কিট হাউসের আঙিনায় বিস্ফোরিত হলে চারজন আহত হয়। এদের মধ্যে একজন গোয়েন্দা বিভাগের কেরানি। অপর তিনজন পুলিশ। আমাদের সেনারা আহতদের সাহায্যে এগিয়ে আসামাত্র হেলিকপ্টার থেকে গুলিবৃষ্টি শুরু করা হয়। ফলে কয়েকজন সেনা হতাহত হয়।’

এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যন্ত হেলিকপ্টারের সাহায্যে আরও কয়েকটি আক্রমণ পরিচালত হয়। হেলিকপ্টারের সাহায্যে ২০-২১টি আক্রমণ পরিচালিত হয়। মিত্রবাহিনীকেও কখনো কখনো আমাদের সাহায্য করতে হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভৈরব সেতুটি ধ্বংস করে দিলে মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযান নদীর ওপারে থমকে যায়। তখন তারা ছত্রীসেনা অবতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। নরসিংদীতে ছত্রীসেনা অবতরণের সময় পাকিস্তানি আক্রমণে মিত্রবাহিনীর বিধ্বস্ত বিমানের এক বৈমানিক ‘বেল আউট’ করতে বাধ্য হন। ওই বৈমানিককে উদ্ধারের জন্য আমাদের সাহায্য কামনা করা হলে তত্ক্ষণাত্ আমরা এগিয়ে যাই। দুর্ভাগ্যবশত ওই বৈমানিককে আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। আমরা অকুস্থলে যাওয়ার আগেই ওই বৈমানিককে পাকিস্তানিরা আটক এবং হত্যা করে।

সিলেট শত্রুমুক্ত হয়েছে কি না সেটা জানতে পারছিলেন না আমাদের স্থল মুক্তিযোদ্ধারা। সিদ্ধান্ত হয় যে সুলতান মাহমুদ ও আমি হেলিকপ্টারে করে সিলেট গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতিটা দেখে আসব। হেলিকপ্টার নিয়ে সিলেটের আকাশে যাওয়ার পর কোনো প্রকার গোলাগুলি ধেয়ে না আসায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই সিলেট বিমানবন্দরে অবতরণ করার। অবতরণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত পাকিস্তানিরা বুঝতে পারেনি যে হেলিকপ্টারটি মুক্তিবাহিনীর। ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু করে দেয় গুলি। পাকিস্তানিরা চিন্তাই করতে পারেনি যে শত্রুপক্ষের কোনো হেলিকপ্টার এভাবে তাদের নাকের ডগায় এসে নামতে পারে। সুলতান মাহমুদ ও আমি ইঞ্জিন যে মুহূর্তে বন্ধ করতে যাচ্ছি ঠিক তখনই পাকিস্তানিরা হেলিকপ্টারটি লক্ষ্য করে গুলি শুরু করে। হেলিকপ্টারটিতে প্রায় ১৫টির মতো গুলি লেগেছিল। এমনকি এর রোটার ব্লেডেও গুলির আঘাত লাগে। আমরা দ্রুত হেলিকপ্টারটি উড়িয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে সক্ষম হই। আমাদের দুজনের কারও কোনো ক্ষতি হয়নি।

ক্যাপ্টেন সাহাবউদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম: অ্যালুয়েট হেলিকপ্টারের বিমানযোদ্ধা

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত