বিজ্ঞাপন
default-image

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে চারপাশের ধ্বংসলীলার মধ্যে রক্তভেজা মৃত্যুগন্ধী মাটিতে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে হয়েছিল, এমন ভয়ংকর মৃত্যুযজ্ঞ যা তছনছ করে দিয়েছে কোটি পরিবারের জীবন। দাউদাউ যে অগ্নিশিখা গ্রাস করেছে লক্ষ গৃহ, ধ্বংসের ছাপ বুকে বয়ে বেরিয়েছে প্রায় সকল জনপদ, সে কি কখনো ভুলবার?

সেই নৃশংস বাস্তব কি কখনো মুছে যাওয়ার? সাড়ে সাত কোটি জনসংখ্যার দেশের এক কোটি জন হয়েছিল আপন আবাস ও স্বদেশ থেকে বিতাড়িত, অর্থাৎ প্রতি সাতজনের একজন হয়েছিল দেশান্তরি। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে কত মানুষ হয়েছিল আশ্রয়চ্যুত, শহর থেকে গ্রামে নির্বাসিত, সেই হিসাবই বা কে রেখেছে! তারপরও জীবন রয়েছে বহমান, সম্মিলিত স্মৃতি লালন করবার যে আয়োজন, তাতে নানা দুর্বলতা একসময়ে যৌথস্মৃতি দুর্বল করে তুলল, ভয়াবহতার স্মৃতি ক্রমে বিচ্ছিন্ন ও বিভাজিত হয়ে ব্যক্তিস্মৃতিতে পর্যবসিত হতে লাগল। তবে দুঃখে জাতি যখন সম্মিলিত হতে অক্ষম, সেই সময়েও জেগে রইল লোকস্মৃতি ও ব্যক্তিস্মৃতি, যা কখনোই মুছে যাওয়ার নয়।

গণহত্যা-উত্তর বাংলাদেশের জন্য জীবনের বাস্তবতা আরও জটিল হয়ে উঠেছিল যখন ১৯৭৫-পরবর্তী রাষ্ট্র হয়ে উঠল স্মৃতি-সংহারক এবং ইতিহাসের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বোধ সঞ্চারে সরকারি আয়োজন অর্জন করল সর্বপ্লাবিতা। এর বিপরীতে স্মৃতির উদ্ভাসন অর্জন করেছিল নতুন মাত্রা এবং সাহিত্যে চিত্রকলায় নাটকে চলচ্চিত্রে ভাস্কর্যে নানাভাবে প্রতিভাত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা। জন্ম নেয় বাংলা সাহিত্যে সম্পূর্ণ নতুন এক ধারা: একাত্তরের স্মৃতিভাষ্য। ইতিপূর্বে দেশভাগের বেদনামণ্ডিত অধ্যায় আমরা রূপায়িত হতে দেখেছি সাহিত্যে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে বিভিন্নভাবে, সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে যার দুই অনন্য উদাহরণ হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি এবং করুণাময় গোস্বামীর ভারতভাগের অশ্রুকণা। কিন্তু পার্টিশনের স্মৃতিভাষ্য তো আমরা বিশেষ পাই না। তুলনায় একাত্তরের রক্তাক্ত অধ্যায় নিয়ে এপিক সাহিত্যের অপেক্ষায় যদি আমরা এখনো রয়ে যাই, তারপরেও এটা লক্ষণীয়, কত ধরনের স্মৃতিভাষ্যই না আমরা পেয়ে চলেছি একাত্তরের দিনগুলি ঘিরে। এর মধ্যে বিপুল আলোড়ন-সঞ্চারী গ্রন্থ আমরা যেমন পেয়েছি, তেমনি আছে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটানো স্মৃতিজাগানিয়া ভাষ্য। এইসব স্মৃতি-আলেখ্য জাতির যৌথস্মৃতি নির্মাণে অবদান রেখে চলেছে, যে যৌথস্মৃতি আমরা একদা হারিয়ে যেতে বসেছিলাম।

এ ক্ষেত্রে আরও যেটা তাৎপর্যময়, বিগত চার দশকাধিক কালে বাংলাদেশে এমন এক তরুণ প্রজন্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, যাদের কোনো প্রত্যক্ষ স্মৃতি নেই একাত্তরের। তাদের ইতিহাস-বোধ নির্মাণ ও স্মৃতিসত্তা গড়ে তুলতে ঐতিহাসিক-দালিলিক-শৈল্পিক উপাদান যেমন গুরুত্ববহ, তেমনি তাৎপর্যময় লোকস্মৃতি ও লোকপরম্পরা, যা পরিবার-পরিজন-সমাজ দ্বারা বিশেষভাবে বাহিত হয়। এ ক্ষেত্রে নবীনসমাজ যে কেবল গ্রহণ করে চলবে পূর্ববর্তী জনের কর্মফল থেকে, তেমন ভাবাটা ভুল হবে। নবীনেরা ইতিহাসের বোধ ধারণ ও আত্মস্থকরণে তাদের মতো করে কাজ করে এবং এর ব্যক্তিক প্রকাশ আমরা দেখি শিল্পে-সাহিত্যে, আর যূথবদ্ধ প্রকাশ দেখি সামাজিক বিবিধ ক্রিয়াকাণ্ডে, হোক সেটা উৎসব-আনন্দে, কিংবা গণজাগরণ মঞ্চে।

জাতীয় এই পরিস্থিতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক যে বাস্তবতার পরিচয় আমরা পাই সেটা আরও জটিল, নানা জটাজালে আক্রান্ত। প্রবহমানতা সেখানে বাধার দেয়ালে মাথা কুটে মরছে বটে, তবে পথ খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টাও রয়েছে অব্যাহত, তা সে যতই ক্ষীণ হোক। ১৯৭১-এর নয় মাসজুড়ে বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা আন্তর্জাতিক মহলে পেয়েছিল ব্যাপক প্রচার। মূলত সাংবাদিকেরা করেছিলেন এই কাজ এবং তাদের সংবাদভাষ্য বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের আলোড়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশে যে নৃশংসতা পাকিস্তানি বাহিনী ঘটিয়ে চলেছিল, সেটা যে ছিল জেনোসাইড, তা বুঝতে ওয়াকিবহাল মহলের বিলম্ব ঘটেনি। মার্চ মাসের শেষ প্রান্তে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাড স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রেরিত গোপন বার্তার শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘জেনোসাইড’ শব্দটি এই প্রথম ব্যবহৃত হলো, তবে অদূর ভবিষ্যতে এর আরও প্রয়োগ ঘটবে বলে মনে হয়। জুলাই মাসে সানডে টাইমসে অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের রিপোর্টের বিশাল হরফ শিরোনাম ছিল ‘জেনোসাইড’। হিন্দুদের বিশেষভাবে নিধনের টার্গেট করার রোমহর্ষক বিবরণ সেখানে দাখিল করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে সংহতির ফরাসি কমিটি ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ঘোষণায় পাকিস্তান সরকারকে অভিযুক্ত করেছিল জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য।

কিন্তু বিস্ময়করভাবে লক্ষ করবার বিষয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মানবাধিকার-বিষয়ক ইন্টারন্যাশনাল এনজিও বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ে ছিল একেবারেই নীরব। আজ জেনোসাইড প্রতিরোধ ও নিবারণে আন্তর্জাতিকভাবে যেসব বিধি-ব্যবস্থা ও উদ্যোগ গড়ে উঠেছে বিগত শতকের সত্তরের দশকে তা ছিল অস্তিত্বহীন ও কল্পনাতীত। ফলে সেই সময় বাংলাদেশের গণহত্যার কোনো স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মেলেনি, যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনচিত্তে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ছবি ছিল জ্বলজ্বলে ও বাস্তব।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গণহত্যার নৃশংস অভিজ্ঞতায় বিচলিত বিশ্বসমাজ মানবতার চরম অধঃপতনে স্তম্ভিত, ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হয়। জাতিসংঘের আওতায় ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় জেনোসাইড কনভেনশন এবং পরদিবস ১০ ডিসেম্বর ১৯৪৮ গৃহীত হয় সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা। তবে অচিরেই স্নায়ুযুদ্ধে বিশ্বসমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং গণহত্যা-প্রতিরোধে সর্বসম্মত অবস্থান নিতে সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি সময়জুড়ে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়া অবধি, জাতিসংঘ গণহত্যা-মোকাবিলার জন্য কিছুই করতে পারেনি, নিতে পারেনি সামান্য কোনো পদক্ষেপ। এই তমসাচ্ছন্ন কালে, ১৯৭১ সালে ঘটেছিল বাংলাদেশে গণহত্যা, বিশ্ববাসীর চোখের সামনে, সংবাদপত্রে ও টেলিভিশনে প্রায় প্রাত্যহিক বিবরণী ও তথ্যপ্রমাণের প্রবাহের মধ্যে। ফলে গণহত্যা অস্বীকার করবার কোনো উপায় কারও ছিল না, কিন্তু উপেক্ষা করবার মতো বাস্তবতা মাথা পেতে নিয়েছিল পঙ্গু, অথর্ব, মানবতাবোধ-বিবর্জিত জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। অথচ এমন নয় যে, গণহত্যা দুনিয়ার বুক থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছিল। সত্তরের দশকেই বাংলাদেশে গণহত্যার পরপর ঘটেছে কম্বোডিয়ায় নৃশংসতা, যা অব্যাহত ছিল চার বছরজুড়ে। ঘটেছে আর্জেন্টিনা চিলি গুয়াতেমালায় রাষ্ট্র পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, কিন্তু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কিংবা সাধারণ পরিষদে তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা বিশেষ ঘটেনি।

সমস্ত আলোচনা ছিল রাজনৈতিক প্রশ্ন ঘিরে কিংবা বড়জোর তা উপচে পড়েছিল মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা বিষয়ে, যেমন ঘটেছে বাংলাদেশ ইস্যুতে যেখানে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব অথবা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ব্যতিব্যস্ত ছিল, গণহত্যা বিষয়টি ছিল তাদের এখতিয়ারের বাইরে।

একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা পেয়েছিল আন্তর্জাতিক মহলের উপেক্ষা এবং স্বাধীনতার পর প্রাপ্য হলো অবজ্ঞা ও অবহেলা। এই গণহত্যা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা বিচার-বিশ্লেষণ করবার মতো কাউকে আর বিশেষ পাওয়া গেল না। এমনকি গণহত্যা বিশ্লেষণে নিয়োজিত ছিলেন সংখ্যাল্প যেসব গোষ্ঠী ও ব্যক্তি, তাঁদের বইপত্র গবেষণায় দেখা যায় কম্বোডিয়ার গণহত্যা বারবার উল্লিখিত হয়েছে, রুয়ান্ডা বা পূর্বতন যুগোস্লাভিয়ার গণহত্যা আলোচিত হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশে গণহত্যা প্রায় কখনোই নয়। পাশ্চাত্য জ্ঞানদর্শন ও চর্চায় সমকালীন রাজনীতির যে প্রভাব, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই বাস্তবতা। কম্বোডিয়ায় নরমেধযজ্ঞ পরিচালনা করেছিল তথাকথিত সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ-অনুসারী গোষ্ঠী, তাই তাদের নিন্দাবাদে পশ্চিম মুখর হতে পেরেছে সহজেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে গণহত্যার হোতা মার্কিন প্রশাসনের পরম বন্ধু পাকিস্তানি সামরিক শাসকগোষ্ঠী, আর নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র এর পেছনে ছিল প্রধান মদদদাতা। তাই পাকিস্তানের নিন্দাবাদের তির তাদেরকেও চিহ্নিত করে এবং সে কাজে ব্রতী হতে বিশেষ কাউকে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশে গণহত্যা ঘিরে তাই ‘কালেকটিভ অ্যামনেসিয়া’ বা সম্মিলিত বিস্মৃতি-প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল যুগ-লক্ষণ।

ইতিহাসের পথ-পরিক্রমণে এই বাস্তবতা আজ পাল্টে গেছে। এমনি পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে বহু কার্যকারণ, আছে অনেক কাঠ ও খড় পোড়ানো। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত বইপত্র গবেষণাকর্মে আবার ফিরে আসছে একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি, কেন কীভাবে এই গণহত্যা সংঘটিত হতে পারল, সেটা হয়ে উঠছে বিচার্য এবং মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে নানাভাবে।

স্মৃতি-বিস্মৃতির পর্ব পেরিয়ে বাংলাদেশের গণহত্যা যে আবারও বিশ্বসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করেছে, তার নানা প্রকাশ আমরা সাম্প্রতিক কালে দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে এক মোড় পরিবর্তনই আমরা লক্ষ করি। গ্যারি জে ব্যাস, শ্রীনাথ রাঘবন, সলিল ত্রিপাঠী, বীণা দি কস্তা, নয়নিকা মুখার্জি প্রমুখ বাংলাদেশের গণহত্যা উপজীব্য করে তথ্যসমৃদ্ধ বই আমাদের উপহার দিয়েছেন। এর আগে লিও কুপার, আর. জে. রামেল, স্যামুয়েল টোটেন প্রমুখের বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার সবিস্তার উল্লেখ আমরা দেখতে পেয়েছি। তবে সেসব ছিল ব্যতিক্রম। গণহত্যা-বিষয়ক বহু তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশনায় বাংলাদেশের গণহত্যা হয় একেবারে উপেক্ষিত হয়েছিল, কিংবা সামান্যই উল্লিখিত হয়েছিল। সে অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সারস্বত সমাজ এবং গবেষক-মহলেও একাত্তরের গণহত্যা ক্রমে স্বীকৃতি অর্জন করছে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারসের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বেশ কয়েক বছর যাবৎ তিন-চারটি গবেষণাপত্রে উদ্দিষ্ট হয়েছে একাত্তরের গণহত্যা। নরওয়ের মরটেন বের্গসমোর নেতৃত্বাধীন ফোরাম ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিন্যাল অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান ল প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতি বিশেষ মনোযোগী এবং বিচার-প্রক্রিয়ার সমর্থনে একাধিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের তারা উদ্যোক্তা। ইয়েল ল স্কুলের হিউম্যান রাইটস ক্লিনিক ১৯৭৩ সালের আইন দ্বারা ১৯৭১ সালের অপরাধের বিচার আয়োজনের আইনগত বৈধতার প্রশ্নে অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের অবস্থান বিশ্লেষণ করে তাদের ইতিবাচক পর্যবেক্ষণ মেলে ধরেছেন। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির আইন বিভাগ নারী নির্যাতনের বিচারকালে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বেজিস্ট্রারের কাছে মেলে ধরেছিল। এ মুহূর্তে কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও জার্মানির খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থী বাংলাদেশের গণহত্যা ও বিচার বিষয়ে পিএইচডি গবেষণার কাজ করছেন।

সব মিলিয়ে যে নতুন পরিবর্তন, তার পেছনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অনেক পালাবদল নিশ্চয় কাজ করেছে, তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশে প্রায় চার দশকের বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে বিচার-প্রক্রিয়ার সূচনা, গণরায়ে বলিষ্ঠ সরকার ২০১০ সালে আইসিটি-বিডি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যার সূচনা করেছে। এই বিচার একাত্তরের গণহত্যাকে আবার মঞ্চের মাঝখানে স্থাপন করেছে এবং এর ওপর নানা দিক থেকে ঘটছে আলোকসম্পাত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিচারে যারা অভিযুক্ত, সেই সব প্রতাপশালী ব্যক্তি এবং তাদের সমর্থক জঙ্গি মৌলবাদীরাও পরোক্ষভাবে অবদান রেখেছে। বিপুল অর্থব্যয়ে তারা যেসব লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, সেসব আইনজীবী বিচারব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রমাণ করতে প্রাণপাত করছেন, লবি করে বেড়াচ্ছেন দুনিয়াময়। আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান যথেষ্ট পোক্ত, অর্থের কারণে তাঁরা যে অবস্থান নিয়েছেন, সে জন্য বিচারের ঘাটতি নির্দেশ করতে সরব হলেও তাঁরা কেউই একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যা ও নিষ্ঠুরতার ব্যাপকতা অস্বীকার করতে পারছেন না, বরং বলতে চেষ্টা করছেন গণহত্যার বিচারের তাঁরা পক্ষে, তবে চান আন্তর্জাতিক মানের বিচার। বিচারের আন্তর্জাতিক মান বলতে কোন সোনার পাথরবাটির কথা তাঁরা বলছেন, সে ভিন্ন বিষয়। তা নিয়ে অনেক কথা বলবার রয়েছে। তবে এখানে যা বিশেষভাবে লক্ষ্যযোগ্য তা হলো, একাত্তরের গণহত্যা আবারও বিশ্বসমাজের দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হচ্ছে। ইতিহাসের এই স্বীকৃতি অর্থময় করে তুলতে আমাদের অনেক কাজ রয়েছে সম্পাদনের। বাংলাদেশের গণহত্যা বিষয়ে নিবিড় অধ্যয়ন, বিশ্লেষণ, গবেষণা, পর্যালোচনা থেকে এর মূল শিক্ষা অনুধাবন এবং তার ভিত্তিতে গণহত্যার মতো নিষ্ঠুরতার চির-অবসান ঘটিয়ে সভ্যতার অগ্রগমনে আমাদেরও যোগ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সেই দায় আজ বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য এবং দায়মোচনে নানা কর্মকাণ্ডের উদ্বোধন বিশেষ জরুরি।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত