বিজ্ঞাপন

দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হয় স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধ। এ যুুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আগে কখনো এভাবে যুদ্ধ করেনি। তাই যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না বললেই চলে। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য উদ্গ্রীব এ দেশের মানুষের কাছে সে যুদ্ধ কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের পেছনে ছিল ব্যাপক জনসমর্থন। এ দেশের ভূখণ্ড ছিল তাদের চেনা। অসীম সাহস সম্বল করে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত যুদ্ধবাজ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে। পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে অপ্রস্তুত জাতি শুরুর কিছুদিন সীমিত অস্ত্র আর শক্তি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। সে অবস্থাটি ছিল সাময়িক। প্রাথমিক দুর্বলতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বাহিনী সংগঠিত হতে থাকে। বাংলাদেশ বাহিনী, যা তত দিন মুক্তিবাহিনী নামে সাধারণ মানুষের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, ছড়িয়ে পড়ে দেশের সর্বত্র। স্থানীয় জনগণের একান্ত সহযোগিতায় হাট, বাজার, শহর, বন্দর, গ্রাম সব জায়গায় তারা শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। বন্ধুরাষ্ট্র থেকে পাওয়া এবং শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র ও অন্যান্য সমরাস্ত্রের সাহায্যে প্রতিরোধযুদ্ধ ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয় গেরিলা যুদ্ধে।

আমাদের মুক্তিবাহিনীর সামরিক তত্পরতা শুধু ভূমিযুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। তারা নৌপথ ও আকাশপথেও আক্রমণ করতে শুরু করে। অবশেষে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় সেটি পরিণত হয় সর্বাত্মক যুদ্ধে। সে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসে বিজয়। জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।

নভেম্বর মাসে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে চলে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন সে সময়ের মাঠপর্যায়ের নেতারা। সেই নেতাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকলেও তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন একেবারে অনভিক্ত বা স্বল্প অভিজ্ঞ। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং তা শত্রুর ওপর প্রয়োগ করেন। কোনো কোনো খণ্ডযুদ্ধের বিজয় বাঙালির মনোবল অনেক গুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের করে তুলেছিল আরও দুর্দমনীয় ও সংকল্পবদ্ধ। কোনো কোনোটির বিজয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তার সফল পরিণতির দিকে। সব যুদ্ধেই যে মুক্তিযোদ্ধারা সফল হয়েছিলেন, তা নয়। তবে কোথাও কখনো ব্যর্থ হয়ে থাকলে পরের অভিযানে তাঁরা তা শুধরে নিয়েছেন। প্রতিটি খণ্ডযুদ্ধ তাঁদের আরও সাহসী করেছে, করেছে আরও কৌশলী ও দক্ষ। দিয়েছে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা।

মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে প্রায় ৪২ বছর আগে। অথচ যুদ্ধের বর্ণনাগুলো এখনো যথাযথভাবে সংরক্ষিত হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের বীরদের যুদ্ধগাথা এখনো অনেকের ভালো করে জানা নেই। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত প্রথম আলোর এই বিশেষ ক্রোড়পত্রে মাঠপর্যায়ের কয়েকজন সমরনেতা তাঁদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। খণ্ডযুদ্ধে অংশ নেওয়া এই মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধবর্ণনার মধ্য দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোকে অনুভব করতে পারব, জানতে পারব তাঁদের বীরত্বগাথা।

এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, বীর উত্তম: মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান, বর্তমানে পরিকল্পনামন্ত্রী

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত