বিজ্ঞাপন
default-image

ক্যারল: বাংলাদেশ প্রশ্নে আপনার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির কোনো অভিলাষ নেই। তাহলে কবে নাগাদ শেষ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন হবে?

মিসেস গান্ধী: এ পর্যায়ে বলা কষ্টকর। বিষয়টি প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করি তা শিগগিরই ঘটবে।

ক্যারল: কত সপ্তাহ বা মাস এমন কিছু কি ভাবছেন?

মিসেস গান্ধী: এখনো বিষয়গুলো এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে বলে আমি এ অবস্থায় কিছু বলতে পারছি না। সেখানকার জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। অবাঙালিদের প্রতি এবং অন্যান্য বিষয়েও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। আমি মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনী এ ক্ষেত্রে সাহাঘ্য করতে পারবে।

ক্যারল: আপনি কি আবারও সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকা ভারতের অধিকারে রাখার ইচ্ছে আপনার নেই?

মিসেস গান্ধী: আমি মনে করি আমি সুনির্দিষ্টভাবেই জনসভায় এবং সংসদে বলেছি যে আমাদের সীমানা সম্প্রসারণের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।

ক্যারল: পাকিস্তানের অধিকারে যে এলাকা রয়েছে যা আপনার মতে ন্যাঘ্যত ভারতের সে ক্ষেত্রেও কি এমনই কথা প্রযোজ্য?

মিসেস গান্ধী: আমি বলেছি যে আমরা বল প্রয়োগ করে তা উদ্ধার করব না। কিন্তু আপনি জানেন, আমরা কেবল বিশ্বাসই করি না, এটা প্রমাণিতও হয়েছে যে যুদ্ধ রহিতকরণ রেখা বরং খামখেয়ালির মাধ্যমে নির্ধারিত এবং তা শান্তি নিশ্চিত করতে সাহাঘ্য করে না। তবে এটা নিয়ে সরকার নতুন করে বা নতুন কিছু ভাবছে না।

ক্যারল: বাংলাদেশের জন্য তার নেতা শেখ মুজিবুরের বিশেষ প্রয়োজন। তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ভারত কী করছে? আপনি কোন ধরনের চাপ দিচ্ছেন?

মিসেস গান্ধী: আমি মনে করি না আমরা অনেকটা চাপ দিতে পারব। আমাদের দুতাবাসগুলোর মাধ্যমে আমরা বিশ্ব সরকারগুলোর কাছে আপিল করেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে চিঠি লিখেছি। আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি, তারা কিছুটা চাপ দেবে। আজ সকালেই দেখলাম আমেরিকান সরকার (পাকিস্তানের সাথে ভারতের) যুদ্ধ বিরতির কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করে বসেছে; আশা করি তারা তাহলে এ ব্যাপারটাও দেখবে।

ক্যারল: কিন্তু আপনি তো তার জন্য জিম্মি হিসেবে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের আটকে রেখেছেন। এটা কি সমঝোতার দর কষাকষিতে একটা ভূমিকা রাখতে পারে?

মিসেস গান্ধী: এ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি জানি না কীভাবে সে আলোচনা হবে বা কী ঘটবে।

ক্যারল: ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে বলে মনে করেন?

মিসেস গান্ধী: পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে এ নিয়ে আমার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। আমি মনে করি দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে যারা এই সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আমাদের প্রতি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। যখনই আমাদের কেউ যেকোনো উদ্দেশে সেখানে গিয়েছে যেমন শিখদের, অতীতে আমাদের ক্রীড়া দলকে তারা উষ্ণ স্বাগতম জানিয়েছে।

ভারতেও দেখবেন পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো কথা নেই; এটা ঠিক তাদের খবরের কাগজে ঘৃণা প্রচারণা অব্যাহত আছে। এমনকি শিক্ষা কর্মসূচিতে। ...ভারতে কী ঘটছে, উন্নয়ন কীভাবে হচ্ছে সে দৃষ্টিতে যদি তারা তাকায়, আমরা যদি সহযোগিতা করি তাহলে দুই দেশই আরও শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান হয়ে আমাদের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে পারব।

ক্যারল: আপনাকে যুক্তিসংগত আশাবাদী শোনাচ্ছে।

মিসেস গান্ধী: আমি মনে করি আমি একজন আশাবাদী মানুষ।

ক্যারল: বাংলাদেশ ও শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের অবস্থান বুঝতে না পারায় আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিরস্কার করেছেন, ফলে আপনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। যদি ধরে নেই আপনার প্রত্যাশা যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কের উন্নয়ন, তাহলে আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদক্ষেপ গ্রহণ দেখতে চান?

মিসেস গান্ধী: হ্যাঁ, এটি আপনিই উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিবের মুক্তি তাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্তবতায় স্বীকার করতে হবে। তাদের পাকিস্তান পরিস্থিতির বাস্তবতাও মানতে হবে। একটা দূরের দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে পারে না, হস্তক্ষেপও করতে পারে না। আপনার পছন্দের বিশেষ সরকারকে আপনি সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সরকার সে দেশের জনগণের জন্য সঠিক কি না? যদি তা না হয়, তাহলে এটি কখনো শক্তিশালী সরকার হতে পারে না—এর পেছনে যত সেনাবাহিনীই থাকুক না কেন, তাতে কিছু এসে যায় না। এটা আমাদের বিষয় নয়, তাদের। এটা পাকিস্তানের ব্যাপার।

ক্যারল: বর্তমানে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের চমৎকার সম্পর্ক। এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথবিষয়ক ব্রিটেন কি করতে পারে বলে আপনার ধারণা?

মিসেস গান্ধী: আমি আগেই বলেছি বাইরের শক্তি যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্রিটেন সম্প্রতি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আপনারা আগে করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অংশত সে কারণেই সৃষ্টি হয়েছে—কেবল আপনাদের নয়, অন্যদের হস্তক্ষেপও।

ক্যারল: আপনি কি মনে করেন আপনার এই উদ্বেগের বিষয়টি আমরা সবাই অবহিত?

মিসেস গান্ধী: হ্যাঁ, আমি মনে করি আপনারা জানেন।

ক্যারল: আমরা যদি বাংলাদেশকে আগে স্বীকৃতি দিই, আপনি তা স্বাগত জানাতেন?

মিসেস গান্ধী: বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানাবে।

ক্যারল: আপনি কি মনে করেন আমাদের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে সংকট সমাধানে সহায়ক হবে?

মিসেস গান্ধী: আমি মনে করি তা হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, কারণ তারা বুঝবে তাদের বন্ধু আছে।

ক্যারল: গত সপ্তাহে মি. কুজনেতজভ যখন দিল্লিতে আসেন, তখন কি বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি দান নিয়ে আলোচনা করেছেন।

মিসেস গান্ধী: না, আমরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ করিনি। তবে আমরা নিশ্চয়ই আশা করব, আরও বহুসংখ্যক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।

ক্যারল: অন্য সব দেশ পেছনে ফেলে কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ছুটে আসবে—এটাকে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন না?

মিসেস গান্ধী: এটাকে বরং আমি এভাবে দেখতে চাই, যত বেশিসংখ্যক দেশ স্বীকৃতি দেবে, বাংলাদেশ তত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এখন বাংলাদেশকে যেসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে তখন তার সমাধান সহজ হয়ে যাবে।

আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, স্বাধীনতা দরজাটা খুলে দেয়; কিন্তু আসল কাজ আসে তারপর।

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দুটি অফিসের একটি দিল্লির প্রশাসনিক ভবন, যেটি সাউথ ব্লক নামে পরিচিত। সানডে টাইমস -এর নিকোলাস ক্যারোল এখানে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত