বিজ্ঞাপন
default-image

মার্চের শেষের দিকে সারা বাংলাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়, বিভিন্ন কারণে এটিকে একক নেতৃত্বের অধীন সংগঠিত করা যাচ্ছিল না। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি বাংলাদেশ বাহিনী গঠিত হলেও মাঠপর্যায়ের যুদ্ধে কেন্দ্রের কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব কাগজ-কলমের মধ্যেই সীমিত থেকে যায়।

প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠা প্রতিরোধযুদ্ধ অনেকটা স্থিমিত হতে থাকে। একক নেতৃত্ব, ভারী অস্ত্র, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা ইত্যাদির অভাবে সশস্ত্র যুদ্ধের ধার কমতে থাকে এবং একপর্যায়ে প্রায় গতিহীন হয়ে পড়ে।

স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তারা বাংলাদেশকে কয়েকটি সামরিক অঞ্চলে ভাগ করেন। জুন মাসের মধ্যে ধীরে ধীরে অঞ্চলের সংখ্যা চার থেকে নয়টিতে পৌঁছায়। অঞ্চল কমান্ডাররা নিজেরাই অঞ্চলের সীমা নির্ধারণ করে নেন। অঞ্চলের কোনো সুনির্দিষ্ট নাম না থাকলেও যে এলাকায় তাঁরা কর্মরত ছিলেন, সেই এলাকার নামে পরিচিত ছিল, যেমন: চট্টগ্রাম অঞ্চল, সিলেট অঞ্চল, রাজশাহী অঞ্চল ইত্যাদি। বাংলাদেশ বাহিনী সদরদপ্তর এতে সম্মতি দান করে। ভারতীয় বাহিনী গড়ে ওঠা অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য আটটি সেক্টর গঠন করে, এগুলোর নাম ছিল ইংরেজি অক্ষরের ক্রমানুসারে যেমন এ, বি, সি, ডি, ই, ই(১), এফ, জে সেক্টর। জুন মাস থেকে বাংলাদেশ বাহিনীর অঞ্চলগুলো সেক্টর হিসেবে পরিচিতি পায়।

নিজস্ব বেতারযন্ত্র না থাকায় অঞ্চলগুলো সংশ্লিষ্ট ভারতীয় সেক্টরের মাধ্যমে বাংলাদেশ বাহিনীর সদরদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করত। ফলে অঞ্চলগুলোর ওপর কেন্দ্রের কার্যকর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল না, প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অঞ্চলসমূহ কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এ ছাড়া অঞ্চলসমূহ নিজেদের মধ্যেও সমন্বয় করতে পারছিল না।

মুক্তিবাহিনীর জন্য নতুন যোদ্ধা সংগ্রহ, তাঁদের প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে অঞ্চল ও বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে অঞ্চলসমূহের যোগাযোগ, লেনদেন ইত্যাদি বিষয় স্বচ্ছ না থাকায় মাঝে মাঝেই ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছিল।

বাংলাদেশ বাহিনীর অধীনস্থ অঞ্চলসমূহে বেশ কিছু সশস্ত্র দল বা বাহিনী গজিয়ে উঠতে থাকে বা তৎপর দেখা যায়। এসব বাহিনী অঞ্চলের সঙ্গে তাদের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কোনো সমন্বয় করত না। এদের অনেকে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশও অমান্য করতে থাকে।

সব মিলিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী, অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা, অবিশ্বাস ইত্যাদি বাড়তে থাকে। সমন্বয় ও নীতিমালার অভাবে আন্তঅঞ্চল সম্পর্কের মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা শুরু হয়।

যেকোনো যুদ্ধের সাফল্য নির্ভর করে মূলত কার্যকর আদেশ-নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্রসম্ভার প্রাপ্তির ওপর। স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর তিন মাস গত হওয়ার পরও ভারতীয় বাহিনী বা অন্য কোনো জায়গা থেকে প্রত্যাশিত অস্ত্রশস্ত্র এবং লজিস্টিক না পাওয়ায় যুদ্ধপরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল।

এপ্রিল ও মে মাসের মধ্যে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে গোলন্দাজ ও সাঁজোয়াসহ পাঁচটি সামরিক ডিভিশন মোতায়েন করতে সক্ষম হয়। প্রাথমিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পর মে মাসের মধ্যে হানাদার বাহিনী নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি করে এবং ধীরগতিতে সারা বাংলায় তাদের দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

এ রকম একটা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য সশস্ত্র যুদ্ধের নীতিমালা, বিভিন্ন সেক্টরের সীমানা ও নেতা নির্ধারণ, যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ও অন্যান্য সমরসম্ভার সংগ্রহ, সর্বোপরি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে।

বিষটি জুন মাসের মন্ত্রিসভায় আলোচিত হয়। সিদ্ধান্ত হয়যে সেক্টর কমান্ডার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভার আয়োজন করা হবে। সভার তারিখ নির্ধারিত হয় ১১ থেকে ১৫ জুলাই।

১২ ডিসেম্বর, ২০১১, ঢাকা

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত