বিজ্ঞাপন
default-image

ইলা মজুমদারউপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত বারীণ মজুমদার অনেকটা একক চেষ্টাতেই ১৯৬৩ সালে যখন ঢাকায় ২৮ নম্বর সেগুনবাগিচায় মিউজিক কলেজের কাজ শুরু করলেন, একমাত্র কন্যাসন্তান মিতুর বয়স তখন তিন বছর ছুঁই ছুঁই। ওয়াইজঘাটের বুলবুল ললিতকলা একাডেমীতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অসম্মানিত হয়েছিলেন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, এখানে আর নয়। শুভাকাঙ্ক্ষী ও বন্ধুদের উষ্ণ সহযোগিতায় গড়ে ওঠা মিউজিক কলেজ চত্বরেই রাতদিন যাপনের ‘কোয়ার্টার’ পেলেন। স্ত্রী ইলা মজুমদার আর কন্যা মধুমিতাও একাকার হয়ে গেল মিউজিক কলেজের ‘উজান যাত্রা’র প্রহরে প্রহরে।

১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের কালরাতেও মা-বাবা আর সাড়ে চার বছর বয়সী ভাই পার্থ মজুমদারের সঙ্গে মিউজিক কলেজের কোয়ার্টারেই ঘুমোচ্ছিল মিতু। মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ি আর তোপখানা রোডের প্রেসক্লাবে পাক হানাদারদের নারকীয় তাণ্ডবে দিশা হারিয়ে ফেলেছিলেন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার ও ইলা মজুমদার। একটানা গুলির শব্দ, আগুনের লকলকে শিখা আর থেমে থেমে মানুষের আর্তচিত্কার মগজের কোষে কোষে তখন ভয় আর বিপন্নতাবোধের ঢেউ তুলছিল ক্রমাগত। ইলা মজুমদার যেন এখনো হাতের নাগালেই দেখতে পান কালরাতকে...।

ইলা মজুমদার বলছিলেন, “২৫ মার্চ সন্ধ্যায় মিউজিক কলেজের কয়েকজন শিক্ষক আর প্রেসক্লাব থেকে আসা বেশ কজন সাংবাদিক নিত্যদিনের মতো কলেজ চত্বরে গল্প করতে বসলেও ওই দিন খুব তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন সবাই। চারদিকে থমথমে অবস্থা। রাত আটটার দিকে কলেজের নেতৃস্থানীয় ছাত্রদের কজন; মায়া, আনু বড়ুয়া, তপন, সালেহ্ রাস্তায় মিছিল শেষ করে হোস্টেলের ঘরে ঢুকে পড়ল। ২১ ফেব্রুয়ারি কালো পতাকা কলেজ ক্যাম্পাসে তোলা হয়েছিল, তা তখনো নামানো হয়নি।

তিন তলায়, ছাদের ওপরে ৭ মার্চের পর তোলা হয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজ পতাকা। পতাকাটা সেলাই করে দিয়েছিলাম আমি। রাত নয়টা-সাড়ে নয়টার দিকে শ্রী বারীণ মজুমদার তাঁর সুরযন্ত্র ‘সুরমণ্ডলে’ তার লাগাতে বসলেন। আমাদের মিতু (আদর করে ডাকতাম ‘বাবু’) বাবার পাশে বসে সাহায্য করছিল। ছেলে বাপুন (পার্থ মজুমদার) তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে হঠাত্ করেই টেলিফোন বেজে উঠলে শ্রী বারীণ মজুমদার ছুটে গিয়ে ফোন ধরলেন। মনে হলো, উত্তেজিত কথাবার্তা হচ্ছে। ফোন লাইনটা হঠাত্ করে কেটে গেল। ত্রস্তস্বরে উনি আমাকে বললেন, হেনা ফোন করেছিল। বলল, পাকিস্তানি আর্মি নেমেছে রাস্তায়।

default-image

বারীণদা, আপনারা শেল্টার নেন। হেনা, মানে হামিদা ইসলাম এখন মিউজিক কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপিকা, তার ফোন পেয়ে ঘর ও বাইরের লাইট অফ করে দিয়ে উনি ছুটলেন নিচে। একুশের কালো পতাকা নামিয়ে ছুটলেন হোস্টেলের ঘরে ঘরে। বললেন, মেইন বিল্ডিংয়ে চলে আসো। দৌড়ে তিন তলায় উঠে নামিয়ে ফেললেন লাল-সবুজ পতাকা।...গুলির শব্দ আসতে থাকল। একজন ছাত্র এসে চুপিচুপি ঢুকল ঘরে। স্যার, দু-তিনজন আর্মি এসে নিচের হোস্টেলের সামনে ঘুরে গেল। আপনাদের এখানে না থাকাই ভালো।...”

কোথায় পালাবেন তাঁরা? দোতলার সিঁড়ির নিচে স্টোর রুমের গুমোট অন্ধকারে মিতু আর বাপুন নেতিয়ে পড়ল। ভোর হতে হতে গুলির শব্দ কিছুটা কমলে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এল সবাই তিন তলায়। মিউজিক কলেজের পাশেই কালা মিয়ার বাসা। দেয়ালের ওপর দিয়ে ছাত্রদের সহায়তায় কালা মিয়ার বাসায় এসে লুকালেন সপরিবারে পণ্ডিত বারীণ মজুমদার। ২৬ মার্চ পার হলো। কারফিউ খানিকটা সময়ের জন্য শিথিল হয়েছে। কলেজ চত্বরে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল না। কলেজের দারোয়ান জব্বার এসে জানালেন, ২৬ মার্চ রাতে আর্মি ঢুকে দরজায় দরজায় লাথি দিয়ে গেছে। কলেজের ভিপি ধর্মদর্শী বড়ুয়া ও জিএস মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার যৌথ সিদ্ধান্তে বেরিয়ে পড়ল সবাই। গন্তব্য, মায়ার নারিন্দার বাসা। তারপর সেখান থেকে আরও দূর গ্রামে, যেখানে আর্মি যায়নি। কিন্তু যাওয়া হলো না।

প্রেসক্লাবের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে সচিবালয়ের দেয়াল ঘেঁষে কিছু দূর হাঁটতেই দৌড়ে এসে জাহিদুর রহিম (রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, বারীণ মজুমদারের ছাত্র) জাপটে ধরে নিয়ে গেল নিজের বাসায় সবাইকে। সেখানেই শোনা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের মৃত্যুর কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন—সব ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষক ও ছাত্রদের খোঁজা হয়েছে এবং হচ্ছে শুনে জাহিদুর রহিম সাহস হারিয়ে ফেললে এবার মায়া ও আরও চার-পাঁচজনসহ আবার বেরিয়ে পড়া। নারিন্দা যেতে যেতে চারপাশে ধ্বংসস্তূপ, মৃতদেহ আর পলাতক মানুষের ব্যস্ত মিছিল কাতর করে তুলল ছোট্ট দুটি শিশু মিতু আর বাপুনকে। মায়ার বাসায় পৌঁছে জানা গেল, পরিবারের সবাই চলে গেছে গ্রামে।

শোনা গেল সাধনা ঔষধালয়ের যোগেশ বাবুকে মেরে ফেলা হয়েছে। বারীণ মজুমদারকে খুঁজে ফিরছিলেন হেমায়েত উদ্দিন (বেহালাবাদক ও শিক্ষক)। মায়ার বাসা থেকে এবার তাঁরা চললেন তাঁর বাসায়। সে বাসাতেই বিকেলে ছাত্র বড়ুয়ার লেখা চিরকুট নিয়ে এল একটি ছেলে। পত্রবাহকের সঙ্গে যেতে হবে। তারপর সন্ধ্যার অন্ধকারে বড়ুয়া সবাইকে নিয়ে পার হবে বুড়িগঙ্গা, বুড়িগঙ্গার ওপারে জিনজিরা এখন নিরাপদ।...বলে চললেন ইলা মজুমদার, “ফরাশগঞ্জের ভেতর দিয়ে আমরা রিকশা করে যাচ্ছি। শত শত রিকশা। হাজার হাজার মানুষ ছুটছে। হঠাত্ করে আর্মি কনভয়ের শব্দ। গাড়ির শব্দ। দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। রিকশাগুলো রাস্তার ঢালু বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে ড্রেনের ভেতর। আমাদের কারও শরীরে যেন কোনো শক্তি অবশিষ্ট নেই।

মৃত্যু অবধারিত। বাপুন আমাকে জাপটে ধরে আছে। মিতু শ্রী বারীণ মজুমদারের কাছে। লরিগুলো থামল না। অস্ত্র উঁচিয়ে কেউবা বসে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে চলে গেল নারায়ণগঞ্জের রাস্তার দিকে। ওরা সম্ভবত মিশন নিয়ে যাচ্ছিল অন্য এলাকা ধ্বংস করতে। মিশনের মাঝপথে থামার নিয়ম নেই আর্মির, তাই আমরা বেঁচে গেলাম। আবার ছুটে চলা। সন্ধ্যার পর পর নদী পার হলাম নিরাপদে। জিনজিরাতে হাজার হাজার আশ্রিত মানুষ। স্থানীয় মানুষেরা তাদের নিজেদের ঘরে ঘরে ঠাঁই দিচ্ছে ঢাকা শহর ছেড়ে আসা পলাতক মানুষদের। সেই রাত কাটল। দূরে গুলির শব্দ শুনি। নদীঘেঁষা গ্রাম জিনজিরা। বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে পাক হানাদারদের লঞ্চ-বোট চলে।

জিনজিরাও আর নিরাপদ থাকল না। আবার ছুটে চলা। শরীর আর চলে না। কোনো দিন আমরা এ রকম পথে হাঁটিনি। কোথায় যাব? কার কাছে যাব? জানা নেই। হাঁটতে হাঁটতে মিতু ও বাপুন ছোট্ট দুটো শিশু আর পারছিল না। দুজনের গায়েই একটু জ্বরজ্বর ভাব। আমরা পৌঁছলাম গোপপাড় নামের একটি গ্রামে। এপ্রিল মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত সেখানে থাকা। নানা রকমের উড়োখবর আসে। জিনজিরায় পাক আর্মি ঢুকেছে। সব ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। কোনো বাঙালি বেঁচে নেই। রাতদিন কাটে আতঙ্কে।...” এটুকু পর্যন্ত ঠিক ঠিক মনে পড়ে ইলা মজুমদারের। যখন কেউ তাঁর কাছে এত দিন পরে সেসব আবার জানতে চায়। তিনি বিষণ্ন হন, সজল হন। একাত্তরের পয়লা এপ্রিল দুপুরবেলা তাঁরা আবার হাঁটতে শুরু করলেন।

শেষ বিকেলে গিয়ে পৌঁছেছিলেন চুনকুঠিয়া গ্রামে। হয়তো খানিকটা নিরাপদবোধও হয়েছিল জায়গাটা। পঁচিশে মার্চ রাত থেকে নিরন্তর আতঙ্ক আর ত্রাস কাঁধে নিয়ে স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে মিউজিক কলেজের কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে এই যে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলা, চুনকুঠিয়া গ্রামে পৌঁছে রাতে চোখে ঘুম টেনে এনেছিলেন অবশেষে। ওই ঘুমের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বর্ণনার সময় ইলা মজুমদারের কণ্ঠস্বর এক রকম; আবার যখন সেই রাতের শেষ প্রহরে তাঁরা ছুটেছিলেন ঊর্ধ্বশ্বাস, ধলেশ্বরী নদীর দিকে, সেই কণ্ঠস্বর ধলেশ্বরীর গভীর জলে ভিজে থাকা শোকার্ত একেকটি ঢেউ। ‘চিত্কার কোলাহলে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

কিন্তু গত কয় দিনের স্মৃতি বলে দিচ্ছিল, ছুটতে হবে। আবার ছুটতে হবে।... কোথায় যাচ্ছি জানি না। শ্রী মজুমদার, মিতু, বাপুন, আমি ছুটছি। ফসল কাটা হয়ে গেছে। ফসলের মাঠ ভরা বড় বড় মাটির ঢেলা। হুমড়ি খেয়ে পড়ছি, উঠছি। এরই মধ্যে বড়ুয়া এসে মিতুর হাত নিজের হাতে ধরে সামনের দিকে ছুটতে থাকল। মাথার ওপর গুলির শব্দ। অবিরাম। শ্রী মজুমদার আমাকে ঠেলে টেনে তুলছেন। দৌড়াতে গিয়ে আবার পড়ে যাচ্ছি। চিত্কার করে কাঁদছি। মিতু মিতু। হোঁচট খেয়ে পড়ছি। আর উঠতে পারছি না। শ্বাস নিতে পারছি না। শ্রী মজুমদার আমাকে আশ্বস্ত করছেন, মিতু বড়ুয়ার কাছে আছে। একটা হলুদ রঙের পাতলা চাদর মিতুর গায়ে জড়িয়েছিলাম। দূরে, ছুটন্ত ভিড়ের ভেতর ভোরের ফ্যাকাসে আলোয় হলুদ একটা ঝিলিক যেন হঠাত্ মিলিয়ে গেল...’ এইটুকু পর্যন্ত ইলা মজুমদার মনে করতে পারেন। এইটুকু বলা শেষে ইলা মজুমদার উঠে পড়বেন বসা থেকে। তারপর শোয়ার ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়বেন। ঠিক যেমন করে একাত্তরের এপ্রিল মাসে, এক ভোরবেলা, বাংলাদেশের এক সোঁদা গন্ধমাখা মাঠে শুয়ে পড়েছিলেন।

যত দিন বড়ুয়া এসে জানায়নি যে মিতুকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না, তত দিন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার, পার্থ আর বাপ্পা অপেক্ষা করেছে। এখন সেটা প্রতীক্ষা। প্রতীক্ষা, ইলা মজুমদারের শোয়ার ঘরের সামনের দেয়ালে সাদাকালো হয়ে সেঁটে থাকে। দেয়ালে ঝোলানো মিতুর ছবিটি কি তা জানে?

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত