ইয়াহিয়া ও তার বর্বর সামরিক চক্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা, স্বাধিকারবোধ ও মানবিক মর্যাদার পবিত্র অনুভবকে ট্যাংকের চাকায় পিষে ফেলতে চাইছে। প্রকৃতির আশীর্বাদ, কবিব স্বপ্ন নদী-মেঘলা-শোভিতা এই শ্যামল ভূখণ্ড ও তার সাড়ে সাত কোটি মানব সন্তানকে আধুনিকতম মারণাস্ত্রের সাহায্যে একদল নরপিশাচ ঝলসে মারতে চায়।
নাপাম বোমার আগুনে তারা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রাচীন নিদর্শনগুলি, বহু স্মৃতি ঘেরা জনবসতি অঞ্চল, এমনকি গায়ের সবুজ মাটিকে পর্যন্ত পুড়িয়ে দিচ্ছে। গোটা জাতির স্বপ্ন, শ্রম আর সম্পদে নির্মিত সেতু, বাঁধ ও প্রকল্পগুলিকে তারা বেছে বেছে ধ্বংস করছে। সারস্বত সাধনার পীঠস্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এই জঙ্গীচক্র কামান দেগে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বিখ্যাত কবি মাইকেল কলেজ এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মূল্যবান গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার ঘাতকরা ধ্বংস করেছে। সংবাদপত্রের কার্যালয়কে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে। বোমা ফেলে মর্টার ছুড়ে হাসপাতাল ভবনে জ্বেলেছে নরকের ভয়াবহ আগুন। মন্দির-মসজিদ-চার্চের পবিত্রতাটুকুও ঐ যুদ্ধোন্মদ রাক্ষসদের নখ এবং দাঁতের কামড় থেকে রক্ষা পায়নি।
হত্যা ও রক্তের নেশায় জঙ্গী ইয়াহিয়া চক্র উন্মাদ হয়ে গেছে। খবর এসেছে কয়েক লক্ষ লোক মারা গিয়েছে—নিজের দেশে মানুষের অধিকারে মায়ের ভাষায়, কথা বলে যারা শান্তিতে বাঁচতে চেয়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের শিকার, কামানের খোরাক, কয়েক লক্ষ অমৃতের সন্তান পচা গলা শবদেহ হয়ে শহরে বন্দরে গ্রামে শকুনির খাদ্য হচ্ছে। তারে কবর দেবার, দাহ করবার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। ইয়াহিয়ার উদ্যত সংগীন কয়েক লক্ষ শবদেহকে নিয়ত পাহারা দিচ্ছে, দেশবাসী যাতে শহীদদের প্রাপ্ত মর্যাদাটুকু দিতে না পারে।
নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ কে মরেনি? শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, চাকুরে, ব্যবসায়ী—কে মরেনি? শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অধ্যাপক—কে মরেনি?
দানবরা মায়ের দুই স্তন কর্তন করে রক্তের উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার মধ্যে অবোধ শিশুর মুখ চেপে ধরেছে। আড়াই বত্সরের বাচ্চাকে কামানের সামনে দাঁড় করিয়ে গোলা ছুঁড়েছে। ইজ্জত লুঠ করে তারপর বাংলাদেশের মা ও বোনদের সংগীন দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান আচার্যদের সারিবন্দি দাঁড় করিয়ে গুলি ছুঁড়েছে। হাসপাতালের প্রত্যেকটি রোগিকে গুণে গুণে খুন করেছে।
কিন্তু নতুন মর্যাদাবোধে উদ্বুদ্ধ সত্য ও সুন্দরের উপাসক বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয় প্রতিরোধে রুখে দাঁড়িয়েছে। বীর রোশেনারা বেগম বুকে মাইন বেঁধে জল্লাদের ট্যাংকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের কিশোরী দেহের সঙ্গে একটা আস্তা প্যাটন ট্যাংককেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা ফৌজীদের হাতে থেকে একের পর এক ঘাঁটি কেড়ে নিচ্ছে। গোটা বাংলাদেশ আজ একটিই অস্তিত্ব হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করছে। বাংলাদেশ জিতছে।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী আমরা, রবীন্দ্রনাথের উত্তর পুরুষ আমরা, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে নীরব বা নিস্ক্রিয় থাকতে পারি না। আমরা ভুলিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ এবং ভারতবর্ষের ভূমিকা। আমরা আমাদের মহান ঐতিহ্যকে কিছুতেই ভুলতে পারি না।
তাই আমরা ‘বাংলাদেশ-সহায়ক শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমিতি’ গঠন করেছি।
আমাদের নিজ নিজ ক্ষেত্র ও নিজ নিজ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা এক ভাবগত আন্দোলন গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর গণতান্ত্রিক চেতনা ও মানবিক শুভবুদ্ধি বাংলাদেশের নবজাত সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সর্ববিধ সাহায্য নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য এক ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু করুক।
সেই সঙ্গে আমরা বিপন্ন মানবতার পক্ষে বাস্তব ও প্রত্যক্ষ সাহায্যও সংগ্রহ করতে চাই। সীমান্তের ওপারে এই মুহূর্তে দরকার ওষুধ, চিকিত্সার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, গুঁড়ো দুধ ও বিস্কুট জাতীয় শুকনো খাদ্য। আর তা কেনার জন্য দরকার টাকা পয়সা।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। রাজপথ, বস্তি, কুটির অথবা অট্টালিকা—যেখানেই আপনি বাস করুন, অবিলম্বে আপনার যতখানি সামর্থ্য তার থেকেও বেশি সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসুন।...
আমাদের মনুষ্যত্ব জাগ্রত হোক। আমাদের বিবেক শুভবুদ্ধির আহ্বানে সাড়া দিক। যেন ভুলে না যাই ইতিহাসের অগ্নি-পরীক্ষায় আমাদেরও উত্তীর্ণ হতে হবে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র, দ্বাদশ খণ্ড
সুত্র: ২৬ মার্চ ২০১৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত