বিজ্ঞাপন
default-image

আলোচনায় অংশ নিয়েছেন

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী,সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

হামিদা হোসেন,মানবাধিকারকর্মী

মেজর জেনারেল (অব.) আমীন,আহম্মেদ চৌধুরী বীরবিক্রম, সাবেক রাষ্ট্রদূত

সঞ্চালক

সাজ্জাদ শরিফ, উপসম্পাদক, প্রথম আলো

সাজ্জাদ শরিফ

সবাইকে শুভেচ্ছা। বিশেষ দিবস উপলক্ষে আগে আমরা এ রকম বৈঠক করতাম। তাতে নানা মতের সমন্বয় করা যেত। পাঠকেরা আকর্ষণ বোধ করতেন। বহুদিন পর আবার আমরা তেমন একটি বৈঠকে বসেছি।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর একটা পটভূমি আছে। ১৯৫০-এর দশক থেকেই আমাদের স্বাধিকার চেতনার স্ফুরণ ঘটতে থাকে। ষাটের দশকের শেষ ভাগে সেটা তীব্র হয়ে ওঠে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার ধরনটি কী, তার কিছু লক্ষণ এ সময়ে আওয়ামী লীগের ছয় দফা এবং ছাত্রদের ১১ দফায় প্রকাশ পায়। কিন্তু ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অসংখ্য নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে হত্যা করার পর পুরো পরিস্থিতি বদলে যায়। মুক্তিযুদ্ধকে আমরা জনযুদ্ধ বলি। কারণ এর পর শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত পুরুষ-নারীনির্বিশেষে দেশের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠী এতে জড়িয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আরও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে আগের আকাঙ্ক্ষার রূপান্তর ঘটে। আমরা বুঝতে চাই, সে জনযুদ্ধে মানুষের সম্পৃক্ততার পেছনে তাদের প্রেরণার জায়গাটা কী ছিল? যদি আমরা সাধারণভাবে বলি যে তারা ‘স্বাধীন দেশ’ চেয়েছিল, তাহলে সেই ‘দেশ’-এর রূপটি তাদের মাথায় কী ছিল? কিংবা ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বলতে আসলে আমরা কী বোঝাতে চাই।

আমরা বুঝতে চাই, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেসব আকাঙ্ক্ষা বা চেতনার বাস্তবায়ন আদৌ ঘটেছিল কি না, ঘটতে শুরু করেছিল কি না। অংশত কিছু যদি ঘটে থাকে, স্বাধীনতার পরের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে—সেনা অভ্যুত্থান, স্বৈরাচার প্রভৃতির ভেতর দিয়ে—তা আবার অপসৃত হয়েছে কি না। এ সময়ে এসে সেগুলো থেকে ফিরিয়ে আনার কিছু আছে কি না, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কাছ থেকে নতুন কিছু নেওয়ার আছে কি না, কিংবা আনার উপায় কী। প্রথমে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে অনুরোধ করছি আলোচনা শুরু করার জন্য।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

মুক্তিযুদ্ধ কি নয় মাসের ব্যাপার, নাকি আরও আগে থেকে এর প্রসঙ্গ টানতে হবে? একাত্তরের মার্চ মাসে যে অসহযোগ আন্দোলন হলো, সেটিকে তো মুক্তিযুদ্ধের একেবারে পূর্বপ্রস্তুতিই বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের ব্যাপার নয়, তার আগের অনেক ঘটনা রয়ে গেছে। প্রত্যাশার কথা যদি বলেন, ১৯৭০-এ নির্বাচন হলো, সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে ইশতেহার ছিল সেখানে অনেক কিছুই ছিল। একটা হলো ছয় দফার বাস্তবায়ন। ছয় দফার মূল কথাটা হচ্ছে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।

পরে আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লাম। যুদ্ধ জয়ের পর দেশ যখন স্বাধীন হবে, আমরা কী চাইব সেটা ওই সময়ে নতুন করে বলার কোনো সুযোগ বোধহয় ছিল না। যুদ্ধ পরিচালনা ও সংগঠিত করা, আন্তর্জাতিক সাহায্য-সমর্থন আদায় করা—এসবই তখন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাহাত্তরে সংবিধান রচিত হলো। আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো একেবারে পরিণত এবং স্পষ্টতম রূপ পেল সেই সংবিধানে। সংবিধান আমাদের শুধু একটা গণতান্ত্রিক দেশ দিচ্ছে না, একটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ দিচ্ছে।

সেই সংবিধানে আমাদের কী কী করতে হবে, কী কী নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে—সব বলা আছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো: আমরা চেয়েছি সংসদীয় গণতন্ত্র। সে প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে, আবার হয়ওনি। কারণ আমরা দেখেছি ’৭৫ থেকে ’৯০ পর্যন্ত অন্ততপক্ষে বছর পনেরো সংবিধানসম্মতভাবে দেশ চলেনি। সংবিধান কখনো বাতিল করা না হলেও এটিকে বদলে দেওয়া হয়েছে। যেভাবে দেশ চলেছে তাতে সংবিধানে আমাদের যে জাতীয় আকাঙ্ক্ষাগুলো ভাষা পেয়েছে, সেগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সেটা ভাবারই সুযোগ আমরা পাইনি। তখন সবকিছুই হারিয়ে গেছে আমাদের। সংবিধান হারিয়ে যাওয়া মানে সব প্রত্যাশা হারিয়ে যাওয়া। নব্বইয়ে একটা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে স্বৈরাচারের পতন হলো। তখন তিন জোট সম্মিলিতভাবে একটা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে অতঃপর অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে না প্রভৃতি।

ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ তিন জোটের ঘোষণাকে বাংলাদেশের ম্যাগনাকার্টা বলেছিলেন। সেটা যদি সামনে রাখি, তাহলে প্রথমেই আসে সংসদীয় গণতন্ত্র, স্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার হাতবদল এবং কোনোভাবেই যাতে অসাংবিধানিক উপায়ে কেউ ক্ষমতায় না আসে তার নিশ্চয়তা বিধান করা। গত ১৫ বছরে তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমরা তিনটি সংসদ পেলাম। তিনটিই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এক পায়ে চলেছে যেন। সরকার আর বিরোধী পক্ষ—এই দুই পায়ের ওপরই সংসদ চলে। মাঝে মাঝে ওয়াকআউট সংবিধানসম্মত। কিন্তু লাগাতার সংসদ বর্জন করা হলে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে আর বলা যায় না।

গত ১৫ বছরে তা-ই হয়েছে। সুতরাং তিন জোটের সম্মিলিত ঘোষণার আকাঙ্ক্ষাই বলুন, কিংবা সংবিধানে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে সেগুলোই বলুন, আমি বলব পূরণ হয়নি। এবারের নির্বাচনের পর একটা আশা জেগেছে। কারণ এখন পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি, যাতে বলা যায় যে গত ১৫ বছরে তিনটি সংসদে যা ঘটেছে তারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, স্পিকারের নির্বাচন—কোনো নির্বাচন নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। বিরোধী দল প্রতিপক্ষ দাঁড় করায়নি; কিন্তু সংসদ একটু হোঁচট খেয়েছে। আসন বণ্টন নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ছোট ব্যাপার, কিন্তু সংসদে কে কোথায় বসবেন প্রভৃতি প্রশ্নে যখন কদিন সংসদ বয়কট হলো, তখন আবার সেই পুরোনো ভয়টা জাগল। মনে হলো আমাদের মনের গড়নটা বদলায়নি। বর্তমান সংসদের মাত্র প্রথম অধিবেশন চলছে। সুতরাং আমরা এটার ওপর নজর রাখব। প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কি না, তার প্রথম পরীক্ষা সংসদ ঠিকমতো চলছে কি না তার ওপর। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো এবার প্রথম থেকেই নিয়মনীতি মেনে যেভাবে শুরু হয়েছে, এটা অত্যন্ত আশাপ্রদ।

এখানে আওয়ামী লীগকে কৃতিত্ব দিতে হবে। প্রথমবার যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা কমিটি পদ্ধতি চালু করার চেষ্টা করেছিল, তবে পুরোপুরি সফল হয়নি। অনেক কমিটি ঠিকমতো বসেনি। মাঝে যে পাঁচ বছর গেল, সে সময় কমিটি পদ্ধতি একেবারেই দুর্বল হয়ে গেল। ছিল কি না বোঝাই যায়নি। আসলে প্রত্যাশা পূরণের যে প্রশ্নটা, সে প্রশ্নে প্রথমেই আমি জাতীয় সংসদ যেভাবে চলা উচিত, সেভাবে ঠিকমতো চলছে কি না, সেটাকেই আমি সবচেয়ে বড় বিষয় বলে মনে করি।

সাজ্জাদ শরিফ

ধন্যবাদ। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বললেন, সংবিধান হারিয়ে গিয়েছিল মাঝখানে। এর সঙ্গে কী এমন ব্যাপার ঘটেছিল যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে আকাঙ্ক্ষাগুলো জন্ম নিয়েছিল, ওই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ওই আকাঙ্ক্ষাগুলোও হারিয়ে গিয়েছিল? সেসবের মধ্য থেকে আমাদের আবার কিছু কি ফিরিয়ে আনার দরকার বা ফিরিয়ে আনার উপায় আছে কি না।

হামিদা হোসেন

আপনারা দুজন, আজকের দুই আলোচক তো খুব সরাসরি জড়িত ছিলেন। আমি দর্শক হিসেবে কথা বলতে পারি। স্বাধীনতার আগে আমি ফোরাম পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ওই সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের বিষয়গুলো ফোরাম-এ প্রতিফলিত হতো। মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের বিষয় তো না। আন্দোলন হচ্ছিল অনেক দিন থেকে। এই আন্দোলন থেকে আমি যেটা দেখেছি, তখন রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর সংস্কৃতির খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। সেখানে একটা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের প্রত্যাশা ছিল। সংবিধানে তার প্রতিফলন ঘটেছে।

সংবিধানে শুধু বাঙালিদের কথা নয়, বিভিন্ন জনজাতির কথাও আসবে—তখন হয়তো এই বাস্তব বোধটা ছিল না। সংবিধানের মধ্যে শুধু বাঙালির কথা বলা হয়েছে। এম এন লারমা তাঁর প্রতিবাদ করেছিলেন সংসদে। একটা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্যে অনেক কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। তবু আমার মনে হয়, বৃহত্তর একটা সমাজের চিন্তা ছিল তখন। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা যদি বলি, সংবিধানে অনেক কিছু বলা হয়েছে: বৈষম্য না থাকার কথা, সমাজতন্ত্রের কথা। সমাজতন্ত্র থেকে সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা এসেছে। পাকিস্তান আমলে রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই সামরিক সরকারের আওতায় ছিলাম।

পুরো আন্দোলনই ছিল গণতন্ত্রের জন্য। অনেক আশা থাকে, সব তো পূরণ হয় না। এটা লম্বা একটা প্রক্রিয়া। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী সংসদীয় পদ্ধতির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি দেখি যে প্রথম থেকে, বাহাত্তর থেকে একটাই দল ছিল। একটা দল থাকলে সংসদীয় রাজনীতির চর্চা খুবই দুর্বল হয়ে যায়। নব্বইয়ের পর প্রথম সংসদে দুই দলেই কমবেশি প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু দুঃখজনক যে রাজনীতিতে সংঘাতের সংস্কৃতি রয়েই গেছে, ফলে সংসদ ওভাবে কার্যকর হয়নি। গত সংসদে দেখলাম খুব আধিপত্যপ্রবণ একটা দল, তারা অন্য কোনো দলের কথা শুনবে না, অন্য দলকে কথা বলতে দেবে না।

এ সংসদে আবার বিরোধী দল খুবই ছোট, কথা বলবে কীভাবে? অনেকে সংসদ থেকে বেরিয়ে বাইরে কথা বলছেন। এখন অনেক টেলিভিশন চ্যানেল হয়েছে। তাঁরা সেখানে কথা বলছেন। আমার মনে হয়, দেশের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও খুব শক্তিশালী ছিল না। যা ছিল, ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যেমন, বিচার বিভাগ। এখানে একটা রাজনীতির ভাব চলে আসছে। এখন তো বিতর্ক চলছে, বিচারকদের নির্বাচন কীভাবে হয়, শুধু নিম্ন আদালতে নয়, হাইকোর্টেও। এই প্রতিষ্ঠানগুলো তো পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে, তারাই যদি দুর্বল হয়ে পড়ে! এক দলের কর্তৃত্ব বেশি হলে গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে যায়। দলের মধ্যেও গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না। এ ছাড়া দলে শৃঙ্খলা আছে কি না, ছাত্রসংগঠন যাঁরা করেন দলের সঙ্গে তাঁদের মতের মিল আছে কি না, ইশতেহারে কোনো বিষয় লেখার সময় সবাই তা বাস্তবায়ন করতে রাজি কি না—এ প্রশ্নগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রত্যাশার কথা বলি। ১৯৭০ বা ১৯৭১ সালে মহিলা পরিষদের একটা সভা হয়েছিল।

সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। তারা কিন্তু ওই কথাই তুলেছে—নারীর প্রতিনিধিত্ব কেমন হবে, নারীর নির্যাতিত হওয়ার কথা আর আইনের সংস্কারের কথা তারা তুলেছে। নারীদের পক্ষ থেকে আমি বলব, অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু প্রথম সংসদেই বলা হলো, নারীদের সংরক্ষিত আসন থাকবে। মহিলা পরিষদ তখনই প্রতিবাদ করেছিল, এটা আমরা চাই না। আমরা স্বাধীনভাবে সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসতে চাই। সেটা তো হয়নি। সরাসরি আসতে হলে আইনের সংস্কারের কথা চলে আসে। শুধু নারীর ক্ষেত্রে না, অনেক ক্ষেত্রে। সমাজকে যদি পুরোপুরি পরিবর্তন করতে হয়, তবে বলতে হবে যে অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে। আমরা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছিলাম।

প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা আসলে ঠিক কী ভেবেছিলাম। শুরুতেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন করা হলো। এখানে বিভিন্ন ধর্মের লোক আছে, তাহলে শুধু ইসলামিক ফাউন্ডেশন কেন? একটিই চ্যানেল, বিটিভি, সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছিল। শুরুতে, ডিসেম্বর মাসে দেখলাম, কোনো ধর্মের কিছু উল্লেখ করা হচ্ছে না। পরে ক্রমে ক্রমে দেখলাম, খবরের আগে গীতা থেকে পাঠ করা হচ্ছে, কোরআন থেকে তিলাওয়াত করা হচ্ছে। চরিত্র একটু একটু বদলাচ্ছে। ধর্মীয় শিক্ষা স্কুলে ঢোকানো হলো আশির দশকে। মাদ্রাসা থাকল। প্রতিটি সরকার এসে মাদ্রাসাকে অর্থ দিয়েছে, উত্সাহিত করেছে। চরিত্রটা মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে একটু দূরে সরে গেছে।

সাজ্জাদ শরিফ

ধন্যবাদ। আমীন আহম্মেদ চৌধুরী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। অনেক সাধারণ মুক্তিযোদ্ধার মনমানসিকতা জানার সুযোগ হয়েছে তাঁর একাত্তর সালে। তাঁদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন কী ছিল তা তিনি দেখেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন। বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে যদি তিনি বলেন, আমরা কী পেয়েছি, কী পাইনি।

আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে পেছনের দিকে যেতে চাই। সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আমাদের অবস্থানটা কেমন ছিল? জিন্নাহ সাহেবের সামনেই ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন শেরেবাংলা। তিনি কথাটা তুলেছিলেন যে আমরা স্বায়ত্তশাসিত দুটি অঞ্চলের স্বাধীনতা চাচ্ছি। আঞ্চলিক স্বাধীনতা। তিনি বলেছিলেন, বাইরের কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বা অন্য জনগোষ্ঠী বাংলার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা আমরা সহ্য করব না। এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের জন্মের পদধ্বনি। অনেকেই বিপুল রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা বলেন। আমি তা খুব বিশ্বাস করি না। আমরা সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম, সেখান থেকে আমি বলব, আমরা জাস্টিস পেয়েছি।

কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমি বলব, পাঞ্জাবে যেহেতু আমরা চাকরি করেছি, ওদের মানসিকতা প্রচণ্ডভাবে নোংরা। ওরা লোককে দাস মনে করে। দেখুন, পাকিস্তান জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করতে পারেনি, ভারতও পারেনি; কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। এই যে মানসিকতার পার্থক্য, এটাই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করেছে। পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের দাবিয়ে রাখতে পারছিল না, ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য তারা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেছে, ষড়যন্ত্র করেছে, প্রাসাদ রাজনীতি করেছে। তারা প্রথমবারের মতো দেখতে পেল, বঙ্গবন্ধু প্রাসাদ রাজনীতিতে না গিয়ে রাজনীতি করছেন। সোহরাওয়ার্দী বলেন, শেরেবাংলা বলেন, তাঁরা কিন্তু কমপ্রোমাইজ করেছেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তাঁরা অনেক উঁচুু, তাঁদের মেধা হয়তো বিভিন্ন দিকে অনেক বেশি, কিন্তু তাঁদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পার্থক্য হলো, বঙ্গবন্ধু পূর্ববাংলার মার্কা মারা একরোখা লোক। এটাই তাঁকে অনন্য করেছে। ’৬৯ সালে, আমরা তখন ইস্ট পাকিস্তান হাউসের গার্ডের দায়িত্বে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হলো।

সেখানে আইয়ুব খান তাঁকে অফার করেছিল, আপনি প্রধানমন্ত্রী হোন। শেষ অফার। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি যদি ছয় দফা মানো, আমি তাহলে নেব। আইয়ুব খান বললেন, ছয় দফা মানার মতো ম্যান্ডেট আমার কাছে নেই। আমি তোমাকে প্রধানমন্ত্রী করতে পারি। আমি নির্বাচন দেব, তুমি যদি মানিয়ে নিতে পারো, আমার কোনো আপত্তি নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, ওই ধরনের কমপ্রোমাইজের মধ্যে আমি নেই। এই সোনালি সুযোগ যখন তাঁর কাছে এসেছিল, সারা দেশ তখন তছনছ। তিনি ইচ্ছা করলে, যা-ই বলতেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা-ই মানতে বাধ্য হতো। তিনি সে পথে যাননি। তিনি জনগণের কাছে ফিরে এসেছেন। নির্বাচন দাও, আমি গণরায় নিয়ে আসব। মানুষের প্রতি তাঁর এবং তাঁর প্রতি মানুষের এই যে আস্থা গড়ে উঠেছিল, এর কারণ একটাই—তিনি ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান বা সাহেবজাদা ইয়াকুবদের চক্রে পড়েননি। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময়ও তিনি মানুষের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। এর ফলে ছাত্র-শ্রমিক-সেনা ও গ্রামবাসী এক কাতারে এসেছিল। ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলার ইতিহাসে ডান-বাম বলুন, গণতান্ত্রিক শক্তি বলুন—সবাই এক হয়েছিল।

আমি বলব, বাহাত্তর সালের যে সংবিধান, এর যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া, অবিকৃত অবস্থায় চোখ বন্ধ করে সে সংবিধানে আগে ফেরত যেতে হবে। এ ছাড়া আপনি শুরু করতে পারবেন না। কারণ এই মুহূর্তে দেশ কীভাবে চলবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। সংসদে বর্তমান সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ আসন আছে। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার এটাই সুযোগ। আপনি কাউকে চ্যালেঞ্জ তো করছেন না। শুধু বলছেন, আমরা এখন থেকে এই সংবিধান মেনে চলব। এটা যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা যাবে তা নয়। কারণ গণতন্ত্রের চর্চাটা আমরা করতে পারিনি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা করার আগেই বিনা কারণে এই সংবিধানে ওপর কাঁচি চালানো হয়েছে।

২৪ বছর আপনি মানুষকে শিখিয়েছেন আইয়ুব খান স্বেচ্ছাচারী, তিনি আমাদের মৌলিক অধিকার হরণ করেছেন। এখন তাদের যদি বলেন, আমি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছি, তাহলে প্রথমেই তারা ভাববে, আপনি স্বেচ্ছাচারিতার দিকে চলে যাচ্ছেন। বাকশাল করার সময় হয়তো বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য মহত্ ছিল। বঙ্গবন্ধু হয়তো মনে করেছেন, গরিবের উপকার করতে হলে আমাকে এই মুহূর্তে একক ক্ষমতায় থাকতে হবে। সেই বিবেচনায় ভুল থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত লাভের জন্য বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য এটা তিনি করেছেন তা আমি বিশ্বাস করি না।

আরেকটা কথা, স্বাধীনতার পরে আমাদের বহুমুখী সমস্যা ছিল। আমরা এই সংবিধানকে পরীক্ষামূলকভাবেও চালু করতে পারিনি। এই সংবিধানকে সামনে রেখে এগোতে পারলে আমাদের গণতন্ত্রের চর্চাটা পাকাপোক্ত হবে। পরে যদি মনে হয় আরও উন্নত সংবিধান দরকার, তাহলে করা যাবে ধীরে ধীরে। কিন্তু এটাকে আগে চালু করতে হবে। আমাদের সংবিধানে স্বাধীনতাগুলো সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে—ধর্মীয় স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, পত্র-পত্রিকার স্বাধীনতা—সব। গণতন্ত্রের অর্থই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজব্যবস্থা। অতএব গণতন্ত্রে যদি আপনি বিশ্বাস করেন, তাহলে আলাদাভাবে সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা আনলেন কেন? আমি মনে করি, এটা বড় ভুল হয়েছে। এর মাধ্যমে আরেক পক্ষকে উসকানি দেওয়া হয়েছে বিসমিল্লাহ লেখার জন্য।

এটা তো হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এখন সংবিধানের একটা মূল স্তম্ভ যখন বলবেন সমাজতন্ত্র—এটা পুরোপুরি স্ববিরোধী। অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে চাইলে বহু রকম পথ আছে। সমাজতন্ত্র একটা দলের ইশতেহার হতে পারে, কিন্তু পুরো রাষ্ট্রের আদর্শ হতে হলে রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নিয়ে আসতে হবে। আপনি রাজনৈতিক ম্যান্ডেট নিয়েছেন ছয় দফার ওপর। সেই দফা বাদ দিয়ে আপনি যদি বলেন সমাজতন্ত্রই আমাদের প্রধান লক্ষ্য, এটি স্ববিরোধী না? অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে, সমবায়ের কথা আছে, মানুষের স্বাধীনতা আর সমান সুযোগ, সমান শিক্ষার কথা আছে। আরেকটা কথা। ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর বঙ্গানুবাদ করা হয়েছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। আমরা তো কারও প্রজা নই, এটা সুস্পষ্ট। আমি কোনো সাংসদ, কোনো প্রধানমন্ত্রীর প্রজা নই।

আমি বাংলাদেশের, স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। এই অধিকার হরণ করার অধিকার কারোর নেই। সুতরাং ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর বাংলা ‘সাধারণতন্ত্র’ হতে পারে, ‘গণতন্ত্র’ হতে পারে কিন্তু ‘প্রজাতন্ত্র’ না। বাঙালিরা কেরানির কাজ করে আসছে সারা জীবন। সেই চিন্তা থেকে ‘প্রজাতন্ত্র’ এসেছে। এই মানসিকতা থেকে আমাদের বেরোতে হবে। হামিদা হোসেন অনেকগুলো সুন্দর পয়েন্ট বলেছেন। মাদ্রাসাব্যবস্থা তুলে দেওয়া দরকার। ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার খুলে দেওয়া দরকার। সহনশীলতা বাড়ানোর জন্য সব ধর্মের শিক্ষা স্কুলের সব ছাত্রকে পড়ানো উচিত। একপেশে রাজনীতি, একপেশে কোনো শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা বা রাখা ঠিক হবে না।

সাজ্জাদ শরিফ

আমরা আবার জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর কাছে যাব। আমরা পুরোনো বিষয়ের নতুন তাত্পর্য বের করি। যেমন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে মুখ্য জায়গাটা ছিল মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার দাবিকে প্রতিষ্ঠা করা। পরে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকজুড়ে নানা তাত্পর্যে আমরা একে ব্যবহার করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেরও সে রকম নতুন কোনো তাত্পর্য কি এ সময়ে এসে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে?

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

আমার মনে হয় একাত্তরের তাত্পর্য এখনো আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিল, তখন আমাদের ধারণা ছিল যে এই স্বপ্ন পূরণের ব্যাপারে বাঙালিরা সবাই একত্র। এর মধ্যে কোনো বিরোধিতা নেই। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যে আমাদের ভুল ভাঙল। আমরা দেখলাম, আমাদের মধ্যে প্রচুর মানুষ আছে, যারা ওই স্বপ্নটা বিশ্বাস করে না। একাত্তরের যে আকাঙ্ক্ষা তার সঙ্গে তারা মোটেও একাত্ম নয়। সংবিধান সংশোধনের ভেতর দিয়ে আমাদের কাছে খুব করে স্পষ্ট হলো যে দেশটা আদর্শগতভাবে বিভক্ত। আমীন আহম্মেদ সাহেব বলছেন, সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কথাটার প্রয়োজন ছিল না। আমি মনে করি খুবই প্রয়োজন ছিল।

পাকিস্তান থেকে আমাদের পার্থক্যটা এখানেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে আমরা কোন ধরনের জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গড়তে যাচ্ছি। যেখানে সব বাঙালি জন্মসূত্রে বাঙালি, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে তারা সবাই বাঙালি; এখানে মুসলিম জাতীয়তাবাদের কোনো সুযোগ যাতে না থাকে। এখন ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকে বলেন, এটা নিয়ে তর্কও চলতে পারে। আর তিনি যে বললেন, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী’ শব্দটা ঠিক হয়নি, সেটা শব্দের ব্যাপার। ‘প্রজাতন্ত্র’ শব্দটি দিয়ে ওই অর্থে দেশের মানুষকে প্রজা বানানো হয়েছে তা আমি মনে করি না। আসলে সবার জন্য রাষ্ট্র। একটা ঘটনা আমার মনে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর যখন বাংলাদেশ হলো, আমাদের সমাজটা তখন অনেকটা লেভেল সোসাইটি ছিল অর্থাত্ ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে খুব বড় বৈষম্য ছিল না। তখন একবার ভারতীয় লেখক মুল্করাজ আনন্দ্ এসেছিলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে আমরা বসেছি।

অনেক কথাবার্তার মধ্যে একপর্যায়ে তিনি বললেন, তোমরা অনেক ভাগ্যবান। তোমাদের দেশে এখনো পর্যন্ত একটা লেভেল সোসাইটি আছে। সুতরাং একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যে লক্ষ্য তোমরা সামনে রেখেছ, সেটা অর্জন করা তোমাদের জন্য খুব সহজ হবে। এখানে কোনো ধনিক সমপ্রদায় নেই। আসলে আমাদের প্রত্যাশা ছিল একটা বৈষম্যহীন সমাজ। এ ক্ষেত্রে আমরা দারুণ আঘাত পেয়েছি। যত দিন গেছে, বৈষম্য তত বেড়েছে। অতি দ্রুত একটা ধনিক সমপ্রদায় সৃষ্টি হয়েছে। কীভাবে হলো? ১৫ বছর গণতন্ত্রহীন যে সময়টা গেছে তখন যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন, এই বৈষম্য সৃষ্টিতে তাঁদের একটা বড় ভূমিকা আছে। আমরা সেটাকে রোধ করতে পারিনি। ১৯৯০ সালকে আমি গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের বছর বলছি। তার পরও গত ১৫-২০ বছরে সমাজের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক বিভক্তি দেখছি, একটা ধনিক সমপ্রদায়ের উত্থান দেখছি। ফলে আজ আমাদের মতো একটা দরিদ্র দেশে ভোগের একটা অদ্ভুত প্রাবল্য দেখছি।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, যারা ধনী হয়েছে আমাদের লাইফস্টাইলটা তাঁরা গড়ে দিয়েছেন। সুতরাং এখানে আমাদের প্রত্যাশা যা ছিল তার বিপরীত ঘটনা ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে লক্ষ্য সামনে ছিল তা আমরা অর্জন করতে পারিনি। না পারার পেছনে একটা বড় কারণ সম্ভবত এই যে একাত্তরে আমাদের মধ্যে যতটা ঐক্যবোধ জেগেছিল, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। এই যে আমরা আমাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো পূরণ করতে পারলাম না, এর জন্য কাকে দোষ দেব? আমরা অনেক সময় রাজনৈতিক দলগুলোকে দোষ দিই। কারণ তাদের যে রকম নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল, সে রকম তারা দিতে পারেনি। তারা দেশের আসল ইস্যুগুলো নিয়ে উচ্চকণ্ঠ না হয়ে তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে সময় কাটিয়েছে। তারা আত্ম-উন্নয়নের জন্য যা কিছু করা দরকার, করেছে। নেতা বা নেতৃত্বকে বড় করে দেখিয়েছে।

কোনো মন্ত্রী তাদের নেতাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে কোনো বক্তৃতাই দেননি। এই যে অতি ভক্তি, অতি আনুগত্য, এটা কিন্তু গণতান্ত্রিক নয়। গণতন্ত্রে যে কথাটি এসেছে সেটা হচ্ছে দলের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করা। সেটা কোনো বড় দলের মধ্যে যে নেই, সে কথা অনেকবার বলা হয়েছে। তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা না হলে তা বিকশিত হবে না। আমাদের সংবিধানে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রামীণ স্তরে না হলেও ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা—অন্তত এই তিন স্তরে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার হবে। কিন্তু এখানে নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী না হলে গণতন্ত্র দাঁড়াবে না। এ ব্যাপারে আমাদের রাজনৈতিক মহল এখন পর্যন্ত মেনে নিতে পারছে না। স্থানীয় সরকার নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একটা অদ্ভুত রকম অবিশ্বাস আমি এখন পর্যন্ত লক্ষ করছি। একাত্তরে আমরা যে প্রশ্নগুলোর মীমাংসা করেছিলাম সংবিধানের ভেতর দিয়ে, তার বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। সংবিধান হচ্ছে কতগুলো ইচ্ছার প্রকাশ।

সে ইচ্ছাগুলো আছে কিন্তু সেই ইচ্ছাগুলো পূরণের একটা পরিষ্কার দিকনির্দেশনা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? পাচ্ছি না। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের সামনে বাংলাদেশের যে ভিশনটা তুলে ধরেছিল, সেটা এখনো লিজেন্ডই রয়ে গেছে। তাই আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের তাত্পর্যটা এখনো রয়ে গেছে। একাত্তর মনে করিয়ে দেয় আমরা কী চেয়েছিলাম, দেশের মানুষ কী চেয়েছিল। সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি চেয়েছিল, নারীর ক্ষমতায়ন চেয়েছিল, সেটা অনেকটা অগ্রসর হয়েছিল। নারীর শিক্ষার ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা অগ্রসর হয়েছি। এ ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন যা হয়েছে তাকে আমি কম মনে করি না। কিন্তু আরও অনেক কিছু করতে পারিনি। বিশেষ করে কার্যকর সংসদ আমরা এখনো পাইনি। এখন আমাদের সামনের দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

হামিদা হোসেন

আসলে কোনো দেশে স্বাধীনতার আন্দোলন যখন হয়, তার একটা সাধারণ লক্ষ্য থাকে—আমি দেশ স্বাধীন করার জন্য আন্দোলন করছি অথবা যুদ্ধ করছি। তাদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর, বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা থাকে। তাদের নিজেদের আলাদা উদ্দেশ্য থাকে। আমরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে দেখেছি, কেন্দ্রীয় একটা লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের। বিভিন্ন প্রদেশে আবার বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন চলছিল। বাংলাদেশেও তাই। অবশ্যই সবাই একটা স্বাধীন দেশ চেয়েছিল। তার পরও যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, সেনাবাহিনী থেকে এসেছেন কি ইপিআর থেকে এসেছেন, তাঁদের ভিন্ন লক্ষ্য ছিল। আমলাতন্ত্রের নিজের ভিশন ছিল আবার ছাত্রদের তো সে রকম ছিল না। ’৭০-এর আগে ছয় দফা ছিল। পরে কিন্তু আওয়ামী লীগ ছাত্রদের কাছ থেকে আসা ১১ দফাকে গ্রহণ করেছে। ১১ দফার মধ্যে কৃষকদের-শ্রমিকদের কথা উঠে এসেছে।

যেখান থেকে আমার মনে হয় সমাজতন্ত্র এসেছে। সোশ্যালিজম শব্দটা খারাপ মনে হয়। কিন্তু আমার মনে হয় এটা দিয়ে আওয়ামী লীগ সামাজিক ন্যায়বিচারকে বোঝাতে চেয়েছে—সবার সমান অধিকার থাকবে; অর্থনীতি এমনভাবে ভাগ হবে যেখান থেকে সবাই কিছু পাবে। সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বিষয়ে আমিও আমীন আহম্মেদ সাহেবের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। এখন আমরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করি। একটা হচ্ছে, ধর্ম আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে রাষ্ট্রের কিছু বলার থাকবে না। সে জায়গায় যদি আমরা ফিরে যেতে পারি, তো ভালো হয়। সংবিধানের মধ্যে একটা ব্যাপার আমি দেখি। রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতা যেভাবে ভাগ করা হয়, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বেশি।

এখানে রাষ্ট্রপতির আসলে কিছু করার নেই। সেটা কেন হচ্ছে? গণতন্ত্রের চিন্তা করলে একটা ভারসাম্য রাখার দরকার ছিল। সেটা আসেনি। দ্বিতীয়ত, কয়েকটি আর্টিকেলে বিশেষ করে লিঙ্গের ক্ষেত্রে, ধর্মের ক্ষেত্রে সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে, আরেকটা আর্টিকেলে আছে নারীর ক্ষেত্রে সমান অধিকার কিন্তু পাবলিক অ্যাফেয়ারে। তার অর্থ হলো, পারিবারিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসাম্য থাকছে। সেটা কিন্তু আর সংশোধন করা হয়নি। সংবিধানে নারীর স্বাধীনতার ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আমার যতটুকু মনে পড়ছে, এটা নিয়ে সংসদে খুব একটা বিতর্ক হয়নি; যা হয়েছে ওই হাত তোলা। আরেকটা বিষয় হলো সংবিধানে আদিবাসীদের প্রসঙ্গ। গত পাঁচ কি দশ বছরে আদিবাসী বা দলিত অবস্থান থেকে যেসব কণ্ঠ বেরিয়ে এসেছে, তাদের তো আমরা তখন চিন্তাই করিনি। এমন গোষ্ঠী আছে, বাংলাদেশে যারা অস্পৃশ্য এবং এ জন্য বৈষম্যের শিকার। সে নিয়ে এখন নতুন নতুন দাবি উঠছে, এ নিয়ে নতুনভাবে কথা উঠে আসছে। আমাদের চিন্তা করতে হবে, সংবিধানে কি অন্যভাবে সমাজের চিন্তার মধ্যে কীভাবে তাদের নিয়ে আসা যায়।

সংসদে অথবা দলে কীভাবে গণতন্ত্রের চিন্তা করতে পারি? আমাদের সমাজে তো সেটা নেই। গ্রামীণ সমাজে সালিসে মাতব্বরেরা বলে এটা করতে হবে—সবাই নীরবে তা মেনে নেয়। পরিবারে গণতন্ত্র কোথায়? মা-বাবা আমাদের বলেন—চুপ করে কথা শোনো, কথা বলবে না। স্কুলে শিক্ষকেরাও একই কথা বলেন। নিজের কথাটা বলার জন্য আমার মেয়েকে একবার স্কুলে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। আমার মনে হয় সাংস্কৃতিক একটা পরিবর্তন খুব দরকার। এটা কীভাবে আসবে—ওপর থেকে আসবে নাকি নিচের থেকে আমরা যাব, সেটা নির্ধারণ করা দরকার। যেমন, সালিসে এখন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন মাতব্বরেরা খুব সহজে কথা বলে না, অন্যের কথা মন দিয়ে শোনে। এই পরিবর্তন ঘটাতে হবে। ’৭২ সালে যেমন তাজউদ্দীন সাহেব একটা প্রস্তাব দিয়েছেন, যেসব ছাত্র গণবাহিনী গড়ে তুলেছিল, যুদ্ধ থেকে এসেছে, তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কীভাবে কাজে লাগানো যায়।

সে প্রস্তাব তখন গ্রহণযোগ্য মনে হলো না। কোথায় হারিয়ে গেল। এ ধরনের অনেক কিছু পরিকল্পনার মধ্যে ছিল; কিন্তু পরে সব হারিয়ে গেল। আবার নতুন করে আসছে। যেমন, এখানে ’৯০-এর কথা বলা হয়েছে, তিন জোটের রূপরেখার মধ্যে ছিল বিটিভি আর রেডিও সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে। কিন্তু বেতার-টিভি আজও স্বাধীন হয়নি। বসুন্ধরা সিটি পুড়ে গেল, বিটিভিতে রাত ১১টার খবরে এক মিনিট দেখিয়েছে।

অন্য চ্যানেলগুলো কিন্তু সারা দিন সরাসরি দেখিয়েছে। এ কারণে আমরা বিটিভি দেখি না। বেসরকারি চ্যানেলগুলো শহরের দিকে দেখা যায়, গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ তা দেখতে পায় না। বিটিভিকে আপনি প্রচারমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। একটা তথ্য মিডিয়া। তথ্য দেন ঠিক আছে। মোটামুটি যদি স্বাধীনতা দিতে হয়। কিন্তু সরকার যদি না-ও দিতে চায়, অ্যাটলিস্ট একটা ইনফরমেশন মিডিয়া করে। কিন্তু এখন তো শুধু প্রচার। একটা সোশ্যাল ডায়েরি হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী কী করেছেন, অমুক মন্ত্রী। এই তালিকা দিয়ে লাভ কী?

সাজ্জাদ শরিফ

এবার আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বক্তব্য দেবেন।

আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

আমার মনে হয়েছে যে ’৭১-এর তাত্পর্যটা যত সিম্পল রাখব এটা তত গতি পাবে। একজন সৈনিক আমি যে যুদ্ধে যোগ দিয়েছি বা আমরা যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ছিলাম তাদের সঙ্গে আমাদের তর্কবিতর্কের মূল বিষয় ছিল কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা সর্বস্তরে জারি করা; এটাকে গ্রথিত করা। সেই চর্চাকে গ্রথিত করতে ’৭২ সালে আমরা সুযোগটা পেয়েছিলাম। ’৭০ সালে দেশের সব মানুষ একত্র হয়েছিল, কিন্তু সেটা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। যাঁরা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাঁরা আপনাআপনি ক্ষমতায় যান। ক্ষমতায় গেলে আপনাআপনি তাঁদের বিরুদ্ধে একটা দল তৈরি হয়। তখন সবাইকে একত্র রাখাটা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তাঁদের তখন একটা দলীয় পরিচয় ছিল। ’৭০-এ বঙ্গবন্ধু ছিলেন সর্বসাধারণের নেতা।

কিন্তু যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্ট হলেন তখন তিনি একটা দলকেও প্রতিনিধিত্ব করছেন। সুতরাং তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়েও একটা বিরোধী দল সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানে আদিবাসীদের কথা বলা হয়নি। বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের উত্থান, সে কারণে সবাইকে হয়তো বাঙালি বলে ফেলা হয়েছে। এটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হয়নি। সেটাকে সংশোধন করে তাদের মূল স্রোতে নিয়ে আসা যায়। আমাদের দেশের অনেক মানুষ এখনো অতটা শিক্ষিত নয়। আপনি তাকে বলছেন আইনের চোখে সবাই সমান। এরপর কি ব্যাখ্যার দরকার নেই? এটাই আমরা করতে পারিনি। ফলে অনেকেই আইনকে উপেক্ষা করে সম্পত্তি বাড়িয়েছে। তারা তো সবাই মনে করে, আমি আইনের ঊর্ধ্বে। আপনি কি সংসদীয় গণতন্ত্র আনবেন? এটা তো করপোরেট কালচার। এটা তো পুরোপুরি গণতন্ত্রের পরিপন্থী।

এটা হলো মানসিকতা। প্রজাতন্ত্র কথাটা হচ্ছে অবচেতন মনে আপনি রাজা হতে চান। আমরা আইয়ুব খানের সমালোচনা করি, কিন্তু সবাই আইয়ুব খান হতে চাই। যুদ্ধ করে যারা ফেরত এসেছে, ওরা সবাই আমাদের সিপাহি হিসেবে যুদ্ধ করেছে। তারা তো টগবগে তরুণ, জওয়ান। তারা তো আমাদের ইংরেজি শেখাতে পারে। সে তো যুদ্ধ করেছে সিপাহি হিসেবে, আর যখন ফেরত এসেছে তখন সে ম্যাট্রিকের ফার্স্ট বয় হিসেবে স্বীকৃত। তার তো একটা অ্যামবিশন আছে। সে অ্যামবিশন তো আমার সঙ্গে মিলবে না। আমি হব মেজর জেনারেল, সে রাষ্ট্রপতি হতে চাইবে অথবা রাজনীতি করবে। তার জন্য যথাযথ পথটি আমরা খুলে দিতে পারিনি। তাতে কী হয়েছে? হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে জাসদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে চটকদারি কথা বলে। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামে কোনো সমাজতন্ত্র রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে নেই। কিন্তু হাজারো ছেলেমেয়ে মারা গেছে। এই যে অপচয় হলো, এটা কী জন্য? এরাই এ দেশকে একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারত।

তারা প্রাণের সঙ্গে ঝুঁকি নেবে। এই শক্তি যদি শেষ না হয়, তাহলে কানমলা দিয়ে আপনি চুক্তি স্বাক্ষর করাতে পারবেন না। এই জিনিসটা আমাদের বুঝতে হবে। চটকদারি কথা বলে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে পূর্ণ করা যাবে না। প্রথমেই করতে হবে সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা। বিদ্যাসাগর যে শিক্ষাব্যবস্থাটা আমাদের দেশে চালু করেছিলেন, ১৮৫১ সালে তিনি বাল্যশিক্ষা লিখেছিলেন, ১৯৫১ সালে আমরা পড়েছিলাম—সদা সত্য কথা বলিবে। এখন আপেল-টাপেল কী কী দিয়ে বাচ্চাদের মাথা খারাপ করে দেওয়া হয়েছে। মিথ্যা বলা যে অপরাধ, এটা তো সব ছেলেমেয়ে তাদের বাবা-মার কাছ থেকে শিখছে না। যা শিখছে সেই শিক্ষা এদের মন্ত্রী বানাচ্ছে। তারা খুন করেও বীরদর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা তো লজ্জাজনক।

আপনি যদি একজন সাবেক বা ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকেন, আপনার সঙ্গে একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী কী করে থাকে? সে জন্য আপনি কোর্ট মার্শাল করতে চান, তো কোর্ট মার্শাল করছেন না কেন? জন-আদালতে তাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছেন না কেন? এটা তো একটা অপরাধ। সে জন্য বলছি শিক্ষাপদ্ধতিকে যদি সর্বজনীন না করা যায়, তাহলে এই ধরনের একপেশে বুদ্ধিজীবী, উকিল, মোক্তার, রাজনীতিবিদ সৃষ্টি হবে। সমাজের জন্য এরা ক্যান্সারের মতো।

পঞ্চাশের দশকে মাদ্রাসাশিক্ষা ছিল না। কিছু জায়গা আছে যেখানে হাত দেওয়া যায় না। আমরা প্রথমেই সে রকম জায়গায় হাত দিয়েছি। এটা একটা মস্ত বড় ভুল। আমি বোরকা পরব কি পরব না, এটা নিয়ে অন্যের চিন্তার কোনো কারণ নেই। আমাদের দেখতে হবে, কেউ কাউকে জোর করে বোরকা পরাচ্ছে কি না। সেটাই আইনের শাসন। গণতন্ত্রকে সামনে রেখে নির্ভেজাল গণতন্ত্রের চর্চা, সর্বস্তরে নির্ভেজাল গণতন্ত্রকে প্রাধান্য দেওয়া—এর বাইরে কোনো কিছু চিন্তা না করাই ভালো।

সাজ্জাদ শরিফ

এবার সমাপনী বক্তব্য দেওয়ার জন্য জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে অনুরোধ জানাচ্ছি।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী

আমাদের আলোচ্য ছিল, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে কি না। দেখা যাচ্ছে যে মূল প্রত্যাশাই পূরণ হয়নি। তার মানে এই নয়, একাত্তরে আমরা যেখানে ছিলাম এখনো সেখানে আছি। অনেক ক্ষেত্রে এগিয়েছি; কিন্তু যে প্রত্যাশাগুলো পূরণ হয়নি, তা আমাদের আজকের আলোচনায় এসে গেছে। আমি যেটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি সেটা হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্র কার্যকরভাবে চালু করা। আলোচনায় বৈষম্যের কথা এসেছে, শিক্ষার কথা এসেছে, নারীর ক্ষমতায়নের কথা এসেছে। এগুলো আমাদের লক্ষ্যের মধ্যে ছিল। তার পরও সামাজিকভাবে আমাদের চিন্তায় যে পরিবর্তনটা আসা দরকার ছিল, সেটা বোধহয় আসেনি। তার জন্য আমাদের অশিক্ষা মূলত দায়ী। রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা ঠিকপথে চলেনি। এটি আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ব্যাপার। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন একটা পথ ধরে চলেছে, যা গণতন্ত্রসম্মতভাবে হয়নি। এই কথাটা আমাদের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে। এখানে এক দলের সঙ্গে অন্য দলের কোনো তফাত্ নেই। সব দলের একই সংস্কৃতি। আমরা এক কথায় যেটা বলি উইনার টেকস অল।

জিতলে আমরাই সব। অপজিশনকে আমরা মানি না। তার ফলে বিভিন্ন দল আর বিভিন্ন মতের মধ্যে বোঝাপড়াটা হয়নি। এই বোঝাপড়াটা আমাদের সংস্কৃতিতে কেন আসছে না? কারণ, গণতন্ত্রের যেটা মূল কথা, আমরা পরমতসহিষ্ণু হতে পারছি না। ’৭১-এ আমরা কিন্তু সব বিভেদ ভুলে গিয়ে অনেকটা এক হয়েছিলাম। আমাদের ইতিহাসে সেটা ছিল এক সোনালি মুহূর্ত। এখন প্রত্যেকটা মুক্তিযুদ্ধের দিন যখন ফিরে আসে, বিশেষ করে মার্চে, তখন এ কথাগুলোই বোধহয় বারবার চোখের সামনে বড় হয়ে দেখা দেয় যে কতটা পেরেছি, কতটা পারিনি। সে জন্য সব সময় একটা মূল্যায়ন হওয়া দরকার। সে মূল্যায়নটা হতে হবে।

আত্মতৃপ্তির কোনো সুযোগ আমি দেখছি না। আমরা হয়তো অনেক ব্যাপারে এগিয়েছি। আমাদের শিল্পকারখানা অনেক বড় হয়েছে। আমাদের শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। কিন্তু তাদের স্বার্থটাও আমরা ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি না। দেশে দেশে তারা নিগ্রহ ও অবিচারের শিকার হচ্ছে, সেখানে তো আমরা বিশেষ কিছু করতে পারছি না তাদের জন্য। যা হোক, তবু, এর মধ্যে আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে, আমরা আশা করছি। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ভাষায় বলতে হয়, এই এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সংবিধান ধ্রুবতারার মতো কাজ করবে। ধ্রুবতারা যদি স্থির থাকে, তাহলে সে ধ্রুবতারা থাকে। ধ্রুবতারা যদি বারবার স্থান পরিবর্তন করে, তাহলে সে ধ্রুবতারা থাকে না। তিনি সংবিধানকে বলেছেন আমাদের ধ্রুবতারা। সে ধ্রুবতারাটি যথাস্থানে রেখে যদি আমরা পথ চলি, তাহলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব।

হামিদা হোসেন

আমার একটু বলার ছিল। গত ৩৬ বছরে বাংলাদেশে দারিদ্র্য ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে চোখের সামনে। আমার মনে আছে, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বসুন্ধরা সিটি উদ্বোধন করতে গিয়ে বলেছিলেন, দেখেন, ঢাকায় কত বৈচিত্র্য—একদিকে বস্তি, অন্যদিকে বসুন্ধরা হচ্ছে। এটির দিকে যদি আমরা নজর না রাখি, আমার মনে হয় একটা বয়েলিং সিস্টেমে না ওটা ফেটে যায়। যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসেন তাঁদের নিজের শ্রেণী, নিজের চিন্তা করাটা যথেষ্ট নয়। আমরা নানা পলিসির চিন্তা করি। গার্মেন্টস খুব সফল ব্যবসা। কিন্তু শ্রমিক আর মালিকের মধ্যে এত বেশি পার্থক্য কীভাবে হয়। ফল হিসেবে ২০০৬ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন হলো।

চিংড়ি চাষে মেয়েদের যেভাবে কাজ করতে হয় তাদের অবস্থা কী; পক্ষান্তরে গার্মেন্টস মালিক বা চিংড়ি রপ্তানি করে যারা তাদের অবস্থা কোথায়? আমরা যদি অন্যভাবে দেখি, সংসদে যাঁরা যাচ্ছেন তাঁদের শুধু পার্টির ব্যাকগ্রাউন্ড না দেখে শ্রেণীর ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেখা দরকার। তাঁদের কতজন ব্যবসায়ী, কী ধরনের ব্যবসা থেকে আসছেন? কয়জন আসলে শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব করছেন। আজকের পত্রিকায় সুজনের একটা রিপোর্টে দেখলাম, নতুন যেসব নারী সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন, তাঁদের অনেক টাকাপয়সা। তাঁরা যদি ওই শ্রেণী থেকে আসেন তো অন্যদের কথা, শ্রমিকদের কথা, কৃষকদের কথা কারা বলবেন? অঙ্গীকার শুধু ইশতেহারে থেকে গেলে তো হবে না। ইশতেহার কজনই বা পড়েন। আমার মনে হয়, এটা আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।

সাজ্জাদ শরিফ

আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৯ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত