বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বই লেখা হয়েছে এন্তার, কিন্তু খুব কম বইতেই সে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকার নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতকে অস্বীকার করার জো নেই, যদিও ১৯৭৫-এর পর সে ভূমিকার স্বীকৃতিসূচক কোনো উল্লেখযোগ্য বক্তব্য এসেছে বলে জানি না। অথচ ভারত একাত্তরে কেবল যে ১ কোটি বাঙালি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছে তা-ই নয়, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছে, নিজেরাও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একযোগে যুদ্ধ করেছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের কয়েক হাজার সৈন্যও নিহত হয়েছিল। পাকিস্তানের নিজস্ব শর্তে এই সমস্যা সমাধানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে যে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে, ভারত তারও মোকাবিলা করে। তার পক্ষে সে সময় একমাত্র শক্তি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট ব্লকভুক্ত পূর্ব ইউরোপের গুটিকয় দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কাবু করার জন্যই সে সময় সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সন পরে স্বীকার করেছেন, প্রয়োজন হলে পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের বিষয়টিও আমেরিকার বিবেচনায় ছিল। বড় ধরনের যুদ্ধে সে জড়িয়ে পড়তে পারে, তা জানা সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসরফায় পৌঁছানোর চেষ্টা করেনি।

এ সবই আমাদের জানা তথ্য, তার পরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা স্বীকার করতে আমরা কেন যেন কিছুটা দ্বিধান্বিত, কিঞ্চিত্ অনাগ্রহী। স্কুলপাঠ্য কোনো গ্রন্থে ভারতের এই ভূমিকাবিষয়ক কোনো তথ্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, তা শুনিনি। বাংলাদেশে কোনো শহরে একাত্তরে ভারতের ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা সরণি নির্মিত হয়েছে, সে কথাও জানি না।

অন্যদিকে ভারতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত অধিকাংশ গ্রন্থে অন্য সব বিষয় থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি কার্যত অনুপস্থিত অথবা বহুলাংশে উপেক্ষিত। অনেক ভারতীয় লেখকই বিষয়টিতে মূলত পাকিস্তান ও ভারতের ঐতিহাসিক বৈরিতার একটি সম্প্রসারণ এবং দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলাফল—এভাবে বিচার করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রধানত ভারতীয় সামরিক শৌর্য ও কূটনৈতিক সাফল্যের প্রতীক—এই মনোভাবটি তাদের অনেক রচনায় উপস্থিত। মার্কিন বা ইউরোপীয় লেখকরাও যখন এ প্রশ্নে আলোকপাত করেছেন, তাকে প্রধানত ভারত পাকিস্তান বৈরিতার পরিপ্রেক্ষিতে যার যার ‘প্রভাববলয়’ নিয়ে মার্কিন-সোভিয়েত-চীন—এই তিন পরাশক্তির লড়াই, সে চোখেই দেখেছেন। কিসিঞ্জার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে তার হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে যে অধ্যায় লিখেছেন, তার নাম ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ওয়ার’। এমনকি রবার্ট জ্যাকসন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা তার অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য বইটির নামকরণ করেছেন দি সাউথ এশিয়ান ক্রাইসিস। ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বই সেখানে মুখ্য, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ তাতে বড়জোর একটি সাব-টেক্সট। একাত্তরের ঘটনাবলির ওপর দুই মার্কিন গবেষক রিচার্ড সিসন ও লিও রোজ ওয়ার অ্যান্ড সিসেসশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যালিফোর্নিয়া ইউ. প্রেস, ১৯৯০) নামে যে প্রামাণ্যগ্রন্থ লিখেছেন তাতে ‘বাংলাদেশ যুদ্ধ’কে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেছেন।

default-image

ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠতম সহকারী ও তার সরকারের অন্যতম সচিব পি এন ধরের লেখা ইন্দিরা গান্ধী, দি ইমেরজেনসি অ্যান্ড ইন্ডিয়ান ডেমোক্রাসি (অক্সফোর্ড, নয়াদিল্লি, ২০০০) এই ধারার খুব যে ব্যতিক্রম, তা নয়। তবে এ বইতে বাড়তি যা যুক্ত হয়েছে, তা হলো পুরো একাত্তরের যুদ্ধকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ। পি এন ধরের চোখে এই যুদ্ধের কেন্দ্রে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সে যুদ্ধের বিজয়েও প্রধান ভূমিকা তার। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অগ্রাধিকার মাথায় রেখে তিনি যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি তার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। ইন্দিরা-কেন্দ্রিক এই বিশ্লেষণ অবশ্য অপ্রত্যাশিত নয়। পি এন ধরের পুরো বইটিই ইন্দিরা ও তার শাসনকালের মূল্যায়ন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার প্রধান বিবেচ্য নয়, তার গ্রন্থের একটি অধ্যায় মাত্র। সে অধ্যায়ের তিনি নামকরণ করেছেন, ‘দি বাংলাদেশ ক্রাইসিস’।

এ কথা অস্বীকার করা অর্থহীন যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটিতে ঘটলেও তাকে ঘিরে যে রাজনীতি, তা কার্যত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল দিল্লি থেকে। উদ্বাস্তু প্রশ্নে ভারতীয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত এ ব্যাপারে একটি বড় ভূমিকা রাখে; কারণ ভারতের মাটিতে ১ কোটি ভিনদেশির উপস্থিতি ভারতের অর্থনীতির ওপরই শুধু যে বড় ধরনের চাপ ফেলে তা নয়, তার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। উদ্বাস্তুরা দ্রুত দেশে ফিরে না গেলে তারা বা তাদের অনেকেই ভারতে স্থায়ীভাবে আবাস গড়ে তুলবে, এমন একটা ভয় ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের গোড়া থেকেই ছিল। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল উদ্বাস্তুদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করতে পারে, ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দল এমন একটি সম্ভাবনা বিষয়েও উদ্বিগ্ন ছিল। সে চেষ্টায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো-বিশেষ করে বামপন্থীরা সফল হলে পূর্ব ভারতের ইলেকটোরাল পলিটিকস বদলে যেতে পারত।

ইন্দিরা সরকারের জন্য তা ছিল একধরনের সমস্যা। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমস্যা ছিল ভারতের সংহতি নিয়ে। ভারতের পূর্ব সীমান্ত আগাগোড়াই সমস্যাসংকুল। অতি বাম সহিংস আন্দোলন তো ছিলই, তার ওপর এ অঞ্চলের রাজ্যগুলোর ভেতর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ষাট ও সত্তরের দশকে প্রবল আকার ধারণ করে। সেসব বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পেছনে যে পাকিস্তান ও চীন ছাতা ধরে বসেছিল, এ ব্যাপারে কোনো বিতর্ক নেই। যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে, বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তত উত্সাহিত হবে, এ কথা ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের জানা ছিল। তাদের বড় ভয় ছিল, পশ্চিমবাংলা নিয়ে। নকশালপন্থী সহিংস আন্দোলন সেখানে ষাটের দশকের শেষ মাথায় জটিল আকার ধারণ করে। এই নকশালবাড়ির প্রভাবে পুরো পূর্ব ভারতের রাজনীতিই ক্রমশ এক চরমপন্থী চরিত্র গ্রহণ করছিল। এ অবস্থায় পশ্চিম বাংলার সীমান্ত বরাবর একটি দীর্ঘস্থায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের প্রভাব যে বহুমুখী হবে, তা বলাই বাহুল্য। এমনকি দুই বাংলা ফের এক হওয়ার আন্দোলন নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে, সে সম্ভাবনাও এক কথায় অস্বীকার করার উপায় ছিল না। (পি এন ধর জানিয়েছেন, বামপন্থী নেতা মওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন, তার তিনটি স্বপ্ন রয়েছে: বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন, সেখানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং ভারত ও বাংলাদেশ মিলে একটি কনফেডারেশন গড়া। তবে তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য খুব জরুরি ছিল আসামের ধুবরিতে—যেখানে তার প্রথম ছেলের কবর—৫ একর জমির ওপর চারটি টিন শেডের বাড়ি নির্মাণ। বলাবাহুল্য, ভারত সরকার ভাসানীকে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত উত্সাহ না জুগিয়ে তাকে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখে)। আদিবাসি অধ্যুষিত পূর্ব ভারতের একাধিক রাজ্যে আকস্মিকভাবে লাখ লাখ বাঙালি উদ্বাস্তু এসে পড়ায় আদিবাসী-অনাদিবাসীর মধ্যে যে ভঙ্গুর ও অত্যন্ত স্পর্শকাতর ভারসাম্য বজায় ছিল, তা ভেঙে পড়ারও সমূহ আশঙ্কা ছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এসবই শিরপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ফলে, ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের একটি ‘অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক’ পরিপ্রেক্ষিত ছিল, তা না মেনে উপায় নেই। আর ভারতের কাছে সেটাই ছিল প্রধান বিবেচ্য, তাতেও কোনো ভুল নেই। পি এন ধরের বিবেচনায়, বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে এই যে সংকট, তার সমাধানে প্রয়োজন ছিল দৃঢ় ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দরকার ছিল এমন একজন নেতার, যার জাতীয় নীতিনির্ধারণ এবং সে নীতির পক্ষে দেশের জনগণকে সংগঠিত করার মতো মেধা, দৃঢ়মন্যতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে নিরাশক্ত মনোভাব। ধরের দাবি, ইন্দিরা ছিলেন সেই রকম একজন ব্যক্তিত্ব। তাকে এ ব্যাপারে ঘনিষ্ঠভাবে সাহায্য করেন পাঁচজন সরকারি আমলা, যাদের তিনজনই ছিলেন ইন্দিরার মতো কাশ্মীরের। সে কারণে তাদের নাম দেওয়া হয় ‘কাশ্মীরি মাফিয়া’। এই তিনজন হলেন পি এন হাকসার (প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের সচিব), আর এন কাউল (বৈদেশিক গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ সচিব) এবং টি এন কাউল (পররাষ্ট্র সচিব)। এই তিনজন এবং এর বাইরের আরও দুজন—সশস্ত্র সচিব কে বি লাল ও মন্ত্রী বিভাগীয় সচিব টি স্বামীনাথন—এই পাঁচজন নিয়ে যে ‘পঞ্চায়েত’ গঠিত হয়, বাংলাদেশ প্রশ্নে অধিকাংশ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে ইন্দিরা তাদেরই ওপর নির্ভর করতেন। পরে হাকসারের স্থলাভিষিক্ত হন পি এন ধর। মুজিবনগরে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর এবং সে সরকারে নেতৃত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কোন্দল দানাবেঁধে উঠলে তা সামলানোর জন্য মস্কো থেকে ডেকে পাঠানো হয় সেখানে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ডি পি ধরকে। তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক সদস্যবিশিষ্ট নীতিনির্ণায়ক পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বাংলাদেশ প্রশ্নে সব রাজনৈতিক সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পি এন ধর নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু ভিন্ন সূত্র থেকে আমরা জানি, মুজিবনগর সরকারের ওপর সরাসরি তদারকির জন্য ভারত সরকার একজন বাঙালি আমলাকেও বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করেন। তার নাম এ কে রায়।

পি এন ধর দুটি সম্পূর্ণ কাকতালীয় ঘটনার উল্লেখ করেছেন, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে ভারতীয় নীতিকে প্রভাবিত করে। প্রথমটি হলো মার্চের শেষে পাকিস্তানি হামলার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা। এক মাস বা তিন সপ্তাহ আগে যুদ্ধ শুরু হলে এর গতি-প্রকৃতি আশু সম্ভাবনার অর্থে ভিন্ন হলেও হতে পারত। একাত্তরের মার্চ মাসে ইন্দিরা কংগ্রেস বিপুল ভোটাধিক্যে ক্ষমতাসীন হন। ১৮ মার্চ, অর্থাত্ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে, তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন ইন্দিরা। কেন্দ্রীয় আইনসভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করায় এককভাবে কোনো দৃঢ় এবং একরোখা সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার অনুসরণের যোগ্যতা ইন্দিরা সরকার অর্জন করে। ধর জানিয়েছেন, ভারতে রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন লোকের অভাব ছিল না, যারা ঢালাওভাবে বাঙালি উদ্বাস্তু প্রবেশের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল, শুধু হিন্দু উদ্বাস্তুদের আসতে দেওয়া হোক। আবার এমন লোকেরও অভাব ছিল না, যারা উদ্বাস্তু অনুপ্রবেশের অজুহাতে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করে এই সমস্যার সামরিক সমাধানে আগ্রহী ছিলেন। এমনকি গান্ধীবাদী বলে পরিচিত প্রবীণ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ পর্যন্ত অবিলম্বে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। (সমর গবেষণা ও বিশ্লেষণবিষয়ক ভারতীয় ইনস্টিটিউটের প্রধান কে সুভ্রামানিয়ামও পাকিস্তানের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অব্যবহিত পর ন্যাশনাল হেরালড পত্রিকায় এক নিবন্ধে তিনি এই ঘটনাকে ভারতের জন্য ‘পাকিস্তান প্রশ্ন’ চিরতরে সমাধানের এক অভূতপূর্ব সুযোগ বলে বর্ণনা করেন।)

ইন্দিরা উভয় চাপই অগ্রাহ্য করেন। সামরিক সমাধান অনুসরণের আগে বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক মনোভাব ভারতের অনুকূলে আনাকেই তিনি ভারত সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে নির্ধারণ করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রক্তচোষা নীতি তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাড়াহুড়োর বদলে সুপরিকল্পিতভাবে এগোনোর যে নীতি তার সরকার গ্রহণ করে, আখেরে তাই ফলপ্রসূ হয়। ডান বা বাম অন্য যেকোনো দলের সাহায্যে মোর্চার মাধ্যমে তাকে সরকার গঠন করতে হলে ইন্দিরা প্রশাসনের পক্ষে এই নীতি আপসহীনভাবে অনুসরণ করা সম্ভব হতো কি না, তা নিয়ে ধরের যে সন্দেহ, তা অমূলক নয়।

দ্বিতীয় ব্যাপারটি আরও আকস্মিক। ৩০ জানুয়ারি ১৯৭১, দুজন কাশ্মীরি মুসলমান ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান অপহরণ করে লাহোরে নিয়ে আসে। পাকিস্তানের পত্রপত্রিকা থেকে শুরু করে সরকারি নেতৃবৃন্দ ও রাজনীতিকরা অবিলম্বে সে দুজন অপহরণকারীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বরণ করে নেয়। পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোও তাদের একজন ছিলেন। তিনি নিজে লাহোর এয়ারপোর্টে এসে তাদের অভিনন্দন জানিয়ে যান। পাকিস্তানি রাজনীতিকদের কাছ থেকে উস্কানি পেয়ে অপহরণকারীদ্বয় সে বিমানকে আগুন ধরিয়ে তা ধ্বংস করে ফেলে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত তার আকাশসীমার ওপর দিয়ে সব ধরনের পাকিস্তানি বিমান চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই অপ্রত্যাশিত কিন্তু সম্পূর্ণ যৌক্তিক ভারতীয় সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জন্য খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায়। পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে তার দূরত্ব প্রায় ১২০০ মাইল। পূর্ব রণাঙ্গণে যুদ্ধ চালাতে হলে পাকিস্তানকে সেনা-সামন্ত-রসদ পাঠাতে হবে। কিন্তু ভারতের আকাশসীমা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাকে শ্রীলঙ্কা ঘুরে বিমান পাঠাতে হতো। এর ফলে পাকিস্তানের সরবরাহ সূত্রই যে কেবল বিঘ্নিত হয় তাই নয়, পাকিস্তানি যুদ্ধ পরিকল্পনাবিদদের জন্য তা এক কৌশলগত দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়।

পি এন ধর পরিহাস করে লিখেছেন, সে ঘটনার দুই মাস পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রসদ সরবরাহে সমস্যা দেখা দেওয়ায় কোনো কোনো পাকিস্তানি নেতা বিমান অপহরণের ঘটনাটি ভারতের সাজানো বলে অভিযোগ করতে শুরু করেন। ‘এই ন্যক্কারজনক ও দুরভিসন্ধিমূলক চক্রান্ত ভুট্টোর সাহায্য ছাড়া ভারতের পক্ষে করা অসম্ভব ছিল’, লিখেছেন ধর।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাটি পাকিস্তানকে বিভক্ত ও দুর্বল করতে অজুহাত হিসেবে ভারত ব্যবহার করেছে—এমন একটি অভিযোগ পাকিস্তানি পণ্ডিতরা বরাবর করে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনও পাক-ভারত যুদ্ধ প্রসঙ্গে তার স্মৃতিকথায় সে যুক্তি দেখিয়ে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের সাফাই গেয়েছেন। তার চেয়েও এক বিঘত্ বাড়িয়ে বলেছেন কিসিঞ্জার। তার নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে ‘গৃহযুদ্ধ’কে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে ভারত শুধু পূর্ব পাকিস্তানকেই বিচ্ছিন্ন করবে না, পশ্চিম পাকিস্তানকেও গিলে খাবে। পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ওপর ভারতের নজর দীর্ঘদিনের। এই যুদ্ধের সুবাদে তার সে লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে। কিসিঞ্জার তার হোয়াইট হাউস ইয়ার্স (লিটল ব্রাউন, বস্টন, ১৯৭৯) গ্রন্থে একটি অজ্ঞাতনামা সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরুর পরপর ‘‘সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত এক সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ নপুংসক করে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার পরিকল্পনামাফিক, বাংলাদেশ ‘স্বাধীন’ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যুদ্ধ-বিরতি ভারত মানবে না। ভারত তারপর পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীর মুক্ত করার লক্ষ্যে তার সৈন্য নিয়োগ করবে। যতক্ষণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তার বিমানবহর সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন না হচ্ছে, ততক্ষণ ভারত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।’’ কিসিঞ্জার এমনও দাবি করেছেন, তার বুদ্ধিতে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর আমেরিকা যে চাপ প্রয়োগ করে, সে কারণেই শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা পশ্চিম পাকিস্তান দখলের পথে যাননি, বাংলাদেশে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পরপর এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে বসেন।

কিসিঞ্জার যে গোপন বিশ্বস্ত সূত্রের কথা বলেছেন, সে যে আর কেউ নয়, ইন্দিরা মন্ত্রিসভার সাবেক সিনিয়র সদস্য (ও পরে প্রধানমন্ত্রী) মোরারজি দেশাই, সে কথা পরে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করেছেন মার্কিন সাংবাদিক-গবেষক সেইমোর হার্শ তার দি প্রাইস অব পাওয়ার গ্রন্থে (সামিট বুকস, নিউইয়র্ক, ১৯৮৩)। কিন্তু সে কথা এককথায় বাতিল করে দিয়েছেন পি এন ধর। কিসিঞ্জার ও নিক্সন উভয়েই দাবি করেছেন, তাদের যে গোপন চর, সে ইন্দিরার মন্ত্রিসভার সদস্য। কিন্তু ১৯৭১-এ ইন্দিরার নতুন মন্ত্রিসভায় দেশাই সদস্য ছিলেন না, দুই বছর আগে ১৯৬৯ সালে ইন্দিরার সঙ্গে বিবাদের ফলে সে মন্ত্রিসভা থেকে তিনি বেরিয়ে যান। পি এন ধর কাষ্ঠহাস্যের সঙ্গে লিখেছেন, ‘কিসিঞ্জারের চীনাপন্থী নীতির কথা সবার জানা ছিল। এমন হতে পারে যে, সিআইএর ভেতর কেউ তাকে খুশি করার জন্য এ তথ্য দিয়েছে।’

২৬ মার্চের পরপরই বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় নীতি চূড়ান্ত হয়নি, ধরের এই দাবি সম্ভবত সঠিক। আগপিছ বিবেচনা না করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইচ্ছা ভারতের ছিল না। সেনাপ্রধান ম্যানেকশ তাকে সরাসরি জানিয়ে দিয়েছিলেন, পুরোমাত্রায় যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। বর্ষাকালে যুদ্ধ সম্ভব নয়। সে জন্য শুকনো মৌসুমের অপেক্ষায় থাকতে হবে। বাঙালি গেরিলাদের ওপরেও ভরসা করা যাবে না, তাদের প্রশিক্ষিত ও প্রস্তুত করতে অনেক সময় লাগবে। এসব সামরিক বিবেচনা ছাড়াও যুদ্ধ শুরু হলে তার যে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া হবে, তা অগ্রাহ্য করাও ইন্দিরার পক্ষে অসম্ভব ছিল। মে মাসে পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে উদ্বাস্তুদের অবস্থা সরজমিনে দেখতে আসেন ইন্দিরা গান্ধী। পি এন ধর সে যাত্রায় তার সফরসঙ্গী ছিলেন। তার কথায়, শুধু সে সফরের পরই বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের নীতি চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ২৪ মে আইন পরিষদে এক বিবৃতিতে ইন্দিরা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, এতদিন পর্যন্ত পাকিস্তান যা তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে দাবি করে এসেছে, তা এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার আকার ধারণ করেছে। তিনি পাকিস্তানের কাছে দাবি তুললেন, উদ্বাস্তুদের শুধু যে ফিরিয়ে নিতে হবে তাই নয়, তাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

একাত্তরের ঘটনাবলি নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন এমন কোনো কোনো লেখক উদ্বাস্তু প্রশ্নটিকে ইন্দিরার তুরুপের তাস বলে বর্ণনা করেছেন। যেমন রবার্ট জ্যাকসন লিখেছেন, এপ্রিল ও মে মাসে ভারত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু আসা বন্ধে আগ্রহী ছিল। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে এবং সীমিত আকারে ভারতীয় সামরিক তত্পরতা চালিয়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করার নীতিও ভারত গ্রহণ করে। উভয় নীতিরই মোদ্দা উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান অর্জন। ভারতের কাছে গ্রহণযোগ্য মানে ছিল শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ। এই পর্যায়ে ভারত উদ্বাস্তু প্রশ্নে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করে; উদ্বাস্তু ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে জাতিসংঘের নেতৃত্ব মেনে নিতেও ভারত আগ্রহী ছিল। কিন্তু তাকে পাশ কাটিয়ে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে জাতিসংঘের আলাপ-আলোচনা শুরু হলে, ভারত তার নীতি বদলে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন অসম্ভব, দিল্লি এই যুক্তি দেখাতে শুরু করে। মে মাস নাগাদ ভারতে এত বিপুল পরিমাণ উদ্বাস্তু এসে পড়ে এবং তাদের দুর্দশা এমন ব্যাপক আন্তর্জাতিক সহানুভূতি আকর্ষণ করে যে, ইন্দিরা স্পষ্ট বুঝলেন, উদ্বাস্তু ‘কার্ড’কে ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে পাকিস্তানের সঙ্গে যেকোনো আলাপ-আলোচনায় বা সমঝোতায় ভারতকে একটি অপরিহার্য পক্ষ বা পার্টি হিসেবে দাঁড় করাতে পারবেন। অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা কেবল পাকিস্তানের নিজস্ব সমস্যা নয়, এ সমস্যা ভারতেরও, এই দাবি তিনি করতে পারবেন। এ সময় থেকেই বাংলাদেশ প্রশ্নে সব আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ রোধ করা ইন্দিরা প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।

উদ্বাস্তু প্রশ্নে ভারতীয় নীতি পরিবর্তনের অবশ্য একটি অভ্যন্তরীণ কারণও ছিল। পি এন ধর জানিয়েছেন, পশ্চিম বাংলায় এবং পূর্ব ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে খুব দ্রুত প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল সে জনমতকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের উদ্যোগী হয়ে ওঠে। তারা অভিযোগ তোলে, ইন্দিরা সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করার পক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই অবস্থায় জাতিসংঘের প্রস্তাবমতো উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন কর্মসূচিতে ভারত সম্মতি দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সুদূরপরাহত হয়ে উঠবে, এ কথা পূর্বাঞ্চলীয় রাজনীতিবিদ ও তথ্যমাধ্যমে খোলামেলাভাবেই বলা শুরু হলো। ধর জানিয়েছেন, এ সময় যে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়, ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য তা সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে। ফলে নিজের অবস্থান অভ্যন্তরীণভাবে সুদৃঢ় করতে ইন্দিরাকে মত ও পথ বদলাতে হলো।

উদ্বাস্তু প্রশ্নে ভারতের কঠোর অবস্থান গ্রহণের আরও একটি কারণ ছিল। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান এ সময় উদ্বাস্তু সমস্যা জটিলতর করে তোলার জন্য ভারতকে দায়ী করে বসেন। তার অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনের মাধ্যমে ভারত নিজেই এই ‘বিশাল সমস্যা’র সৃষ্টি করেছে।

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মহাসচিব উ থান্ট জুলাইয়ের গোড়ার দিকে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদের তত্ত্বাবধানে উদ্বাস্তুদের সম্পূর্ণ স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তনের এক কর্মসূচি পেশ করেন। বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধানের আগে উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়, এই যুক্তিতে ভারত সে প্রস্তাব বাতিল করে দেয়।

তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারও জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে। ২৭ জুলাই কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হোসেন আলি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, উ থান্টের এই প্রস্তাব তারা ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছেন। মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে নাক গলালে তাদের হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তার তাঁবেদারদের যে চোখে দেখা হয়, তাদের সে চোখেই দেখা হবে। অন্য কথায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরাও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হবে (বিস্তারিত দেখুন: রবার্ট জ্যাকসন, পৃ. ৬৬-৬৭)।

এই কূটনৈতিক বাদ-প্রতিবাদের ভেতর জুন-জুলাই নাগাদ বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত যে নীতি গ্রহণ করে, তার দুটি সুস্পষ্ট ধারা ছিল: তারা একদিকে বিশ্বের কাছে উদ্বাস্তুদের দুর্দশা ও পাকিস্তানি গণহত্যার বিবরণ অগ্রাধিকারের ভিতিত্তে তুলে ধরে; অন্যদিকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সাহায্য বৃদ্ধি করে। এপ্রিলের গোড়া থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অধিকতর সামরিক সাহায্যের দাবি তুলে আসছিলেন, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রতি সামরিক সাহায্যের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত তখনো গৃহীত হয়নি। পি এন ধরের কথা থেকে স্পষ্ট, স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারত সামরিক সাহায্য বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য তাকে এই পথে আসতে বাধ্য করে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় সেসব সাফল্যের কাহিনী খুব ফলাও করে ছাপা হয়। ফলে ভারতীয় সরকারের ওপর মুক্তিবাহিনীর প্রতি সর্বাত্মক সাহায্য প্রদানের চাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ধর স্বীকার করেছেন, ‘মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যে ভারত আগ্রহী ছিল, কিন্তু পাশাপাশি পাকিস্তানের সঙ্গে খোলামেলা সংঘর্ষে জড়িয়ে না পড়ার ব্যাপারেও ইন্দিরা সচেতন ছিলেন।’

পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে বদলে যায় জুলাই মাসের প্রাক্কালে, হেনরি কিসিঞ্জারের চীন সফরের ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর। বাংলাদেশের প্রশ্ন নিয়ে চীন, পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাট্টা হচ্ছে, এ কথা পরিষ্কার হয়ে গেলে ভারতের নেতৃত্বের ওপর চাপ প্রবল হয়ে ওঠে। সমস্যা যত দীর্ঘায়িত হবে, তা ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া তত অনিবার্য হয়ে উঠবে, এ কথা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরে ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে আসা হয়। কিসিঞ্জার আগস্ট মাসে স্বাক্ষরিত সে চুক্তিকে একটি ‘বম্বশেল’ বলে বর্ণনা করেছেন, যদিও এ ধরনের একটি চুক্তির সম্ভাবনা কম করে হলেও দুই বছর ধরে আলোচিত হচ্ছিল। ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ তার প্রস্তাবিত এশীয় সম্মিলিত নিরাপত্তা চুক্তির যে প্রস্তাব পেশ করেন, তার কেন্দ্রে ছিল এই ধরনের একটি চুক্তি। পি এন ধর লিখেছেন, ইন্দিরা নিজে সে চুক্তি স্বাক্ষরে মোটেই আগ্রহী ছিলেন না। দেশের ভেতর ডানপন্থীদের চোখে ইন্দিরা সোভিয়েত-অনুসারী বলে এমনিতেই পরিচিত ছিলেন। দক্ষিণপন্থী জনসংঘ তাকে সোভিয়েত এজেন্ট বলে অভিযোগ তুলতেও কসুর করেননি। অন্যদিকে এমন একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে দেশের বামপন্থীরাও দেশের রাজনীতির ধারাকে আরও বামমুখী করার চাপ দিতে পারে, এমন ভয়ও ইন্দিরার ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দূতালিতে কিসিঞ্জার চীন সফর করে এলে অবস্থা বদলে গেল। ভারতের নিরাপত্তার কারণে ও নিজের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে ইন্দিরার জন্য এ ধরনের একটি চুক্তি এ সময় অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

কিসিঞ্জারের পৌরহিত্যে পাকিস্তান-চীন-যুক্তরাষ্ট্র আঁতাত গড়ে ওঠার ফলেই যে ভারত শেষ পর্যন্ত মস্কোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করে, সে কথা একাধিক মার্কিন বিশ্লেষক স্বীকার করেছেন। এসব মার্কিনির অন্যতম ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন। ১৯৭১-এ ভ্যান হলেন মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের অন্যতম সহকারী মন্ত্রী ছিলেন। তার কথায়, ‘চীন-যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে গড়ে ওঠা আঁতাতে ভারতে অনেকেই শঙ্কিত ছিল; কিন্তু এই চুক্তির ফলে মিসেস গান্ধী একটি কূটনৈতিক বিজয় অর্জন করলেন; বিশেষ করে সেই সব রাজনীতিকের বিরুদ্ধে, যারা তার পাকিস্তাননীতিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করছিল। সীমিত আকারে হলেও চীন পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দিচ্ছিল, সে সাহায্যের পটভূমিকায় এই চুক্তির মাধ্যমে ইন্দিরা সরকার এই আশ্বাস অর্জন করল যে, ভারতের বিরুদ্ধে চীন কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বসে থাকবে না। এ কথা বিশেষভাবে তাত্পর্যবহ এই কারণে যে, কিসিঞ্জার ভারতকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন—১৯৬২ সালে চীনা আক্রমণের সময় আমেরিকা তাকে যে সমর্থন দিয়েছিল, এবার সে তা পাবে না। (বিস্তারিত দেখুন: ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন, এশিয়ান সার্ভে, ৪ এপ্রিল ১৯৮০)। স্মরণ করা যেতে পারে, জুলাই মাসে চীন সফর শেষে ওয়াশিংটনে ফিরে কিসিঞ্জার ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব টি এন কাউলকে ডেকে নিয়ে এই বলে হুঁশিয়ার করে দেন যে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে, আর সে যুদ্ধে চীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাক গলাবে না, সে নিরপেক্ষ থাকবে। তার সে হুঁশিয়ারিতে এ কথা গোপন থাকেনি যে, ওয়াশিংটন মনে করে, সম্ভাব্য পাক-ভারত যুদ্ধে চীন-পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করবে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের স্মৃতি তখনো মলিন হয়নি, ফলে ভারতীয় নেতৃবর্গ কিসিঞ্জারের সেই রুমালে ঢাকা হুঁশিয়ারি থেকে যা বোঝার ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন।

পি এন ধর দাবি করেছেন, ইন্দিরা সরকার আগাগোড়াই বাংলাদেশ প্রশ্নের সামরিক সমাধানের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাধানেই বেশি আগ্রহী ছিল, কিন্তু ২০ ও ২১ নভেম্বর যশোর জেলার সীমান্তবর্তী বয়রা গ্রামে পাকিস্তানি সামরিক হামলার পর সে সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়। সীমান্ত অতিক্রম করে আসা তিনটি পাকিস্তানি যুদ্ধ বিমান ও ১৩টি ট্যাংক সে যুদ্ধে ধ্বংস হয়। যুদ্ধ হিসেবে এই ঘটনা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না হলেও কূটনৈতিক ইতিহাসে তার গুরুত্ব কম নয়। তার একটি প্রধান কারণ, কিসিঞ্জার তার আত্মজীবনীতে ২১ নভেম্বরের ঘটনাকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর সূচনা বলে উল্লেখ করে ভারতকেই আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। নভেম্বরের গোড়া থেকেই সারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর তত্পরতা প্রচণ্ড রকম বেড়ে যায়; এমনকি চট্টগ্রামে পাকিস্তানি নৌবহরের ওপরেও তারা সাফল্যজনক হামলা চালায়। সম্ভবত মুক্তিবাহিনী কমান্ড ও ভারতীয় সেনা নেতৃত্ব যৌথভাবে এসব হামলা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌথ অভিযানে অংশ নেয়। সিসন ও রোজ তাদের বইতে সে দাবিই করেছেন। ১২ দিন পর, ৩ ডিসেম্বর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

বয়রার ঘটনাই যে অবশেষে পাক-ভারত যুদ্ধে পর্যবসিত হয়, এ ব্যাপারে পি এন ধর দ্বিমত পোষণ করেন না, কিন্তু তার দাবি, পাকিস্তান সেখানে হামলাকারী, তারা সুপরিকল্পিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধ সূচনার এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তার যুক্তি, মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি বাহিনী পরাস্ত হোক, ইয়াহিয়া ও তার সামরিক কমান্ডাররা তা কখনোই মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। কারণ পরাজয়ের তেমন একটা অনভিপ্রেত ফলাফল হিসেবে পাকিস্তানের ভেতর বেলুচি ও সিন্ধিরা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে উত্সাহিত হতে পারত। অন্যদিকে পুর্ব রণাঙ্গনে ভারতের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে পরাজিত হলেও পাকিস্তান কাশ্মীরে বিপুলভাবে জয়ী হতে পারে, তেমন জয়ের সম্ভাবনা পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের হিসেবে অবশ্যই করে থাকবে। তারা এ কথাও ভেবে থাকতে পারে যে, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে থাকবে এবং ভারতকে তাদের শর্তে যুদ্ধ-বিরতি মানতে বাধ্য করবে। সিসন ও রোজ অবশ্য পি এন ধরের এই দাবি বা ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন। কিসিঞ্জারের সঙ্গে একমত হয়ে তারা লিখেছেন, পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু না হলেও ‘বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গিতে’ বলা যায়, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় ২১ নভেম্বর থেকেই। সেদিন ভারতীয় সাঁজোয়া বহর পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত অতিক্রম করে এবং সে দেশের অভ্যন্তরে সেনা অবস্থান গ্রহণ করে। এই দুই গবেষক একাত্তরের যুদ্ধের প্রায় ২০ বছর পর সকল পক্ষের সঙ্গে কথা বলে, অনেক নথিপত্র ঘেঁটে যে ইতিহাস লিখেছেন, তাতে বলা হয়েছে, বয়রার যুদ্ধের সময় থেকে, ২১ থেকে ২৫ নভেম্বরের মধ্যে, ভারতীয় বাহিনীর কয়েক ডিভিশন সৈন্য একাধিক রণাঙ্গনে একযোগে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে তারা এই সময়ের মধ্যে একাধিক ‘আপারেশনাল বেস’ গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়।

পি এন ধর দাবি করেছেন, পূর্ব পাকিস্তান তার পশ্চিমাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হোক, এমন কোনো গোপন অভিসন্ধি ইন্দিরার ছিল না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কোনো চক্রান্তও তিনি ফাঁদেননি। ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক অভিযান শুরুর পর লাখ লাখ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশের পর তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, যেকোনো মূল্যে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া। শান্তিপূর্ণ উপায়ে সে সমস্যার সমাধানই তার কাম্য ছিল। পি এন ধরের দাবি, এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব ছিল, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এ ব্যাপারে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু পাকিস্তান মার্কিন সমর্থন পেয়ে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টার বদলে সামরিকভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান চেষ্টা করে। তার ফলেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

পি এন ধরের এই মূল্যায়ন সম্ভবত সঠিক। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ যদি ১৯৭০-এর নির্বাচনী ফল মেনে নিতেন এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানাতেন, একাত্তরের ঘটনা হয়তো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতো। কিন্তু উদ্বাস্তুরা ফিরে যাক, শুধু এই ইচ্ছা থেকে ইন্দিরা অবশেষে সামরিক পথ বেছে নেন, তার সে ব্যাখ্যা কিছুটা মনগড়া। ১৯৭১ অথবা তার আগে থেকে ভারত তার এই পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর প্রশ্নে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা অনুসরণ করছিল। একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ পূর্ব বাংলা (বাংলাদেশ) গঠিত হোক, এই লক্ষ্য তার সে এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তেমন একটি রাষ্ট্র গঠন ভারতের নিজস্ব স্বার্থেই কাম্য ছিল।

পূর্ব বাংলায় যদি ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র (বা সরকার) গঠিত হয়, তাহলে তার পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত হবে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠিত হলে সেখানে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ হ্রাস পাবে, সেখান থেকে ভারতে হিন্দুদের বহিরাগমন হ্রাস পাবে—ভারতের অঙ্কে এই হিসাবও ছিল। আরও একটি কৌশলগত উদ্দেশ্য ভারত অনুসরণ করে থাকতে পারে। আগেই বলেছি, পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন বিদ্রোহী রাজনৈতিক গ্রুপ পাকিস্তান ও চীনের কাছ থেকে সামরিক এবং আর্থিকভাবে সাহায্য পেত। তাদের ক্রমবর্ধমান তত্পরতা ভারতের সংহতির জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশে তার বন্ধুভাবাপন্ন একটি রাষ্ট্র গঠিত হলে বিদ্রোহীদের প্রতি সে সাহায্য বন্ধ হবে, ভারত সে আশা করে থাকতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশ স্বাধীন হোক, শুধু এই রণকৌশল ভারত অনুসরণ করেনি, সেখানে ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ বা তার নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সরকার ক্ষমতায় আসুক, ভারত মনেপ্রাণে তাই চেয়েছিল। ভারতের প্রতি বৈরী বা তার জন্য রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক এমন দল যেন সেখানে ক্ষমতায় না আসে, সে চিন্তা ভারতের মাথায় সব সময়ই ছিল।

ওয়াশিংটন পোস্টের সঙ্গে ১৩ নভেম্বর ডি পি ধরের এক সাক্ষাত্কারের কথা উল্লেখ করে সিসন ও রোজ লিখেছেন, ভারতীয় নেতৃবর্গ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের সম্ভাবনাতেই কেবল সন্দিহান ছিলেন না, তাদের হাতে ভবিষ্যত্ বাংলাদেশ সরকারের চরিত্র নিয়েও তারা চিন্তিত ছিলেন।

তাদের ভয় ছিল, পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরার মতো সমস্যাসংকুল ও বামঘেঁষা রাজ্যের পাশে কোনো অতি-বাম সরকার ক্ষমতায় এলে তা পূর্ব ভারতের রাজনীতির জন্য স্থিতিহীনতার কারণ হয়ে উঠতে পারে। ঠিক সে কারণে ভারত প্রথম থেকেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলি ও গতি-বিধি কড়া নজরে রাখে। এই সরকার যাতে মধ্যপন্থী রাজনীতি ত্যাগ না করে বা চরমপন্থী কোনো দল তার ওপর নিয়ন্ত্রণ অর্জন না করে, তা নিশ্চিত করতে তার আগ্রহে কোনো রাখঢাক ছিল না। অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ওপর খবরদারি করার জন্যই ইন্দিরা তার একান্ত বিশ্বস্ত ডি পি ধরকে মস্কো থেকে ডেকে আনেন। এটা কোনো গোপন বা অজ্ঞাত ব্যাপার নয় যে, আওয়ামী নেতারা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব নিজেদের বাইরে অন্য কোনো দল বা নেতাকে আনতে আগ্রহী ছিলেন না। ভারত সরকারের চাপেই সেপ্টেম্বরের গোড়ার দিকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ভাসানী ও ন্যাপ মোজাফফরকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি পাঁচদলীয় কমিটি গঠন করা হয়। বিভিন্ন বাঙালি লেখক সে কমিটি গঠনকে মুজিবনগর সরকারের সিদ্ধান্ত বলে দাবি করলেও তার পেছনে যে ডি পি ধরের হাত ছিল, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

১৯৭১-এর বাংলাদেশ যুদ্ধকে ভারতীয় নেতারা তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রয়োজনে সফলভাবে ব্যবহারে সক্ষম হলেও মাত্র চার বছরের মাথায় সব পরিস্থিতি আমূল বদলে গেল। পাকিস্তানকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে ভেবে ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন, কিন্তু ১৯৭৫-এর পট পরিবর্তনের ফলে সেই পাকিস্তান আবার মধ্যমঞ্চজুড়ে আবির্ভূত হলো। কিন্তু সে আরেক ইতিহাস। তা বড় বেদনার, বড় বঞ্চনার।

২১ মার্চ ২০০৬, নিউইয়র্ক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত