১৯৭১ সালে পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হয়েছিল একটি নতুন রাষ্ট্র। জন্ম নেয় আত্মপ্রত্যয় ও দুর্জয় মনোবলে বলীয়ান একটি নির্ভীক নতুন জাতি। সে রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ, আর সেই জাতি বাঙালি। ঘটনার অবিস্মরণীয় তাৎপর্যে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও বেদনাময় আত্মোৎসর্গের অতুলনীয় ঐশ্বর্যে সেই দেশ ও জাতির নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
আত্মবোধ ও অগ্নিময় চেতনায় উদ্বুদ্ধ একটি মহান জাতিকে সুপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন নারকীয় পন্থায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সব পাশবিক প্রচেষ্টা এবং সর্বশক্তিপ্রযুক্ত উন্মত্ত ধ্বংসলীলা ও নিধনযজ্ঞের অবসান ঘটে স্থিতধী বলিষ্ঠ নেতৃত্বের এক সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক প্রয়াস ও আপামর মানষের একক সমর্থন, সহযোগিতা এবং শেষ পর্যায়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গ্লানিকর পরাজয় ও নাটকীয় আত্মসমর্পণে।
মনে পড়ে সেই ভয়াবহ ২৫ মার্চ সকালে আমার স্বামী তাজউদ্দীন [তাজউদ্দীন আহমদ] আমাকে বলেছিলেন, ‘লিলি, আজ রাতে আমি বাসায় থাকব না, তোমরাও কেউ বাসায় থেকো না। ইয়াহিয়ার সামরিক বাহিনী বোধ হয় কঠিন পথ বেছে নিয়েছে। তাই বাসায় থেকে অজানা বিপদের ঝুঁকি না নেওয়াটাই বিবেচনায় সঠিক মনে করছি।’ তিনি এর বেশি আর কিছুই বললেন না। এরপর তিনি বাসা থেকে প্রতিদিনের মতো বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় শুধু বললেন, কাঁধে ঝোলানো যায়, এমন একটি কাপড়ের ব্যাগ কিনে রেখো।
ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের যে বৈঠক ও আলোচনা চলছিল, তার ব্যর্থতায় পরিণামের ভয়াবহতার পূর্বাভাস যেন সবাই আঁচ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে কী হতে যাচ্ছে, তা হয়তো তাঁরা কেউ ভাবতেও পারেননি তখনো। চারদিকে কেমন যেন একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। মনে হচ্ছিল, একটা অশুভ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। সেদিন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত–অপরিচিত অনেকেই আমাদের বাসায় এসে ভিড় জমিয়ে জানতে চাইছিলেন সত্যিকার খবর কী? অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলেও যাচ্ছিলেন।
শত আশঙ্কা সত্ত্বেও আমি বাসা থেকে অন্যত্র পা বাড়াতে পারিনি। কারণ, রাত হতে থাকল, তাজউদ্দীন ফিরছেন না। আমি অপেক্ষা করছিলাম তাঁর জন্য। রাত আটটার দিকে তাজউদ্দীন মুজিব ভাইয়ের বাসা থেকে ফোন করে আমাকে বলেছিল, ‘আমি বাসায় না ফেরা পর্যন্ত তুমি কোথাও যেয়ো না।’ তাজউদ্দীন জানতেন আমাকে দুই বাচ্চাসহ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ হামিদ ভাই তাঁর ফতুল্লার বাসায় নিয়ে যাবেন।
আমার বড় ও মেজ মেয়ে রিপি [শারমিন আহমদ রিপি] ও রিমি [সিমিন হোসেন রিমি] এবং পরিণত বয়সের এক ভাগনি, যে কিছুদিন আগে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিল—এই তিনজনকে আগের দিন তাঁতীবাজারে আমার বড় বোনের বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমার এক বছর তিন মাস বয়সের একমাত্র ছেলে সোহেল [সোহেল তাজ] এবং পাঁচ বছরের মেয়ে মিমি [মাহজাবিন আহমদ মিমি] আমার সঙ্গেই ছিল। ভেবেছিলাম, যদি সত্যি পালিয়ে যেতে হয়, তাহলে ওদের সবাইকে নিয়ে পালানো ঝামেলা হতে পারে; দুজনকে নিয়ে হয়তো দ্রুত সরে যেতে পারব।
রাত ১০টার পরে তাজউদ্দীন বাসায় ফিরলেন। আমি দেখলাম গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন তাঁর মুখমণ্ডল। উপস্থিত সবাই চলে গেলে তিনি বাসার শানের খোলা জায়গায় পায়চারি করতে থাকলেন। একটু পর আমাকে বললেন কাপড়ের ব্যাগটাতে একটা লুঙ্গি, গেঞ্জি আর রাইফেলের কিছু গুলি রাখতে। এদিকে সারা দিনের মানুষের ভিড় আর কথাবার্তা অন্যদিকে তাড়াহুড়ায় কাপড়ের ব্যাগটা কোথায় রেখেছিলাম খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এঘর–সেঘরে খুঁজতে খুঁজতে দেখি আলমারির ওপরে রাখা কাপড়ের ব্যাগটা। কিন্তু ততক্ষণে তাজউদ্দীন ভীষণ রেগে গেলেন। প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘কী করে বোঝাব, এক মুহূর্তের বিলম্বে গোটা জাতির ইতিহাসের গতিধারা পাল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যে রোগীকে অপারেশনের জন্য চেতনাশূন্য করা হলো একটি মিনিট সময়ের জন্য, কিন্তু অপারেশনের যাবতীয় সরঞ্জাম টেবিলে থাকা সত্ত্বেও তার একটি দিতে নার্স দেরি করেছিল এক মিনিট। আর তাতেই রোগীর মৃত্যু হয়েছিল। ওই এক মিনিটই ছিল রোগীর জন্য ভয়াবহ সময়। আমার জন্য সময় ঠিক তেমনি গুরুত্ব বহন করছে। এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন এলেন। তিনি তাঁদের সঙ্গে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেলেন। আমার কানে ভেসে এল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’ দেখলাম তাদের গাড়িটা দ্রুত বেগে ধানমন্ডির ১৫ নম্বর রোড পর্যন্ত গেল। এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে উল্টো দিকে লালমাটিয়ার দিকে গেল। আমি তখন বাড়ির গেটের কাছে একটি ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে। এমন সময় দূর থেকে গোলাগুলি ও মর্টার আক্রমণের শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই নজরে পড়ল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাদের কয়েকটি গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে তীব্র বেগে লালমাটিয়ার দিকে চলে গেল। সেটা দেখে এক অজানা আশঙ্কায় আমি কেঁপে উঠলাম। এরপরও ভাবলাম, অন্ধকার দুর্গম পথে যে মহান দায়িত্বভার নিয়ে বাড়ি ছেড়ে এইমাত্র তাজউদ্দীন বেরিয়ে গেলেন, সে পথ যতই ভয়াবহ ও গভীর তমসাচ্ছন্ন হোক না কেন, কোনো অদৃশ্য শক্তি দুর্বার গতিতে তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে আপন গন্তব্যে। পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ধরতে পারবে না। ওদের আওতার বাইরে চলে যেতে সক্ষম হবেন তাঁরা। মনের দৃষ্টিতে যেন দিব্য প্রত্যক্ষ করলাম এ ঘটনা।
তখন আমাদের বাড়িটি ছিল দোতলা। আমরা নিচতলায় থাকতাম। দোতলায় ভাড়াটে হিসেবে থাকতেন আবদুল আজিজ বাগমার ও তাঁর স্ত্রী আতিয়া আজিজ। আজিজ সাহেবের পৈতৃক বাড়ি ছিল কালীগঞ্জে [গাজীপুর জেলার অন্তর্গত]। তিনি একসময় ছাত্রলীগের সহসভাপতি ছিলেন।
তাজউদ্দীন চলে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাচ্চা দুটি নিয়ে আমাদের গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে বললাম, যত তাড়াতাড়ি পারো সামনেই অর্থাৎ উল্টো দিকে ২১ নম্বর রোডের ভেতর ঢুকে পড়ো। ওখানে যেকোনো একটি বাড়িতে আমি নেমে যাব। এ সময় ভীষণ গোলাগুলির শব্দ আশপাশে। একটু পর দেখলাম ইলেকট্রিক ও টেলিফোনের তার ছিঁড়ে পড়তে। আর তখনই আজিজ ভাই ও আতিয়া প্রায় দৌড়ে এসে ভীষণভাবে বাধা দিল আমাকে। তারা চাপা গলায় বলল, ভাবি একমুহূর্ত দেরি না করে গাড়ি থেকে নেমে আসুন। গেটের বাইরে গেলেই মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবেন। মনটা স্থির হলে বুঝতে পারলাম, পালানোর পথ রুদ্ধ। এদিকে বাড়িতেও থাকা যাবে না। দ্রুত চিন্তা করছিলাম এখন কী করা যায়। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়িঘরের আড়ালে গিয়ে আতিয়াকে বললাম, আমি তোমাদের সঙ্গে ওপর তলাতেই যাই আর আমিও ভাড়াটে সেজে পড়ি।
এই কথা তাদের মনে ধরল। আরেকটা কারণে মনে বল পেলাম। আতিয়া ও আমার ভালো উর্দু জানা ছিল। ওপরে গিয়ে দ্রুত সালওয়ার ও কামিজ পরে দুজনেই নিজেদের বেশ পরিবর্তন করে ফেললাম। আতিয়া মাঝেমধ্যে বাসায় সালোয়ার–কামিজ পরত। সালোয়ার–কামিজ পরে দৈহিক উচ্চতা ও আকৃতিতে আমাদের দুজনকেই অবাঙালির মতো দেখাচ্ছিল। এতে মনে ভরসা হলো, এই পোশাকে হয়তো শত্রুর কবলমুক্ত হতে পারব।
সেই রাতে আজিজ ভাইয়েরও বাসায় থাকার কথা ছিল না। আতিয়ার কঠোর বাধার কারণেই তাঁকে বাসায় থাকতে হয়েছিল। এর পরিণাম হয়েছিল মর্মান্তিক। পাকিস্তানি সেনার হাতে ধরা পড়ে আজিজ ভাইকে সাত মাস ক্যান্টনমেন্টে অন্তরীণ অবস্থায় মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। পরে শুনেছি অন্তরীণ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত কয়েকবার প্রহার করেছে। শেষে অভাবনীয় ও অলৌকিকভাবেই তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন।
যাহোক, আমি ওপরতলায় গিয়ে আমার পোশাক পাল্টানোর পরে আতিয়ার শোবার ঘরের বিছানায় ঘুমন্ত ছোট ছেলে ও মেয়ে মিমিকে শুইয়ে দিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চারদিকে এবং দূর থেকে গুলি ও আরও সব বিকট শব্দ ভেসে আসছিল। জানালার ফাঁক দিয়ে দেখলাম আকাশ আলোয় ভরা। এরপর জানালা থেকে সরে এসে দেখলাম বড় হলঘরে আতিয়া ও আজিজ ভাই তাদের শোবার ব্যবস্থা করছেন দুটি সোফার ওপরে। সেটা দেখে আমার মনে হলো আতিয়া ও আমার একঘরে থাকাটাই বুদ্ধির কাজ হবে। এর মধ্যে গোলাগুলির শব্দ ক্রমশ নিকটবর্তী হতে লাগল। আতিয়াকে নিয়ে এক ঘরেই থাকলাম। আমাদের কারও মুখে কোনো কথা নেই। দক্ষিণের জানালার ফাঁক দিয়ে আবার বাইরে তাকালাম। অভাবনীয় দৃশ্য চোখে পড়ল। দেখলাম দক্ষিণের সারাটা আকাশ লালে লাল। লালের মাঝে পুরো আকাশটাই যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তখন পরপর অনেক গাড়ি আমাদের বাড়ির সামনে থামার শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো আমাদের গোটা বাড়ি যেন মিলিটারিরা ঘিরে ফেলেছে। এরপর সত্যি সত্যি ওরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়িতে ঢুকে পড়ল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বানে ওরা হয়তো ভেবেছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে নিশ্চয় প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রণের সব ধরনের ব্যবস্থাই রয়েছে। দেখলাম, অস্ত্রসজ্জিত আর্মিরা আমাদের বাড়ির চারদিকে পজিশন নিয়ে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে। একনজর জানালার ফাঁক দিয়ে দেখে নিয়েছিলাম বাইরের বড় রাস্তার অবস্থাটা। শুধু পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের গাড়ি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল না।
আতিয়া ও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরেই থাকব। ওরা খুলতে বললেই অথবা ধাক্কা দিলেই খুলে দেব। এরপর ওদের মোকাবিলা করব। ততক্ষণে নিচতলায় ভীষণ গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। শব্দে বুঝতে পারছি পাকিস্তানি সেনারা গুলির আঘাতে ঘরের দরজা-জানালা ও বারান্দার মোটা তারের বেড়াগুলো ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছিল আর নিচের প্রতি ঘরে ঢুকে তাজউদ্দীন ও আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
এ সময় আমি কঠিন মনোবল নিয়ে মৃত্যুর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। আমার আব্বা সেদিন আমাদের বাসাতেই ছিলেন। আমার এক ভাগনে ও ননদের ছেলেও ছিল। এ ছাড়া ছিল ৬০ বছরের বারিক মিঞা। তিনি বাড়ির দেখাশোনা ও গেটের কাছে থাকতেন। পাকিস্তানি সেনারা বাড়ি ঘিরে ফেললে বারিক মিঞা আব্বা যে ঘরে ছিলেন সে ঘরের বাথরুমে লুকিয়ে পড়েন।
পাকিস্তানি সেনারা আব্বা ও বারিক মিঞার হাত বেঁধে ঘিরে দাঁড়িয়ে আমরা কোথায় চিৎকার করে তা জানতে চাইছিল। একটি দল সিঁড়ির দরজা ভেঙে চুরমার করে দোতলার বারান্দায় প্রবেশ করে। মনে হলো সেনাদের একাংশ দোতলার ছাদের দিকে ছুটে গেল।
সেনাদের দল আমি ও আতিয়া যে ঘরে ছিলাম, সে ঘরের দরজায় বিকট শব্দে এক ধাক্কা দিতেই আতিয়া কৌন হ্যায় জি বলেই দরজা খুলে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা ঘরে ঢুকেই তাদের অস্ত্র আমাদের বুকের দিকে তাক করে দাঁড়াল। অফিসার মতো একজন প্রশ্ন করল, ‘তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়? মিসেস তাজউদ্দীন কৌন হ্যায়? তুম ইয়া তুম...।’ কয়েকজন আবার জানালার কাছে গিয়ে বাইরে গুলি করল। আতিয়া উত্তর দিল, ‘আরে জি ইহা মিসেস তাজউদ্দীন কাহা হ্যায়, আপ ইয়ে কেয়সা গালতি বাতা রাহে! হাম সাব টিমেন্ট হ্যায়, তাজউদ্দীন হামারে ল্যান্ডলর্ড, উনহোনে তো জি গ্রাউন্ড ফ্লোরমে রাহতে।’
আমার আশঙ্কা হচ্ছিল নিচে আমার ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে। এ কারণে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার ছেলেটা কোলেই ছিল। দ্রুত ওকে আমার মুখের সামনে নিয়ে আমার মুখটা কিছুটা আড়াল করে আতিয়ার উত্তর শেষ হওয়ামাত্র আতিয়াকে আমি ধমকের সুরে বললাম, ‘আরে জি তুমহে তো পাহেলেই মানা কিয়েথে ইয়ে সাব পলিটিসিয়ানকে ঘর কেরায়া নেহি লেনা, আখেরি এহি থা নাসিবমে, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন...।’ আমার কথা শেষ হওয়ামাত্রই যে অফিসারটি রাগের ভঙ্গিতে কথা বলছিল, সে তার অস্ত্র নামিয়ে ফেলে আমাদের দুজনের দিকে তীক্ষ্ণ একপলক দৃষ্টির ঝাপটা রেখেই বলল, ‘হামারা গালতি হো গিয়া আপলোগ ইতমিনানসে রাহিয়ে, মুঝে আওর কুচু কারনা নেহি।’ এর মধ্যে আমার মেয়ে মিমির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। ভাগ্যিস সেই মুহূর্তে সে বাংলায় কোনো কথা বলেনি। অফিসারটি আমার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘বিবি তুম শো যাও ডারনেকা কুচু নেহি।’ এদিকে কয়েকজন সেনা বাথরুমের ওপরের অংশে ভালো করে দেখে নিল; ওখানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না। এরপর ওরা সশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আতিয়াও ওদের পেছনে অগ্রসর হয়েছিল।
পাশের ঘরেই আতিয়াদের পরিচিত এক নবদম্পতি মেহমান ঘুমিয়ে ছিলেন। তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে বিকেলে বেড়াতে এসে খাওয়াদাওয়ার পর দেরি হয়ে যাওয়ায় এবং রাতে অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকায় ঝুঁকি না নিয়ে শেষ পর্যন্ত থেকেই গিয়েছিলেন। দরজা ধাক্কার বিকট শব্দে তারা হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন এবং বেশ কয়েক মিনিট পর তারা দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ান। তখন একজন আর্মি অফিসার পুরুষ লোকটিকে কঠোর ভাষায় ওদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য আদেশ করে। সঙ্গে সঙ্গেই আতিয়া বলল, ‘আরে হাবিব ভাই আপ ইয়ে কেয়সে তারিকেমে নিন্দ যা রাহে, ইনহোনে ইতনে চিল্লা রাহে, আপ দারওয়াজা খুলনেসে ইতনে দের কিউ কিয়া?’ এর জবাবে হাবিব সাহেবের স্ত্রী উর্দুতেই মিনতির সুরে অপরাধ স্বীকার করে নেন। তখন অপর একজন আর্মি অফিসার হঠাৎ করে বলল, ‘ঠিক হ্যায় তমলোগ শো যাও।’ অভাবনীয়ভাবেই তারা দুজন পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পান। এই দম্পতিকে আমি চিনতাম না। পরে জেনেছি হাবিব সাহেব কিছুদিন আগে পড়াশোনা শেষ করে নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।
এরপর পাকিস্তানি সেনারা আতিয়ার স্বামী, তাদের বাবুর্চি আবদুল, আমার ভাগনে ও ননদের ছেলে এবং আমাদের সেই বারিক মিঞাকে বেঁধে ভীষণভাবে মারতে মারতে গাড়িতে নিয়ে ওঠায়। এসব অবশ্য আমি দেখিনি। আজিজ ভাইয়ের এক ভাগনেও সেদিন ওই বাসাতেই ছিল। সে লুকিয়ে সব দেখে পরে আমাকে বলেছিল।
আমার আব্বা আমাদের নিচতলায় কোনার রুমে ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা সেখানে গিয়ে ক্রুদ্ধ ভাষায় আব্বাকে নানা কথা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। আব্বা তখন অসুস্থ ছিলেন। তিনি বিছানা থেকে উঠতেই পারছিলেন না। তখন দুজন অফিসার তাঁকে শুয়ে থাকতে বলে। কিন্তু তারা আব্বাকে নানা প্রশ্ন করে।
আব্বা কিন্তু বাঁচার আশায় শুয়ে পড়েননি। তিনি মনে করেছিলেন শোয়ামাত্রই পাকিস্তানিরা তাঁকে গুলি করবে। তিনি ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠেই ইংরেজিতে ওদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। অফিসারদের প্রশ্নে তিনি বলেন, তাজউদ্দীন কোথায় আছে সে কথা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই ভালো বলতে পারবেন। সেদিন আব্বাও কম অভিনয় করেননি, শুয়ে শুয়েই তখনকার শেখ সাদির সময়োপযোগী একটি মূল্যবান কবিতার একাংশ প্রথমে ফার্সিতে পড়ে ইংরেজিতে তার ভাবার্থ ওদের শুনিয়েছেন। তখন অফিসাররা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আসসালামু আলাইকুম বলেই সশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তারা দড়ির একটা বিরাট গোল বান্ডিল আব্বার ঘরে ফেলে রেখে চলে যায়। সম্ভবত তাজউদ্দীন ও অন্যদের বেঁধে নিয়ে যাওয়ার জন্যই দড়িটা তারা এনেছিল। সেই দড়িটা আমি রেখে দিয়েছি। স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস যদি কোনো দিন লেখা হয়, এই দড়িটাও তার এক ক্ষুদ্র স্মারক হয়ে থাকবে।
পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িতে প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টাকাল লঙ্কাকাণ্ড করে যখন চলে যায়, তখন আমরা যেন পাথরের মতো হয়ে গেছি। কেউ একটুও নড়ছি না। কারও মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। খুব সাবধানে চারদিকে চোখ বুলিয়ে আগে দেখলাম কেউ কোথাও আছে কি না। ওপর তলায় আমি ও আতিয়া আর পাশের ঘরে হাবিব সাহেবরা দরজা বন্ধ করে রয়েছেন। নিচে শুধু আমার আব্বা একা। এমন অবস্থায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছিল এক ভয়ংকর উত্তেজনায়। তখন আমাদের করণীয় তো কিছু ছিল না।
অন্যদিকে একই সময় অর্থাৎ নিদারুণ সেই মুহূর্তে সূক্ষ্ম এক বেদনার অনুভূতির জ্বালা অনুভব করছিলাম প্রাণের এক অবচেতন কোণে। আমি এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম আমার অজান্তেই, কী আশ্চর্য মানুষের মন। মনে হচ্ছিল, তাজউদ্দীন আমাকে কিছুই বলে গেল না। কোনো পথের ইঙ্গিতও সে জানাল না। সেই রাত সাড়ে দশটার দিকে তিনি আবদুস সামাদ আজাদ ও মোহাইমেন [এম এ মোহাইমেন, পাইওনিয়ার প্রিন্টিং প্রেসের স্বত্বাধিকারী। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য] সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় এলেন। আমি লক্ষ করলাম, গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন তাজউদ্দীনের মুখমণ্ডল। তিনি আসার পর আরও কয়েকজন এলেন। নূরজাহান মুরশিদও এলেন। এরপর সবাই চলেও গেলেন। তখন তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার কোনো কথা হয়নি। সবাই চলে যাওয়ার পর দেখলাম তিনি বাসার সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন। মনে হচ্ছিল তিনি কোথাও যাবেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও ড. কামাল হোসেন আমাদের বাসায় এলেন। তাঁরা আসার পর তাজউদ্দীন প্রায় ঝড়ের বেগে তাঁদের সঙ্গে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার মুহূর্তে তিনি ছুটে এসে আমার কাছ থেকে থলে ব্যাগটা নিয়ে গূঢ়তত্ত্ব কথা বলে চলে গেলেন। সে সময় মনে হলো তাঁর কথার একটা শব্দ ভেসে এল শুধু, ‘আমি চলে যাচ্ছি, আমি চলে যাচ্ছি।’ কোনো কথাই শেষ মুহূর্তে তাঁর সঙ্গে বলা হয়নি। ভাবছিলাম, তিনি কি আমাকে এভাবে বিপদের মুখে ফেলেই চলে গেলেন! কী করে সম্ভব হতে পারল। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এর উত্তর আমি খুঁজে পেয়েছিলাম। সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকারের প্রশ্ন এমন জ্বলন্ত বাস্তব সত্যের আভায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল সেই মুহূর্তের সিদ্ধান্তে, যার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর চার সন্তান ও স্ত্রী।
২৫ মার্চের নিদারুণ অস্বস্তিকর সে রাত হারিয়ে গেল দানবদের এক মহাতাণ্ডবের মধ্য দিয়ে। মর্টারের গোলা ও মেশিনগানের গুলির শব্দে তখনো চারদিক প্রকম্পিত। সারা রাত রাস্তায় ট্রাক ও জিপে করে মিলিটারিরা সরব ছোটাছুটি আর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য কারফিউ ঘোষণা করেছে। রাত প্রভাত হলো, ভয়ার্ত নিঃস্ব একটি সকাল। অনুভূতিহীন প্রাণে বেঁচে আছি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী হয়ে গেল, আর কী হতে যাচ্ছে, সেই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি দারুণ বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম কীভাবে বাড়ি ছেড়ে পালাব। দেখলাম মিলিটারির আনাগোনা অব্যাহত আছে। সেটি দেখে মনে হলো নিজ বাসায় থাকা এক মুহূর্তও নিরাপদ নয়। তখনো রাতের মতোই থেমে থেমে গোলাগুলি আর মর্টারের শব্দ আকাশ–বাতাস কাঁপিয়ে তুলছিল। আমাদের বাসার দক্ষিণের একতলা বাড়িতে এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক সপরিবার ভাড়া থাকতেন। অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতেই অনেকের মতো তাঁরা দেশের বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁর বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন বয়স্ক এক নারীকে। তিনি সেই বাড়ি দেখাশোনার পাশাপাশি সেখানে এক পাল হাঁস-মুরগি পালতেন।
অন্ধকার কেটে যাওয়ার পর আমি অতি সন্তর্পণে দোতলার পেছনের গোল বারান্দা দিয়ে সেই দক্ষিণের বাড়িতে যাওয়া যায় কি না দেখছিলাম। তখন সকাল ছয়টা হবে। দক্ষিণের বাড়ির ওই বয়স্ক নারীকে দেখলাম। দৈনন্দিন ধারাবাহিক কাজে ব্যস্ত। একটু চাপা আওয়াজে তাঁকে বললাম, ‘একটা টুল দেয়ালের ওপাশে রাখ, আমি তোমাদের বাসায় আসব বাচ্চা দুটোকে নিয়ে।’ উত্তরের আশায় আর থাকতে হলো না। বয়স্ক নারী বললেন, ‘মাগো মা, বাসায় কেউ নাই, আমিই বাইরে থাকি’, এই বলেই তিনি ভেতরে কোথায় যেন মিলিয়ে গেলেন। দুশ্চিন্তায় আমার মন ছেয়ে গেল।
কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু আনমনা ছিলাম। আমাদের উত্তর দিকের বাসায় থাকতেন তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার [বর্তমানে এ নামে কোনো দেশ নেই] এক কূটনীতিক। তিনি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের মার্চের প্রথম সপ্তাহে দেশে পাঠিয়েছিলেন। আমার নজর সে বাড়িতে পড়তেই দেখি সেই যুগোস্লাভিয়ান ভদ্রলোক উঠে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। রাতে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন সব শেষ। তাই আমাকে দেখামাত্র বেশ উত্তেজিত হলেন তিনি। এরপর অতি সাবধানে ইশারায় জানতে চাইলেন, আমি তাঁর আশ্রয় চাই কি না এবং কোনো প্রকারে সেখানে যেতে পারি কি না। কিন্তু সে বাড়িতে যাওয়ার পথে দক্ষিণের বাড়ির কোনার মতো কোনো আড়াল নেই। গেটের সামনে রাস্তায় মিলিটারি পাহারা রয়েছে তখন। ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেয়াল টপকানো একেবারে অসম্ভব। এত বড় ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না। ইশারায় সেটা তাঁকে বোঝালাম।
আর তখনই আমার নজরে পড়ল আমাদের বাড়িতে সানশেডে কী যেন লাগানো রয়েছে। দেড় হাত লম্বা ওয়ারলেসের একটা জিনিস। সেটা দেখে আমি চমকে উঠে সচেতন হলাম। আমার মনে হলো এটা পাকিস্তানি আর্মিরাই লাগিয়ে রেখেছে আমাদের গতিবিধি নজরদারি করার জন্য।
এর মধ্যে আমি আমাদের গৃহকর্মী দিদারকে দিয়ে নিচতলার দেয়ালে টাঙানো আমার সব ছবি সরিয়েছি। কে জানে যদি কোনো মিলিটারি চ্যালেঞ্জ করে বসে। এই সময় হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে আমরা আবার কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ভাবলাম, এবার বুঝি সব শেষ। বেলের শব্দে আমার আব্বা ঘরের বাইরে গেলেন। দেখলাম কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাঁকে ছাদ থেকে শোকচিহ্নের কালো পতাকা নামিয়ে ফেলতে এবং পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়াতে বলছেন। আব্বা অতি নম্রভাবে তাদের কথায় রাজি হয়ে তখনই সে কাজগুলো করলেন। এরপর তারা চলে গেল। সকাল তখন আটটা। দিদারকে ট্রে হাতে দোতলায় নাশতা নিয়ে আসতে দেখে উর্দুতেই তাকে বকলাম চাপা গলায়। নিচতলা থেকে আব্বা এসব খাবার পাঠিয়েছেন আমাদের জন্য। আমরা তো তখন ভাড়াটে ভান করে রয়েছি। নিচ থেকে এত আনাগোনা হলে ধরা পড়ে যাওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা।
নাশতা টেবিলের ওপরই থাকল পড়ে। আমি, মিমি, আতিয়া এবং তার গত রাতের মেহমান হাবিব ভাই ও তাঁর স্ত্রী, আমরা টেবিলের চারদিকে বসে আছি স্তব্ধ হয়ে। খাবার পড়ে আছে টেবিলে। কিন্তু কে খায়। গলা দিয়ে নামার পথও যেন বন্ধ। রেডিওটা টেবিলের ওপরেই ছিল। ঢাকা সেন্টার খুলে দেখি বন্ধ। একটু পর এক উর্দুওয়ালার বিকৃতভাবে উচ্চারিত বাংলা দু-একটা খবরেই বুঝলাম, কোনো বাঙালি যায়নি। উর্দুওয়ালা বিকৃত বাংলায় সংবাদ পরিবেশ করছে। হায়, তবে কি সব মেরে শেষ করে ফেলেছে? আতিয়াও উদ্বিগ্ন। গত রাতে তার স্বামী আজিজকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। আমার দুই ভাগনে ও বারিক মিঞাকে নিয়েছে।
তাঁদের হয়তো রাতেই শেষ করে ফেলেছে। চিন্তায় বাধা পেলাম আতিয়ার প্রশ্নে। সে বলল, ভাবি, আজিজ ফিরে আসবে কখন? ওদের তো কোনো দোষ নেই, কেন ধরে নিয়ে গেল? কারফিউ এখনই উঠে যাবে তো? এতগুলো প্রশ্ন একসঙ্গে করে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল আতিয়া।
আতিয়ার প্রশ্নে আমি আমার মনের ভাব গোপন রেখে উত্তর দিলাম, ভেবো না আতিয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারফিউ উঠে যাবে হয়তো। তখন আজিজ ভাই ফিরে আসবেন, তাকে এই উত্তর দিলাম বটে। কিন্তু ভাবছি, কোথায় মাহমুদ-তোফাজ্জল (ভাগনেরা), কোথায় আজিজ ভাই। হায়রে হতভাগারা। বাড়িতে থাকার পরিণাম তাদের এই হলো। এরপর আতিয়া আমার কথায় সান্ত্বনা পেয়ে চাপা গলায় তাগাদা দিল নাশতা খেয়ে নিতে। ওর তাগাদা উপেক্ষা করা গেল না, কিছু একটু মুখে দিতেই হবে, তাই টেবিলের দিকে দৃষ্টি ও মন ফেরালাম। সেদিন সেই মুহূর্তে এমন উত্তেজনার মধ্যেও এক ঝিলিক হাসির বিনিময় হয়ে গেল আতিয়া ও আমার মধ্যে। আমরা বিস্ময়াহত হয়ে দুজনেই দেখি আব্বা নিচতলা থেকে নাশতা পাঠিয়েছেন এত দুর্যোগের মধ্যেও। টেবিলভর্তি খাবার। গত রাতে আমার এক ভাগনের ছেলের আকিকায় নিমন্ত্রণ ছিল আমাদের সবার। আমরা না যাওয়াতে সে বেচারা বিরিয়ানি, কোরমা, চপ, দই অনেক কিছুই পাঠিয়েছিল। রাতে আমরা কেউই খাইনি। তাজউদ্দীনের খাবারও টেবিলের ওপর রাখা ছিল। এরপরই তো সব ভোজরাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। আব্বা সেসব খাবার সকালে গরম করে যত্নের সঙ্গে সাজিয়ে ওপরে পাঠিয়েছেন। একটা দীর্ঘনিশ্বাস আমার অলক্ষ্যেই বুক চিরে যেন বেরিয়ে এল। আমার আব্বা কত নিশ্চিন্ত। এক আধ্যাত্মিক শক্তিতেই তিনি হয়তো পরিচালিত হচ্ছেন।
রেডিওটা টেবিলের ওপরই ছিল। ঢাকার সেন্টার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রেডিওর নব ঘুরিয়ে কলকাতার সেন্টারে দিয়ে রেখেছিলাম। সেখানে একখানা কী গান যেন হচ্ছিল। পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেল। ঘোষকের গম্ভীর গলা শুনতে পেলাম—পূর্ব বাংলায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে...ভয় নেই ভাই, ভারত আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। তারা জেনে গেছে সব সত্যিকার ঘটনা। যদিও সংবাদ বলছে গৃহযুদ্ধের কথা, কিন্তু তা কোন যুদ্ধের শুরু, তা ওরা ভালো করেই জানে। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পাশে বসা হাবিব ভাইকে কথাগুলো বললাম। এই যে নৃশংসভাবে বিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে ট্যাংক, মর্টার, মেশিনগান নিয়ে পাকিস্তানিরা আলোচনার আড়ালে এবং তার ব্যর্থতার কিছুমাত্র পূর্বাভাস না দিয়ে ঘুমন্ত নিরস্ত্র নাগরিকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, এমন মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের ঘটনা শুধু ভারত কেন, কেউ মেনে নেবে না। ক্রমে সারা বিশ্বে এটা ছড়িয়ে পড়বেই দেখে নিয়ো।
এমনি অবস্থায় সময় কেটে যাচ্ছিল। শহরজুড়ে রাতের মতো তখনো থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টারের গোলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই শব্দ আকাশ–বাতাস কাঁপিয়ে তুলছিল। এমন সময় নিচে বেশ কয়েকজনের ভারী গলার শব্দ পেলাম। তাদের পাকিস্তানি সেনাই মনে হলো।
মনে হলো তারা আব্বার সঙ্গে কথা বলছে। তখন আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। সারা শরীর মনে হচ্ছে অবশ। আমার মনে ভীতি, নিচতলার ঘরগুলোতে আমার ছবি ঝোলানো রয়েছে। যেকোনো সময় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে আমার ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। আব্বা বুড়ো মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলেন। একটু পর মনে হলো ওরা চলে গেছে।
আতিয়ার বসার ঘরেই নিঃশব্দে আমি, আতিয়া, হাবিব ভাই ও তাঁর স্ত্রী বসেছিলাম। হাবিব ভাই ও তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রীর চোখেমুখে আতঙ্ক। তাঁরা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। ঘরে বসে থেকেও জানালা পথে আমার দৃষ্টি যেন চলে গিয়েছিল বহুদূরে কোথাও। তখন আমি আচ্ছন্ন হয়েছিলাম একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার মধ্যে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তাজউদ্দীন দুর্গম পথে যাত্রা শুরু করেছেন, সে যাত্রা কতটুকু সফল হবে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার শক্তি ও সাহস তাঁর অটুট থাকবে কি।
আমার বড় দুই মেয়ের কথা চিন্তাও করিনি তখন। ভেবেছিলাম, ওরা নির্বিঘ্নেই রয়েছে তাঁতীবাজারে আমার বোনের বাসায়। কিন্তু জানতাম না, সেখানেও চারদিকে আগুন জ্বলছে, গোলাগুলি চলছে অবিরাম। আমার বোন ও বাচ্চারা এক বিভীষিকার মধ্যে অবস্থান করছে। সে কথা পরে জানতে পেরেছিলাম।
অনেক ঘটনার মধ্যেই দুপুর গড়িয়ে গেল। বিকেল সাড়ে চারটা হবে, তখন সমস্ত মনেপ্রাণে একটা ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। মনে ভাবনা এল, আর নয়। যে করেই হোক এখান থেকে আমাকে পালাতে হবে। কারফিউর মধ্যেই ঝুঁকি নিলাম বাসার পেছনের দেয়াল টপকিয়ে পালানোর। রাতে পাকিস্তানি সেনাদের ধোঁকা দিতে পেরেছি। আজও যে সম্ভব হবে, সেটা হলফ করে বলা যায় না। সেই মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প কোনো ব্যবস্থা আমার জানার মধ্যে ছিল না। এরপর সবকিছুই পড়ে থাকল পেছনে। আমি ছোট মেয়ে মিমির হাত ধরে ও ছেলেটিকে কোলে নিয়ে দ্রুত ও সন্তর্পণে নিচতলায় নেমে এলাম। নেমে প্রথমেই দৃষ্টিতে পড়ল আব্বা বসে আছেন ভেতরের এক বারান্দায়। উদাস তাঁর দৃষ্টি। আমি তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে অনুচ্চ স্বরে বললাম, ‘আব্বা, আমি পালাচ্ছি পেছনের দেয়াল টপকে, দোয়া করবেন।’ আব্বা বললেন, ‘লিলি যাসনে, কারফিউ যে চলছে! মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবি।’ আব্বার কথা শেষ হয়নি, তিনি আরও কী যেন বলছিলেন। আমি ততক্ষণে দেয়ালের কাছে গিয়ে পৌঁছেছি। পেছন ফিরে আব্বাকে দেখার সাহস আমার আর হয়নি। পাছে মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে পড়ি। তখন কিছুই আমাকে ধরে রাখতে পারছিল না। আব্বার মিনতিভরা পিছু ডাক, বাড়িঘর, আসবাব—সবকিছুই অতি তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। একটি সিদ্ধান্তের অনুভূতিই আমাকে চালিত করছিল। শুধুই মনে হচ্ছিল পালাতে হবে, বাঁচতে হবে আর কাজ করতে হবে অনেক।
এই ভাবনা থেকে আমি আমাদের বাসা থেকে কীভাবে পালানো যায়, সে চিন্তা করতে করতে বাসায় পেছন দিকে চলে গেলাম। পেছন দিকে আশপাশের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। এর আগে ভোরে প্রথম যে বাড়িতে যেতে চেয়েছিলাম, সে বাড়িতে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তখন পেছনের দেয়াল টপকে যাঁর বাড়িতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম, তিনি এক অতি ভদ্র ও অমায়িক ব্যক্তি। সিলেটে তাঁর বাড়ি। ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। কিন্তু আমাকে দেখামাত্র তিনি, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ছুটে এসে উঁচু দেয়াল থেকে আমার ছেলে সোহেল ও মেয়ে মিমিকে কোলে তুলে নিলেন। ভদ্রলোক শুধু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমিই মিসেস তাজউদ্দীন কি না। অতি দুর্যোগ মুহূর্তেও এমন আশ্রয় দান, তার মূল্যটুকু সেদিন মহামূল্যবানই মনে হয়েছিল আমার। তাঁদের ব্যবহারে আমি কিছুক্ষণের জন্য হলেও তখন কেমন জানি তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। যেন কিছুই হয়নি। স্বাভাবিক নিশ্চিত একটি পরিবেশই যেন বিরাজ করছে চারদিকে। নিদারুণ মর্মান্তিক বিপদের ঝুঁকি দূরে ঠেলে ফেলে মানবতাবোধ দেখিয়েছেন তাঁরা।
ধানমন্ডি ১৩ নম্বর রোডে আমার বড় ভাই কিবরিয়া থাকতেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাণ্ডব শুরু হওয়ার পর রাত দুইটায় যখন মর্টার–মেশিনগানের গোলাগুলির তীব্র শব্দে আকাশ–বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় বড় ভাইয়ের বাসায় শোবার ঘরের জানালায় কে যেন ঠকঠক করে করাঘাত করছিল। আমার ভাই তখন অন্ধকার ঘর থেকে পর্দা তুলে কাচের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে পান উনিশ–কুড়ি বছর বয়সের একটি ছেলে চারদিকে সজাগ ও সতর্ক দৃষ্টি ফেলে কাচের জানালায় টোকা দিচ্ছে। তিনি তখন জানালার ধারে এসে ছেলেটির পরিচয় ও কী প্রয়োজন জানতে চাওয়ার আগেই ছেলেটি শান্ত ও দ্রুত কণ্ঠে বলে, আপনি কি রিপির বড় মামা? আমার বড় ভাই হ্যাঁ বলায় ছেলেটি তাকে বলে, ‘তাজউদ্দীন ভাই ধরা পড়েননি। তিনি বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। আমি তাঁর বাড়ির উল্টো দিকে ২১ নম্বর রোডের বাড়িতে ছিলাম। তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাড়িতে ভীষণ গোলাগুলি হয়েছে। পাকিস্তানি আর্মিরা বোধ হয় আপনার বোনকে মেরে ফেলেছে, আপনি খোঁজ নেবেন সকালে, আমি চললাম।’ বড় ভাই নাকি তখন তাকে বলেছেন, ‘আরে শোনো, তুমি কোথায় যাচ্ছ? এত রাতে এই প্রচণ্ড গোলাগুলির ভেতর তুমি আমার এখানে কী করে এলে?’ কিন্তু ছেলেটি দাঁড়ায়নি। যেতে যেতে ছেলেটি বলেছে, একটার পর একটা বাড়ির দেয়াল টপকে এখানে এসেছি। আর কথা নয়, আমাকে রাত তিনটার আগেই জগন্নাথ হল ও ইকবাল হলে [বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল] যেতে হবে। এই বলেই সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। এরপর আমার ভাই স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকেছেন। আর মনে মনে ভেবেছেন, কোন মায়ের এই দুঃসাহসী দুরন্ত ছেলে, যে নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে এমন দুর্যোগপূর্ণ রাতে বেরিয়েছে আদর্শের অগ্নিপথে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপন কর্তব্য পালনে? পরে ভাইয়ের মুখে তার কথা শুনে আমিও সে কথা ভেবেছি। সেই ছেলেটির পরিচয় আমাদের কাছে আজও অজ্ঞাত। আজ সে কোথায় আছে এবং আদৌ বেঁচে আছে কি না, জানি না। সে রাতের অগণিত মৃত্যুর ভিড়ে হয়তো সে–ও হয়েছিল সহযাত্রী, যে খবর চিরকালের জন্যই থেকে গেল অজ্ঞাত।
২৭ মার্চ সকালে আটটায় কারফিউ তুলে নেওয়া হলো। দুই ঘণ্টার বিরতি। দারুণ উৎকণ্ঠায় দুদিন কাটানোর পর কারফিউ উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বড় ভাই তাঁর লাল গাড়িখানা নিয়ে আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে দুবার পাকিস্তানি সেনারা তাঁর গাড়ি থামিয়ে তাঁকে রাস্তার ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য করেছে। তিনি বিনা প্রতিবাদে তাদের নির্দেশ পালন করে রেহাই পেয়েছেন।
এরপর নানা চিন্তায় আচ্ছন্ন আমার ভাই বেরিয়েছিলেন আমার সন্ধানে। আমাকে বাড়িতে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেন আশপাশে। খুঁজতে খুঁজতে তিনি আমার খোঁজ পান। আমি যেখানে ছিলাম, সেখানে তিনি হাজির হন। বড় ভাই আমাকে বললেন তাঁর সঙ্গে যেতে। কোথায় যেতে হবে, কোথায় থাকব কিছুই তখন জানি না। আমার আশ্রয়দাতা সিলেটের সেই ভদ্রলোকের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। ভাই আমাকে তাঁর বাড়িতেই নিয়ে গেলেন। আপাতত তাঁর বাড়িতেই থাকতে বললেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে যখন রওনা হয়েছিলাম, তখন বোধ হয় ১০টা বাজে।
সেদিন সকালে কারফিউ উঠে যাওয়ার পর থেকে আমিও ভাবছিলাম অন্য কোথাও চলে যেতে। সেদিন সেখানে থাকাটাও নিরাপদ মনে করিনি। আমি ভাবছিলাম আবার কারফিউর আগেই অন্য কোথাও সরে পড়া যায় কি না। এমন সময় আমার বড় ভাই ওখানে এসেছিলেন।
ওদিকে তাজউদ্দীন সেই ২৫ মার্চ রাতে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামসহ লালমাটিয়া পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। ওখানে তাঁরা একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁরা আটকা পড়েছিলেন। পরদিন ছিল কারফিউ। ২৭ মার্চ কারফিউ উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমীর উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। সাত মসজিদ সড়ক অতিক্রম করে তাঁরা রায়েরবাজার হয়ে জিঞ্জিরায় চলে যান। এ ঘটনা অবশ্য আমি তখন জানতাম না। পরে তাঁর কাছেই শুনেছিলাম। রায়েরবাজার অতিক্রম করার সময় তিনি থমকে দাঁড়িয়ে একবার আমাদের খোঁজ নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, আমরা হয়তো বাড়ি থেকে বের হতে পারিনি। কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টিয়েছেন। তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অবিচল আস্থায়, যে আস্থায় সেই ক্ষণিকের ভাবনার মৃত্যু ঘটেছিল। মনে মনে চিন্তা করেছেন, যদি ওরা (মানে আমরা) বেঁচে থাকে, যেকোনোভাবে সরে পড়ার ব্যবস্থা করে নেবে। যদি পাকিস্তানি সেনারা তাদের মেরে ফেলে থাকে, তবে কিছুই করণীয় নেই। বরং অদৃশ্য থেকে বিশাল কর্তব্যের যে ডাক এসেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির প্রশ্নে মুক্তির আহ্বানে আপন ব্যক্তিস্বার্থের সেখানে চিরসমাধি হয়ে গেছে।
২৭ মার্চ বেলা ১১টায় ভাইয়ের বাসায় আমি উদ্গ্রীব হয়ে বসেছিলাম। জানার চেষ্টা করছিলাম আমার বড় বোনের অবস্থা। সেখানে আমার বড় দুই মেয়ে ছিল। ভাবছিলাম, আমার দুই মেয়ে, বড় বোন এবং তার বাচ্চারা বেঁচে আছে কি না। এমন সময় মুসা সাহেব নামে একজন বড় ভাইয়ের বাসায় এলেন। তিনি আমাকে সাদা কাগজের একটি চিরকুট দিলেন। চিরকুটটি খুলতেই অতিপরিচিত হাতের লেখা আর কয়েকটি লাইন চোখে পড়ল। চিরকুটটি তাজউদ্দীনের লেখা, স্পন্দিত হৃদয়ে রুদ্ধশ্বাসে আমি সেটি পড়ে ফেললাম। তাতে যা লেখা ছিল, ‘লিলি আমি চলে গেলাম, আসবার সময় কিছুই বলে আসতে পরিনি। মাফ করে দিও। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। আবার কবে দেখা হবে জানি না,…মুক্তির পর।’
কতক্ষণ যে কাগজটি হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। সেদিনের সেই মুহূর্তে এ কথা কয়টি শুধু কথার কথাই ছিল না, জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করার জন্য সেই লেখাগুলো ছিল এক পবিত্র প্রেরণার উৎস। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে নতুনরূপে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন। এরপর ফিরে পেলাম এক নতুন সত্তা। শুরু হলো অবিস্মরণীয় মহান যাত্রা। (সংক্ষেপিত)
অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি উদয়ের পথে থেকে
জোহরা তাজউদ্দীন তাজউদ্দীন আহমদের সহধর্মিনী, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য।