লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ১৯৬৯ সালের মে থেকে ১৯৭২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইউপিএল থেকে প্রকাশিত তাঁর সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা গ্রন্থ থেকে নির্বাচিত অংশের অনুবাদ এখানে ছাপা হলো।
...১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল প্রায় পাঁচটা ৪০ মিনিটে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতের পশ্চিম সীমান্তে আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ শুরু করে। একসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিমানঘাঁটির ওপর হামলা চালানো হয়, কিন্তু আমার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল সামান্যই। আমি আজও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি, তাদের এই আক্রমণের পদ্ধতি ও সময়-নির্ধারণের পেছনে কী যুক্তি ছিল।...
৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ছয়টায় আমি অফিসেই ছিলাম। এর মধ্যে জেনারেল মানেকশর একটি টেলিফোন পাই। তিনি আমাকে বললেন, ‘পাকিস্তানি বিমান থেকে পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের বিমানঘাঁটিগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে; কলকাতার রাজভবনে অবস্থানরত প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে আমি যেন এই সংবাদ জানাই।’ আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা আমাদের সেনা পরিচালনা করব কি না। তিনি আমাকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি (মানেকশ) আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে এটাও জানাতে হবে। এ ব্যাপারে শিগগিরই তিনি দাপ্তরিক আদেশ ইস্যু করবেন বলে আমাকে জানান।
দুই কামরার মাঝখানের স্যুইং ডোর ঠেলে আমি জেনারেল অরোরার কামরায় ঢুকে তাঁকে এই আলোচনার কথা জানালাম।...অরোরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন।
..স্টাফদের একসঙ্গে পেতে কোনো সমস্যা হয়নি..। অ্যাডভান্সড এয়ার হেডকোয়ার্টার্সে জানানো হলো, আমি বিমানবাহিনীর সহযোগিতা সমন্বয় করার জন্য জেএএওসিতে আসছি। স্টাফ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় অর্ডার ইস্যু করে। সব কোর কমান্ডারকে আমি ফোনে ব্রিফ করি। জেএএওসিতে বিমান বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং বিমান অভিযানের জন্য বাহিনীতে সেনা বরাদ্দ করা হয়। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি বিমানঘাঁটিগুলোর রানওয়ে। রাত সাড়ে আটটার দিকে আক্রমণ শুরুর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্ত্ততি ও সমন্বয় শেষ হয়। অরোরা ঠিক তখনই প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিফ করে ফিরেছেন। গৃহীত প্রস্ত্ততির কথা আমি তাঁকে জানালে সবার মধ্যে স্বস্তি নেমে আসে। সেনারা অধীর আগ্রহে আক্রমণ শুরুর নির্দেশের অপেক্ষায় ছিল। ... অরোরা ছিলেন খুবই উৎফুল্ল। তিনি তাঁর এডিসিকে মেস থেকে এক বোতল হুইস্কি আনতে বললেন।..
আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিচ্ছি, এমন সময় নিউইয়র্ক টাইমস- এর প্রতিবেদক সিডনি শ্যানবার্গের ফোন এল। শ্যানবার্গ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পশ্চিমাঞ্চলে পাকিস্তানি আক্রমণের জবাবে আমরা কী করতে যাচ্ছি। আমি তাঁকে হালকা সুরে জানালাম, আমরা খানাপিনায় ব্যস্ত আছি। তিনি জানতে চাইলেন, আমরা শঙ্কিত কি না। আমি উত্তরে তাঁকে বললাম, আমাদের পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনী শিগগিরই বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেলবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।...তার আগে ৩ ডিসেম্বর সকালে আমাদের ইস্টার্ন ন্যাভাল কম্যান্ডের ফ্ল্যাগ অফিসার কম্যান্ডিং ইন চিফ অ্যাডমিরাল কৃষ্ণণ টেলিফানে আমাকে জানান, একজন মৎস্যজীবী বিশাখাপত্তম বন্দরের প্রবেশমুখে পাকিস্তানি সাবমেরিনের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেয়েছে। বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সময় পাকিস্তানি সাবমেরিন ‘গাজি’র ইনটারসেপ্ট করা সংকেত আমাদের কাছে ছিল। এই তথ্য আমরা আগেই ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। কৃষ্ণণ বললেন, মাইন পাততে গিয়ে ১ বা ২ ডিসেম্বর ‘গাজি’র ধ্বংস হওয়া দৈব ঘটনা ছাড়া কিছু নয়। এই ঘটনার ফলে আমাদের নৌবাহিনীও আক্রমণ শুরুর আরও বেশি স্বাধীনতা পেয়ে গেল।
পরবর্তী সময়ে নৌবাহিনীর আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে বলা হয়, ৪ ডিসেম্বর ইস্টার্ন ফ্লিটের জাহাজগুলো সাবমেরিন ‘গাজি’ ডুবিয়ে দিয়েছে।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত