১৪ ডিসেম্বরে আর কোনো কিছুর জন্যই অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না কারও। এমনকি মৃত্যুর জন্যও না। মৃত্যুর করাল ছায়ার তলে নিপতিত ঢাকায় মৃত্যুভয়ও যেন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছিল। সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছিল বিজয়ের উত্তেজনা আর স্বাধীন দিনের সূর্য দেখার সাধ। যশোর তখন মুক্ত হয়ে গেছে। ঢাকার কাছাকাছি চলে এসেছে মুক্তিফৌজ আর মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সেনারা। আকাশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভারতীয় যুদ্ধবিমান। ঢাকার চারদিকের নদীর ওপারে বাংলাদেশ ও ভারতে মিত্রবাহিনী চূড়ান্ত আঘাতের জন্য প্রস্ত্তত। শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে গেরিলাদের বিভিন্ন ইউনিট। এ রকম সময়ে জীবনের আশা, স্বাধীনতা আস্বাদনের স্বপ্ন ছাড়া আর কী ভাবতে পারে অবরুদ্ধ নগরের মানুষ?
সামরিক ব্যর্থতা থেকে পাকিস্তানিরা তখন রাজনৈতিক পথে শেষ চেষ্টার জন্য দুই দিন বেশি সময় নিয়েছিল। অথচ এই রাজনৈতিক সমাধানকেই তারা ২৫ মার্চ রাতেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। এই অতিরিক্ত সময়টাতেই, স্বাধীনতার একদম কিনারে দাঁড়ানো অনেক মানুষ বর্বরভাবে নিহত হয়। নিয়াজি আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয় ১৪ ডিসেম্বর। তাদের যোগাযোগব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের বার্তা ভারতীয়দের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্রেরও যুদ্ধ। তাই যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ইসলামাবাদ, দিল্লি ঘুরে ওয়াশিংটন ঘুরে দিল্লি পৌঁছায় দুই দিন পর। এই সময়টাই তারা ব্যবহার করে গণহত্যার লক্ষ্য চূড়ান্ত করতে, শেষ আঘাত হানতে। হত্যাযজ্ঞ দিয়ে শুরু বাংলাদেশের যুদ্ধ হত্যাকাণ্ড দিয়েই শেষ হয়। বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান মিশে যায় মুক্তিযুদ্ধের সকল মৃত্যুতে।
নিশ্চিত পরাজয় ও ধ্বংস জেনেও যে রকম শীতল নৃশংসতায় বেছে বেছে শিক্ষক-সাংবাদিক-শিল্পী-লেখক ও পেশাজীবী ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছিল, তাতে বোঝা যায় সেটা ছিল তাদের অসমাপ্ত পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার বেপরোয়া চেষ্টা। এবং তারা সফল হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলা র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের মে মাসে কিছু সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর কাছে দখলদার সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ফর্ম পাঠানো হয়। এ থেকেই বোঝা যায়, তারা তখন হত্যার লক্ষ্য ঠিক করছিল। যারা স্বাধীনতার আন্দোলনে জনগণের আবেগ ও আদর্শকে ছুঁতে পেরেছিলেন, এই উপমহাদেশের ইতিহাসের এক মহাকাব্যিক জাতীয় সংগ্রামে যারা ছিলেন ফলার মতো, সেইসব ব্যক্তিদের তারা নিশানা করেছিল।
সংস্কৃতির তেজষ্ক্রিয়তা তারা প্রথম টের পায় ভাষা আন্দোলনের সময়। আইয়ুব খানের স্বৈরশাহী প্রথমে বৃত্তি, পদ, সম্মান ও অর্থ দিয়ে বুদ্ধিজীবীদের দাহিকাশক্তি নষ্ট করার চেষ্টা করে। যারা টলার তারা টলে। ওদিকে নতুন বাংলা সাহিত্য, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ, ইতিহাস রচনা দিয়ে নির্মিত হতে থাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভাবাদর্শ। গল্প-উপন্যাস-নাটক-গান-কবিতায় প্রতিরোধের সংস্কৃতি দানা বাঁধতে থাকে। কামরুদ্দীন আহমদের পূর্ব বাঙলার সমাজ-অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং বদরুদ্দীন উমরের সাম্প্রদায়িকতা গ্রন্থ নিষিদ্ধ হয়। আইয়ুবের অনুচর গভর্নর মোনায়েম খানের রোষের শিকার হয়ে বদরুদ্দীন উমরকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাও ছাড়তে হয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে।
ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শক্তি বুঝে ফেলে বাঙালিদের প্রতিরোধের প্রাণভোমরা লুকিয়ে আছে তাদের সংস্কৃতির ভেতরেই। সেই সংস্কৃতিকে ভেতর থেকে নিস্তেজ করতে একবার উর্দু হরফে বাংলা ভাষা, একবার পাক তমুদ্দুন, একবার ইসলামি সমাজতন্ত্রের জিকিরসহ বহু বিচিত্র ছলনা-জাল পাতা হয়। কাজ হয় না। গণআন্দোলনের উত্তাল ঢেউয়ের শীর্ষে চড়ে চলে আসে রক্তক্ষরা একাত্তরের মার্চ মাস।
একাত্তরের নয় মাসজুড়ে একটি মুহূর্তের জন্যও তারা বুদ্ধিজীবীদের প্রতি হত্যার নিশানা সরায়নি। ফেউ যেমন বাঘকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে, তেমনি বিশ্বাসঘাতক মিলিশিয়া আলবদর-আলশামস একটানা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যায়। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধের অন্ধ বিকার চরিতার্থ করাও তাদের উদ্দেশ্য ছিল। যাদের চেতনার ঔরসে স্বাধীনতা, সেই স্বাধীনতাকে তারা শাস্তি দিয়েছিল তার স্বপ্নদ্রষ্টাদের হত্যা করে।
বধ্যভূমিময় বাংলাদেশের মাটিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অস্থি-মজ্জা-হাড় তিরিশ লাখ শহীদের দেহাবশেষের সঙ্গে মিশে আছে। এই দেশের আকাশ তাদেরই শেষ নিঃশ্বাসের বেদনায় নীল। এই বাংলার উদিত সূর্যে তাদেরই রক্তের লালিমা। নদীতে নদীতে তাদেরই অশ্রুর সারাৎসার। এই বাংলাদেশ চিরকাল সেই ঘাতকদের অভিশাপ দেবে। এখনো ঘাতকদের বিচার হয়নি। এখনো রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জাগ্রত ১৯৭১। চিহ্নিত-অচিহ্নিত বধ্যভূমির মাটিতে, ভুলে যাওয়া বন্দিশালার দেয়ালে, স্বজনহারাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনো একাত্তরের সকল মৃত্যু দুঃখের প্রদীপ হয়ে জ্বলে। সেই ব্যথার পূজা এখনো যে হয়নি সমাপন!
১৮ মার্চ ২০১১, ঢাকা
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত