বিজ্ঞাপন
default-image

সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন অর্জন করেছিল। এ ছিল এক অভূতপূর্ব বিজয়। ষাটের দশকের শুরু থেকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছিল। নির্বাচনের ফলাফল এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে ও স্বাধীনতার স্পৃহাকে বলীয়ান করেছে। নির্বাচনে সাধারণ মানুষের এই আবেগ ও আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন হয়েছিল। পূর্ববাংলা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন তথা ছয় দফা দাবি থেকে সরে না আসায় ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা হলেও ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়।

অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় তাত্ক্ষণিকভাবে শুরু হয় মিছিল, মিটিং, হরতাল। এই অঞ্চলের বাঙালি সেদিন নতুন করে উপলব্ধি করেছিল, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলের নেতাদের হাতে কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করায় পাকিস্তানিদের এই মনোভাব সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। সবকিছু নিয়ে ঢাকা শহরজুড়ে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। শুরু হয় ঢাকাসহ সমগ্র পূর্ববাংলায় অসহযোগ আন্দোলন।

কী হবে, কী হবে—সবার মধ্যে এই প্রশ্ন জাগতে শুরু করে এবং একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আমি তখন ঢাকা আর্ট কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৫ মার্চের পর শুরু হয় মুজিব-ইয়াহিয়া নিষ্ফল আলোচনা। একসময় ভুট্টোও আলোচনায় যোগ দেন। একদিকে চলতে থাকে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়া বৈঠক অন্যদিকে চলে সমগ্র পূর্ববাংলায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। দেশ পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এভাবেই কেটে যায় উত্তাল মার্চের কয়েকটি দিন। আলোচনার পাশাপাশি ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন সেনানিবাসে জড়ো হতে থাকে পাকিস্তানি মিলিটারি। নিরস্ত্র করা হতে থাকে বাঙালি সেনা সদস্যদের। একসময় মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনাও ভেঙে যায়।

২৫ মার্চ ১৯৭১, সকাল থেকেই থমথমে ভাব। সবার মুখে মুখে আলোচনা হতে থাকে, যেকোনো সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করতে পারে। একই সঙ্গে প্রস্তুতি চলতে থাকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণা অনুযায়ী আক্রমণ প্রতিরোধের। শক্তিধর প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ প্রতিরোধ যে কত তুচ্ছ ছিল কিছুক্ষণের মধ্যে তা বুঝতে পেরেছিলাম। ২৫ মার্চ বিকেলই শুরু হয়ে যায় গাছ কেটে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানের রাস্তা অবরোধ। ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে নিউমার্কেট-সংলগ্ন আর্ট কলেজ হোস্টেলে ছাত্রের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আমরা সাত-আটজন একসঙ্গে ছিলাম। সন্ধ্যার পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাজুড়ে একটা গুমোট ভাব। বুঝতে পারছিলাম, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সবাই উদ্বিগ্ন ও উত্কণ্ঠিত। ভয়ঙ্কর কিছু একটা হতে যাচ্ছে—এঁরা সবাই বুঝতে পারছিল। সবার মধ্যে চাপা আতঙ্কও বিরাজ করছিল।

রাত ১০টার দিকে ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করেছি। নিউমার্কেট ও বলাকা সিনেমা হলের সামনের রাস্তায় তখন গাছের ব্যারিকেড। বলাকা হলের সামনে এসে দাঁড়াতেই মনে হলো, অনেক দূরে সার্চলাইটের আলোর মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। তারপর ঠা-ঠা-ঠা গুলির শব্দের সঙ্গে আগুনের ফুলকি ছুটে আসতে থাকে সামনে। বুঝতে বাকি রইল না, পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অবস্থানরত ছাত্রদের হত্যার জন্যে রাস্তায় নেমেছে। অসংখ্য গুলির শব্দ। আর্মি কনভয় খুব দ্রুত আমাদের কাছাকাছি চলে আসে। সেই সময় কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

আর্ট কলেজ হোস্টেলে ফিরে যাওয়ার মতো অবস্থাও ছিল না। কেননা সেই সময় আর্ট কলেজ হোস্টেলের সন্নিকটে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকেও পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। ভয়ে ছুটতে শুরু করি পেছনে। ছুটতে ছুটতে এসে দাঁড়ালাম নিউমার্কেটের প্রধান গেটের উল্টোদিকের টেলিফোন বুথের সামনে। টেলিফোন বুথ-সংলগ্ন আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টার, যে বিল্ডিংগুলোর ছাদে ২৩ মার্চের পর থেকেই উড়ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। হঠাত্ মনে হলো এক্ষুনি বোধহয় গুলি এসে আঘাত করবে। আবার দিলাম দৌড়। ঝড়ে পড়া পাখির মতো নিরাপদ আশ্রয় নিতে দেয়াল টপকে ঢুকে পড়ি কোয়ার্টারের ভেতরে। বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় গিয়ে নক করতেই দরজায় খুলে গেল, ভেতরে ঢুকে পড়লাম।

বাড়িওয়ালার আশ্রয়ে সারা রাত ড্রয়িংরুমে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ছিলাম। বোমার আওয়াজ, মেশিনগানের গুলির ঠা-ঠা-ঠা শব্দে কাঁপতে থাকি, ভয় ও মৃত্যুর আশঙ্কায় একটু পরপর শিউরে উঠি। বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে গুলি ও কামানের শব্দ। বুঝতে পারি, পিলখানার ইপিআর সদস্যদের ওপর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে চলছে বিরামহীন হত্যাযজ্ঞ। পিলখানা ও পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারগুলো থেকেও বোমা-গুলির শব্দ প্রচণ্ড বেগে ভেসে আসছিল। মানুষের চিত্কার, আর্তনাদ ও বেঁচে থাকার আর্তিতে পুরো এলাকাটাই যেন তির-তির করে কাঁপছিল। একেক সময় মনে হচ্ছিল বিল্ডিংগুলো যেন উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাসার লোকজন চাপা স্বরে কথা বলছে। হূদয় বিদীর্ণ করা আর্তচিত্কারে মনে হচ্ছিল, সকাল হতে হতে আমাদেরও বোধহয় আর বাঁচার উপায় থাকবে না। গোটা রাত গোলাগুলির শব্দ একটুও থামেনি।

মাঝে একটু বন্ধ হয়েছিল। ২৬ মার্চ ভোরের দিকে চারিদিক সুনসান। শব্দগুলো অনেক দূরে চলে গেছে। বাইরে এসে দেখি, রাস্তাঘাট জনশূন্য। সকাল সাতটায় ছাত্রাবাসের দিকে এগোতে থাকি। এসে দেখি, বৃদ্ধ সুইপারটা বসে আছে। মুখজুড়ে ভয় আর ক্লান্তির ছাপ। হলের নিচতলায় আরও দেখা পেলাম আমার দুই বছরের সিনিয়র জাহাঙ্গীর ভাই, পরেশদাসহ আরও দুজনের। ভয়ে সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। সবাই বুঝতে পারছে, এই পরিস্থিতিতে মৃত্যু অবধারিত। সারা রাত যেভাবে নিরীহ লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে, আমাদের সবার ভাগ্যেও একই লিখন লেখা আছে। শুনলাম, দোতলায় আছেন শাহনেওয়াজ ভাই (চতুর্থ বর্ষ), নজরুল ভাই (তৃতীয় বর্ষ) এবং আরও রয়েছেন কিবরিয়া স্যার (শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া)।

মনে করলাম, দিনের বেলায় হয়তো আর পাকিস্তানি আর্মি আসবে না। তবে দূর থেকে থেমে থেমে দু-একটি গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তখনো আমাদের কারও কিছুই খাওয়া হয়নি। হঠাত্ দেখতে পেলাম, হোস্টেলের সামনের রাস্তা দিয়ে একটি মিলিটারি জিপ চলে গেল। জিপটি দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হলাম। পরক্ষণে দেখলাম, মিলিটারি জিপটি ঘুরে এসে আমাদের হোস্টেলে প্রবেশ করছে। বুঝতে বাকি রইল না, নির্ঘাত মৃত্যুর মুখে আমরা। মিলিটারি জিপ হোস্টেল গেটে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই কী ভেবে আমরা নিচতলায় যারা ছিলাম, তারা সবাই ডাইনিং রুমে আশ্রয় নিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলাম। মিলিটারিরা করিডর দিয়ে চলাফেরা আর ওপর-নিচ করছিল। বুটের মচমচ শব্দে বুকের ভেতরটা তখন হিমশীতল হয়ে গেছে। শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। হাত-পাগুলো অবশ হয়ে গেছে। নড়তে পারছিলাম না। এরই মধ্যে বুড়ো সুইপারটা হাঁচি দিতে যাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি করে ওর মুখ চেপে ধরলাম।

এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। দুপুরের পর বুঝতে পারলাম, হোস্টেলের পেছনের বস্তিতে আগুন দিয়েছে পাকিস্তানি আর্মি। পোড়ার মচমচ শব্দ শুনতে পেলাম। বস্তিবাসীর কোলাহল ও আর্তনাদে বুঝতে পারলাম, মিলিটারি ছাদের ওপর থেকে বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এবং গুলি ছুড়ছে। দুপুরের আরও কিছু পরে টের পেলাম, সেনারা বিভিন্ন রুমের দরজার কড়া নাড়ছে। বিভিন্ন কক্ষ তছনছ করার শব্দের সঙ্গে গুলি এবং একটা গোঙানির শব্দও ভেসে আসছিল। একসময় ডাইনিংরুমের দরজার কড়া নাড়তে থাকল মিলিটারি। সেই সঙ্গে দরজায় বুটের লাথিও মারছিল। আমরা সবাই মিলে দরজা চেপে ধরলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, যা হয় হবে, দরজা খুলব না।

সবাই নিশ্চিত ছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের জীবন মিলিটারির হাতে শেষ হয়ে যাবে। ডাইনিং রুমের ভেতরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। মনে হয়, সে মুহূর্তে আমাদের সবার শ্বাস-প্রশ্বাসও বন্ধ ছিল। এক-একটি সেকেন্ড মনে হচ্ছিল কত দীর্ঘ; সময় শেষ হতে চায় না। মনে হয়েছে, এক্ষুনি জীবনদীপ নিভে যাবে। কী মনে করে মিলিটারিরা ডাইনিং রুমের দরজা ভাঙল না। আমরাও নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে রক্ষা পেলাম। আমরা ভাবছিলাম, শাহনেওয়াজ ভাই, নজরুল ভাই ও কিবরিয়া স্যার বেঁচে আছেন কি না।

সন্ধ্যার কিছু আগে মিলিটারিরা হোস্টেল ত্যাগ করে। ভয়ে সামনের দরজা খোলার সাহস পেলাম না। পেছনের দরজা দিয়ে বের হলাম। যে যার মতো দেয়াল টপকে বস্তির ভেতর ঢুকে পড়লাম। সেখানে জব্বার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। বস্তির ভেতরে সে এক করুণ দৃশ্য। অগ্নিসংযোগের চিহ্ন, বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত ছিন্নভিন্ন কয়েকটি লাশ। বস্তির মানুষেরাই বেশির ভাগ মিছিলে অংশগ্রহণ করেছিল। মিলিটারির সব রাগ ও ক্ষোভ প্রকাশ পায় এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বস্তিতে শুধু লাশই চোখে পড়ছিল না, সঙ্গে অর্ধমৃত মানুষের গোঙানির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এভাবে রাতটা সেই বস্তিতেই কাটাই। পরদিন ২৭ মার্চ ভোরে কীভাবে এসে ঢাকা কলেজ অবধি পৌঁছলাম, জানি না। ঢাকা কলেজে এসে দেখা হলো পদার্থবিদ্যার এক অধ্যাপকের সঙ্গে (সম্ভবত ড. বেলায়েত হোসেন)। ছাত্রাবাস থেকে পালিয়ে আসা পরেশ, জাহাঙ্গীর আর আতাউরের সঙ্গেও দেখা হলো। সেখানে এসে জানতে পারলাম, শাহনেওয়াজ, নজরুল ও নজরুলের এক বন্ধুকে একসঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। শাহনেওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হয়। নজরুলকে কারা যেন আহত অবস্থায় ঢাকা কলেজের ভেতরে রেখে গেছে।

মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। ভয় ও উত্কণ্ঠা বেড়ে গেল। কোথায় যাব, কীভাবে যাব—সে চিন্তাটুকু পর্যন্ত করতে পারছিলাম না। এখানেই শুনতে পাচ্ছিলাম ছাব্বিশ মার্চ সারা দিন ও রাতে কারফিউ ছিল। জগন্নাথ ও জহুরুল হক হলে অসংখ্য ছাত্রকে এই কারফিউ চলাকালে হত্যা করা হয়েছে। ২৭ মার্চ সকাল নয়টা থেকে দু-তিন ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হয়েছে। বাইরের যা অবস্থা, কারফিউ না থাকলেও বাইরে যাওয়ার সাধ্য কারও নেই। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম থেকে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়ে গেছে। ২৭ মার্চ সকালে আমরা ঢাকা কলেজের সেই অধ্যাপকের বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এখনই ঢাকা শহর ছাড়তে হবে। ছাব্বিশ মার্চ রাতে আশপাশের অনেক লোক এসে ঢাকা কলেজে আশ্রয় নিয়েছিল।

বাইরে যাওয়ার জন্য বড় রাস্তায় এসে উঠলাম। কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে। এ সুযোগে অসংখ্য মানুষ নেমেছে রাস্তায়। যে যার মতো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। মনে হলো, পুরো শহরটা টালমাটাল হয়ে ঘুরছে; আস্তে আস্তে জনশূন্য হয়ে পড়ছে। আমরা মিরপুরের দিকে এগোতে থাকি। ফেরি পার হয়ে মিরপুরের ওপারে যাওয়া যেত। নদী ছিল শুকনো। আমরা হেঁটেই নদী পার হলাম।

হঠাত্ দেখি, মাথার ওপর হেলিকপ্টার। মনে হচ্ছিল হেলিকপ্টার বোধহয় আমাদেরই ফলো করছে। মিরপুরের ওপারে তখনো মিলিটারি আসেনি। আমি, পরেশদা, জাহাঙ্গীর ভাই ও আতাউর—চারজনে হাঁটছি তো হাঁটছিই। আমাদের আশপাশে অনেকেই হাঁটছে। তারাও ঢাকা ছাড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে ধামরাই পর্যন্ত চলে আসি। পরেশদা ও জাহাঙ্গীর ভাইয়ের বাড়ি ধামরাই। রাতটা পরেশদার বাড়িতে কাটাই।

পরদিন আতাউর ও আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। গ্রামবাসী ঢাকা থেকে আসা লোকজনের কাছে জানতে চায় ঢাকার অবস্থা। আস্তে আস্তে সবাই জেনে যায় ঢাকায় মিলিটারিদের অত্যাচারের কথা, গণহত্যার কথা, অসংখ্য, অগুনতি নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করার কথা। গ্রামের লোকজনও আর ঘরে থাকতে চাইছে না। বাক্স-পেটরা মাথায় করে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে তারা নেমে পড়েছে রাস্তায়। কোনো যানবাহন নেই। হাঁটছে। সড়ক কিংবা গ্রামের রাস্তা ধরে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে।

হেঁটে হেঁটে মানিকগঞ্জে আতাউরের বাড়িতে এসে পৌঁছি। সেই রাত ও পরদিন ২৯ মার্চের রাতে আতাউরের বাড়িতেই ছিলাম। ৩০ মার্চ ভোর হতেই জামালপুর যাওয়ার চিন্তায় আমি অস্থির। কিন্তু পা দুটো যেন আর চলতে চাইছে না। তবুও জামালপুর যাওয়ার জন্য আবার রাস্তায় নামি। কীভাবে যাব—ভাবতে ভাবতে এসে একটা দোকানের পাশে গাছের নিচে বসে পড়ি। হঠাত্ শুনতে পেলাম রেডিও বাজছে। একজন কানের কাছে একটা রেডিও তুলে ধরেছে। অন্যরা গোল হয়ে বসে শুনছে। কলকাতা থেকে খবর হচ্ছিল। মোটামুটি যা শুনলাম, তাতে বলা হয়েছে ২৫ মার্চের রাতে ধ্বংসযজ্ঞের কথা, পূর্ববাংলায় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা। একটু বিরতি দিয়ে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে পড়তে শুরু করি। হঠাত্ একটা ট্রাকের শব্দে অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। ট্রাকটি টাঙ্গাইল যাবে। উঠে বসলাম। যতটা যাওয়া যায়। মাঝপথে ট্রাক থেকে নামতে হলো। আবার অপেক্ষা করছি বাকি পথ কীভাবে যাব। লোকজনের চোখে-মুখে একটাই প্রশ্ন, উত্কণ্ঠা—শেখ মুজিব বেঁচে আছেন কি না। পথচারীদের কেউ এ প্রশ্নের উত্তর জানে না।

অনেকটা সময় বসে ছিলাম। অবশ দেহটাকে কোনোরকমে টেনে তুলি। দ্বিতীয়বার ট্রাকে চেপে বসি। কীভাবে জামালপুর আসি এবং বাড়িতে পৌঁছাই বলতে পারব না। বাড়িতে এসে দেখি, বাবা-মা-বোন সবাই আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। আমাকে দেখেও তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল না আমি বেঁচে ফিরে এসেছি।

বিশ্বাস আমারও হচ্ছিল না। অনেকদিন আমি ঢাকার সেই গোলাগুলির শব্দ ভুলতে পারিনি। সারাক্ষণ বোমা আর মেশিনগানের ঠা-ঠা-ঠা শব্দ শুনতাম। উপলব্ধি করার চেষ্টা করতাম—আমি আসলে এখন ঢাকায়, না বাড়িতে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত