জাতির ইতিহাস প্রবহমান নদীর মতো, কখনো তার প্রবাহ শান্ত নিস্তরঙ্গ, হঠাৎ কখনো উত্তাল তরঙ্গসঙ্কুল। একাত্তরে বাঙালির জাতীয় জীবন ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও ঊর্মিসঙ্কুল। ১৯৭১ সালের মতো অমন সময় বাঙালির আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে আর কখনো আসেনি। সেই একাত্তরের মার্চের মতো মাসও বাঙালির জীবনে আর আসেনি।
ব্যাপারটি যেন কাকতালীয়। একাত্তরের মার্চের আগে আর একটি মার্চ এসেছিল ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে, যা ছিল শোষিত-বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানের জীবনে আশাসঞ্চারী। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাঞ্জাবের লাহোর নগরীর রাবি নদীর তীরে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে প্রস্তাব পাঠ করেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক।
পরবর্তীকালে সেই প্রস্তাবের সঙ্গে লীগের নেতারাই বিশ্বাসঘাতকতা করেন। লাহোর প্রস্তাবের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল: ‘ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সন্নিহিত স্থানসমূহ অঞ্চল (জোন) হিসেবে নির্দিষ্ট করতে হবে, প্রয়োজনমতো সীমানা সুসামঞ্জস্য করে ওই সব অঞ্চল এমনভাবে পুনর্বিন্যাস করতে হবে, যাতে ভারতের উত্তর-পশ্চিমে ও পূর্বাঞ্চলে যেসব স্থানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেই সব অঞ্চলসমূহকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণতি করা যায় এবং সেই রাষ্ট্র গঠনকারী অংশসমূহ স্বাধীন ও সার্বভৌম হবে।’
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যে ছয় দফা দাবিনামা জাতির সামনে পেশ করেন, তার শুরু এ রকম:
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাতে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার থাকিবে।...লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আজমসহ সকল নেতার দেওয়া একটি নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের নির্বাচন এই প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ একবাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোটও দিয়াছিল এই প্রস্তাবের দরুনই।’ (শেখ মুজিবুর রহমান, ‘আমাদের বাঁচার দাবী ৬-দফা কর্মসূচী’)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে। সেই নির্বাচনের ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের ম্যান্ডেট। নির্বাচনের আগে ও পরে বঙ্গবন্ধু সভা-সমাবেশে বলেছেন, ‘আমার ছয় দফা যেহেতু জনগণ গ্রহণ করেছে, সুতরাং তা পরিবর্তন–সংশোধন করার অধিকার আমার নাই। পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি এবং সেখানকার সামরিক–বেসামরিক আমলাদের কাছে ছয় দফা ছিল বিছুটির মতো, যা তাদের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিত।’
ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ায় জানুয়ারিতেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে পারত, কিন্তু সরকার ও পিপলস পার্টি-মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্র করে পিছিয়ে দেয়। ৩ মার্চ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ তাতে আপত্তি করেনি, বরং অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। তবে সাধারণ মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছিল এবং উপলব্ধি করতে পারছিল একটা ষড়যন্ত্র পাকানো হচ্ছে, যাতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারে। ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করছিল। সরকারও চালাচ্ছিল দমননীতি। তাতে ফেব্রুয়ারিতেই বহু মানুষ পুলিশ-বিডিআরের গুলিতে নিহত হয়।
পুরো পাকিস্তানে দ্বিতীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই দায়িত্ব-জ্ঞানহীন, অসংযত ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। তিনি ঢাকায় পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছিলেন। আরও এমন সব উক্তি করছিলেন, যা তাঁর মতো আধুনিক শিক্ষিত মানুষ নয়, অপ্রকৃতিস্থ লোকের পক্ষেই সম্ভব। যেমন তিনি বলছিলেন, তাঁর দলের এমপিরা ঢাকা এলে তাঁদের হত্যা করা হবে। অথচ তখন পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো দলের এমপি ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।
পরিষদের অধিবেশন বসার নির্ধারিত তারিখ ৩ মার্চ, তার ৩ দিন আগে ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি বঙ্গবন্ধুকে এক সংবর্ধনা দেয়। সেখানে তিনি এক দীর্ঘ নীতিনির্ধারণী ভাষণ দেন। তাঁর দলের নীতি ও কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। ভুট্টোর অমূলক কথাবার্তার জবাবে বলেন, ‘আমাদের সব এমপিদের বসে আলোচনা করে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো দলের একজন এমপিও যদি যুক্তিযুক্ত কথা বলেন, তা আমরা গ্রহণ করব। আমাদের ছয় দফা কারও ওপর চাপিয়ে দেব না।’ অর্থনৈতিক প্রশ্নে তিনি বলেন, তাঁর সরকার ‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি’ গ্রহণ করবে, বাংলাদেশে আর কোনো ‘২২ পরিবার’ হতে দেবে না।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের আওয়ামী লীগের সব সদস্যের বৈঠক বসে ১ মার্চ সকালে পূর্বাণী হোটেলে। মাত্র এক দিন বাদেই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এমপিরা। রাজনৈতিক মহলে শঙ্কা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রত্যাশাও ছিল যে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। পূর্বাণীতে বৈঠক যখন চলছিল, সেই সময়ই পাকিস্তানে গণতন্ত্রের মাথায় বজ্রপাত হয়: সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ অনুষ্ঠেয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।
সংকট বাঙালিরা সৃষ্টি করেনি, ইয়াহিয়া–ভুট্টো চক্রের সৃষ্টি, কিন্তু ইয়াহিয়া বলেন, দেশ বর্তমানে ‘গভীরতম রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে।’ কয়েক সপ্তাহ আলোচনার পরও রাজনৈতিক দলগুলো মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পরিষদের অধিবেশনে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সামরিক জান্তার প্রধান অযাচিতভাবে আরও বলেন, ‘ভারত অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যা পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।’ সব সমস্যার মূলে ভুট্টো হলেও তাঁকে দোষারোপ না করে তিনি ভারতের ওপর দোষ চাপান। তখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের কোনো রকম প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ নেই। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসহ বিভিন্ন দল পরিষদে যোগ দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত, সেখানে একটি মাইনরিটি পার্টি যদি যোগ দিতে না চায়, সে দায় তার, রাষ্ট্রের বা সরকারের নয়।
স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ
এমনিতেই সরকারের প্ররোচনায় পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত, সে অবস্থায় পরিষদের অধিবেশন বসার ৪৮ ঘণ্টা আগে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করায় বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় বেলা দুইটা পর্যন্ত এবং ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করেন। অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক ছাত্র–শ্রমিক সংগঠন হরতালে সমর্থন দেয়। অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চ ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সেদিন ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এবং বলেন, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন।
এদিকে ফেব্রুয়ারি থেকেই সভা-সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল এবং তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটছিল প্রতিদিন। ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ৬টা-২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট, স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন, পিআইএ, রেলওয়ে, সড়ক ও নৌযান, মিল-কারখানা, বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার প্রভৃতি বন্ধ থাকবে। শুধু চালু থাকবে অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার কর্মীদের গাড়ি। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার ডাক দেন।
বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তা কোনো একক দলের আন্দোলন ছিল না। তা ছিল দল–মতনির্বিশেষে সর্বাত্মক জনযুদ্ধের প্রস্তুতি। মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামের মতো গণবিচ্ছিন্ন ও পাকিস্তানবাদী দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রেণি–পেশার মানুষ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাতে স্বাধিকার আন্দোলনে সঞ্চারিত হয় অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ। মার্চের অসহযোগ আন্দোলনে যাঁরা রাজপথে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন না। তাতে ডান-বাম–মধ্যপন্থার সব শ্রেণির মানুষ ছিলেন, নির্দলীয় মানুষ তো ছিলেনই। ছিলেন কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মী, কট্টর কমিউনিস্ট যেমন ছিলেন, আলেম-উলামারাও ছিলেন। তাঁদের অবদান অস্বীকার করা হবে অকৃতজ্ঞতা শুধু নয়, ইতিহাসকে অস্বীকার। সব দল-মত ও শ্রেণি-পেশার সমর্থন ও অংশগ্রহণের ফলেই মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধে পরিণত হতে পারে।
পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করা এবং তার ফলে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ায় রাজনীতিতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের মধ্যে যাঁরা কিছুটা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং পাকিস্তানের দুই অংশের ঐক্য ও সংহতি চাইতেন, তাঁরাও সাধ্যমতো তৎপরতা শুরু করেন। ৪ মার্চ করাচিতে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান এক সংবাদ সম্মেলন করে শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান। তিনি ভুট্টোকেই দোষারোপ করেন, তবে বলেন মুজিবের ছয় দফার প্রতিও তাঁর সমর্থন নেই।
স্বাধীনতার দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ রাজপথে ছিলই, কিন্তু নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু থেকেই মানুষ শুনতে চাইছিল স্পষ্ট ঘোষণা। ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় জনসভায় তিনি বলেন, ‘আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাছারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।...রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সত্তরের নির্বাচন মাওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বর্জন করলেও কৃষক-শ্রমিক ও মধ্যবিত্তের মধ্যে তাঁর অসামান্য প্রভাব ছিল। শেখ মুজিবের প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ ধরনের দুর্বলতা ও সমর্থন। উভয়ের মধ্যে সব সময় ছিল ব্যক্তিগত যোগাযোগ। একাত্তরে তা আরও ঘনিষ্ঠ হয়। তিনি অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন দেন। ৯ মার্চ তিনি আরও কয়েকটি দলের নেতাদের নিয়ে পল্টন ময়দানে জনসভা করেন। সভার প্রতিবেদনে দৈনিক পাকিস্তান-এর শিরোনাম ছিল: ‘ভাসানী-মুজিব এক হবে’। প্রতিবেদনে মাওলানা ভাসানীর বক্তব্য এভাবে প্রকাশ করা হয়:
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার আপসও সম্ভব নয়। আগামী ২৫ মার্চের মধ্যে এই দাবি মেনে না নিলে আমি শেখ মুজিবের সাথে এক হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করব।...কেউ কেউ বলছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলে শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাথে আপোস করবেন। এই সন্দেহ অমূলক। শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে মাওলানা ভাসানী বলেন, তাঁকে আপনারা অবিশ্বাস করবেন না।
ভুট্টোর পরিষদ বর্জনের হুমকি প্রসঙ্গে ন্যাপপ্রধান বলেন, এটাও নজিরবিহীন ঘটনা। আজাদিপূর্বকালে ভারতীয় পার্লামেন্টে মুসলমানরা সংখ্যালঘিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পার্লামেন্টে যোগ দেব না—এরূপ কথা বলেনি।
অনবদ্য সিদ্ধান্ত
২ মার্চ থেকে বাংলাদেশের প্রশাসন চলছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন ২৫ মার্চ। দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি ঢাকা আসেন তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে। কয়েক দিন তাঁদের মধ্যে বৈঠক হয়। বাইরে রাজপথে স্বাধীনতাকামীদের উত্তাল আন্দোলন ও সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধের প্রস্তুতিও চলে। ২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকা আসেন। তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করেন।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে বলেন, ‘১৬ মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কী? জবাবে ইয়াহিয়া জানান, এ ব্যাপারে তাঁদের তেমন কোন আপত্তি নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে ৪ দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।’
অচলাবস্থা ও রক্তপাত এড়ানোর লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ থেকে যে চার শর্ত দেওয়া হয় এবং যা প্রেসিডেন্ট মেনে নেন বলে জানান, সেগুলো হলো:
এক. মার্শাল ল প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
দুই. প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলগুলোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
তিন. ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
চার. জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
প্রখ্যাত সংবিধানবিশেষজ্ঞ ড. এ কে ব্রোহির কাছে গণমাধ্যম ও রাজনীতিকেরা জানতে চেয়েছিলেন, এই শর্তের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তরে কোনো আইনগত বাধা আছে কি না। তিনি ২২ মার্চ এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, কোনো আইনগত বা সাংবিধানিক বাধা নেই।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধুর আলোচনা চলছিল, তখন গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও গোলাবারুদ আসছিল বাংলাদেশে। বাঙালির স্বাধীনতার স্পৃহাকে স্তব্ধ করে দিতে গণহত্যার প্রস্তুতি নেয় ইয়াহিয়া–ভুট্টো চক্র। ২২–২৫ মার্চ অনুষ্ঠেয় অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়। ক্রোধে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ।
২৩ মার্চ ‘পাকিস্তান দিবসে’ বাংলাদেশের সর্বত্র ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’ উত্তোলন করা হয়। পরিষদের অধিবেশন বন্ধের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২৭ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। তার আগেই ২৫ মার্চ রাতে শুরু হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এবং ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা, যা অব্যাহত থাকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ওই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের মধ্যে যেমন তাজউদ্দীন আহমদ, কামাল হোসেন ২৫ মার্চ সন্ধ্যারাতে বঙ্গবন্ধুকে আত্মগোপনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তিনি তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনেই অবস্থান করেন। তাঁর আত্মগোপনে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর জীবনের সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত। তিনি যে একজন গণতান্ত্রিক নেতা এবং সাহসের সঙ্গে সাংবিধানিক উপায়েই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চান, তা তাঁর গ্রেপ্তারের ভেতর দিয়েই প্রমাণিত হয়। নিজের রাজনীতির ধরন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য: ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ, আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৩৪)
বঙ্গবন্ধু জানতেন, কোনো নেতা পালিয়ে গিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়ে সংগ্রাম করে সফল হয়েছেন এবং পৃথিবীর মানুষ তাঁকে সমর্থন দিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই। যদিও উন্মত্ত পাকিস্তান আর্মির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ছিল ভয়ংকর ঝুঁকির ব্যাপার। তাঁকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানের নির্জন কারাগারে বন্দী করে রাখায় মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে যায়। যদি তিনি তাঁর দলের অন্যান্য নেতার মতো বা মাওলানা ভাসানীর মতো ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতেন, পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক প্রতিপন্ন করত, তাতে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বাধীনতাসংগ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হতো। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যে নিরপেক্ষ দেশ ব্রিটেনের লন্ডনে যান, সেটাও ছিল তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক ও লেখক