নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পাল্টে যাচ্ছিল যুদ্ধের ছবি। মুক্তিবাহিনী তখন অনেক সংগঠিত, ভারতীয় বাহিনী পেছন থেকে জোগাচ্ছিল জোর সমর্থন, মুক্ত হতে শুরু করেছিল সীমান্তবর্তী কিছু কিছু এলাকা। ঢাকাবাসীর কাছে এসব ছিল দূরের যুদ্ধ; আগুনের আঁচ তাদের গায়ে লাগেনি, কিন্তু বাঘের থাবার নিচে চলছিল তাদের বসবাস। সেই ছবি আমূল পাল্টে গেল ডিসেম্বরের ৩ তারিখ গভীর রাতে, যখন আকস্মিকভাবে ট্রেসার বুলেটের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রাতের আকাশ, বিমানবিধ্বংসী কামানের গোলার ভয়ংকর শব্দে ক্রমাগতভাবে কেঁপে উঠছিল মাটি, ফাঁকে ফাঁকে শোনা যাচ্ছিল দূরাগত বোমারু বিমানের মৃদু গুঞ্জন, সংগীতের মূর্চ্ছনা যেন তা দিচ্ছিল ছড়িয়ে সবার মনে।
ঢাকায় দ্রুতই যুদ্ধ এক আনন্দরূপ ও শঙ্কারূপ নিয়ে দেখা দিল। গোড়াতে এসব ছিল আকাশযুদ্ধে ভারতীয় বিমানের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার নাটকীয়তা, অবরুদ্ধ শহরবাসীর জন্য তা ছিল পাকিস্তানের চরম হতমান পরাজয়ের প্রত্যক্ষ চিত্র। বিমান আক্রমণের সাইরেন বেজে উঠলে নিরাপত্তার জন্য ট্রেঞ্চে নয়, সবাই উঠে যেত ছাদে, পাকিস্তানের আরেক নাটকীয় পরাজয়ের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার অভিলাষে। ১০ কিংবা ১১ ডিসেম্বর থেকে ঢাকাবাসী পেতে শুরু করল আরেক আনন্দময় ধ্বনি। ভারী কামানের গোলাবর্ষণের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ জানান দেয় সম্মুখযুদ্ধও চলে এসেছে শহরের কাছাকাছি। সেই সঙ্গে চলছিল পাকিস্তানি সেনাপ্রধানদের আস্ফালন; ‘ক্র্যাশ ইন্ডিয়া’ স্লোগান তুলে পাকিস্তানপন্থীদের মিছিলও অনুষ্ঠিত হয়ে গেল শহরে। জেনারেল নিয়াজি বিদেশি সাংবাদিকদের ডেকে জানালেন, তাঁর শবদেহের ওপর দিয়ে ট্যাংক চালিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে ঢুকতে হবে ঢাকায়, ‘ফোর্ট্রেস ঢাকা’ পরাভূত করার শক্তি কারও নেই।
শহরবাসীর বুঝতে বাকি ছিল না, শুরু হতে যাচ্ছে সেই চূড়ান্ত ‘ব্যাটল অব ঢাকা’। এমনিতেই ঢাকা শহর ছিল বিরান, এবার শুরু হলো শহর ত্যাগের আরেক পালা। রাস্তাঘাটে মানুষের দেখা বিশেষ মেলে না। পাশাপাশি নানা দুর্লক্ষণও দেখা দিচ্ছিল—অবাঙালি বেসামরিকজনের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল অস্ত্র, প্রকাশ্যে সেসব নিয়ে ঘুরতে কসুর ছিল না তাদের। একদিন দেখলাম অবাক করা দৃশ্য, আকাশে যুদ্ধবিমান দেখা দিতেই রেসকোর্সের রাস্তায় অবাঙালি মোটরসাইকেল-আরোহী দ্রুত থেমে পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি ছুড়তে থাকে আকাশের দিকে। আহাম্মক বটে, তবে সেই নির্বোধের হাতে আছে অস্ত্র এবং তার যথেচ্ছ ব্যবহারে পিছপা নয় মোটেও। এমনই দুর্লক্ষণ আরও বড়ভাবে দেখা দিল, যখন গভীর রাতে নিচু দিয়ে উড়ে চলা প্রপেলারচালিত টাইগার মথ বিমান ওড়ার শব্দে বিস্ময়ে সচকিত হয়ে উঠল শহরবাসী। প্রতি রাতে এমনি করে বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছিল লোকালয়ে, চরম জঘন্য কাজ করে পাকিস্তানিরা দেখাতে চেয়েছিল ভারতীয় বিমান হামলায় মৃত্যুবরণ করছে সাধারণ মানুষ। একদিন এই বোমা বিস্ফোরিত হলো তেজগাঁওয়ের এক এতিমখানায়, ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল অনেক শিশুর দেহ।
১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকে কীভাবে যেন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল বার্তা, পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে চলেছে। কেউ তখনো বিশেষ জানে না, জেনারেল নাগরার বাহিনী মুক্তিসেনাদের সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেছে মিরপুরের তুরাগতীরে, ব্রিগেডিয়ার জামশেদ তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেছেন ক্যান্টনমেন্টে। দুপুর নাগাদ প্রথম দেখা মিলল ভারতীয় সেনাদের তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল তথা বর্তমান শেরাটন হোটেলের সামনে, যে স্থান ঘোষিত হয়েছিল রেডক্রসের মুক্ত এলাকা হিসেবে। দেখতে দেখতে মানুষ বের হয়ে আসতে শুরু করে বাড়িঘর থেকে। রাস্তাজুড়ে দেখা যাচ্ছে আরেক অভিনব দৃশ্য—অস্ত্র নামিয়ে ধরে মাথা নিচু করে ক্যান্টনমেন্টের দিকে হেঁটে চলেছে হাজারে হাজারে পাকিস্তানি সেনা, কখনো বা তারা চলছে ট্রাকে গাদাগাদি করে; তাদের অস্ত্র তখনো উঁচিয়ে ধরা, চোখ রক্তলাল।
সাধারণ মানুষ অবরুদ্ধ আবেগ নিয়ে তাদের দেখছিল। তখনো যুদ্ধের শেষ হয়নি, বাঁধভাঙা আবেগে তারা ফেটে পড়তে পারেনি, মাঝেমধ্যে বেধে যাচ্ছিল সংঘাত। যেমন ঘটেছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে; পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল হঠাৎ আক্রমণ করে বেসামরিক নাগরিকদের, সঙ্গে সঙ্গে আসে ভারতীয় বাহিনীর দাঁতভাঙা জবাব, কিন্তু ততক্ষণে ঝরে পড়েছে কতক সাধারণ নাগরিকের প্রাণ।
আমার বিজয় দিবস ছিল ভিন্নতর। অগ্রজপ্রতিম সৈয়দ শরফুল আনামের গাড়িতে করে ছুটে ফিরছিলাম ইতিউতি, নানা জায়গার খবর সংগ্রহ করে ভাগ করে নিতে হবে সহকর্মীদের সঙ্গে। ডেমরার শীতলক্ষ্যাপারের যুদ্ধাবস্থান থেকে ফিরে আসা পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি ছিল না যুদ্ধের কোন পরিণতি ঘটছে। গভর্নর হাউসে কোনো প্রহরী নেই, দ্বার অবারিত, বিমান হামলায় দরবার হলের ছত্রখান অবস্থা জানান দিয়েছিল পাকিস্তানি প্রশাসন তছনছ হওয়ার বাস্তবতা। আমরা রেসকোর্সের ময়দানে পৌঁছাতে পারিনি সময়মতো; পরে যখন তেজগাঁও বিমানবন্দরে যাই, তখন যৌথ বাহিনীর নেতাদের নিয়ে হেলিকপ্টার উড়াল দিয়েছে আকাশে। তাঁদের বিদায় জানিয়ে টারমাকে অপেক্ষা করছিলেন মেজর হায়দার; সেই প্রথম এবং বোধ করি শেষ তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ, হাত মিলিয়ে যেন পেলাম মুক্তির স্বাদ।
তবে মুক্তির আলোয় সত্যিকারভাবে স্নাত হলাম পরদিন ১৭ ডিসেম্বর, যখন আমাদের গেরিলা দলের সদস্যরা ঢুকল শহরে। আমরা ইতিমধ্যে প্রস্ত্ততি নিয়েছিলাম শহীদ মিনারে নাগরিক সমাবেশের। গেরিলা দল যখন এল সেখানে, সুফিয়া কামালও হাজির হয়েছিলেন রিকশায় একজন সঙ্গী নিয়ে। যোদ্ধাদলের সদস্য মাহবুব জামানকে কাছে টেনে আমি জানতে চাইলাম, আজাদ কি সত্যি নেই! তার জবাবে আমি সেই প্রথম নিশ্চিত হলাম, সহযোদ্ধা নিজামউদ্দিন আজাদ হারিয়ে গেছেন। আমাদের বিজয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত অযুত মানুষের হারিয়ে যাওয়ার বেদনা! মাথায় ভর করে কত কত মানুষের মুখ! ততক্ষণে ভাঙা শহীদ মিনারে উঠে দাঁড়িয়েছেন সুফিয়া কামাল; তিনি কথা বলতে শুরু করেছেন, তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে আর আমাদের সবার চোখ বেয়ে নামছে অশ্রুর ঢল।
১৯ মার্চ ২০১১, ঢাকা
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত