বিজ্ঞাপন

যেকোনো দেশ বা জাতির স্বাধীনতাযুদ্ধের শুরুটা হয় সাধারণত অগোছালোভাবে সহজলভ্য দেশীয় আর হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাকামী মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে থাকে এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে যায়, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বাঙালির বুঝতে বাকি থাকে না, ন্যাঘ্য অধিকার বা ক্ষমতা দেনদরবার করে নয়, বরং জোর করে আদায় করতে হবে। কিন্তু ওই মুহূর্তে সামরিক জান্তাকে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য করা বা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার মতো শক্তি বাঙালির ছিল না। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের কারণে বাঙালির সশস্ত্র যুদ্ধের সূত্রপাত হয়।

শুরুতে পাকিস্তানি বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা বাঙালি রেজিমেন্টের সেনাসদস্যরা তাঁদের বহনযোগ্য হাতিয়ার নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন, ভারী অস্ত্র পরিবহনের সুযোগ না থাকায় সেগুলোর বেশির ভাগই ফেলে আসতে হয়। আর অবাঙালি-অধ্যুষিত ব্যাটালিয়নের বাঙালি সদস্য এবং ছুটিতে থাকা বাঙালি সেনাসদস্যরা হাতিয়ার ছাড়াই স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেন। দেশের সাধারণ মানুষ গাদাবন্দুক আর শিকার করার বিভিন্ন রকম বন্দুক নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রারম্ভিককালে ভারত কিছু অস্ত্রশস্ত্র দিলেও তা ছিল সাধারণ মানের। এসব সাধারণ ও হালকা অস্ত্র নিয়েই শুরু হয় বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধ।

জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ বাহিনীকে অধিক যুদ্ধোপযোগী করা এবং চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সাংগঠনিক পরিবর্তন আনা এবং তুলনামূলকভাবে নতুন ও উন্নত অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহ শুরু হয়। জুলাই মাসে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম ব্রিগেড এবং প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে জন্ম নেয় বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী। এরই মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর সরাসরি নেতৃত্বে বাঙালি নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ ও অভিযান শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত সাংগঠনিক পরিবর্তন আর নতুন নতুন সমরসম্ভার মুক্তিবাহিনীকে অধিক শক্তিশালী করে তোলে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি করে। এসব সাংগঠনিক উদ্যোগ ও সমরসম্ভার স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরাট ও ব্যাপক কর্মযজ্ঞের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ হলেও কয়েকটি উদ্যোগ ও সমরসম্ভারের ব্যতিক্রমী অবদান বা কৃতিত্ব লক্ষ করা যায়। এগুলোকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মাইলফলকও বলা চলে। এগুলোর নাম স্মরণে এলে স্মৃতিতে ভেসে আসে স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরবমণ্ডিত কিছু স্মৃতি। এ ধরনের উদ্যোগ বা সমরসম্ভারের মধ্যে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত তিনটি উদ্যোগ ও সমরসম্ভার সম্পর্কে কিছু তথ্য দেওয়া হলো।

জেড ফোর্স: বাংলাদেশ বাহিনী গঠনের পরপরই জেনারেল ওসমানী পদাতিক ব্যাটালিয়নগুলো নিয়ে ব্রিগেড সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন। তিনি মে মাসের শেষের দিকে প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তেলঢালায় (মেঘালয়) নিয়ে আসেন। ব্যাটালিয়নগুলোর ঘাটতি জনবল পূরণ এবং প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে যুদ্ধোপযোগী করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই তিন ব্যাটালিয়নকে নিয়ে ৭ জুলাই বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম ব্রিগেডের জন্ম হয়। পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডের সঙ্গে যোগ দেয় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ব্যাটারি বা ‘রওশন আরা ব্যাটারি’ নামের আরেকটি সিগন্যাল কোম্পানি। ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত হন লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান। ব্রিগেড সদর দপ্তর স্থাপিত হয় তেলঢালায়। ১০ সেপ্টেম্বর প্রধান সেনাপতি ব্রিগেড কমান্ডারের নামের আদ্যাক্ষর অনুযায়ী এই ব্রিগেডের নামকরণ করেন ‘জেড ফোর্স’। জেড ফোর্সের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা নির্ধারিত হয় বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এবং পরে সিলেটকেও ব্রিগেডের অন্তভু‌র্ক্ত করা হয়। ব্রিগেডের কর্মক্ষমতা প্রমাণের জন্য ৩১ জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল কামালপুর বিওপি, ২ আগস্ট তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল বাহাদুরাবাদ ঘাট এবং ৮ আগস্ট অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল নকশী বিওপি আক্রমণ করে। পরবর্তীকালে ডিসেম্বর মাসে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘জেড ফোর্স’ তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় বেশ কয়েকটি দুঃসাহসিক যুদ্ধ পরিচালনা করে। চূড়ান্ত যুদ্ধে জেড ফোর্সের ব্যাটালিয়নগুলো যৌথ বাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেডের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সিলেট অঞ্চল শত্রুমুক্ত করে।

মুজিব ব্যাটারি

default-image

নিয়মিত ব্রিগেড সৃষ্টির পর অধীনে থাকা পদাতিক ব্যাটালিয়নগুলোকে ফায়ার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৭১ সালের ২২ জুলাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কোনাবনে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ ইউনিটের জন্ম হয়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে এই ব্যাটারির নামকরণ হয় ‘মুজিব ব্যাটারি’। এই ব্যাটারিতে ৩ দশমিক ৭ ইঞ্চি ছয়টি কামান ছিল। এগুলো ১৯৪২ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে ভারতে প্রস্ত্তত হয়। এই ধরনের কামান সর্বপ্রথম ১৯২০ সালে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীতে যুক্ত হয় এবং ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তা ব্যবহৃত হয়। কামান থেকে প্রতি মিনিটে পাঁচটি করে গোলা সর্বোচ্চ ছয় হাজার ৪০০ মিটার দূরত্বে নিক্ষেপ করা যেত। প্রতিটি কামান পরিচালনার জন্য নয়জন ক্রু লাগত। পাকিস্তান বাহিনী থেকে পালিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে যোগ দেওয়া বাঙালি গোলন্দাজ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরা এই ব্যাটারি পরিচালনা করতেন। জনবলের ঘাটতির কারণে গণবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যকেও এই ব্যাটারিতে সংযুক্ত করা হয়। প্রথমে ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশা এবং পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলম মুজিব ব্যাটারিকে নেতৃত্ব দেন। ‘কে ফোর্স’ গঠিত হলে মুজিব ব্যাটারিকে কে ফোর্সের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে এ ইউনিট কাইয়ুমপুর, কসবা, সালদা নদী, আখাউড়া, নাজিরহাট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং নিপুণ ও লক্ষ্যভেদী ফায়ার সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।

২০১১ সালের ২৩ জুন ভারতীয় বাহিনীর প্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিং স্বাধীনতাযুদ্ধে ব্যবহৃত মুজিব ব্যাটারির দুটি কামান এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধানকে হস্তান্তর করেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর সামরিক জাদুঘরে মুজিব ব্যাটারির ছয়টি কামানসহ ‘মুজিব ব্যাটারি কর্নার’ উদ্বোধন করেন এবং সর্বসাধারণের জন্য তা উন্মুক্ত করেন।

অটার যুদ্ধবিমান

default-image

১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি ডিসি-৩ বিমান, একটি অটার বিমান আর একটি অ্যালুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। এ সময় পাকিস্তান বিমানবাহিনী এবং পিআইএ থেকে পালিয়ে আসা নয়জন কর্মকর্তা ও ৪৭ জন বিমানসেনা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। উইং কমান্ডার এ কে খন্দকারকে বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। নাগাল্যান্ড রাজ্যের ডিমাপুরে বিমানবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। অটার ও অ্যালুয়েটের সাহাঘ্যে বিমানবাহিনী তার আক্রমণ পরিচালনা করত আর ডিসি-৩ মূলত পরিবহনকাজে ব্যবহৃত হতো।

default-image

অটার বিমানটি কানাডায় তৈরি একটি বেসামরিক বিমান ছিল। এটি ভারত সরকার যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ সরকারকে দান করে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর সহায়তায় বেসামরিক বিমানটিকে যুদ্ধজাহাজে রূপান্তর করা হয়। অটার বিমানটির দুই পাখার নিচে ট্রাসের মাধ্যমে দুটি রকেট পড লাগিয়ে সাতটি করে ১৪টি রকেট বহন করার উপযোগী করা হয়। পেছনের দরজা খুলে লাগানো হয় মেশিনগান। এর মাধ্যমে একজন অপারেটর বসে থেকে এই মেশিনগানের সাহাঘ্যে গুলি চালাতে পারতেন। বিমানের মেঝের পাটাতন খুলে ২৫ পাউন্ডের ১০টি বোমা যুক্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। বোমাগুলো স্বয়ংক্রিয় ছিল না, ক্রুরা হাতের সাহাঘ্যে পিন খুলে লক্ষ্যবস্ত্ততে নিক্ষেপ করতেন। লক্ষ্যবস্ত্ততে আঘাত হানার সুবিধার্থে অটারের জন্য বিশেষ ধরনের এইমিং সাইট তৈরি করা হয়। অল্প দিনের মধ্যে বেসামরিক এই অটার বিমানটিকে শত্রুধ্বংসের দক্ষতাসম্পন্ন জঙ্গি বিমানে রূপান্তর করা হয়। অটারের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ৮০ মাইল। যদিও অটারের রাত্রিকালে ওড়ার যোগ্যতা ছিল না, তার পরও বেশির ভাগ অভিযান রাতের অন্ধকারেই করতে হয়। অটার যুদ্ধকালে মোট ছয়টি অপারেশনে অংশ নেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে দুঃসাহসিক অভিযান ছিল ৩ ডিসেম্বর পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির কাছে তেলের ডিপো ধ্বংস করা।

মুহাম্মদ লুৎফুল হক: লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১২ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত