বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন: আপনি এবং ভারত যুদ্ধের কতটা কাছাকাছি?

উত্তর: আমার বলার কোনো কারণ নেই যে যুদ্ধ আসন্ন নয়। ভারতীয়রা যুদ্ধ শুরু করেই দিয়েছে। মুখোমুখি সংঘর্ষ না হওয়ার কারণ আমরা প্রত্যাঘাত করছি না। আমি প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন যুদ্ধটা ছড়িয়ে না দেন। ...ভারত প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টায় ১৫০ থেকে ৩০০০টি আর্টিলারি ও মর্টার শেল পূর্ব পাকিস্তানে নিক্ষেপ করছে। এ সপ্তাহের প্রথমে এক দিনেই ২৫ পাউন্ড ফিল্ড গান এবং তিন ইঞ্চি মর্টার থেকে ৫০০০ গোলা নিক্ষেপ করেছে।

প্রশ্ন: ভারত ৬,০০,০০০ মজুদ সেনা মোতায়েন করেছে। আপনিও কি তাই করেছেন?

উত্তর: সৈন্যদের সতর্ক করা হয়েছে এবং কিছুসংখ্যক অফিসারকে তলব করা হয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার সেনারা কি যুদ্ধের জন্য মোতায়েন হয়েছে?

উত্তর: আমাদের সেনারা ক্যান্টনমেন্ট ও ব্যারাক থেকে বের হয়েছে, সামনে এগিয়ে গেছে, কিন্তু যুদ্ধের জন্য পজিশন নেয়নি।

প্রশ্ন: কেন নেয়নি?

উত্তর: কারণ আমি চাই না যুদ্ধ লাগুক।

প্রশ্ন: সুবিধাজনক আশ্রয়ে ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশের প্রতিশোধ না নিয়ে কত দিন সহ্য করবেন?

উত্তর: ...কিছু না করার কারণে আমার লোকজন নিশ্চয়ই আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

প্রশ্ন: যদি যুদ্ধ লেগেই যায়, আপনি কি মনে করেন জিততে পারবেন? নাকি অধিকাংশ বিদেশি পর্যবেক্ষক যেমন বলছে এতে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে বাধ্য?

উত্তর: আমি অবশ্যই হারব না। আমার লোকজন যুদ্ধ করে জিতবে। কিন্তু পাঁচগুণ বড় যে সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করা এবং জেতা? তাদের যুদ্ধে ডেকে আনা আমার জন্য সামরিক উন্মত্ততা। কিন্তু আমাদের আক্রমণ করা হলে আমরা প্রত্যাঘাত করব।

প্রশ্ন: ১৯৬৫ সালে যুদ্ধে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফুরিয়ে গিয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল—আপনার সশস্ত্র বাহিনী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কত দিন যুদ্ধ করতে পারবে?

উত্তর: সেটাই আমাদের বড় সমস্যা। ভারতের জন্য এতটা নয়। তাদের যুদ্ধযন্ত্র অনেক বড় এবং অনেক বিষয়ে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। যুদ্ধটা আমাদের শুরু করা তাই এক ধরনের পাগলামিরই সাক্ষ্য দেবে। তারা যদি দৈনিক ৩০০০ শেল নিক্ষেপ করতে পারে তাহলে বুঝতে হবে তাদের হাতে অনেক গোলাবারুদ। এটা বিলাসিতা, আমাদের সেনাবাহিনীর সে সামর্থ্য নেই।

প্রশ্ন: যদি যুদ্ধ হয়, যেখানে পূর্ব পাকিস্তানে সাপ্লাই লাইন ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বন্দর ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে ঘেরাও, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে কতটা সময় ধরে রাখতে পারবেন?

উত্তর: এটা সত্যি, কাজটা খুব সহজ নয়। সৌভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি প্রতিরক্ষাকারী শক্তির জন্য সহায়ক। আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, এটা ওয়াকওভার হবে না। বড় যুদ্ধের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে আমাদের শক্তি এখানে, পশ্চিমে।

প্রশ্ন: যদি যুদ্ধ লেগে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কতটুক?

উত্তর: সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা আমি বলতে পারব না। কিন্তু ভারতের সঙ্গে তাদের যে চুক্তি তার নিশ্চয়ই একটা মানে আছে। ভারতের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য সম্ভবত তারা তা ব্যবহার করবে। আর চীনাদের ব্যাপারে পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন তা সহ্য করবে না। সরাসরি হস্তক্ষেপ না হলেও আমরা অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাব। আর যদি রাশিয়ান ও চীনারা এসে যায়, তাহলে আমরা একটা বিশ্বযুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়ে যাব, তখন কী হবে তা কল্পনাও করা যায় না।

প্রশ্ন: যুদ্ধ বেঁধে গেলে চীনের সামরিক সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি কি আপনি নিশ্চিত?

উত্তর: অবশ্যই নিশ্চিত।

প্রশ্ন: কোনো কোনো প্রতিথযশা ভারতীয় মনে করেন পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা সম্ভব এবং এক পক্ষকালের মধ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা সম্ভব। ভারত যদি তাই করতে চায় এবং তাতে সফলও হয় আপনি আর কী করতে পারবেন?

উত্তর: ব্যাপারটা একটা ভিন্ন দেশের। বলপূর্বক তাদের নয় এমন একটা দেশ দখল করা। পৃথিবী সেটা গ্রহণ করতে পারে না। আমি সত্যটা জানি পূর্ব পাকিস্তানিরাও তা গ্রহণ করবে না। ...ভুলবেন না পূর্ব পাকিস্তানই একসময় একক রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তারা তখন হিন্দুদের আধিপত্য থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চেয়েছিল। বাঙালিরা কারও কাছ থেকে ন্যাঘ্য পাওনা বুঝে পায়নি। আমরাও অনেক ভুল করেছি—তাদের উন্নয়নের দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া হয়নি সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে আমরা চেষ্টা করছি।

প্রশ্ন: এখনো প্রতিদিন ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছে—এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

উত্তর: না, তারা যাচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। যেভাবে ভারতীয়রা গোলা নিক্ষেপ করছে সীমান্তবর্তী মানুষদের এমনিতেই প্রাণের ভয়ে ছুটোছুটি করতে হচ্ছে। সীমান্ত চীনের প্রাচীরের মতো নয়। সীমান্তে চিহ্ন নেই—ভারতীয়রা বিদেশিদের ধরে নিয়ে যায়, দেখায় এটাই সীমান্ত—সেটা হয়তো ভারতের ১৫ মাইল ভেতর ভূখণ্ডে। সে জন্যই আমি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের কথা বলি, দুই পাশ থেকে তারাই দেখুক কি ঘটছে। কিন্তু ভারত এ প্রস্তাব গ্রহণ করবে না, কারণ ভারত জানে ভারত কি করছে।

প্রশ্ন: মাত্র কয়েক মাসে নব্বই লাখ মানুষ কীভাবে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়?

উত্তর: সংখ্যাটা আমি মানতে নারাজ। ২০ থেকে ৩০ লাখ হতে পারে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক দিয়ে গুনলে ৪০ লাখও পাওয়া যেতে পারে। সংখ্যা যাই হোক, মার্চের পর যেকোনো পাকিস্তানি ভারতে গিয়ে থাকলে আমি তাকে ফিরিয়ে নেব। এটা একমাত্র জাতিসংঘ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (১৯৪৭-এর) গণ-অভিবাসনের সময় যারা ভারতে গিয়েছে তাদের অনেককে এখনো পুনর্বাসিত করা হয়নি। কলকাতার দিকে তাকিয়ে দেখুন এখনো ১০ লাখ লোক রাতের বেলা রাস্তায় ঘুমায়।

প্রশ্ন: আপনি যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত করে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যেতে দেন এবং তিনি যদি স্বায়ত্তশাসনের বেশি দাবি করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দেন এবং আপনি সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেন তাহলে কী হবে?

উত্তর: অনেকেই হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু আমি মনে করি তিনি ফিরে গেলে তাঁর নিজের লোকজনই তাঁকে হত্যা করবে। ভোগান্তির জন্য তাঁকে দায়ী করবে। যাকগে এটা একটা একাডেমিক প্রশ্ন। তিনি দুই বছর অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন কিন্তু ফিরে গেছেন নিজের বক্তব্যে। তিনি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ-সংগঠিত করেছেন এবং নেতৃত্ব দিয়েছেন...। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা এবং সেনাবাহিনীর অনুগত্য বিনষ্টের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেশের সবচেয়ে ভালো এবং শ্রদ্ধেয় আইনজীবী কে ব্রোহি তাঁর পক্ষে মামলা নিয়েছেন। সামরিক আদালতে যাচ্ছেতাই হতে পারে মনে করলে তিনি মামলা নিতেন না। অনেক সরকারই যেমন করে থাকে, আগে গুলি করে হত্যা, তারপর বিচার, আমি তা করিনি। সাজা হওয়ার পর কী হবে সেটা রাষ্ট্রপ্রধানের এখতিয়ার। আমি খেয়ালের বসে তাকে মুক্তি দিতে পারি না—এটা অনেক বড় দায়দায়িত্বের ব্যাপার। কিন্তু জাতি যদি তার মুক্তি চায়, মুক্তি দেব।

(ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউনে ১ নভেম্বর ১৯৭১ সালে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল প্রেস অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার-এ পুনমু‌র্দ্রিত)।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত