বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন বিশ্ব ইতিহাসেরই এক অন্যতম ঘটনা। শত শত বছর ধরে বাঙালি স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছে। এ দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-দার্শনিক এবং রাজনৈতিক নেতারাও নানাভাবে বাঙালির সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করেছেন। কিন্তু স্বপ্নের সেই স্বাধীনতা আসেনি। তবে ইতিহাসের নানা পালাবদলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের নানা পদ্ধতি-পন্থা এবং পথরেখা কখনো অলক্ষ্যে কখনো পরোক্ষে কখনো বা একেবারে ধরাছোঁয়ার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কিছুটা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান আন্দোলনের মধ্যেও পূর্ব বাংলার বাঙালি মুসলমান প্রকৃতপক্ষে নিজ অঞ্চলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রসত্তারই আকাঙ্ক্ষা করেছিল। কিন্তু নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে তা বাস্তবায়িত হয়নি। অবশেষে পাকিস্তানের ভেতরেই বাঙালি তার নিজস্ব স্বাধীনতার প্রকল্পটিকে নানা আঙ্গিকে বিন্যস্ত করে তা বাস্তবায়নে প্রয়াসী হয়। কখনো বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, কখনো চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভ, কখনো সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র-গণ-আন্দোলন, কখনো ছয় দফা এবং এসব অগ্নিগর্ভ উপাদানের সমন্বয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং তাকেই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মোড়কে সাজিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় এই স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার একটি অজেয় পাটাতন তৈরি করে দেয়।

জনগণের এই নিরঙ্কুশ নির্বাচনী ম্যান্ডেট লাভ করেই বাংলার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা লাভের সব প্রাথমিক প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করেন। একাত্তরের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে সেই সম্পর্কে যেমন অবহিত করেন, তেমনি তাদের করণীয় নির্ধারণ করে দেন এবং অনন্য কৌশলে ওই ভাষণে এমনভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা হতবাক হয়ে সেই ঘোষণা শোনে, কিন্তু তাদের কিছুই করার থাকে না। এরপর বাকি থাকে হানাদারদের দেশ থেকে তাড়িয়ে সগৌরবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের পতাকাটি উত্তোলন করা। সেই কাজটিই করতে হয়েছে পূর্ব বাংলার লড়াকু বাঙালিকে ‘স্বাধীনতা নয় মৃত্যু’ এই দীক্ষামন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে।

উপর্যুক্ত বয়ানটি আমাদের মহান স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি সরল ন্যারেটিভ। এই ন্যারেটিভের সফলতম পরিসমাপ্তির নানা ঐতিহাসিক গৌরবগাথা আছে, উদ্ভাবনাময় উদ্যোগপর্ব আছে, আছে বহু উপায়-উপকরণ এবং নানা কীর্তিগাথা। এই বিষয়গুলো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জনের অবিস্মরণীয় স্মারক। এই স্মারকগুলোই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতা অর্জনের পর্যায়ক্রমিক সামগ্রিকতাকে বুঝে নেওয়ার জন্য অপরিহার্য। প্রথম আলো স্বাধীনতা দিবস বিশেষ সংখ্যাটিতে এসব অপরিহার্য স্মারকগুলোকেই এবার বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু কৌশলময়ভাবে একাত্তরের ৭ মার্চেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। ঘোষণাটি যাতে একতরফা ঘোষণা হয়ে না যায়, তার জন্য একটি অন্তরাল সৃষ্টি করা হয়েছিল।

কিন্তু ২৫ মার্চের কালরাতে যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরপরাধ বাঙালির ওপর অন্যায়ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণহত্যা শুরু করে দিল, তখন তিনি ওয়্যারলেসে সারা দেশে পাঠিয়ে দিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা। রাত ১২টার পরে প্রচারিত এই ওয়্যারলেস বার্তায় বলা হলো, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ এই ঘোষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী। তাঁর লেখা নিয়ে সাজানো ‘বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস বার্তা’। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কালুরঘাটের ট্রান্সমিটারটি ছিল ইতিহাস জ্ঞাপনে এক বাঙ্ময় যন্ত্র। সেই যন্ত্রের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথাও আছে স্বাধীনতার এই বিশেষ সংখ্যায়। এই দুটি উপাদানই স্বাধীনতার মৌখিক গণজ্ঞাপনতাকে সর্বত্রগামী ও প্রাণবন্ত রূপ দিয়ছিল। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এ দুটি উপাদানের ভূমিকা ছিল ব্যাপক ও বিপুল।

‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি অনন্য মর্মবাণীসমৃদ্ধ বয়ানই শুধু নয়, আমাদের সাংবিধানিক দলিলেরও মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যে দলিলে মানুষের সব অধিকারের সর্বাধিক নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রের নেই। সেদিক থেকে আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল্যও অসাধারণ। এ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞের রচনা বর্তমান সংখ্যাটিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

মূল ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে চারপাশে সংঘটিত ঘটনাগুলো মূলকে শক্তিশালী করে। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধকেও এভাবেই সমৃদ্ধ করেছিল তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা ঐতিহাসিক কীর্তি। স্বাধীনতার পতাকা, তার নির্মাণ এবং উড্ডয়নের ইতিহাসও শুধু অপরিহার্যই নয়, একেবারেই মূলেরই অংশ। কারণ পতাকা ছাড়া কোনো স্বাধীনতা হয় না, হয় না কোনো স্বাধীন দেশ। মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকায় ২ মার্চ একাত্তর এবং ৩ মার্চে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পল্টন ময়দানে। ছাত্রনেতারা সে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। পল্টন ময়দানের সে উত্তোলনের মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সে ছিল ইতিহাসের এক দুঃসাহসিক প্রয়াস। কিন্তু যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষভাবে ঘোষণা করা হয়, তারপর যেভাবে সরকারি পর্যায়ে পতাকা উত্তোলিত হলো, তারও ইতিহাস তো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসেরই এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেই ঘটনা অন্তভু‌র্ক্ত হয়েছে স্বাধীনতার বিশেষ সংখ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালি যুদ্ধ করেছে, কখনো লাঠি, দেশীয় অস্ত্র বা তীর-ধনুক নিয়ে। আর ছিল বিপুলভাবে রাইফেল। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে, পেয়েছে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের আনুকূল্য, কখনো বা তৎকালীন বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের কাছ থেকে। পরবর্তীকালে মিত্রবাহিনীর সৌজন্যেও অস্ত্র লাভ করেছে। অতএব বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের সমরাস্ত্রের ইতিহাসটিও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষভাবে থাকা চাই। সে বিষয়টিও যুক্ত হয়েছে বর্তমান সংখ্যায়।

অস্ত্রই শুধু মোক্ষম হয় না সব সময়। একমাত্র অস্ত্রই যুদ্ধ জেতায় না। অন্য অনেক উপাদানও কখনো প্রতীকীভাবে, কখনো মর্মগতভাবে, কখনো দেশপ্রেমের অনন্য আবেগসমৃদ্ধ ভাবাবেগও মানুষকে এমন মারকুটে ও লড়াকু করে তুলতে পারে—যা অস্ত্রের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এই অসাধারণ শক্তির সেল ছিল কোনো অস্ত্র নয়, একটি চিত্রকর্ম। বাংলার শক্তিমান শিল্পস্রষ্টা কামরুল হাসানের ‘এই জানোয়ারকে হত্যা করতে হবে’ ছিল এমন একটি অনন্য সাধারণ অস্ত্র। এটি বুকের কাছে রেখে মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে লড়ে গেছেন। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই চিত্রটিও এক ঐতিহাসিক ভূমিকায় নিজকে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই স্মারকটিকেও কখনো ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। কারণ এ ছিল এক ভীষণ শক্তিশালী অস্ত্রের চেয়েও শক্তিধর।

কিছু কিছু ব্যাপারকে সাধারণ বলে মনে হয়, মনে হয় নিরীহ। তেমনি একটি উপাদান হলো ডাকটিকিট। প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়েছিল, তা শুধু ডাকটিকিট সংগ্রহকারীদের কাছে এক অমূল্য নিদর্শনই ছিল না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকেও ধারণ করেছিল এই ডাকটিকিট তার ঐতিহাসিক দালিলিক মূল্যে। এমন যে ফুটবল খেলা, যাকে মনে করা যায় শুধুই বিনোদনের উপাদান। সেই ফুটবল খেলাও আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কম অবদান রাখেনি। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলা শুধু খেলাই ছিল না, ছিল যেন যুদ্ধ জয়েরই অন্য নাম। এই ফুটবল খেলার মধ্য দিয়েই আমাদের সৌর্য-বীরত্ব এবং অনমনীয়তাকে প্রকাশের এক প্রয়াস ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহরের মাঠে-ময়দানে।

আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা গৌরবময়। পাকিস্তানের ২৩ বছরে তাঁরা পূর্ব বাংলার বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে শুধু লেখালেখিই করেননি, সংগ্রাম করেছেন নানা আঙ্গিকে, নানা পটভূমিকায়। সেই সংগ্রামও অনন্য গৌরবসমৃদ্ধ ছিল বলেই স্বাধীনতা লাভের অন্তিমলগ্নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর-আলশামসরা আমাদের মহান বুদ্ধিজীবীদের এক শ্রেষ্ঠাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেসব শহীদদের ব্যবহার্য জিনিসপত্রও আমাদের স্বাধীনতাকে যে কত বিপুল মূল্যে কিনতে হয়েছে তার এক স্মারক হিসেবে আমরা দেখে থাকি। সেই বিষয়ের লেখাটি আমাদের স্বাধীনতার এক করুণ আলেখ্য হিসেবে অন্তভু‌র্ক্ত হয়েছে এই সংখ্যায়। অমিত শক্তিধর পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হওয়ার পর বীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে রমনার রেসকোর্স ময়দানে যখন আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে, তখন তাৎক্ষণিকভাবে খঁুজে পেতে যে টেবিলটি এনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তার ইতিহাসটিও আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের অংশ। সেই টেবিলের বিবরণটিও অনুপুঙ্খভাবে অন্তভু‌র্ক্ত হয়েছে বর্তমান সংখ্যায়।

মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারকগুলো আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের অতি মূল্যবান বিষয়। এসব বিষয় সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা দেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

শামসুজ্জামান খান: প্রাবন্ধিক, বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১২ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত