পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার মার্শাল (অব) এম. আসগর খানের বই উই হ্যাভ লার্নট নাথিং ফ্রম হিস্ট্রি: পাকিস্তান—পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি পাওয়ার সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অক্সফোর্ড, করাচি থেকে। বাংলাদেশে বইটি শীঘ্রই প্রকাশ করবে ইউপিএল, ঢাকা। একাত্তরের অনেক তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনায় বইটির লেখক নিজে একটা চরিত্র, অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তার বইয়ের ‘হাউ বাংলাদেশ ওয়াজ বর্ন’ অধ্যায়ে সেসব অভিজ্ঞতার বর্ণনা আছে। অনুবাদ করেছেন কাজী আলিম-উজ-জামান
যে মুসলিম লীগের ওপর ছিল বাঙালির অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস, স্বাধীনতার সাত বছরের মাথায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তা হারিয়ে গেল। পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের আকস্মিক ও বিস্ময়কর এই বিজয় পাকিস্তানি শাসকরা মেনে নিতে চাইল না। তারা বেছে নিল চিরাচরিত সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্র—ভাগ করো এবং শাসন করো। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও এ কে ফজলুল হককে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হলো। ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫৮-র অক্টোবরে সামরিক আইন জারি হওয়ায় নির্বাচন বাতিল হয়ে গেল।
সামরিক শাসকের অধীনে নির্দলীয় নির্বাচন হলো, আর হলো মৌলিক গণতন্ত্রের নামে তামাশা। তথাকথিত এই মৌলিক ‘গণতন্ত্র’ প্রক্রিয়ায় সোহরাওয়ার্দীর মতো প্রখ্যাত রাজনীতিবিদরা লড়ার অযোগ্য ঘোষিত হলেন। ১৯৬৫ সালেও সেই একই ধারার পুনরাবৃত্তি—মৌলিক গণতন্ত্র! ওই বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট কারচুপির প্রতিবাদে সম্মিলিত বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাবতে পারেননি তার এত বিপুল বিজয় হবে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে দুটি বাদে সব কটি পেলেন। এতে তার ছয় দফা দাবিতে দরকষাকষির সুযোগ বাড়ল। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো পেলেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জাতীয় সংসদে পাঞ্জাবে ৮২টি আসনের মধ্যে ৬২টি, সিন্ধুর ২৭টির মধ্যে ১৮টি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ২৫টির মধ্যে একটি আসন পেলেন ভুট্টো। তবে ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) বেলুচিস্তানে কোনো আসন পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানেও কোনো আসন পায়নি পিপিপি। সেখানে দলের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে ভুট্টো কোনো পদক্ষেপ নেননি।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছে হেরে গিয়েও বিরোধীদলীয় নেতার আসনে বসতে আগ্রহী ছিলেন না ভুট্টো। নির্বাচনের ফলাফল বেরোনোর কয়েকদিন পরেই বললেন, পাকিস্তানে তিনটি শক্তি আছে—সশস্ত্র বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টি। তাই পাকিস্তানের জন্য দরকার দুজন প্রধানমন্ত্রী। একজন পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, আরেকজন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। ভুট্টোর এই অবস্থান ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফার খুবই কাছাকাছি। তাদের এই অবস্থান একক পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার প্রত্যাশাকে পিছিয়ে দিল।
নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি ঢাকা সফরে যান। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল এস এম আহসানের মাধ্যমে ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৭১-এর ১২ জানুয়ারি ঢাকায় এসেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গভর্নর আহসানকে বললেন, শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট হাউসে তলব করতে। সেখানে ইয়াহিয়া তার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। শেখ মুজিবের আসার আগেই আহসান সেখানে হাজির হন। ইয়াহিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেন, ছয় দফার সবগুলো তার জানা আছে কি না। আহসান বললেন, তাদের সব জানা আছে। সবাই অপেক্ষা করছিল মুজিবের জন্য। মুজিব এলেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার আন্তরিক পরিবেশে বৈঠক হলো। ইয়াহিয়া মুজিবকে ছয় দফা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে বললেন। মুজিব করলেন।
মুজিব ইয়াহিয়াকে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশনের ভাষণে তিনি নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়াকেই দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার আহ্বান জানাবেন। তার এ কথায় চট করে উঠে দাঁড়িয়ে ইয়াহিয়া বললেন, মুজিব যদি এ প্রস্তাব আনে তবে তিনি তার ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ প্রয়োগ করবেন এবং এটি প্রত্যাখ্যান করবেন। ইয়াহিয়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমাকে কেন প্রেসিডেন্ট হতে বলছেন?’ জবাবে মুজিব বললেন, তিনি এবং তার দল মনে করে, এটাই হতে পারে সবচেয়ে সঠিক সমাধান। ইয়াহিয়া এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
পরদিন ইসলামাবাদের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগের আগে বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে।’
কিন্তু এই আনন্দ উন্মাদনা’ বেশি দিন টিকল না। ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ অনেকেই চাননি শেখ মুজিবের কাছে এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক। বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো একদমই চাননি। ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে কোনো ধরনের নিষ্পত্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি।
কয়েকদিন পর ভুট্টো তার পারিষদ নিয়ে ঢাকায় এসে মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করলেন। আন্তরিক পরিবেশে তাদের বৈঠক হলেও কার্যকর কোনো অগ্রগতি কিন্তু হলো না। যদিও সেটা বিস্ময়করও ছিল না। ঢাকা থেকে ফিরে ভুট্টো সব সময় ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। লারকানায় ইয়াহিয়া ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেনারেল হামিদ ও জেনারেল পীরজাদাকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়ে বিপুলভাবে আপ্যায়িত করেন ভুট্টো। এ সময় তারা সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেন মুজিব তার আচরণ পরিবর্তন না করলে পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনী নামানো হবে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রাওয়ালপিন্ডিতে সামরিক জান্তার প্রতিনিধিদের সভায় এই সিদ্ধান্ত পুনরায় অনুমোদন করা হয়।
সত্তরের মাঝামাঝি এক আলাপচারিতায় ইয়াহিয়া আমাকে বলেন, ‘ভুট্টো তাকে বলেছেন নির্বাচন ভুলে যেতে। কারণ আমি সেনাবাহিনীর লোক, আর তিনি রাজনীতিবিদ। এই দুয়ে মিলে একটি ভালো টিম হতে পারে। আর এই টিমই তো পারে দেশের নেতৃত্ব দিতে।’ ইয়াহিয়া খান আমাকে আবার বললেন, তিনি এ বিষয়ে ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে তার প্রস্তাব কী? জবাবে ভুট্টো বলেন, ‘পূব পাকিস্তান কোনো সমস্যা নয়। সেখানকার হাজার বিশেক লোককে হত্যা করতে হবে। তাহলে সব ল্যাটা চুকে যাবে।’ তখন আমি ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এ বিষয়ে তার মতামত কী? তিনি বললেন, ‘এ ধরনের প্রস্তাবের ব্যাপারে কী বলার থাকতে পারে!’
এদিকে শেখ মুজিবের কাছে খবর পৌঁছাল, ইয়াহিয়া খান লারকানায় আছেন। তিনি বুঝতে পারলেন তাকে ঘিরে কোনো ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যে মুজিব ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে একটু নমনীয় ছিলেন, বিজয়ের পরে তার অবস্থান হলো কঠোর।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় পার্লামেন্টের অধিবেশন ডাকলেন। কিন্তু ২৮ ফেব্রুয়ারি লাহোরে এক সভায় ভুট্টো ঘোষণা করলেন, তার দলের কোনো এমএলএ যদি ঢাকায় অধিবেশনে যোগ দিতে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন, তাহলে তিনি তার ঠ্যাং ভেঙে দেবেন। পরদিন ইয়াহিয়া আকস্মিকভাবে অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়া ঘোষণা দিলেন, পার্লামেন্টের অধিবেশন হবে ২৫ মার্চ। তার উদ্দেশ্য ছিল, এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রধান দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য কমিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। কিন্তু ততদিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। বাঙালিদের কাছে ইয়াহিয়া ও তার প্রশাসনের যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তা আর থাকল না।
অসফল মধ্যস্থতা
এই অবস্থায় ১৯৭১-এর মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকা যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি ভুট্টোর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বললাম, ঢাকা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। ভুট্টো আমাকে সময় দিতে রাজি হলেন। সেই অনুযায়ী আমি করাচি গেলাম। কিন্তু তার এক সহযোগী আমাকে হতাশ করে বললেন, ‘চেয়ারম্যান ব্যস্ত আছেন। তিনি দেখা করতে পারবেন না।’
আমি ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় সপ্তাহব্যাপী অবস্থানকালে আমি শেখ মুজিবের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করি। একটা বাদে বাকি সবগুলো বৈঠকে কেবল আমরা দুজনেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে কথা বলি। মুজিব নিশ্চিত ছিলেন, ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দমাতে সেনাবাহিনী ব্যবহার করবেন।
মুজিব আমাকে বলেন, তিনিও পাকিস্তানি ছিলেন। পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন। পাকিস্তানে পতাকা হাতে নিয়ে ‘বন কর রহেগা পাকিস্তান’ স্নোগান দিতে দিতে কলকাতা থেকে দিল্লি গেছেন। তখন কোথায় ছিলেন ইয়াহিয়া আর ভুট্টো? মুজিব ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে বলেন, বাঙালিকে কখনো বিশ্বাস করা হয়নি। তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা মানুষের সঙ্গে কেউ করে না।
ইয়াহিয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি কেন রাওয়ালপিন্ডি গেলেন না, আমি তাকে এ প্রশ্ন করাতে তিনি বললেন, নতুন সংবিধানের খসড়া তৈরি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আর তার সমর্থকরা এই পরিস্থিতিতে তাকে সেখানে যেতে দিতে চায়নি। যদিও মুজিব বলেননি, তারপরও আমার মনে হয়েছে, তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বিশ্বাস করেছিলেন তিনি রাওয়ালপিন্ডি গেলে তাকে হত্যা করা হতে পারে।
আগামী দিনগুলোতে কী ঘটবে সে সম্পর্কে মুজিবের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি জানতেন, ঢাকায় প্রথমে ইয়াহিয়া আসবেন। তারপরে আসবেন পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান এমএম আহমেদ। তারপরে আসবেন ভুট্টো। ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীকে অভিযান শুরু করার নির্দেশ দেবেন। নিজের সম্পর্কে তার ধারণা ছিল, তাকে বন্দী করা হবে। তা না হলে তিনি নিহত হবেন হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বারা, না হলে নিজ জনগণের দ্বারা। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, মুজিব যা ভেবেছিলেন, পরবর্তী দিনগুলোতে তাই-ই ঘটতে লাগল।
তখন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর মুজিবের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ। তার আহ্বানে ধর্মঘটে অচল হয়ে গেল ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তান। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে ৭ মার্চ ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে মহাসমাবেশে ভাষণ দিলেন মুজিব। সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল এই মহাসমাবেশ থেকে মুজিব ‘বাংলাদেশে’র স্বাধীনতা ঘোষণা দেবেন। ৭ মার্চের মহাসমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য ভোর থেকে মানুষ ঢাকার রাজপথে জড়ো হতে লাগল। এই সভা শুরু হলো বিকেলে। বিকেলে রেসকোর্স পরিণত হলো জনসমুদ্রে। তাদের অনেকেরই হাতে ছিল লাঠি। ১৮ মিনিটের ভাষণে তিনি অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানালেন। মুজিব বললেন, ২৫ মার্চ সংসদের অধিবেশন বসার আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
কিন্তু এ দাবির ব্যাপারে ইয়াহিয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। ভুট্টোও তার অবস্থানে অনড় থাকলেন। ১৪ মার্চ ইয়াহিয়ার গোপনে ঢাকায় আসার আগে ভুট্টো এক বিবৃতিতে বললেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দাবি মেনে সাংবিধানিক কোনো নিষ্পত্তির আগে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হয়, তাহলে এটা করতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে। পরদিন আরেক বিবৃতিতে ভুট্টো বললেন, পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে যেহেতু ভূখণ্ডগত দূরত্ব রয়েছে, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসনের বিষয়টি ধোপে টেকে না।
যেহেতু পরিস্থিতি ছিল গুরুতর, আমি আশা করেছিলাম ইয়াহিয়ার অবস্থান হবে ইতিবাচক। চেয়েছিলাম জনমতের চাপটা তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন। তবে এই মতটা যদি পাঞ্জাবে হতো, তাহলে সঠিক হতো। পাঞ্জাব-নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইয়াহিয়া। তিনি আবার ভুট্টোর কাছ থেকে চাপের মধ্যে পড়লেন। কারণ ভুট্টো পাঞ্জাবের নির্বাচিত প্রধান। তবে যদি ইয়াহিয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা না-ও থাকে, তবু তিনি পাঞ্জাবের অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারেন না। আমি মুজিবকে পরামর্শ দিলাম পাঞ্জাব সফর করতে। আমি আশাবাদী ছিলাম মুজিব পাঞ্জাব সফর করলে জনসমর্থন তার পক্ষে নিতে পারবেন। এবং সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হবে। আমি তাকে বললাম, তার এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আছে পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেওয়ার এবং তার এই অধিকার পরিত্যাগ করা উচিত নয়। তাহলে পাকিস্তানও রক্ষা পাবে আর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও তাদের অধিকার পাবে। কিন্তু তিনি (মুজিব) মনে করলেন এসব করার জন্য সময় অনেক দেরি হয়ে গেছে।
১১ মার্চ করাচিতে সাংবাদিকদের উদ্দেশে এক বক্তৃতায় আমি বললাম, পাকিস্তান রক্ষার জন্য আর কয়েকটি দিন মাত্র সময় আছে। আমি বললাম, ঢাকায় যদি একটা বুলেট ছোড়া হয় এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয়, তাহলে পাকিস্তান ধ্বংস হবে। ১৯ মার্চ মুলতানে ডিস্ট্রিক্ট বার অ্যাসোসিয়েশনে ভাষণদানের আগে পাকিস্তান পিপলস পার্টির কর্মীরা আমাকে কথা বলতে বাধা দেয়। তারা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। দরজা-জানালা ভাঙতে শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ না হওয়া পর্যন্ত আমি ও আমার কর্মীরা একটি ছোট কক্ষে আশ্রয় নিই। কিন্তু পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো ভূমিকা রাখেনি। মুলতানের ঘটনার পর আমি নিশ্চিত হলাম ইয়াহিয়া নিষ্পত্তি চাচ্ছেন না। আমি জনগণকে সত্যটা জানাই, তাও তিনি চাচ্ছেন না। মুজিবই ছিলেন সঠিক অবস্থানে।
ইয়াহিয়া ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে বৈঠক করলেন। তার সঙ্গে মাওলানা শাহ আহমাদ নুরানি, আবদুল ওয়ালি খানসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যও ছিলেন। বৈঠক হলো পরদিন। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের ছয় দফার মূল দাবিগুলো মেনে নিলেন বলে মনে হলো। অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হলেন। সিদ্ধান্ত হলো, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হবে এবং ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি দুটি কমিটিতে বিভক্ত হবে, কমিটি দুটি গঠিত হবে প্রতিটি দল থেকে পৃথকভাবে সদস্যদের নিয়ে। তারা বিশেষ বিধান সহকারে সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করবে এবং পার্লামেন্টের পূর্ণ অধিবেশনে তা বিবেচনা করা হবে।
ভুট্টো, প্রথমে যিনি ঢাকা যেতে আপত্তি করেছিলেন, সবকিছু নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে দেখে ২১ মার্চ ঢাকা এলেন। মুজিবের সঙ্গে সমঝোতার খসড়া যখন ভুট্টোর কাছে গিয়ে পৌঁছাল, তিনি অবস্থান নিয়ে বললেন, ন্যাশনাল এসেম্বলির বৈঠক ছাড়া সামরিক আইন প্রত্যাহার হতে পারে না। তার একটা ধারণা ছিল, এটা সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি করবে। পুরো সমঝোতা আগে হতে হবে। এরপর থেকে ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগল। ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠকে বসতে শেখ মুজিবকে রাজি করানো হলো। ২২ মার্চ মুজিব ও ভুট্টো আনুষ্ঠানিক বৈঠক করলেন। এই বৈঠকের দুদিন আগেই যে সমঝোতা হয়েছিল, তা থেকে সরে এলেন মুজিব এবং দেশের দুটি দলের কাছে পৃথকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ সৃষ্টি করলেন, এক মাস আগে ভুট্টো যে ধরনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ২২ মার্চের বৈঠকেও কোনো অগ্রগতি হলো না। পরদিন ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান-সংক্রান্ত লাহোর প্রস্তাব পাসের বার্ষিকী। আর ওইদিনই বাস্তবিকভাবে পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটল।
পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে লাগল। অদৃশ্য হয়ে গেল পাকিস্তানের পতাকা। যেসব বিদেশী দূতাবাসে পাকিস্তান পতাকা উড়ছিল, সেসব স্থানে পাথর নিক্ষেপ করা হলো। শেখ মুজিব তার খসড়া সংবিধান পেশ করলেন। তাতে ছিল দুটি সার্বভৌম দেশের একটি কনফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা। প্রস্তাব করা হলো প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, মুদ্রা ও বাণিজ্য অভিন্ন থাকবে। প্রস্তাবে বলা হলো, এই অভিন্ন বিষয়গুলো পরিচালনায় উভয় দেশকেই অর্থায়ন করতে হবে। মুজিবের এই প্রস্তাব তার আইন উপদেষ্টা কামাল হোসেন ২৩ মার্চ পেশ করেন। প্রস্তাবটি ইয়াহিয়া উপদেষ্টাদের কাছে পাঠানো হলো এবং যথারীতি অগ্রহণযোগ্য হলো। ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে মুজিবের একটি বৈঠক ছিল। কিন্তু তা হলো না। এ অবস্থায় শিগগিরই যে সামরিক অভিযান হতে যাচ্ছে না তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল। ২৫ মার্চ ঢাকা শহরে যেন ভুতুড়ে অবস্থা বিরাজ করছিল। সবার মধ্যে বিরাজ করছিল শঙ্কা। কিছু নির্দেশনা দিয়ে সন্ধ্যার পর ইয়াহিয়া খান করাচির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করলেন। ভুট্টো তখনো ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে।
গ্রীষ্মের পাগলামি
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরে হোটেলের সাত তলার কক্ষে বসেই ভুট্টো ঢাকায় মেশিনগানের গর্জন শুনছিলেন। আর পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার পথে শ্রীলঙ্কার আকাশসীমায় উড়োজাহাজে বসে ইয়াহিয়া যখন স্কচের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছিলেন, তখন উড়োজাহাজের কাপ্টেন তাকে জানিয়ে দেন, ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়ে গেছে।
সেনাবাহিনীর এক দল কমান্ডো শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এদিকে পাঞ্জাবি ও বাঙালিরা একে অপরকে হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। তারা উভয়ই বলল, ইসলামের মহান মর্যাদা রক্ষার জন্যই তারা এটি করছে!
পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়ে উপলব্ধি করল, তারা শুধু স্থানীয় জনগণের হামলার শিকার হচ্ছে না, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসাররাও তাদের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। পাগল ছাড়া আর কে ভাবতে পারে যে, পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতে থাকবে, তখন প্রতিবেশী ভারত ধৈর্য ধরে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ দেখবে। এপ্রিলের শেষ দিকেই ভারত থেকে সশস্ত্র গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তান ভূখণ্ডে অনুপ্রবেশ করে। এদিকে আমাদের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা নজর কাড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের। পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা বাড়িয়ে দিতে থাকে ভারত।
এ অবস্থায় পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো দেশের এমন কোনো চুক্তি ছিল না, যার মাধ্যমে কোনো দেশকে সহায়তায় বাধ্য করা যাবে। যুক্তরাষ্ট্রও ওই সময় সাহায্যের কোনো অঙ্গীকার করেনি। তা ছাড়া ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানে প্রচণ্ড সমালোচিত। পাকিস্তান যদিও সিয়াটোর সদস্য ছিল, তবে এই চুক্তির শর্ত ছিল যদি কোনো কমিউনিস্ট দেশ দ্বারা তারা হামলার শিকার হয়, আর কংগ্রেস যদি অনুমোদন করে, তাহলে মার্কিন সহায়তা পেতে পারে। চীনের সঙ্গেও এমন কোনো চুক্তি ছিল না যাতে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে তাদের বাধ্য করা যায়।
করাচি থেকে চট্টগ্রামের নৌ দূরত্ব ৩ হাজার মাইল এবং সেখানে পৌঁছাতে হবে শত্রু দেশ ভারতীয় উপকূল অতিক্রম করে। পূর্ব পাকিস্তান ছিল তিন দিক দিয়ে ভারতের দ্বারা ঘেরা। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরেও ভারতের আধিপত্য। আর ফেব্রুয়ারিতেই ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিস্ময়কর হলো, এর পরও পাকিস্তানে এ রকম অসংখ্য মানুষ, সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদ আশাবাদী ছিলেন ইয়াহিয়া খান তার এই উন্মাদ অ্যাডভেঞ্চারে বিজয়ী হবেন।
ঔদ্ধত্য ও নির্বুদ্ধিতা
জুলাই ও অক্টোবরে আমি দুবার ঢাকা সফর করি। সেখানে আমি যা দেখি তা আমাকে হতাশ করে। সত্তরের নির্বাচনে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত জামায়াত-ই-ইসলামি একটা ভুল ধারণা নিয়ে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থন দিতে থাকে। তাদের ধারণা ছিল, তারা ইসলামের সেবার জন্য এ সমর্থন দিচ্ছে। জুলাইয়ে পূর্ব পাকিস্তান সফর থেকে ফিরে আমি ইয়াহিয়াকে বিস্তারিত জানিয়েছিলাম। ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর নিপীড়নে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা কোনো নিন্দা তো জানায়নি, বরং তারা আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইয়াহিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
জুলাইয়ে ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার আলোচনা হয়। তাকে আমি পূর্ব পাকিস্তানের শোচনীয় পরিস্থিতির কথা জানাই। তাকে আমি পরামর্শ দিই, যদিও দেরি হয়ে গেছে, তারপরও একটা রাজনৈতিক সমাধান খোঁজার চেষ্টা ভুল হবে না। আমি বলি, আওয়ামী লীগের সব রাজনীতিবিদদের সাধারণ ক্ষমার আওতা আরও বাড়িয়ে আবার দেশে ফিরিয়ে আনা যায়। আমি পরামর্শ দিই পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকে আইন অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে। আমি বললাম, এ ধরনের সমাধান ছাড়া বিকল্প কিছু আর নেই। কিন্তু সে পরামর্শে কর্ণপাত করলেন না ইয়াহিয়া। তার কাছে তখন তার আত্মসম্মান এবং ক্ষমতার ক্ষুধাই ছিল বড়। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে বললাম অন্তত গভর্নরের পদ থেকে টিক্কা খানকে সরিয়ে দিতে। কারণ বাঙালি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় টিক্কা খান নামটি পূর্ব পাকিস্তানে ঘৃণিত হয়ে উঠেছিল। ইয়াহিয়া বললেন, এরই মধ্যে তিনি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। টিক্কা খানের বদলে কাকে নিয়োগ দেওয়া যায় যে বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইলেন। আইয়ুব খান আমলের সবচেয়ে সফল গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল আযম খানের নাম প্রস্তাব করলাম। কিন্তু এ প্রস্তাব ইয়াহিয়ার মনঃপূত হলো না। কারণ আগেই তিনি ড. আবদুল মালিককে ঠিক করে রেখেছিলেন। ইয়াহিয়া মন্ত্রিসভার সাবেক এই সদস্য ফিলিপাইনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আমি বললাম, এটা মন্দ হবে না। ড. মালিক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব নিলেন।
এরই মধ্যে ঢাকায় মার্শাল ল হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো সেখানকার পরিস্থিতি দেখার জন্য। আমাকে বলা হলো, সেনাপ্রধান মার্শাল ল হেড কোয়ার্টারে আমার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি আমাকে ব্রিফ করবেন। এই অস্বাভাবিক আমন্ত্রণ আমি গ্রহণ করি। মানচিত্রের সাহায্যে আমাকে পরিস্থিতি দেখানোর চেষ্টা করা হয়। আমাকে জানানো হয়, বর্ষাকালে কিছু এলাকায় সেনাবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তিনি আমাকে জানান, আরো রাজাকার নিয়োগের জন্য জেনারেল হেড কোয়ার্টার থেকে অর্থ এসেছে এবং শুকনো মৌসুমে মুক্তিবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া সম্ভব হবে। জেনারেল আমাকে জানালেন, ওই কাজটি করা সম্ভব হবে চার থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে। আমাকে মানচিত্রে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান দেখিয়ে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, পরিস্থিতি শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
আমি তাকে বললাম, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতিকে দেখতে হবে ওই এলাকার সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে। ভারতের জড়িত থাকার প্রশ্নটি তুলে আমি বললাম, এটা নিশ্চিত ভারত মুক্তিবাহিনীকে ব্যবহার করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্ষতি করতে চাইবে। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রবেশের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। এ কথা শুনে জেনারেল সাহেব বললেন, ও আচ্ছা! তেমন কিছু ঘটলে সেটা হবে ইসলামাবাদের সমস্যা।
বৈঠক শেষে যখন উঠতে যাব তখন জেনারেল বললেন, দু-এক মাসের মধ্যে আবার এসে আমি যেন অগ্রগতি দেখে যাই। কিন্তু জেনারেলকে আমি বললাম, সম্ভবত ঢাকায় এটাই আমার শেষ সফর। তার এবং পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সেনাবাহিনীর শুভ কামনা জানিয়ে আমি বিদায় নিলাম।
রাওয়ালপিন্ডি ফিরে এক অনুষ্ঠানে আমার সঙ্গে দেখা হয় পুরোনো বন্ধু, স্কুলের সহপাঠী সেনাবাহিনীর প্রধান গুল হাসান খানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে আমি তার সঙ্গে কথা বলি। তিনি নিজেও কদিন আগে ঢাকা থেকে ফেরেন। সেখানকার সেনাবাহিনীর অবস্থা শোচনীয় সে বিষয়ে তিনি একমত হলেন। এখন কী করার আছে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘যুদ্ধ’। কেন? আমি প্রশ্ন করলাম। ‘যুদ্ধবিরতির জন্য’—বললেন তিনি। আমি বুঝলাম ইয়াহিয়া খানের কথার প্রতিধ্বনি করছেন তিনি।
ওই সময় সেনা শাসকদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসবে। ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মধ্যস্থতায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই দুই শক্তিকে কাছাকাছি আনতে তিনি সহযোগিতা করেন। ইয়াহিয়ার মধ্যে এই ধারণা ছিল, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতকে চাপের মধ্যে রাখবেন। এক পর্যায়ে ভারত-পাকিস্তান আলোচনায় টেবিলে ফিরে যাবে। এরই মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের পর জেনারেল ইয়াহিয়া তার টেলিভিশন ভাষণে ইঙ্গিত দিলেন, তিনি আশা করছেন বিশ্বের বৃহত্ শক্তিগুলো পূর্ব পাকিস্তানে সহিংসতা বন্ধে সাহায্য করবে, সেখানে ভারত ইন্ধন যোগাচ্ছে।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তান যাওয়ার আগে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের গভর্নর ও প্রদেশের সামরিক আইন প্রশাসকের কাছ থেকে আমি একটি চিঠি পেলাম। চিঠিতে তিনি আমার রাজনৈতিক তত্পরতা বিষয়ে আপত্তি তুলেছেন। তিনি বললেন, আমার কাজকর্ম (আসন্ন বিপদ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য) নাকি জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, আমার কার্যক্রম সংক্ষিপ্ত করতে সামরিক আইনের অধীনে সরকার তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারে। ঢাকা থেকে ফিরে এ চিঠির জবাব আমি তাকে দিয়েছি।
হিসাবনিকাশ
ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার প্রায় কাছাকাছি চলে এল। জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি আগেই ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হলেন। নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে ভারত-পাকিস্তান বিবাদ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল। ৬ ডিসেম্বর ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌঁছালেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাদে জাতিসংঘের সব দেশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে একমত ছিল। যেহেতু ঢাকার পতন হয়নি, তাই যুদ্ধবিরতিতে ভারতকে রাজি করানোর একটা সুযোগ অন্তত ছিল, যাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাদের পরিবারকে ঢাকা থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া যায়।
নিরাপত্তা পরিষদ যখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করছে তখন বিশ্ব নেতাদের জানানো হলো, ভুট্টো ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের এটি হোটেলে আছেন। এমন এক সময় ভুট্টো অসুস্থ হয়ে পড়লেন যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করছে এবং আত্মসমর্পণ তখন প্রায় আসন্ন। সুস্থ হয়ে ভুট্টো ১৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যোগ দিলেন। ততক্ষণে মূল্যবান সময় অনেক নষ্ট হয়েছে। তারপরও মনে হয় আত্মসমর্পণ ঠেকানো সম্ভব ছিল।
কিন্তু আমার কাছে মনে হলো, নিরাপত্তা পরিষদে ভাষণ দেওয়ার মতো যোগ্য হয়ে ওঠেননি ভুট্টো। তার চেয়ে বরং মোচি গেটেই (লাহোরের প্রখ্যাত জনসমাবেশস্থল) তাকে ভালো মানায়। প্রায় সব দেশ যখন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের কথা ভাবছে তখন তিনি এ ধারণা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে বললেন, ‘প্রয়োজনে পাকিস্তান হাজার বছর যুদ্ধ করবে।’ এই বলে তিনি লম্বা লম্বা পা ফেলে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার এ মন্তব্য ছিল আমাদের দুর্বল রাজনৈতিক ভাবনার প্রকাশ। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে তার ভাষণ প্রশংসিত হলো।
পরদিনই পতন হলো ঢাকার। রেসকোর্সে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল। শত শত বিদেশী টিভি ক্যামেরায় এ দৃশ্য দেখানো হলো। বিশ্বের সব বড় বড় সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় শীর্ষ খবর হিসেবে এটি বেরোলো। পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সেনা কর্মকর্তারা ব্যাপক মানহানির শিকার হলেন। ৯৩ হাজার সৈন্য, বেসামরিক নারী-পুরুষকে পাঠানো হলো বন্দী শিবিরে। বিজয়ের পরে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের মৃত্যু হলো। সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হলো বিহারিরা। ওই বিহারিরা ভারতের নেফা ও বিহার থেকে ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এসেছিল। কিন্তু তারা কখনো বাঙালি সমাজে নিজেদের এক করতে পারেনি। ভাষা ও জাতিগতভাবে সমস্যার শিকার এই বিহারিরা কখনো বাঙালি সমাজে মিশে যাওয়ার চেষ্টাও করেনি। বাঙালিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে তাদের অন্ধ সমর্থন স্থানীয়দের ক্ষুব্ধ করে তোলে। এ জন্য বিজয়ের পরে তাদের প্রতি কোনো করুণা প্রদর্শন করা হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাই অসংখ্য বিহারিকে খুন করা হয়। এখনো বিপুল সংখ্যক বিহারি ঢাকায় বিভিন্ন শিবিরে আছে। আমরা এখনো তাদের স্বীকৃতি দিইনি। অথচ আমরা এক সময় তাদের দেশপ্রেম ও সাহসিকতার প্রশংসা করেছিলাম, যখন তাদের সমর্থন আমাদের প্রয়োজন ছিল।
তবে কেবল বিহারি আর পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও বিশ্বাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে তাদের উদ্ধার করবে। চীনও তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু যখন দেখা গেল তেমন কোনো আশা নেই, তখন সত্যি সত্যিই সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। আর ঢাকায় সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রতিক্রিয়া ছিল চরম। সেনাবাহিনীর সব শাখায় ছিল অপমান-অপদস্থ হওয়ার হতাশা। সশস্ত্র বাহিনীর অফিসার কোর প্রথমবারের মতো পুরো বিষয়টি পরিচালনায় হতাশা প্রকাশ করে।
তবে এই হতাশাগুলো নিয়ন্ত্রিত উপায়েই প্রকাশ পাচ্ছিল। আত্মসমর্পণের কয়েক দিন পর চিফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান খান পুনরায় সেনাবাহিনীকে স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে আনার প্রচেষ্টা নিলেন। কিন্তু এ সময় তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে সেনা কর্মকর্তাদের চাপা ক্ষোভ উপলব্ধি করলেন। এ অবস্থায় তিনি এবং বিমানবাহিনীর প্রধান রহিম খান বিষয়টি নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলোচনা করলেন। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হলেন। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের পদে থেকে যেতে চাইলেন।
এদিকে ভুট্টো সতর্কভাবে নিউইয়র্কে বসেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন। এ সময় পাকিস্তানে আসার জন্য রাওয়ালপিন্ডি থেকে তাকে সবুজ সংকেত দেওয়া হয়। গুল হাসান খান ও রহিম খান তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলেন।
ভেতরে ভেতরে কী হচ্ছে এটা না জেনে ১৯ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে একটি বড় জনসমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলনে আমি ভাষণ দিলাম। এতে আমি ইয়াহিয়াকে পদত্যাগের আহ্বান জানালাম। আমি বললাম যেহেতু এই মুহূর্তে বিকল্প কেউ নেই, তাই ভুট্টোকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হোক, এই সরকারের কাজ হবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। যেহেতু তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, তাই তিনিই পারেন সরকার গঠন করতে, যদিও বিগত কয়েক মাসে ভুট্টোর নীতির সঙ্গে আমি একমত ছিলাম না।
১৯৭১-এর ২০ ডিসেম্বর ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডি এলেন। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে শপথ নিলেন। ‘সম্মানজনক’ভাবে অবসর নিলেন ইয়াহিয়া খান। অবসান হলো তার ৩৩ মাসের শাসন। কাজ শুরু করল নির্বাচিত সরকার। (ঈষত্ সংক্ষেপিত)
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত