বিজ্ঞাপন
default-image

বড় লেখকরা কী না পারেন? একটা সামান্য ঘটনা, একটা সামান্য চরিত্রকে নিয়েও লিখে ফেলতে পারেন একটা বিরাট মূল্যবান কালজয়ী গ্রন্থ। আর ছোট লেখকের হাতে পড়ে, একটা বড় ঘটনা, একটি বহু গুণে গুণান্বিত মহত্ চরিত্রও পরিণত হতে পারে একজন সামান্য মানুষে। এটা শুধু যে একজন লেখকের সৃজনক্ষমতার ওপরই নির্ভর করে, তা নয়, লেখকের নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতার ওপরও লেখার সাফল্য নির্ভর করে। অসামান্য বড় লেখকের ঔদ্ধত্য এবং ছোট লেখকের হীনম্মন্যতা বা কপট বিনয়— কোনোটাই আমার নেই। তারপরও নিজের লেখার দুর্বলতার প্রতি আমার যে একটি দুর্বল সাফাই গাইবার আছে, তা জানলে পাঠক হয়তো আমাকে কিছুটা ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখবেন।

মুক্তিযুদ্ধের মতো একটি বহুমাত্রিক বিশাল সময়খণ্ডের ওপর আমার রচনার দৈন্য নিয়ে তারা হয়তো আমাকে কিছুটা হলেও লঘুদণ্ড প্রদান করবেন। আমি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য স্মরণীয় কোনো রচনা লিখে উঠতে পারিনি। কিছু কবিতা, কিছু গল্প লিখেছি; আমার আত্মজীবনীতেও আমার কণ্ঠস্বর-এ মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের কিছু তথ্যচিত্র তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। একটি পালাকাব্য লিখেছিলাম ইয়াহিয়াকাল নামে। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলোকে সেখানে একজন কবিয়ালের মুখ দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।

আমার অত্যন্ত পরিশ্রমের ফসল হওয়ার পরও ওই পালাকাব্যটি পাঠকমহলে প্রত্যাশিত সাড়া পায়নি। ফলে আমি কিছুটা বিরক্ত ও হতাশা বোধ করে ওই পথে আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। কিন্তু প্রতি বছরই আমাদের বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে কিছু প্রিয় পত্রিকার চাপে ও টাকার প্রয়োজনে আমাকে কিছু না কিছু লিখতেই হয়।

এবার স্থির করেছি, লিখতে যখন হবেই তখন একটু কষ্ট করে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটু বড় আকারেই না হয় কিছু লিখি। মার্চ মাস নিয়ে লিখব। আমাদের জাতীয় জীবনে এই মাসটির মতো এমন ঘটনাবহুল, এমন রক্তরঞ্জিত, এমন গৌরবময় মাস আর দ্বিতীয়টি নেই। লেখাটির নাম হতে পারে ‘মার্চ মাসের দিনপঞ্জি। মার্চ গাছ।’ এই নামে এক সময় একটি কবিতা লিখেছিলাম, কোথায় ছাপা হয়েছিল ভুলে গেছি। সংগ্রহে নেই। ইতিহাস বিকৃতির কথা বিবেচনায় নিয়ে ‘মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ’ নামটাও গ্রহণ করা যেতে পারে।

একজন লেখকের বড় শত্রু হচ্ছে আলস্য। তার সঙ্গে যদি অর্থাভাব যুক্ত হয়, তাহলে তার শত্রুসংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে পড়ে। আমার ক্ষেত্রে, মনে হয় এমনকিছুই একটা ঘটেছে। আমার মধ্যে প্রচুর আলস্য রয়েছে। কায়িক শ্রমের ডাকে আমার দেহ-মন সহজে সাড়া দেয় না। কাব্য রচনার প্রতি আমার যে বিশেষ পক্ষপাত, সে আমার কাব্যদেবীর দৈবানুগ্রহের কারণে নয় বা আমি জন্মসূত্রে কবি বলে নয়; ওই বিশেষ আর্টফর্মটিই যে সকল আর্টফর্মের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম দৈহিক শ্রম দাবি করে, তা আমি খুব ছোটবেলা থেকেই বুঝে গিয়েছিলাম বলে। পরবর্তীকালে আপন সৃষ্টির মর্যাদা রক্ষাকল্পে আমি যে কাব্যকে ভাবের আর গদ্যরচনাকে অভাবের শিল্প বলেছি (ব্যঙ্গ করে কমলাপুর রেল স্টেশনের বা সদরঘাটের টার্মিনালের কুলিদের কাজের সঙ্গেও), তা আমার অর্থাভাববাহিত বাস্তবজীবনের নির্মম অভিজ্ঞতা থেকে লব্ধ।

ফলে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী যত না, তার চেয়ে অনেক বেশি গদ্য আমি লিখেছি আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। যখন হঠাত্ কোনো নির্জন মুহূর্তে আমি আমার বিপুলাকৃতির তিন খণ্ড গদ্যসমগ্রর দিকে তাকাই, আমি খুবই অবাক হই। এগুলো আমার লেখা ভেবে অবাক হই। আমার তো গদ্য রচনার কথা ছিল না। প্রস্তুতিও ছিল না। কাব্য রচনাই হবে আমার জীবনের মূল মোক্ষ, মূল মাধ্যম—এমনটিই মনে করতাম, আজও মনে করি। কিন্তু এ কী? আমার গদ্যসম্ভার যে ক্রমশ আমার কাব্যসম্ভারকে ছাপিয়ে উঠেছে, তার ব্যাখ্যা কী হবে? শুধুই অভাব?

গভীর বিশ্লেষণে এটাই আমার জন্য সত্য বলে মনে হয়। কর্মসূত্রে যখন কোনো সংবাদপত্রে যুক্ত থেকেছি, তখন গদ্য লিখতে হয়েছে। যখন নিয়মিত বিরতিতে চাকরিচ্যুত হয়ে বেকার হয়ে পড়েছি, তখনো ওই গদ্য লেখার ওপরই নির্ভর করেছি আমার জীবিকার জন্য। আমার আত্মজীবনীর দুটি খণ্ড—আমার ছেলেবেলা এবং আমার কণ্ঠস্বর ছাড়া আমার বাকি প্রায় নব্বইভাগ গদ্যই প্রাণের তাগিদে নয়, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রচিত। অর্থাত্ জীবিকামুখ্য প্রণোদনা।

মুক্তিযুদ্ধের ওপর আমি ওই রকমের একটি আলস্যতাড়িত রচনা রচিতে রাজি নই। আমার বর্তমান রচনাটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ লেখা হিসেবে বিবেচনা না করে, এটিকে আমাদের জাতীয় জীবনেতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ওপর রচিতব্য একটি বড় লেখার প্রাককথন রূপে পাঠক গ্রহণ করবেন, এই আশা। অলমিতিবিস্তারেন।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত