এই লেখাটির নাম অন্য কিছুও হতে পারত, ‘রাষ্ট্রের খবর পাই, সমাজের খোঁজ কী’ দিলে অসঙ্গত হতো না; কেননা এ লেখা ঠিক শহীদ সাবেরকে নিয়ে নয়, রাষ্ট্র ও সমাজকে নিয়েই। কিন্তু এটি লিখতে গিয়ে শহীদ সাবেরকে বারবার মনে পড়ছে, একাধিক কারণে। একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তিনি একজন। তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ও ছিল, একসময়ে থাকতাম আমরা একই পাড়াতে, যখন বয়স আমাদের অল্প ছিল। তৃতীয়ত, তার কথা নতুন করে স্মরণে এসেছে আমার চট্টগ্রাম থেকে ১৯৪৭-৫২-তে প্রকাশিত পত্রিকা সীমান্তর একটি সংগ্রহ পড়তে গিয়ে। যে-পত্রিকা সম্পর্কে একটু পরে কিছুটা বিস্তারিতভাবে বলতে হবে। সবচেয়ে বড় কারণ অবশ্য এটা যে, শহীদ সাবেরকে কেবল একজন ব্যক্তি মনে হয় না আমার, যেন তিনি প্রতীকও। প্রতীক তিনি প্রতিশ্রুতির ও অঙ্গীকারের, এবং পথানুসন্ধানের।
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন সেই কিশোর বয়সে, পাকিস্তানি কারাগারে বিনা বিচারে আটক ছিলেন একটানা চার বছর। তখন তিনি কলেজের ছাত্র। জেল থেকে বের হয়ে এসে বিএ পাস করেন, চাকরি নিয়েছিলেন শিক্ষকতার। পরে যোগ দিয়েছেন সাংবাদিকতায়।
রাষ্ট্র তাকে ভীষণভাবে পীড়ন করেছে, সমাজ তাকে রেখেছে প্রচণ্ড চাপের মুখে। মেধাবান ও সংবেদনশীল মানুষটি স্থির থাকতে পারেননি। প্রধান সত্য ছিল এটা যে, তিনি একজন লেখক। সেই কিশোর বয়সে, আইএ ক্লাসের ছাত্র শহীদ সাবের গোপনে এবং নাম প্রচ্ছন্ন রেখে একটি লেখা পাঠিয়েছিলেন কলকাতার নতুন সাহিত্য পত্রিকাতে; ওই পত্রিকা তখন সাহিত্যানুরাগী মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ‘আরেক দুনিয়া থেকে’ নামের লেখাটি প্রকাশের পর সাড়া পড়ে গিয়েছিল, কৌতূহল ও বিস্ময় জেগেছিল লেখকের বিষয়ে। তারপর তিনি যখনই সুযোগ পেয়েছেন লিখেছেন—গল্প, কবিতা, অনুবাদ, ছোটদের জন্য লেখাসহ নানা ধরনের কাজ আছে তার। বই রেখে গেছেন। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী তাকে মরণোত্তর একাডেমী পুরস্কার দিয়েছে, ছোটগল্পের জন্য। একাডেমীর জন্য সেটা একটা ভালো কাজ। কিন্তু জীবনকালে তিনি স্থির থাকতে পারেননি, ধারাবাহিকভাবে কাজ করা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে, কেননা একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন ছিল তার পরিবেশ। তার পেশা হতে পারত সাংবাদিকতা, সে পেশাতে তিনি যোগও দিয়েছিলেন, কিন্তু সাংবাদিকতা তখনো আজকের মতো সংগঠিত পেশা হয়ে ওঠেনি। বেতন ছিল অল্প ও অনিয়মিত। একসময়ে আমরা কাছাকাছি বাসায় থাকতাম। দেখতাম তিনি অস্বস্তিতে আছেন। জানতাম ঘরে তার সত্মা, পরিবারের তিনি প্রথম সন্তান। পিতা সরকারি চাকুরে, জেলখাটা পুত্র তার জন্য স্বস্তির কারণ ছিল না। পিতা কাজ করতেন স্বরাষ্ট্র বিভাগে, সাবের তখনো জেল থেকে বের হননি, আমরা আমাদের হাতে লেখা পত্রিকা ছেপে বের করেছিলাম। কে যেন আমাদের বলেছিল কাজটি বেআইনি, সাবেরের পিতার সঙ্গে আমাদের দেখা বাসায় বাসায় গিয়ে পত্রিকা বিক্রির উপলক্ষে, তাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি হেসে বলেছিলেন, হ্যাঁ, তোমাদের এই পাবলিকেশন তো আনঅথরাইজড নিউজ লেটার বলে গণ্য হবে, এটা বেআইনি প্রকাশনা। আমরা অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল সরকারি কর্মচারীর স্বর শুনতে পেয়েছিলাম তার কণ্ঠে; আমাদের মনে পড়েছিল যে তার জ্যেষ্ঠ সন্তান তখন কারাগারে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে।
শহীদ সাবেরের ওপর স্বভাবতই চাপ ছিল সরকারি চাকরি খোঁজার। চোখে কী একটা অসুবিধা ছিল, যে জন্য সিএসএস পরীক্ষা দেননি। তবে পরীক্ষা দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্য সার্ভিসের এবং তাতে সারা পাকিস্তানে প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু চাকরিতে যোগ দেওয়া হয়নি, যে-ছেলে ছাত্র অবস্থায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে জেল খেটে এসেছে তথ্য দপ্তরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় তার জায়গা হয় কী করে। ইতিমধ্যে তার পিতা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন, সপরিবারে চলে গেছেন গ্রামে। সাবের সাংবাদিকতা শুরু করেন, বাসা ঠিক করে পিতা-মাতা, ভাইবোনদের নিয়ে আসেন ঢাকায়। কিন্তু তার আয় ছিল অল্প, বাসা তাই গুটিয়ে ফেলতে হয়। তারপর তার থাকার আর নির্দিষ্ট কোনো জায়গা ছিল না। হতাশা নিশ্চয়ই তাকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করে ফেলছিল। তাকে উদ্ভ্রান্ত মনে হতো। একসময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন। কিছুকাল রাত্রিযাপন করতেন দৈনিক সংবাদের কার্যালয়ে। ওই দৈনিক শুরু হয়েছিল মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে। কিন্তু পরে হয়ে দাঁড়িয়েছিল বামপন্থীদের সমর্থক, পাকিস্তানি হানাদারদের রোষ ছিল দৈনিকটির ওপরে। একাত্তরের ৩১ মার্চ রাতে তারা আগুন লাগিয়ে দেয় পত্রিকার কার্যালয়ে, অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান শহীদ সাবের। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র তাকে সহ্য করেনি, যখন তিনি কিশোর তখনই তাকে অবরুদ্ধ করেছিল কারাগারে, আত্মসমর্পণের আগে তাকে হত্যা করল। তাদের সাহস ছিল না যে বিচার করবে, অভ্যাস ছিল নির্বিচারে প্রাণদণ্ডাদেশ দানের।
শহীদ সাবেরের মৃত্যু অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি ও মেধার ক্ষয়ক্ষতি বটে। ওই ঘটনা একটি নয়, অনেক ঘটেছে। সেসব ঘটনার প্রতিনিধি তিনি, প্রতীকও বলা যাবে। ব্যর্থতার বোধটা ব্যক্তিগত ছিল। কিন্তু পেছনে প্রধান কারণটা ছিল সমষ্টিগত। রাষ্ট্র তাকে উত্ত্যক্ত করেছে, সমাজ তাকে আশ্রয় দেয়নি। যে বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে কৈশোরেই তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সে রাজনীতি ধারাবাহিকভাবে সামনের দিকে এগোতে পারেনি। এই বেদনাটা সহ্য করা সহজ ছিল না। আমরা কাজী নজরুল ইসলামকে জানি। অনেক বড় প্রতিভা, স্বপ্ন দেখতেন বড় মাপের। রাষ্ট্র তাকেও কারারুদ্ধ করেছে, বই বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে দিয়েছে; কিন্তু খুব বড় একটা দুঃখ নিশ্চয়ই পেয়েছেন এটা দেখে যে, লালিত স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য যে আন্দোলনটা ছিল, যার সঙ্গে তার যোগটা ছিল মনেপ্রাণে, সেটি বেগবান হচ্ছে না, বরঞ্চ সম্পূর্ণ বিপরীত যে রাজনীতি—সাম্প্রদায়িকতার—সেটাই ক্রমাগত প্রবল হয়ে উঠেছে। সে আঘাত নিশ্চয়ই কঠিন হয়েছিল তার পক্ষে বহন করা, এবং সেটাই প্রধান কারণ হবার কথা তার স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। নজরুল দেশবিভাগ দেখে যাননি, কিন্তু তার প্রস্তুতিপর্বের সাজসাজ রবটা তো শুনছিলেন চতুর্দিকে।
শহীদ সাবেরের বেলাতেও অনেকটা সে রকমেরই ঘটনা ঘটল। চার বছর একটানা জেল খেটে যে তরুণ বের হয়ে এলেন বাইরে, এসে তিনি আন্দোলনটা দেখতে পেলেন না। দেখলেন নির্বাচন, ১৯৫৪ সালের। সে নির্বাচনে বামপন্থী কর্মীরা কাজ করেছেন, তাদের চাপেই আসলে লীগবিরোধী যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, কিন্তু প্রার্থী তালিকায় তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই নগণ্য। পাছে যুক্তফ্রন্ট গঠিত না হয় এবং গঠনের পরে ভেঙে যায় এই ভয়ে কমিউনিস্ট পার্টি নিজের পরিচয়ে যুক্তফ্রন্টে থাকার জন্য চাপাচাপি করেনি, নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। পেছন ফিরে তাকালে এখন তো মনে হয় যে, বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরে পূর্ববঙ্গে লীগ-বিরোধিতা এতটাই প্রবল ছিল যে, যুক্তফ্রন্ট না করে ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ যদি বামপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে একাই এগিয়ে যেত তাহলেও মুসলিম লীগের পরাজয় অনিবার্য ছিল, এবং তাতে সুফলটা হতো এই যে, পরবর্তীকালে যুক্তফ্রন্টের ভেতরে যে প্রচণ্ড গৃহবিবাদ বাধে এবং যার ফলে সামরিক শাসন জারির পথটা প্রশস্ত হয় সেসব ঘটনা ঘটত না। আরো লাভ হতো এই যে, রাজনীতি কিছুটা হলেও পরিচ্ছন্ন পথ ধরে এগুত।
যুক্তফ্রন্টে তখনকার মৌলবাদী দল নেজামে ইসলামও ছিল। আর তাদের সরাসরি চাপটা ছিল কমিউনিস্ট পার্টিকে কিছুতেই যুক্তফ্রন্টে রাখা চলবে না, রাখলে তারা থাকবে না। চাপটা তারা দিচ্ছিল ফজলুল হকের মাধ্যমে, যিনি তখন ছিলেন যুক্তফ্রন্টের তিন প্রধানের একজন। কমিউনিস্টদের সঙ্গে নেওয়ার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীরও বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। হক ও সোহরাওয়ার্দী একে অপরের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, কিন্তু তারা এক ব্যাপারে একমত ছিলেন, সেটা হলো প্রার্থী তালিকা থেকে বামপন্থীদের সরিয়ে দেওয়া। বামের গন্ধ মাত্র পাওয়া গেলেই তারা বিরক্ত হতেন। বামপন্থীরা আন্দোলনে রইলেন ঠিকই, কিন্তু নির্বাচন তাদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনল না। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর রাজবন্দিদের (সে সময়ে তাদের প্রায় সবাই ছিলেন বামপন্থী) মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে-মুক্তি ছিল অল্প সময়ের, কিছুদিন পরেই আবার তাদের যথারীতি কারাবন্দি করা হয়।
সেকালে আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল যে তরুণেরা তাদের অধিকাংশই ছিলেন বামঘেঁষা। যুক্তফ্রন্টের সেই ঐতিহাসিক বিজয়টা তো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেরই প্রত্যক্ষ ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন—যেমন আবদুল মতিন, গাজীউল হক, অলি আহাদ—তারা কেউই দক্ষিণপন্থী ছিলেন না, তাদের ঝোঁকটা স্পষ্টতই ছিল বাম দিকে; বাম আন্দোলন তখন প্রকাশ্য হওয়ার সুযোগ পায়নি, পেলে এরা তার সঙ্গেই যুক্ত থাকতেন। আমরা সীমান্ত পত্রিকার কথা বলছিলাম, যে-পত্রিকায় কিশোর শহীদ সাবের লিখতেন, সেই পত্রিকার তরুণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম চৌধুরী বায়ান্ন সালে ছিলেন চট্টগ্রামের সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক, ঢাকায় পুলিশের গুলি চালনার সংবাদ পেয়ে রোগশয্যা থেকে যিনি কবিতা লিখেছিলেন, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’, ১৯৪৭-এ নিজেকে তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের একজন কর্মীই মনে করতেন।
কিন্তু বামপন্থীরা রাজনীতির মূল ধারায় পরিণত হতে পারেননি, সেটা অন্যতম কারণ যে-জন্য শহীদ সাবেরের মতো অসংখ্য মানুষ হারিয়ে গেছেন। বামপন্থীরা কেন সামনে রইলেন না তার কারণগুলো অজানা নয়। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বামপন্থীদের সহ্য করতে পারত না, তাদেরকেই মনে করত সবচেয়ে বড় আপদ ও বিপদ, তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। একাত্তরে সংবাদ আওয়ামী লীগ সমর্থক পত্রিকা ছিল না কিন্তু রাষ্ট্রীয় হানাদারেরা তার ছাপাখানা ও ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, মৃত্যুর কারণ হয়েছে শহীদ সাবেরসহ ওই কার্যালয়ে অবস্থানকারী অন্য কর্মীদের। সীমান্তর লেখক তালিকায় সায়ীদুল হাসানের নাম দেখছি, তখন তিনি চট্টগ্রামে থাকতেন, হয়তো কোনো কোম্পানিতে কাজ করতেন; পরবর্তীকালে তিনি বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন, মওলানা ভাসানী ঢাকায় এলে কখনো কখনো তার বাসাতে উঠতেন; গোপন বামদলের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক গণশক্তি যখন প্রকাশিত হয়, তখন তিনিই ছিলেন তার প্রকাশক, অর্থাত্ কিনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মোটেই যুক্ত ছিলেন না তিনি, বরঞ্চ তার অবস্থান ছিল আওয়ামীবিরোধী বামপন্থী শিবিরেই; কিন্তু হানাদারেরা তাকে চিনতে ভুল করেনি, তাকে ধরে নিয়ে গেছে যুদ্ধের শুরুতেই এবং তিনি আর ফিরে আসেননি। হানাদারেরা টাঙ্গাইলে মওলানা ভাসানীর বাড়িতে গিয়েও হানা দিয়েছে, তাকে না পেয়ে পুড়িয়ে দিয়ে এসেছে তার বাসগৃহ। কিশোর শহীদ সাবেরের পক্ষে রাষ্ট্রের জন্য কতটুকুই বা বিপজ্জনক হওয়া সম্ভবপর ছিল। কিন্তু তাকেও তো তারা রেহাই দেয়নি। ওই রাষ্ট্রের নির্যাতন যে কতটা নির্মম হতে পারত তার দৃষ্টান্ত তো লেখা আছে ইলা মিত্রের জীবনীতেও।
রাষ্ট্র ছিল প্রতিপক্ষ, সমাজ ছিল অনুদার ও অপ্রস্তুত। বামপন্থীদের মনে করা হতো নাস্তিক, রাষ্ট্রই ওই প্রচারটা ঘটিয়েছে, সমাজ যাতে বিরূপ হয়। ওদিকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের বেশির ভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক। সেটাই ছিল স্বাভাবিক। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে মুসলমানরা তো পিছিয়েই ছিল। দেশভাগের পর মধ্যবিত্ত হিন্দুর পক্ষে পূর্ববঙ্গে থাকাটা ক্রমশ অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল এবং অনেকেই বাধ্য হচ্ছিলেন দেশত্যাগে, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের কেউ কেউ তো অবশ্যই, নেতৃত্বেরও একাংশ চলে গেছেন সীমান্ত পার হয়ে। যারা রইলেন তাদের আত্মগোপন করতে হয়েছে, অনেকেই বন্দী হয়ে থেকেছেন কারাগারে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দরুন হিন্দু কমিউনিস্টদের জন্য মুসলমান আশ্রয়ে আত্মগোপনও খুব সহজ ছিল না।
ওই যে হিন্দু সম্প্রদায়ের নীরব দেশত্যাগ তার প্রভাবে পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক তো বটেই, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিত্সা, বিচার সর্বক্ষেত্রেই ক্ষতির কারণ ঘটেছে। সীমান্ত পত্রিকার কথাটাই ধরা যাক। তার লেখকদের অনেকেই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। প্রথমদিকে মাহবুব-উল আলম চৌধুরীর সঙ্গে সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন সুচরিত চৌধুরী। পত্রিকা যখন তৃতীয় বর্ষে পড়েছে তখন অর্থাত্ ১৯৫০ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে, তিনি আর সম্পাদনার কাজ করছেন না, সবটা কাজ মাহবুব-উল আলমকে একাই করতে হচ্ছে। পত্রিকায় অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী লিখতেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। একে তো হিন্দু তার ওপরে আবার কমিউনিস্ট, তার পক্ষে তাই ঢাকায় বেশিদিন থাকা নিরাপদ ছিল না। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর তিনি কলকাতায় চলে যান, শরণার্থী হয়ে। সেখানে তার জন্য যে সম্মানজনক পদ অপেক্ষা করছিল তেমনটা মোটেই নয়। জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে কলকাতায় গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাজ নেন। পরে অবশ্য যাদবপুর অঞ্চলে শরণার্থীদের প্রতিষ্ঠিত একটি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন, এখন নিশ্চয়ই তিনি জীবিত নেই, কিন্তু সব সময়েই বাম আন্দোলনে ছিলেন; শুধু তাই নয়, নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরু হলে তাতে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছিলেন বলে শুনেছি।
এদের পক্ষে দেশত্যাগ না করে তো উপায় ছিল না। যদি না যেতেন তাহলে পঞ্চাশে বাঁচলেও একাত্তরে বাঁচতেন না। অমিয়ভূষণের সহকর্মীদের অনেকেই বাঁচেননি। গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য—এরা কেউই তো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু একাত্তরের ঘাতকেরা তাদের বাঁচতে দেয়নি। ঢাকার অধ্যক্ষ যোগেশচন্দ্র ঘোষ, টাঙ্গাইলের রণদাপ্রসাদ সাহা, চট্টগ্রামের নূতনচন্দ্র সিংহ—এরা তো বলতে গেলে মাটি আঁকড়েই পড়ে ছিলেন; নিয়োজিত ছিলেন মানুষের উপকার করার কাজে, কিন্তু কেউ তো রক্ষা পেলেন না। যুদ্ধে যোগ দিতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন চট্টগ্রামেরই পূর্ণেন্দু দস্তিদার যিনি আওয়ামী লীগের নন, আজীবন বামপন্থী রাজনীতি করেছেন। চমত্কার লিখতেন; পাকিস্তান আমলের অনেকটাই কেটেছে কারাগারে এবং আত্মগুপ্ত অবস্থায়। খুব স্বাভাবিক ছিল এটা যে, দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গ যেখানে ছিল সেখানে থাকবে না, সাংস্কৃতিকভাবে নেমে যাবে। গেছেও। আমরা ওঠার চেষ্টা করেছি, কিছুটা যে উঠিনি তা নয়, কিন্তু একটা বড় আঘাত পাওয়া বাকি ছিল, যেটা পেলাম একাত্তরে। একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারটা আপতিক ব্যাপার ছিল না, ছিল সুপরিকল্পিত ঘটনা।
কমিউনিস্ট দলের আত্মগত দুর্বলতাও ছিল। দেশভাগের আগে ছাত্র, শ্রমিক তে-ভাগা অঞ্চলের কৃষক, প্রান্তবর্তী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা—এদের মধ্যে তাদের কর্মী ও সমর্থক ছিল, কিন্তু কেন্দ্র ছিল দুর্বল। ১৯৪৬-এর সেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি প্রার্থী দিয়েছে বটে। কিন্তু আসন পেয়েছে মাত্র তিনটি, একটি কলকাতায় শ্রমিক অঞ্চলে, বাকি দুটি প্রান্তিক এলাকাতে। দেশভাগের সময় পার্টি ছিল নিরুপায় দর্শক। সাতচল্লিশের পরে পার্টি জঙ্গি হঠকারী রাজনীতি গ্রহণ করে, যেটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। প্রতিক্রিয়ায় এর পরপরই পার্টি চলে যায় প্রায় বিপরীত অবস্থানে, নীরবে কাজ করার। রাষ্ট্র তো ক্ষিপ্ত প্রাণীর মতো আচরণ করছিলই, সাম্প্রতিক রাজনীতিদুষ্ট এবং সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাত্পদ সমাজও কমিউনিস্টদের সক্রিয় সমর্থন দেয়নি।
তাত্ত্বিক বিভ্রান্তিও ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়েই পার্টি ধ্বনি তুলেছিল সকল ভাষার সমান মর্যাদার। আদর্শিকভাবে এই বলাটা ঠিকই ছিল, কমিউনিস্টরা অবশ্যই সকল ভাষা ও জনগোষ্ঠীর সকল মর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারে বিশ্বাস করে; কিন্তু বায়ান্নতে যখন লড়াইটা চলছে রাষ্ট্রের শতকরা অধিবাসীর ছাপান্ন জনের (অর্থাত্ বাঙালির) সঙ্গে পাঞ্জাবি শাসকদের তখন পশ্চিম পাকিস্তানের পশতু বা সিন্ধি ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বাঙালি উত্তেজিত হবে এমনটা আশা করার কোনো কারণই ছিল না। তখনকার পরিস্থিতিতে সকল ভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে বরঞ্চ বিবেচনা করা হতে পারত আন্দোলন বানচাল করার অভিসন্ধি হিসেবে। কমিউনিস্ট পার্টি তো পরে নিজেই বিভক্ত হয়ে গেছে মস্কো ও পিকিং লাইনে এবং উভয়ের শত্রুপক্ষ যে ধনিক শ্রেণী, তাদের চেয়েও বড় শত্রু মনে করেছে এক পক্ষ অপর পক্ষকে। মস্কোপন্থীরা চলেছে আওয়ামী লীগের পিছু পিছু, আর পিকিংপন্থীরা নানা খণ্ডে টুকরো টুকরো হয়ে চলে গেছে অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে।
পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করবার কথাটা বাম মহল থেকেই প্রথমে উঠেছে। মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, যার দরুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি হয়েও সেই দল ত্যাগ করে বামপন্থীদের নিয়ে ন্যাপ গঠন করেন এবং প্রয়োজনে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সিরাজ শিকদারও স্বাধীন পূর্ববঙ্গের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন।
কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব বামপন্থীরা দিতে পারেননি। তার একাধিক কারণ ছিল। একটা হচ্ছে বামপন্থীদের মধ্যে তাত্ত্বিক বিভ্রান্তি ও সাংগঠনিক বিভাজন। সেকালে বাঙালি জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসকদের দ্বন্দ্বটাই যে প্রধান ছিল সেটা তারা পরিষ্কারভাবে ধরতে পারেননি, যেমনভাবে পেরেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শ্রেণীদ্বন্দ্বকে স্পষ্টতর করার জন্যই যে জাতিগত সমস্যার মীমাংসা করা দরকার ছিল সেটা অনুধাবনে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, কেবল রাষ্ট্র নয়, গোটা শাসকশ্রেণীই ছিল তাদের বিরুদ্ধে; ভাসানীকে কেবল যে ইস্কান্দার মির্জারাই ভারতের চর বলতেন তা নয়, সোহরাওয়ার্দীও বলেছেন, ন্যাপ গঠনের পরে। বামপন্থীদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হলে সে যুদ্ধের চরিত্র হতো আলাদা, বিজয় হয়তো বিলম্বিত হতো, কিন্তু নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ উভয়ের চরিত্রই যেত বদলে, যেমনটা ঘটেছে। ধরা যাক, চীনে, কিউবাতে ও ভিয়েতনামে।
২.
সীমান্ত পত্রিকার কথা বলছিলাম, এবার তার দিকে একবার তাকানো যাক। স্পষ্টতই পত্রিকাটি ছিল সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় বিশ্বাসী। সম্পাদক নিজেকে বামধারার লোক বলেই মনে করতেন, কিশোর শহীদ সাবের যে ধারায় সংলগ্ন হয়েছিলেন, সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। স্মরণ করা যাক, যে সীমান্ত আত্মপ্রকাশ করে ১৯৪৭ সালেই, নভেম্বর মাসে। তখনো বাংলা নাম নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ রেওয়াজে পরিণত হয়নি, তখন ছিল ‘আজাদ’, ‘ইত্তেহাদে’রই যুগ। কিন্তু বাংলা নাম হলেই তা যে প্রগতিশীল হবে, এমনটা মনে করারও কারণ নেই। সংগ্রাম তো চমত্কার বাংলা নাম, কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর পত্রিকা। কিন্তু সীমান্ত ছিল নামে অগ্রসর, চিন্তাতেও তাই।
প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠাতেই হবীবুল্লাহ বাহারের একটি শুভেচ্ছা বক্তব্য আছে; তখন তিনি মন্ত্রী; বক্তব্যটিতে দেখছি তিনি বলছেন, “সীমান্তবর্তী চট্টগ্রাম সাহিত্যে আবার নতুন পথ সৃষ্টি করবে এ ভরসা আমরা করতে পারি। বাঙ্গালা সাহিত্যের কারবার এখনো মধ্যবিত্ত সমাজকে নিয়ে। জনগণকে সাহিত্যে প্রতিফলিত করা, তারই জন্য পথ রচনা করুক ‘সীমান্ত’-এর অগ্রপথিকরা।” তিনি নিজে চট্টগ্রামেই বড় হয়েছেন, সীমান্তের অগ্রপথিকদের অনেককেই ব্যক্তিগতভাবে জানতেন, সে জন্যই বোধকরি ওইভাবে ভরসা করতে পেরেছিলেন।
সীমান্ত নিজেও জানত সে কী চায়। সম্পাদক ছদ্মনামে লেখা পত্রিকা প্রসঙ্গ নামের একটি রচনায় লিখছেন যে, পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক সাময়িকপত্র বের হয়েছে, যে-উদ্যম প্রশংসনীয়, কিন্তু এটাও তিনি লক্ষ করেছেন যে, ‘অনেক মাসিক পত্রিকার কোনো সুষ্ঠু আদর্শ নেই। তার ফলে অনেক কাগজ থাকা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক অন্ধকার বেড়েই চলেছে।’ (তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা) সুষ্ঠু আদর্শ সামনে না-রাখাকে তিনি বলছেন ‘দায়িত্বহীনতা’।
এই ত্রুটি আর যারই থাক সীমান্তর ছিল না। এ পত্রিকা ছিল পরিপূর্ণরূপে দায়িত্বমানসম্পন্ন। অঙ্গীকার ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গণ্ডি পার হয়ে জনজীবনের কাছে যাওয়া, যার প্রয়োজনীয়তার কথা হবীবুল্লাহ বাহার বলেছেন তার শুভেচ্ছায়। কাজটা করতে গিয়ে রক্ষণশীলদের রোষের মুখে পড়তে হয়েছে। সম্পাদক জানাচ্ছেন (দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা) যে, তাদের কমিউনিস্ট বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে, ‘আমাদের সাহিত্যকে তারা বঙ্গোপসাগরে ফেলতে চায় মার্কসীয় সাহিত্য বলে নয়—কারণ আমাদের সাহিত্যের প্রগতি ও শক্তি দেখে তারা ভীত।’
ওই সময়ে কবি মতিউল ইসলাম চট্টগ্রামে থাকতেন। তিনি ছিলেন সরকারি কর্মচারী, সীমান্তে তার লেখার কথা নয়, তিনি লিখেনওনি; কিন্তু তার নামে একটি কবিতা ও একটি ছড়া ছাপা হয়েছে, কবিতাটির নাম ‘খণ্ডিত এদেশে’, যাতে দেশভাগ হওয়ার মর্মযন্ত্রণার কথা বলা হচ্ছে, ছড়াটির নাম ‘স্বাধীনতার উত্সবে’, যাতে স্বাধীনতার তৃতীয় বর্ষপূর্তি উত্সবকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। ঘটনাটির ভেতর একটি কৌতুক আছে। তার নাম ব্যবহার করে সম্পাদক নিজেই মনে হয় ওই লেখা দুটি তৈরি করেছেন (সম্পাদক নিজের নামে তো লিখতেনই, নানা ছদ্মনামেও লিখতেন)। কৌতুকটা এইখানে যে মতিউল ইসলাম পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল ছিলেন, যার প্রমাণ আছে ওই সময়েই অর্থাত্ ১৯৫০ সালে প্রকাশিত তার কবিতার বইতে, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন, কায়েদে আজম তোমার জন্য। সীমান্তে বইটির সমালোচনা করা হয়েছিল, যার অংশবিশেষ উদ্ধৃতিযোগ্য। বলা হচ্ছে যে—
ফরিয়াদ-এর কবিকে নতুন বইটিতে পাওয়া গেল না। বরঞ্চ এই পুস্তকের কবিতা পড়ে মনে হয় কবির কোনো বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নেই। এলোমেলো স্ববিরোধী চিন্তার ঘুরপাকে মতিউল ইসলাম সাহেবের মতি স্থির নয়। জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও মানবতার বহু জায়গায় উল্লেখ আছে।...মতিউল ইসলাম সাহেবের মনে গাঁথনি কাঁচা। তাই তার মানবতাবোধ হয়ে ওঠে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ যার অপর নাম ফ্যাসিজম। হয়তো এ ব্যাপারে তিনি সচেতন নন। কিন্তু সদিচ্ছার সঙ্গে তা রূপায়ণের পথ জানা না-থাকলে এমনই ট্র্যাজেডি ঘটে। এ জন্য মতিউল ইসলাম সাহেব মানবপ্রেমিক হয়েও শেষ পর্যন্ত ধর্মের সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে পারেন না। অতীতমুখী ফিউডাল অহঙ্কারকে মনে করেন জাতীয়তাবোধ। (তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা)
বলা বাহুল্য, এই ট্র্যাজেডি কোনো একজনের ছিল না, ছিল অনেকের জন্যই সত্য। আর লেখক যে ফ্যাসিবাদী প্রবণতার কথা বলছেন সেকালের প্রগতিশীলদের পদে পদে তার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখনো হয়। কারণ রাষ্ট্রে রদবদল ঘটেছে, কিন্তু তার চরিত্রে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং সমাজ রয়ে গেছে সেই আগের মতোই, শ্রেণীবিভক্ত এবং সাংস্কৃতিক অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে পত্রিকাটির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মারা যান ১৯৪৭-এ, মাত্র ২১ বছর বয়সে, ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে। শহীদ সাবের যেমন সুকান্তও তেমনি বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন কিশোর বয়সেই। দুজনের জন্মও কাছাকাছি সময়ে, শৈশবে সাবেরও কলকাতাতেই পড়ালেখা করতেন, পিতার সঙ্গে থেকে, দেশভাগ না হলে একই আন্দোলনে থাকা ও লেখালেখির কারণে দুজনের দেখা-সাক্ষাত্, এমনকি বন্ধুত্বও হতে পারত—অবশ্য সুকান্ত যদি অমন তাড়াহুড়ো করে চলে না যেতেন। দেশভাগের অনেক কুফলের একটি হলো সাবেরদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া সুকান্তদের কাছ থেকে। সুকান্তের মৃত্যুর পর ওই বছরই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ছাড়পত্র বের হয়; আমরা দেখছি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তা চট্টগ্রামের এই সীমান্ত পত্রিকাতে আলোচিত হচ্ছে; কেবল তাই নয়, আলোচক জীবনকুমার চক্রবর্তী সুকান্তের কবিতার যথাযথ মূল্যায়নই করছেন কবির মহত্ সংবেদনশীলতা ও ইতিহাসবোধের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে। বলছেন, ওই দুটি গুণের বেশ অভাব দেখা গেছে তখনকার কবিদের ভেতর—
নতুবা, অশীতিপর বৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারায় ‘পূরবী’র পর দীর্ঘ ১২ বছরের ব্যবধানে যুগোপযোগী পরিবর্তনের ঢেউ উঠল, মার্কসবাদের মারফত্ নয়, শুদ্ধমাত্র অপূর্ব সংবেদনশীলতার সহায়তায়, আর তার থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দীকালের ব্যবধানে বুদ্ধদেব বসুর মতো একজন জাত কবিইবা কেন ‘নিজের লেখা থেকে চুরি’র আবর্তনেই ঘুরপাক খেতে থাকবেন? (প্রথম বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা)।
১৯৫০ সালে ঢাকা শহরে ঢাকা আর্ট গ্রুপ নামে শিল্পীদের একটি গোষ্ঠী তাদের প্রথম এবং শহরের জন্যও প্রথম চিত্রকলার প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান করে। আমরা তখন স্কুলের ছাত্র। মনে পড়ে সেই প্রদর্শনী আমাদের ভেতর কেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। এত বছর পরে তার একটি সমালোচনা পড়লাম সীমান্ত সমগ্রে, যেটি তখন লিখেছিলেন অধ্যাপক অমিয়ভূষণ চক্রবর্তী, যাঁর বিষয়ে আগে উল্লেখ করেছি। তাঁর বক্তব্যও ওপরে উদ্ধৃত জীবনকুমার চক্রবর্তীর মতোই। ছবিগুলো তিনি দেখেছেন, দেখে তার মনে হয়েছে এসব ছবিতে শিল্পীদের জনজীবনসংলগ্নতা নেই, যেন তারা ছবি আঁকছেন মনের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে; অভাব, জীবনকুমার যাকে বলছেন সংবেদনশীলতা ও ইতিহাসবোধ সেই দুই গুণেরই (চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা)। যোগ করলে অন্যায় হবে না যে, ওই দুই গুণ সুকান্তের যেমন ছিল, তেমনি ছিল শহীদ সাবেরেরও।
সীমান্ত যখন তৃতীয় বর্ষে পড়েছে সেই সময় ঢাকা থেকে মুকিত নামে একটি স্বল্পস্থায়ী মাসিক পত্রিকা বের হয়। মনে পড়ে যে আমরা ওই পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যা আগ্রহের সঙ্গে পড়তাম। আমাদের মনে হতো যে পত্রিকাটি আধুনিক এবং যথার্থ অর্থেই প্রগতিশীল। কিন্তু সীমান্ত লক্ষ করেছে তার কোনো কোনো লেখা রীতিমতো প্রতিক্রিয়াশীল। একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হচ্ছে, “পূর্ববংগ ও পশ্চিমবংগ দুয়ের ব্যবধান চিরকালই ছিল।...‘বাঙ্গাল’ ও ‘ঘটীর’ মধ্যে একটা সহজ বিভেদ হামেশাই নজরে পড়তো।” সীমান্তেরই মন্তব্য—‘গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাই মানুষের পার্থক্যকে বড় করে দেখেন।’ আরও বলা হয়েছে, ‘উগ্র জাতীয়তাবাদ যে আজকের যুগে ফ্যাসিজমের নামান্তর তাও তিনি জানেন না।’ (তৃতীয় বর্ষ, তৃতীয় সংখ্যা) ঢাকা কলেজ-বার্ষিকীতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ সম্পর্কেও মন্তব্য রয়েছে। প্রবন্ধটিতে একজন অধ্যাপক বলেছেন, ‘ভাত-কাপড়ের সঙ্গে আইনস্টাইনের থিওরির কোনো সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া বিড়ম্বনা ও যুক্তিহীন।’ এ প্রসঙ্গে সীমান্তের মন্তব্য হচ্ছে, ‘তিনি কি জানেন না যে আইনস্টাইন যে ল্যাবরেটরিতে কাজ করেন তা সামাজিক দান। বুদ্ধদেবের আমলে কারো পক্ষে গবেষণা করা অসম্ভব ছিল। সমাজ তাকে অবসর পাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ল্যাবরেটরি দিয়েছে এ সমস্ত সামাজিক ব্যাপার।’ আরও আছে যেমন, ‘শাশ্বত, চিরন্তন, মারফতি, মিস্টিসিজম ইত্যাদি মধ্যযুগীয় চিন্তার মোল্লাদের থেকে অধ্যাপকের এই উক্তি আদৌ স্বতন্ত্র নয়। তফাত শুধু রঙের।’
এই পত্রিকা যে কেবল জনজীবনের কাছে যেতে চাচ্ছিল তা নয়, সে-জীবনের ছবি আঁকাতেও তার সন্তোষ ছিল না, চাইছিল ওই জীবনে (অর্থাত্ সমাজে) মৌলিক পরিবর্তন আনতে। যে জন্য কেবল ইতিবাচক কথা বলেই শান্ত থাকেনি, নেতিবাচক চিন্তাগুলোর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়েছে—যখনই প্রয়োজন দেখা দিয়েছে লিপ্ত হবার। তখনকার দিনে যেসব বামপন্থী লেখকেরা লিখতেন তাদের ওপর আলোচনা থাকত, কোনো কোনো রচনার অনুবাদও প্রকাশ করা হতো—দেখতে পাচ্ছি।
অত্যন্ত তরুণ তারা, কলেজে পড়েন, তাদের উত্সাহ দেওয়া ছিল এ পত্রিকার দায়িত্ব, যে কারণে শহীদ সাবের এতে লিখেছেন। মেয়েরাও লিখতেন। একজনের লেখা দেখে চমকে উঠেছি, মোশফেকা রহমান, আজাদ পত্রিকার মুকুলের মহফিলে লিখতেন, আমরা অনেকেই লিখতাম সেখানে। কিন্তু সীমান্তে যে কবিতাটি লিখেছেন তিনি, সেটি আমি দুবার করে পড়লাম। কবিতাটির নাম ‘ঝড়’। মোশফেকা রহমান তখন কলেজে ছাত্রী হবেন, ১৯৪৮ সালের ওই কবিতায় তিনি বিপ্লবের কথা বলছেন, শেষ পঙিক্ত দুটি এ রকমের “কঠিন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সারি সারি মিছিলের হাত, বিঘোষিছে রাত্রি শেষ: ‘দিন এসে গেছে ভাই’।” আটচল্লিশে যে ঝড়ের কথা লিখেছেন, সে ঝড় বায়ান্নতে উঠেছিল, উঠেছিল ঊনসত্তরে, তারপর একাত্তরে। একাত্তরের ঝড়ে মোশফেকার স্বামী মামুন মাহমুদ শহীদ হন। মামুন মাহমুদ তখন রাজশাহী বিভাগে পুলিশের প্রধান কর্মকর্তা। তার অবস্থান অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। হানাদারেরা একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় তাকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। তিনি আর ফিরে আসেননি। স্বামী ফেরত আসবেন মোশফেকা মাহমুদ এ বিশ্বাস অনেকদিন আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন, ১৯৮৬-তে তিনিও চলে গেছেন। কিন্তু আটচল্লিশের ওই কবিতাতে যেন পূর্বাভাস ছিল একাত্তরের। কেবল ওই একটি কবিতা নয়, সীমান্তর অনেক রচনা সম্পর্কেই কথাটা সত্য।
সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেছে ১৯৫২ সালে। সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। বিস্ময়ের ব্যাপার বরঞ্চ এটি যে, ওই পত্রিকা একদিন বের হয়েছিল এবং বেশ কয়েক বছর টিকে ছিল। এর অবশ্য ব্যাখ্যা আছে। সেটা হলো চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন। তিরিশের দশকে ওইখানেই তো সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব-অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তার ঢেউ চট্টগ্রাম থেকে কখনোই মিলিয়ে যায়নি। ওই অভ্যুত্থানে যারা যুক্ত ছিলেন তাদের অনেকেই পরে বামপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। দ্বিতীয় কারণ, চট্টগ্রাম হচ্ছে বন্দরনগর। সেখানে নানা মানুষের যাতায়াত। নানা ধরনের অফিস, কাচারি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসব ছিল। রেলওয়েরও একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল ওই শহর, যার দরুন রেলের বহু কর্মচারী ও তাদের পরিবার সেখানে থাকতেন। একটি শক্তিশালী স্থানীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণী সেখানে ছিল। যারা কেবল যে পেশাজীবী ছিলেন তা নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ‘সওদাগর’ শুনলে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে লোকের ভ্রূ হয়তো সংকুুচিত হতো, বন্দরের কারণে চট্টগ্রামে তেমনটা ঘটত না; সওদাগররা সেখানে বেশ সম্মানিত ছিলেন।
সীমান্ত পঞ্চাশের দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বায়ান্নতে তার সম্পাদকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছে। এরপর সে টিকে থাকে কী করে?
শহীদ সাবের একাত্তরে চলে গেছেন। যদি না যেতেন, যদি থাকতেন তিনি স্বাধীন বাংলাদেশে তাহলে কি তার অবস্থা ও অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসত?
মনে হয় না। তার চিকিত্সা? কে নিত সে দায়িত্ব? মরণোত্তর যে সাহিত্য পুরস্কার তিনি পেয়েছেন জীবিত থাকলে তা-ই বা পেতেন কি না কে জানে। তাহলে কি তিনি হারিয়েই গেলেন? সে রকমই তো মনে হয়। একাত্তরের পরে মাহবুব-উল আলম চৌধুরী আবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন পত্রিকা প্রকাশের। এবার সাময়িকপত্র নয়, সরাসরি দৈনিক পত্রিকা, দৈনিক স্বাধীনতা নামে। কয়েক বছর বেঁচে ছিল, তারপরে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এমনকি সীমান্ত পত্রিকার সব সংখ্যাও তো উদ্ধার করা যায়নি। ৪৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল, যাদের মাত্র ১৩টি খুঁজে পাওয়া গেছে, ওই কয়টি নিয়েই সীমান্ত সংগ্রহ। তাহলে?
না, কিছুই হারিয়ে যায়নি। সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে আছে। রয়েছে সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার অংশ হিসেবে, অনুভব ও চিন্তার সমন্বয় ক্ষেত্রে। ইতিহাসের চাকা যে পেছন দিকে যাবে না, এটা কোনো সান্ত্বনা বাক্যমাত্র নয়, বাস্তব সত্যও বটে।
তবে যা ঘটবার কথা ছিল তা-ই ঘটেছে। সমষ্টিগত স্বপ্নটি এখন আর আগের মতো জীবন্ত নেই। ঘটনাপরম্পরায় অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। এর জন্য দায়ী দেশের শাসকশ্রেণী। তারা সবাই জাতীয়তাবাদী; বাঙালি জাতীয়তাবাদ দ্বিজাতিতত্ত্ব থেকে আলাদা, কিন্তু আমাদের শাসকশ্রেণীর একাংশ তো বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসই করে না, অপরাংশ বিশ্বাস করে বটে কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে যে ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধানে তার পুনর্বাসনের ব্যাপারে তাদেরও আগ্রহ নেই, এমনকি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে তারা যে অসম্মত তা-ও বলা যাবে না।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যা করেছে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী তার চেয়ে কম কিছু করছে না। অন্য সব অপকর্ম তো রয়েছেই, সাধারণ মানুষের জন্য একটা বড় রকমের অসুবিধার কাজ তারা করেছে। সেটা হচ্ছে সামাজিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তনকে প্রতিহত করা। সমাজ আগের মতোই শ্রেণীবিভক্ত ও পশ্চাত্পদ রয়ে গেছে। আর সমাজ বদলায়নি বলেই রাষ্ট্রও বদলায়নি, তার চরিত্র রয়ে যাচ্ছে অপরিবর্তিত। বর্তমান জাতীয়তাবাদীরাও আগের জাতীয়তাবাদী শাসকদের মতোই নিজেদেরই জাতি মনে করার সুযোগ পাচ্ছে।
সাতচল্লিশের পরে সীমান্তের লেখকেরা সমাজ ও রাষ্ট্রে যে ধরনের পরিবর্তন আনার কথা লিখছিলেন, দীর্ঘ সংগ্রামের পরেও তা আসেনি। দায়িত্বটা আসলে ছিল সমাজতন্ত্রীদেরই। জাতীয়তাবাদীরা যা করার করেছেন, তাদের ইতিবাচক কাজ একাত্তরে বিজয়ের মুহূর্তেই শেষ হয়ে গেছে, এটা জেনে নিয়ে সমাজতন্ত্রীদের দায়িত্ব ছিল মুক্তির সংগ্রামকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তারা সেটা করতে পারেননি বলেই স্বপ্ন এখন অস্পষ্ট, শহীদদের স্মৃতিও অনুজ্জ্বল।
আগামী দিনের ইতিহাস কীভাবে লেখা হবে সেটা নির্ভর করছে সমাজতন্ত্রীদের কাজের ওপরই, অন্যসব ঘটনা গৌণ বটে, তা যতই তারা চাঞ্চল্যকর ও বিভ্রান্তিজনক হোক না কেন।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত