বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা সমের্ক বেশ কিছু প্রামাণ্য গ্রন্থ ইতিমধ্যে রচিত হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশ-জাপান কূটনৈতিক সমের্কর ৩০তম বার্ষিকী উপলক্ষে নানা রকম ছবি ও দলিল সংযুক্ত প্রমাণ সাইজের গবেষণাধর্মী এমনই একটি বই লিখেছেন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক এস এ জালাল। তারও আগে অবশ্য এ জাতীয় আরো কিছু বই প্রকাশ হওয়ার কথা জানা যায়। তবে দুঃখজনকভাবে এ ধরনের গবেষণা গ্রন্থের প্রায় সবকটি ইংরেজি ভাষায় রচিত হওয়ায় বাংলাদেশের পাঠককুলের অনেকেই বইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ তেমন পাননি। লেখককুল সম্ভবত বই প্রকাশের অর্থ সংগ্রহের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকায় বাংলাদেশের পাঠকদের কথা বিবেচনা করে দেখার খুব একটা সুযোগ তাদের হয়নি। ফলে নিজ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবজনক এক অধ্যায়ে জাপানের ভূমিকা ঠিক কী ছিল, তার অনেকটাই বাঙালি পাঠকদের বলা যায় আজও প্রায় অজানাই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাপানের ভূমিকা অবশ্য আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করে দেখলে তেমন বড় মাপের কিছু ছিল না। তবে তা সত্ত্বেও বলতে হয় জাপানের জনগণের একটা অংশ যে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই প্রশ্নে বিতর্কের কোনো সুযোগ আদৌ নেই। আর এ কারণেই আমাদের মুক্তির যুদ্ধে জাপানের সেই সমর্থন বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড় এক পাওনা হিসেবেই গণ্য।

১৯৭১-এর জাপান ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরোধিতা করে যাওয়া পরাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ে একেবারে পা থেকে শুরু করে মাথা পর্যন্ত নিমজ্জিত দেশ। ফলে জাপানের সেই সময়ের সরকারের কাছ থেকে তেমন বড় কোনো প্রত্যাশা আমাদের নিজেদেরও থাকার কথা ছিল না। ঘটনার ধারাবাহিকতা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে যে পথে এগিয়ে নিয়ে যায়, তাতে স্নায়ুযুদ্ধের বিভাজনে বিভক্ত সেই সময়ের বিশ্বে আমাদের অবস্থান ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন শিবিরের প্রায় বিপরীতে। বাংলাদেশ প্রশ্নে পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিতর্কেও পরিষ্কারভাবেই এর প্রতিফলন চোখে পড়ে। বাংলাদেশ-জাপান দ্বিপক্ষীয় সমের্কর একেবারের শুরুর সেই দিনগুলো নিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত একাধিক গবেষণা গ্রন্থে বিশেষ ওই রাজনৈতিক সমীকরণের পর্যালোচনামূলক দিকটির অনুপস্থিতি সত্যিকার অর্থে পীড়াদায়ক। গবেষকদের প্রায় সবাই যেন ধরে নিয়েছেন জাপানের সরকারি-বেসরকারি উভয় পক্ষের আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সক্রিয় সমর্থন দিয়ে যাওয়ার কথা বলা তাদের জন্য কোনো এক ধরনের নৈতিক দায়িত্ব বিশেষ। অথচ মার্কিন প্রভাব বলয়ের অগ্রসর দেশ হিসেবে জাপান বিবেচিত হওয়ায় ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে সরকারিভাবে জাপানকে কিন্তু ধরি মাছ না ছুঁই পানির অবস্থান গ্রহণ করতে হয়। প্রথাগত কিছু বিবৃতি প্রদানের বাইরে সেই সময়ের জাপান সরকারকে তেমন আগ বাড়িয়ে কোনো রকম ভূমিকা পালন করতে একেবারই দেখা যায়নি, যদিও ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করতে কোনো রকম দ্বিধা জাপান করেনি। বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের পথে সরকারিভাবে জাপানের সবচেয়ে বড় অবদান তাই সেই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিকেই গণ্য করা যেতে পারে, ১৯৭২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারির যে স্বীকৃতি ছিল বিশ্বের অগ্রসর শিল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম।

আগেই যেমন বলা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসে সরকারিভাবে জাপানের অবস্থান তেমন উল্লেখ করার মতো না হলেও জাপানের জনগণের অগ্রসর এক অংশ কিন্তু শুরু থেকেই এগিয়ে এসেছিলেন আমাদের প্রতি একাত্মতা প্রদর্শন করতে। আর এরই ফলে একদিকে যেমন দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১ কোটি শরণার্থীর জন্য অর্থ আর ত্রাণসামগ্রী সংগ্রহে সক্রিয়ভাবে তাদের জড়িত হতে, অন্যদিকে জাপানের সংবাদ মাধ্যমও নিয়মিতভাবে তুলে ধরে বাংলাদেশের মানুষের বীরত্ব আর আত্মত্যাগের কাহিনী, পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দেশী সহচর বদর দস্যুদের পশুসুলভ আচরণের মুখোমুখি হওয়া আপামর জনগণের অসহায় অবস্থার প্রতিচ্ছবি ও দেশত্যাগী মানুষের দুর্দশার কথা।

বর্তমানে জাপানের নেতৃস্থানীয় একটি শরণার্থী সংস্থায় কর্মরত সেদিনের তরুণ কবি আরিমিত্সু কেন একান্ত এক সাক্ষাত্কারে বর্তমান প্রতিবেদককে জানিয়েছিলেন একাত্তরের মাঝামাঝি সময়ে ‘মায়নিচি শিম্বুনে’ কুকুরের ভক্ষণরত শবদেহের ছবি দেখে কীভাবে প্রচণ্ড রকম আলোড়িত তাকে হতে হয় এবং কীভাবেই বা মনের সেই অস্থির অবস্থা নিজের অজান্তেই তরুণ কবিকে টেনে নিয়ে যায় বাংলাদেশের অসহায় সেইসব মানুষজনের জন্য কিছু একটা করার তাগিদে সমমনা লোকজনকে একত্র করতে পারার দায়িত্ব পালনে। আরিমুত্সুর মতো আরো বেশ কিছু জাপানি সেদিন আমাদের দুর্দশায় দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে দূর থেকে একাত্মতা প্রকাশ করে গেলেও খুব অল্প কয়েকজন জাপানি নাগরিকেরই সুযোগ হয়েছে সেদিনের ঘটনাবলি সরাসরি প্রত্যক্ষ করার। সেরকম দুর্লভ জাপানিদের একজন হচ্ছেন সাংবাদিক নাওয়াকি উসুই।

নাওয়াকি উসুই জাপানের যথেষ্ট পরিচিত সাংবাদিক। দেশের নেতৃস্থানীয় একাধিক সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা ছাড়াও বিদেশের পরিচিত বেশ কিছু গণমাধ্যমেও একসময় তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। বর্তমানে প্রতিরক্ষা বিষয়ক আন্তর্জাতিক একটি সাময়িকীর জাপান প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতায় নিজেকে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত রেখেছেন। জাপানের সাংবাদিকতার জগতে উত্কর্ষতার প্রতীক হিসেবে তার প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে আশির দশকের শেষ দিকে টোকিওর বিদেশী সাংবাদিকদের প্রেসক্লাবের সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করা। ১৯৭১ সালের শেষ দিকটায় একমাত্র জাপানি সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। সে দায়িত্ব ডিসেম্বরের শুরুর দিকে তাকে নিয়ে যায় কলকাতা থেকে যশোর হয়ে বাংলাদেশের সদ্য হানাদারমুক্ত দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খুলনায়।

বিরল অভিজ্ঞতার অধিকারী সেই সাংবাদিকের নিজের মুখ থেকে সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার কথা শোনার জন্য কিছুদিন আগে টোকিওতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল বাংলাদেশ লেখক সাংবাদিক ফোরাম, জাপান। অনুষ্ঠানে সমবেত বাংলাদেশী দর্শকদের জন্য সেই অভিজ্ঞতা ছিল যেন অজানা এক জগতের দুয়ার খুলে যাওয়ার মতো, যে দরজার ফাঁক দিয়ে কখনো উঁকি মেরে উপস্থিত হয় প্রায় জোর করে ভুলিয়ে দেওয়া কতিপয় সত্য, কখনো আবার উঠে আসে আত্মত্যাগ আর বীরত্বের গৌরবগাঁথা। সাংবাদিক উসুই যখন এক পর্যায়ে পরিষ্কার বাংলায় উল্লেখ করেন এখনো ভুলে না যাওয়া ১৯৭১ সালে তার ব্যাপকভাবে শোনা দুটি বাক্য। অনেকেই তখন নিশ্চিতভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে দেশের মানুষকে দিয়ে মিথ্যা ভাষণ সম্ভব হলেও বিদেশীদের দিয়ে সেরকম কিছু বলানো আসলেই দুঃসাধ্য। যে দুই বাক্য বাংলাদেশের সর্বত্র শুনে আজও মনের পর্দায় পরিষ্কার গাঁথা রয়ে গেছে বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তা হলো, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ আর ‘তোমার নেতা আমার নেতা—শেখ মুজিব শেখ মুজিব।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে নাওয়াকি উসুইয়ের কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হওয়া ছিল সমঙ্ূর্ণভাবেই ঘটনাক্রমিক। ২৭ বছরের তরুণ উসুই ফরাসি ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া শেষ করে এর মাত্র অল্প কিছুদিন আগে সাংবাদিকতা পেশায় প্রবেশ করেন। সদ্য পেশাগত জীবন শুরু করা সেরকম কোনো তরুণকে বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার তথ্য সংগ্রহে পাঠানো সাধারণত সংবাদ মাধ্যমের প্রচলিত নিয়মভুক্ত নয়। তবে ফরাসি ভাষার দক্ষতা ও সেই সঙ্গে ইংরেজি জানা থাকার কারণেই সমঙ্াদকরা সেদিনের সেই তরুণকে ওই কাজে সবচেয়ে যুত্সই প্রার্থী বিবেচনা করেছিলেন।

একাত্তরের শেষ দিকটায় হঠাত্ করেই এ রকম গুজব শোনা যায় যে, বিশিষ্ট ফরাসি চিন্তাবিদ ও সাহিত্যিক আন্দ্রে মারলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে ট্যাঙ্কবহর নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানির দখলাধীন স্বদেশে মারলো নিজে ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, পরবর্তী সময়ে যিনি বিশ্বের মুক্তিকামী জনগণের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ সমর্থন সব সময় দিয়ে গেছেন। তারও আগে ত্রিশের দশকে সেেনর গৃহযুদ্ধে প্রজাতন্ত্রীদের পক্ষ নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে মারলোর সক্রিয় অংশগ্রহণের চমত্কার বর্ণনা পাওয়া যায় তার উপন্যাস ‘ডেইস অব হোপ’-এ।। ফলে হানাদারদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর এক ধরনের একাত্মতা আন্দ্রে মারলো স্বাভাবিকভাবেই পোষণ করেছিলেন এবং ট্যাঙ্কবহর নিয়ে বাংলাদেশের সেইসব তরুণের পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছার কথাও নিজের পরিচিতদের তিনি বলেছিলেন।

তত্কালীন বিশ্বের নেতৃস্থানীয় সেই চিন্তাবিদের বাংলাদেশের যুদ্ধে অংশগ্রহণের খবর জাপানে পৌঁছে যাওয়ার পর দেশের কয়েকটি নেতৃস্থানীয় সাময়িকী নাওয়াকি উসুইকে অনুরোধ জানায়, তাদের পক্ষ থেকে বিশেষ সেই সংবাদের সবরকম অগ্রগতির ওপর নজর রাখার জন্য কলকাতার পথে যাত্রা করতে। সমঙ্াদকরা নিশ্চিতভাবেই ধারণা করে থাকবেন, আন্দ্রে মারলো বেশ কিছু ফরাসি নাগরিককে নিয়েই হয়তো কলকাতা গিয়ে উপস্থিত হবেন। আর এ কারণেই ইংরেজির পাশাপাশি ফরাসি ভাষা জানা থাকায় তরুণ সাংবাদিক উসুইকে গুরুত্বপূর্ণ সেই দায়িত্বে তারা নিয়োজিত করেছিলেন।

নভেম্বর মাসের শুরুতে নাওয়াকি উসুই যখন কলকাতা উপস্থিত হয়ে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে ঘাঁটি গাড়েন, ইওমিউরি শিম্বুনের প্রতিনিধি তার কিছুদিন আগে থেকেই সেখানে অবস্থান করে বাংলাদেশের যুদ্ধ সমের্ক নিয়মিতভাবে সংবাদ সরবরাহ করে আসছিলেন। সেদিক থেকে উসুইকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহকারী প্রথম জাপানি সাংবাদিক আখ্যায়িত করা যায় না এবং সেরকম দাবি তিনি নিজেও কখনো করেননি। তবে ইওমিউরির সেই সংবাদদাতাকে নভেম্বর মাসে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরে যেতে হওয়ায় পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত জাপানি সাংবাদিকদের মধ্যে একমাত্র উসুই কলকাতায় থেকে যান। আন্দ্রে মারলো অবশ্য তার সেই ট্যাঙ্কবহর নিয়ে কলকাতায় আদৌ উপস্থিত হননি। তবে উসুইয়ের অবশ্য কোনোরকম মনপীড়া তাতে দেখা দেয়নি। কেননা যুদ্ধের গতির ওপর নজর রেখে যাওয়ায় সংবাদের অফুরান উেসর সন্ধান ততদিনে তিনি পেয়ে গেছেন, যে সূত্র ধরে শেষ পর্যন্ত যশোর হয়ে তার খুলনা যাত্রা।

সদ্য মুক্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যাত্রাকারী ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী একটি দলের সঙ্গে অল্প কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে তিনিও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যশোর হয়ে খুলনা যাওয়ার পথে বিস্ময়ে তিনি লক্ষ করেছেন মুক্তির আনন্দে জনতার উত্সবে মত্ত হওয়া। চারদিকজুড়ে যে গান সেদিন শোনা যাচ্ছিল স্বাভাবিকভাবেই তা হচ্ছে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...।’

হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের বিভিন্ন দৃশ্য সচোক্ষে দেখলেও সাংবাদিকের চোখ তার সব সময়ই ছিল খোলা, যে চোখের শাণিত দৃষ্টিতে বিজয়ী জনতার দুয়েকটি নৃশংস আচরণের ছবিও এড়িয়ে যায়নি। তবে নির্মম অত্যাচারের শিকার হওয়া জনগণের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ যে সাধারণত এভাবেই ঘটে থাকে, ফ্রান্সের ইতিহাস সমের্ক গভীরভাবে অবহিত এই সাংবাদিকের তা জানা থাকলেও নিষ্ঠুরতার প্রকাশ প্রত্যক্ষ করে মনের ব্যাথা কিন্তু তিনি ঢেকে রাখতে পারেননি।

খুলনায় পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন; দেখেছেন মাত্র দুদিন আগের বলদর্পী বীররা নত মস্তকে অপমানের বোঝা মাথায় নিয়ে কীভাবে যাত্রা করছে শত্রুর দেশ ভারতের পথে। ভারতীয় বাহিনী পরাজিত পাকিস্তানিদের কয়েকজনকে অস্ত্র বহন করার অনুমতি দেওয়ায় অবাক হয়ে তার কারণ তিনি জানতে চেয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজরের কাছে। মেজর তাকে বুুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অস্ত্র রাখার অনুমতি না দিলে বাংলাদেশের সাধারণ লোকজন পথে এদের কচুকাটা করবে। কেননা এদের চালিয়ে যাওয়া নির্যাতন আর নিপীড়নের স্টিম রোলারের স্মৃতি অনেকের মনেই সজীব রয়ে গেছে যা কিনা তাদের অনুপ্রাণিত করবে ঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আঘাত হানতে।

খুলনা থেকে যশোর হয়ে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পথে সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বাঁশের বেড়ার ঘের দিয়ে তৈরি করা এক চায়ের দোকানে যাত্রাবিরতির সময় হঠাত্ করেই তিনি দেখা পেয়ে যান তরুণ এক মুক্তিযোদ্ধার। যাত্রাবিরতিতে সাংবাদিকের দল যখন চা পানের ফাঁকে দিনের ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনায় মগ্ন, ঠিক সেই সময় তরুণ সেই মুক্তিযোদ্ধা দ্রুত দোকানে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর শব্দ করে অটোমেটিক রাইফেলটি রাখলে উসুইসহ অন্য সবাই সচকিত হয়ে ওঠেন। তবে না, ভয়ঙ্কর সেই অস্ত্র থেকে কোনো রকম গুলি সেদিন বের হয়নি বরং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্তরঙ্গ আলোচনায় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করলে উসুই জানতে পারেন, সেই তরুণ আসলেই হচ্ছেন চট্টগ্রাম ইসঙ্াত কারখানার একজন প্রকৌশলী। জাপানের কোবে স্টিল মিলের কারিগরি সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত ইসঙ্াত কারখানার চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর জাপানে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ তার হয়েছিল, তবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নিজের সেই পেশাগত জীবনকে পেছনে রেখে ঝাপিয়ে পড়েন তিনি দেশকে মুক্ত করার মহান দায়িত্ব পালনে। সেদিনের সেই তরুণ প্রকৌশলী জাপানি সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন, লক্ষ্য প্রায় অর্জিত হয়ে যাওয়ায় আবারও নিজের পুরনো কাজে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি তিনি নিচ্ছেন, সদ্য স্বাধীন দেশকে আদর্শ এক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার নতুন এক যুদ্ধ যেখানে তার জন্য অপেক্ষমান। তিন দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পর তরুণ সেই মুক্তিযোদ্ধার নাম উসুই এখন আর মনে করতে না পারলেও তরুণের সেই মুখচ্ছবি তার স্মৃতির পর্দায় আজও অান রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাংবাদিক হিসেবে নাওয়াকি উসুইয়ের প্রতিষ্ঠা জাপানে এনে দিয়েছে। কলকাতা থেকে তার পাঠানো রিপোর্ট পাঠ করে স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব সমের্ক জাপানের পাঠকদের অনেকে অবহিত হন ও তার তোলা ছবি দেখে পাকিস্তানিদের নৃশংসতা আর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষজনের দুর্দশার মাত্রা সমের্ক তারা আঁচ করতে পারেন। আর এভাবেই একটি যুদ্ধ ও এর পেছনের কাহিনী তরুণ এক সাংবাদিককে সাহায্য করে পেশাগত জীবনে পায়ের নিচের শক্ত মাটি খুঁজে পেতে। ফলে বাংলাদেশ তার হূদয়ে দখল করে আছে বিশেষ এক স্থান। আর তাই একাত্তরের উত্তাল সেই দিনগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের প্রক্রিয়ায় ধ্বংস আর নৃশংসতা নাওয়াকি উসুইকে প্রত্যক্ষ করতে হলেও সেই স্মৃতি সতত হচ্ছে প্রকৃত অর্থেই মধুর এক স্মৃতি।

টোকিও, ৫ মার্চ ২০০৩

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত