বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আমার যে অনুভূতি, তার পুরোটাই ব্যক্তিপর্যায়ের; এর কারণ, আমি নিজে একজন বাঙালি। গত মার্চ থেকে সেখানে যেসব অস্বাভাবিক প্রকৃতির ঘটনা ঘটছে, তা আমার মধ্যে মামুলি সহানুভূতির উদ্রেক করেনি, বরং এর চেয়েও জোরালো অনুভূতি কাজ করছে; কারণ আমি বাঙালি। অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে আমি প্রত্যক্ষভাবে সেখানকার পরিস্থিতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। কারণ সেখানকার অগণিত মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তারা কোনো রকমে প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে। অসংখ্য লোককে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আমার দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি, আত্মীয়, মুসলমান বন্ধুসহ বহু ঘনিষ্ঠজন রয়েছে। এমনকি আমার গুরুর পরিবারের লোকজনকেও হত্যা করা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব শেষ করে দেওয়া হয়েছে।

এ কারণে মার্চ থেকে পরবর্তী কয়েক মাস ধরে চলমান ঘটনাপ্রবাহ আমাকে বেদনাবিদ্ধ করেছে। কষ্ট দিয়েছে। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছি।

জুন মাসের শেষ দিকে রাগা অ্যালবামের কাজের জন্য জর্জ হ্যারিসন ক্যালিফোর্নিয়ায় এল। এ সময় আমার মনটা খুব অশান্ত ও বিচলিত ছিল। বাংলাদেশের মানুষের জন্য কিছু করতে মন চাইছিল। আমি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বহু সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমাকে পরিবেশনা বাবদ ভালো সম্মানী দিতেও রাজি ছিল। কিন্তু আমি বৃহৎ পরিসরে এমন কিছু করতে চাইছিলাম, যা বড় অঙ্কের একটা তহবিলের জোগান দেবে। পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক প্রচারণাও পাবে।

default-image

এ কারণে ভাবলাম, জর্জকে বড় ধরনের একটা কনসার্ট করার কথা বলব। সে যদি নিজে অংশ না-ও নেয়, অন্তত এ বিষয়ে অন্য শিল্পীদের অনুরোধ করে, পরামর্শ দিয়ে বা অন্য কোনোভাবে সাহাঘ্য করতে পারে কি না, জিজ্ঞেস করব। চেষ্টা করলে হয়তো বড় একটা অনুষ্ঠান করে ২৫ থেকে ৫০ হাজার ডলারের তহবিল জোগাড় করে ফেলতে পারি।

বিষয়টি তাকে বলার পর সে আমার আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হলো। আমি বাংলাদেশিদের করুণ অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য তাকে বাংলাদেশ-সম্পর্কিত বইপত্র ও সাময়িকী দিলাম। একজন ভারতীয় হিসেবে নয়; বরং একজন খাঁটি বাঙালি হিসেবে আমি তাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলাম। ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড, নরওয়ে, আমেরিকাসহ বহু দেশের সংবাদপত্র বাংলাদেশের ভাগ্যবিড়ম্বিত লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন কষ্ট ও দুর্দশা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরছিল। সেগুলো পড়ার পর জর্জের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এর পরই সে আমাকে জানায় যে এই মহান অনুষ্ঠানে সাহাঘ্য করতে পারলে, এমনকি পরিবেশনার সুযোগ পেলে খুশি হবে।

এর পরই কাজ দ্রুত এগোতে থাকে। স্পেনে ওই সময় একটা ফিল্মের কাজ করছিলেন রিঙ্গো। জর্জ তাঁকে ডাকল। তিনি লিওন রাসেলের সঙ্গে কথা বলেন এবং পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলের বিখ্যাত সব সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানালেন। এরপর তিনি মিস্টার ক্লেইনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁকে এই কনসার্টের ব্যবসায়িক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দিলেন। প্রত্যেকেই গভীর সহমর্মিতা নিয়ে এগিয়ে এলেন।

সৌভাগ্যক্রমে বব ডিলানকেও আমরা পেয়ে গেলাম। তিনি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে রীতিমতো উদ্বেলিত ছিলেন। মাত্র চার বা পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে এই মহা আয়োজন সম্পন্ন হলো। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এ ধরনের বিশাল একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা এবং সফলভাবে তা সম্পন্ন করা বিশ্ব বিনোদন জগতে নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড।

এ জন্য সবাইকে অজস্র ধন্যবাদ।

এখন আমি বড় ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতে পারছি। জর্জের ‘বাংলাদেশ’খ্যাত গান, আমার একটি পরিবেশনা, কনসার্ট নিয়ে বানানো প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, প্রকাশিতব্য অ্যালবাম—এই সবকিছুর মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া গেছে, তা-ও সহায়তা তহবিলে যোগ হবে।

৮০ লাখ শরণার্থী এবং তাদের মধ্যকার অগণিত শিশুর সাহাঘ্যার্থে জোগাড় করা এই অর্থ যদিও মহাসাগরে এক ফোঁটা জলের সমান; এ দিয়ে হয়তো বড়জোর তাদের দুই থেকে তিন দিনের অন্নের সংস্থান করা যেতে পারে; কিন্তু সেটাই মুখ্য বিষয় নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তহবিল সংগ্রহের বাইরে আমরা কনসার্টে আসা যুব সম্প্রদায়কে (আগত দর্শকদের মধ্যে ৪০-৫০ হাজার তরুণ-তরুণী ছিল) বাংলাদেশ সম্পর্কে এবং সেখানে মানুষ কী দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে, সে বিষয়ে ধারণা দিতে পেরেছি।

‘যত দূর সম্ভব, প্রত্যেকের কাছে দায়িত্ব পৌঁছে দেওয়ার যে চেষ্টা, যে আকুতি, এই কনসার্ট ছিল তারই একটা স্ফুলিঙ্গ আমার মনে হয়, সেই মহৎ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পেরেছি।’

অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

১ আগস্টের প্রথম কনসার্টের দুই দিন পর একটি অনানুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার থেকে মাইকেল ভসের সম্পাদিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর পরিচিতিমূলক পুস্তিকা থেকে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১১ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত