বিজ্ঞাপন
default-image

যুদ্ধের আগের সতর্কতামূলক সময়টাতেই বঙ্গোপসাগরের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে পূর্বাঞ্চলীয় নৌবহর মোতায়েন করা হয়েছিল, যাতে লড়াই বাঁধলেই শত্রুপক্ষকে হতবাক করে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে আমাদের কিছু বিমানঘাঁটিতে হামলা চালালে নৌবহরটি ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বিকেলে আন্দামান থেকে যাত্রা করে। বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী কে কোথায় অভিযান চালাবে তা আগেই আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা ছিল। ৪ ডিসেম্বর ভোরে আমাদের যুদ্ধজাহাজটি পূর্ব পাকিস্তানের হামলার আওতায় চলে আসে। ৪ ডিসেম্বর সকালে যুদ্ধজাহাজ বিক্রান্ত কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে আঘাত হানে। খারাপ আবহাওয়ার কারণে পরদিন কোনো বিমান হামলা চালানো হলো না। তবে ৬ ডিসেম্বর প্রচণ্ড বিমান হামলা চালানো হয় এবং এর ফলে অনেক ছোট নৌযান, কিছু বাণিজ্য জাহাজ ও কয়েকটি রণতরী ডুবে যায়। ১০ ডিসেম্বরের দিকে সমুদ্র ও নদীপথের প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থাই পুরোপুরি স্থবির করে দেওয়া হয়। এই সময়োচিত আক্রমণ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয়ে দারুণভাবে কাজে দেয়।

এখানে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকার কথা স্বীকার না করলেই নয়। পূর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাবাহিনীর তত্পরতা পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালিদের ব্যাপক অংশকে বিক্ষুব্ধ করে এবং অনেক নৌসেনাসহ ব্যাপক সংখ্যক সৈন্য পালিয়ে যায়। পাকিস্তান নৌবাহিনী ঐতিহ্যগতভাবেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে রিক্রুটের ওপর নির্ভর করত। তবে নৌবাহিনীর কারিগরি ট্রেডের নাবিকদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই পালিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া পাকিস্তান থেকে মুক্তিলাভের আন্দোলন করছে এমন অনেক সংগঠন রাতারাতি নড়েচড়ে উঠে এবং এগুলোর সদস্যরা শরণার্থীদের সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে আসে। এই মুক্তিযোদ্ধারা পরে নিয়মিত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এবং তাদের লড়াইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।

default-image

মুক্তিবাহিনীর নৌ কমান্ডো অংশটি গঠিত হয়েছিল এমন সব নাবিকদের নিয়ে, যারা পাকিস্তানের দাফনে ক্যাটাগরির সাবমেরিন মাংরু থেকে পালিয়ে এসেছিল। আরো অনেক উত্সাহী বাঙালি যুবক এই অংশটিকে ঘিরে সংগঠিত হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন এবং জাহাজ ও রণতরী ধ্বংস করায় এই বাহিনীটিই অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডোর এফওসি-এন-সি ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান ঠিকই অনুমান করেছিলেন যে, ঢাকার হাইকমান্ড পূর্ব পাকিস্তান থেকে যত সংখ্যক সম্ভব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পালিয়ে আসার ব্যাপারে সব সময় আশাবাদী ছিল। তার ধারণা ছিল, বাণিজ্য জাহাজের ধারণক্ষমতায় কুলালে প্রায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও জওয়ান ধরা পড়ার আগেই পালিয়ে যাবে। তবে এই বিশাল মাপের পলায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল এমন বড় জাহাজের, যা শুধু চট্টগ্রাম বন্দর থেকেই ছেড়ে যায়। ১০ থেকে ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও বিক্রান্ত চট্টগ্রাম বিমানঘাঁটি ধ্বংস করতে এবং তিনটি বাণিজ্য জাহাজ ও একটি পাক নৌ রণতরী ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এগুলো ক্যামোফ্লাজ অবস্থায় ছিল এবং পাক হাইকমান্ডের পলায়নের জন্য প্রস্তুত রাখা ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনচালিত সব ভাসমান নৌযানই ডুবিয়ে দেওয়া হলে ১৬ ডিসেম্বর হাইকমান্ডের সামনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। একমাত্র যে জাহাজটি রাতের অন্ধকারেও পালিয়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেয় সেটি হলো পিএনএস রাজশাহী। পূর্বাঞ্চলীয় লড়াই মঞ্চে টিকে থাকা একমাত্র জাহাজ ছিল এটি।

default-image

পাকিস্তানের গাজি সাবমেরিন মোতায়েনের ব্যাপারটি ছিল ভবিষ্যদ্বাণী প্রায় পুরোপুরি মিলে যাওয়ার মতোই। ভারতীয় নৌবাহিনী স্থান-কাল বিবেচনা করে ইঙ্গিত দিয়েছিল পাকিস্তানের একমাত্র গাজিরই বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালানোর মতো পাল্লা ও কার্যকারিতা রয়েছে এবং গাজিকেই এ মিশনে পাঠানো হচ্ছে। একই হিসাব সম্ভবত পাকিস্তানও করেছিল। কারণ বঙ্গোপাসাগরে গাজিকে মোতায়েনের সিদ্ধান্তটি পাকিস্তান সদর দপ্তর অবশ্যই অক্টোবরের শেষ দিকে নিয়েছিল। তা না হলে ১৪ নভেম্বরের মধ্যে সাবমেরিনটিকে পূর্ব উপকূলের দিকে পাঠানো সম্ভব হতো না। এটি সঙ্ষ্ট ছিল, বঙ্গোপসাগরে জুলাই-আগস্ট মাসে বিক্রান্তকে পাঠানো হয়েছে জেনেই গাজিকে মোতায়েন করা হয়েছিল। বিক্রান্তের বঙ্গোপসাগরে অবস্থানের বিষয়টি গোপন রাখা ছিল প্রায় অসম্ভব। তবে জাহাজটির প্রকৃত অবস্থান বিষয়ে শত্রুপক্ষের গোয়েন্দা বিভাগকে ধাঁধায় ফেলার সর্বোচ্চ কৌশল নেওয়া হয় এবং তাতে ভারত সফলও হয়।

আমার স্টাফ এও অনুমান করতে পেরেছিল, বিক্রান্ত্ত ও গাজি একে অন্যের গতিপথ অতিক্রম করবে। পাকিস্তানি সাবমেরিনটি ২৫-২৭ নভেম্বর মাদ্রাজ থেকে যাত্রা শুরু করে এবং যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার মুহূর্তে এটি বিশাখাপত্তাম ছাড়ছিল। ৩-৪ ডিসেম্বর রাতে বিশাখাপত্তাম থেকে চালানো এক বিস্ফোরণে গাজি ধ্বংস ও সাগরে নিমজ্জিত হয়। এরপর অনেক ডুবুরিদল ধ্বংসস্তূপে অভিযান চালিয়েছে। আর এতে সন্দেহ নেই যে, ওখানেই গাজি ধ্বংস হয়েছে এবং ছিল এর টার্গেট।

আমরা পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সব ধরনের সংকেতের ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছিলাম। ফলে তাদের যাবতীয় কার্যক্রমের প্রস্তুতি এবং লড়াই বাঁধার আগে জাহাজ ও সাবমেরিন মোতায়েনের বিষয়ে দফায় দফায় শলাপরামর্শের বিষয়ে যথেষ্ট ভালো একটি চিত্র তৈরি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়। তবে একইভাবে শত্রুপক্ষও যাতে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নজরদারি না করতে পারে সে ব্যাপারে আমরা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। এর মধ্যে ছিল নকল সংকেত প্রেরণ, কোড-ভায়োলেশন মনিটরিং এবং অন্যান্য নিরাপত্তাবিষয়ক কার্যক্রম।

পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ড পাকিস্তানিদের এই ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে, বিক্রান্ত বিশাখাপত্তাম পোতাশ্রয়ে রয়েছে, যদিও সেটি ওই মুহূর্তে ছিল আন্দামানে। ২৫ নভেম্বর পাকিস্তান নৌবাহিনী যেকোনো মূল্যে জোন ভিকটর (বিশাখাপত্তামের ছদ্মনাম) দখল করতে গাজিকে নির্দেশ দেয়। কারণ পাক নৌগোয়েন্দারা তাদের বলেছিল, ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজটি সেখানেই রয়েছে। ৩-৪ ডিসেম্বর রাতে ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজি নিশ্চয়ই অধীর আগ্রহে বিক্রান্তের জন্য ক্লান্তিকর প্রতীক্ষা করছিল!

গাজির নিমজ্জনের খবর যুদ্ধে এক চমত্কার সূচনা ঘটায়। তবে গাজির ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধারকৃত আলামত সূত্রে ইতিবাচক প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি খবরটি চেপে যাই। এক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করতে পূর্বাঞ্চলীয় নৌ কমান্ডের এফওসি-ইন-সি ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণান যেসব কৌশল প্রণয়ন করেছিলেন, সেগুলোর অবদানের কথা স্বীকার করতেই হবে।

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আমরা দেখি পাকিস্তান তাদের সব জ্বালানিচালিত নৌযানকেই পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশীদের জন্য রাখা ছিল ছোট কিছু রণতরী। তবে অপ্রয়োজনীয় ধ্বংস যুদ্ধের পর বাংলাদেশীদেরই ক্ষতি করবে ভেবে শুরুর দিকে আমরা প্রতিটি নৌযানেই আঘাত না হানার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। পরে এই সিদ্ধান্ত বদলানো হয় এবং বিক্রান্তকে নির্দেশ দেওয়া হয় নদী বা বন্দরের সব যন্ত্রচালিত নৌযানেই যেন হামলা চালানো হয়। কারণ যুদ্ধ চলাকালে এ ধরনের যানকে শত্রুযান হিসেবেই দেখা উচিত।

মনে হচ্ছিল সবাই এ কথা জানত যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী যেভাবে অব্যাহত গতিতে এগোচ্ছে তাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর টিকে থাকার সম্ভাবনা সীমিত। এক্ষেত্রে তারা হয় আত্মসমর্পণ করবে, নয় সমুদ্রপথে পিছু হটবে। বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি আসন্ন-এ খবর পেয়ে আমরা ধরে নিলাম পাকিস্তানিরা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নেবে।

পাকিস্তানিদের চট্টগ্রাম, চালনা ও খুলনা বন্দর দিয়ে যন্ত্রচালিত নৌযান ও ফেরিতে চড়ে সমুদ্রে গিয়ে জাহাজে ওঠার সম্ভাবনাটি সহসাই খুবই বাস্তব হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় চট্টগ্রামসহ অন্যান্য বন্দরে এ ধরনের যান নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এক পর্যায়ে সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। আমরা স্বস্তির সঙ্গে অনুমান করলাম, এর গভীর পানির জলযানগুলো অগভীর পানিতে চলাচল করতে গেলে বাধাগ্রস্ত হবে। সেই সঙ্গে এটিও খুব সঙ্ষ্ট হয়ে যায়, পাকিস্তান যদি তাদের সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ চায় সেক্ষেত্রে তারা চট্টগ্রাম বন্দর কিংবা অন্যান্য নদীবন্দর থেকে ছোট্ট নৌযানে করে মাঝসমুদ্রে গিয়ে জাহাজে চড়বে। তাই পলায়নের সব পথ রুদ্ধ করে দিতে বন্দরের সব জাহাজসহ যাবতীয় নৌযান ও ফেরিতে হামলা চালানোর আদেশ দেওয়া হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে তিন বাহিনীর প্রধান মানেকশ (সেনাবাহিনী), প্রতাপ লাল (বিমান বাহিনী) এবং আমি জলে ও স্থলে একসঙ্গে অবতরণের সম্ভাবনার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। সৈন্য মোতায়েনের ভার নেয় সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিবহনের দায়িত্ব পড়ে আমাদের ওপর। আমরা দুটি এলএসটি (ল্যান্ডিং শিপ ট্যাঙ্ক ভ্যাসেলস, যার মাধ্যমে সমুদ্রপথে অবতরণকারী সৈন্যদের ট্যাঙ্ক বহন করা হয়) প্রস্তুত করি। কিছু গুর্খা জওয়ানকে অপারেশনের দায়িত্ব দেয় সেনাবাহিনী। তবে যেহেতু স্থলভাগেই অপারেশন চলছিল, শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে জলস্থলভাগে অবতরণের আর প্রয়োজন পড়েনি।

উভচর অবতরণের ধারণাটি তিন বাহিনীর প্রধানদের বৈঠকে উঠেছিল ১২ ডিসেম্বর কিংবা কাছাকাছি কোনো তারিখে। ততদিনে পাকিস্তানিরা প্রায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। তাই তৈরি থাকার পরও আমাদের উভচর বাহিনীকে আর মোতায়েন করা হয়নি। সেনাবাহিনী মনে করে তাদের সব প্রস্তুতি শেষ, সৈন্যরাও হামলা করতে প্রস্তুত রয়েছে, তাই তাদেরই ব্যবহার করা হোক।

আমরা জানতাম ওই অঞ্চলে আমাদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হবে না। আমাদের এও জানা ছিল, এ এক এমন অনুশীলন যার মাধ্যমে জানার সুযোগ হবে আমরা যা অর্জন করতে চাই তা আদৌ সম্ভব কিনা। আসলে ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডকে অভিযান চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেনেই আমরা উভচর অবতরণের ধারণাটি বিবেচনা করেছিলাম। পরিকল্পনামতো গুর্খা জওয়ানরা আমাদের এলএসটিতে আরোহণ করে। তাদের অবতরণস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা হয় সংশ্লিষ্ট সব উপাদানের হিসাব-নিকাশে ভুল করি কিংবা জওয়ানরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত ছিল না। ফলে আমাদের কিছু সৈন্য প্রাণ হারায়।

বাংলাদেশ যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মি চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি হয় ১০ ডিসেম্বর, যেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে পুব দিকের অংশটি মেঘনা নদী অতিক্রম করে। সেদিনই সঙ্ষ্ট হয়ে যায় যে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে ইতিমধ্যেই হেরে গেছে। তবে পূর্বাঞ্চলের লড়াইয়ের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের লড়াইয়েরও গভীর সমর্ঙ্ক ছিল, কারণ পাকিস্তান এমনটিই চেয়েছিল। সরাসরি যুদ্ধ এড়াতে এবং যুদ্ধ যাতে একই এলাকায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতে পাকিস্তান শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলে চাপ কম রাখার কৌশল নিয়েছিল। এই প্রপঞ্চটি উপলব্ধি করা জরুরি। কারণ ১০ ডিসেম্বরের পর এটি সঙ্ষ্ট হয়ে যায় যে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলে হেরে গেছে, তবে পশ্চিমাঞ্চলে এর প্রভাব তখনো ছিল অনিশ্চিত।

উপমহাদেশের দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এই যুদ্ধনাট্যের পেছনে আরেকটি নাটকেরও মঞ্চায়ন হচ্ছিল, যার দুই কুশীলব যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার। স্নায়ু যুদ্ধের পটভূমিতে দুটি দেশই পরসঙ্রকে টেক্কা দিতে চেয়েছিল।

এই প্রেক্ষাপট থেকেই সোভিয়েত নৌবহর এন্টারপ্রাইজ একদিন বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও ভেবেছিল ভারত সাগরে তাকে কোনো প্রভাব রাখতে হলে সেটা সমুদ্রপথেই সম্ভব। তাই এন্টারপ্রাইজের অগ্রাভিযানের খবর পাওয়ার পর আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতি বিষয়ে দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকেও অগ্রসর হওয়ার ‘আদেশ’ দেওয়া হয়েছে, এ খবরটি আমরা পাই ১০ ডিসেম্বর বিকেলে গোয়েন্দা সূত্র ও পত্রপত্রিকার খবর মারফত। প্রধানমন্ত্রী (ইন্দিরা গান্ধী) আমাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহরের যাত্রার খবরটি আমি শুনেছি কিনা। আমি হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিই। শুনে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে আপনারা কী করতে যাচ্ছেন’? আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, ‘আপনি কি মনে করেন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায়’? এবার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনার এই মন্তব্যের হেতু কী’? আমি জবাব দেই, ‘ম্যাডাম, তারা আমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চাইছে। তবে আমাদের উচিত শক্ত থাকা। আমি আমাদের জাহাজবহরের ক্যাপ্টেনদের নির্দেশ দিচ্ছি কোনো মার্কিন জাহাজের মুখোমুখি হলে তারা যেন পরিচয় বিনিময় করে এবং চা-কফির দাওয়াত দেয়।’ শুনে প্রধানমন্ত্রী শুধু হাসলেন। এরপর আমি অ্যাডমিরাল কৃষ্ণানকে নির্দেশ দিই, তিনি যেন এ অনুযায়ী সব জাহাজকে নির্দেশ দেন।

এটি সত্যি যে, ওই সময়ে রাশিয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মার্কিন জাহাজের গতিবিধি জেনে আমাদের সেসব অবহিত করত। ১১ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বেশ কিছু বড় ঘটনা ঘটে, যেগুলোর ব্যাখ্যা প্রয়োজন আছে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ইসলামাবাদ পূর্ব পাকিস্তানে তাদের হাইকমান্ডকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে যে, পরাশক্তি বন্ধুরা তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসছে। পাকিস্তান এই পরাশক্তি বন্ধুদের কখনো ‘সাদা’ কখনো ‘হলুদ’ বলে উল্লেখ করত। এসব সাংকেতিক শব্দের অর্থ আমাদের জানা ছিল। তাই সবকিছু হেসে উড়িয়ে দেব সেই পরিস্থিতি আমাদের ছিল না।

১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর এন্টারপ্রাইজের অবস্থান সমের্ক কিছু সন্দেহ ছিল। তবে ১৪ ডিসেম্বর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে যখন আমাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করা হয়, তখন নৌবহরটি মালাক্কা প্রণালীতে ছিল। আমাদের কাছে এও সঙ্ষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের পতনের আগে ও পরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ভূমিকার তফাতটা হবে আকাশ-পাতাল।

ওই সময়ে আমাদের আত্মবিশ্বাসে কিছুটা ভাটা পড়ার পরও এ কথা সত্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের পতনের পর সপ্তম নৌবহরের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী হবে তা আমরা তখনও সঠিকভাবে অনুমান করতে পারিনি। যুদ্ধের পর এ বিষয়ে বেশ কিছু বক্তব্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের স্মৃতিচারণ ও অ্যাডমিরাল এলমো জুমওয়াল্টের আত্মজীবনী ওন ওয়াচ। তবেই এই দুজনই নিজের মতো করে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছেন। বড় বিষয়গুলোতে দুজনের কথায় মিল থাকলেও খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ে মিল নেই। অথচ এ ধরনের খুঁটিনাটি বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেই কোনো লড়াইয়ের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ণয় করতে হয়।

অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট তার আত্মজীবনী ওন ওয়াচ-এ লেখেন, ১৯৭১-এর মার্চের দিকে ভারত-পাকিস্তানের সমের্কর দ্রুত অবনতি ঘটে এবং ভারত মহাসাগরের জন্য একটি সর্বাত্মক মার্কিন নীতি তৈরির সংকটটি সঙ্ষ্ট হয়ে উঠে। ভারত ও পাকিস্তানের এই দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে ওয়াশিংটন সেকশন অ্যাকশন গ্রুপ (ডব্লিউএসএজি) ১৯৭১-এর ১৭ আগস্ট, ৮ সেপ্টেম্বর, ৭ অক্টোবর, ২২ নভেম্বর এবং ১, ৩, ৪, ৬ ও ৮ ডিসেম্বর বৈঠকে বসে। উপর্যুপরি এসব বৈঠক অনুষ্ঠান প্রমাণ করে মার্কিন প্রশাসন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই উদ্বিগ্ন ছিল। মার্কিন প্রশাসন মরিয়া হয়ে একটা মতৈক্যে পৌঁছার চেষ্টা করছিল। তবে প্রতিবারই তারা সময় থেকে এক ধাপ পিছিয়ে পড়ছিল এবং একের পর এক ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। তাদের কোনো কৌশলই কাজ করছিল না। ‘জোরালো’ কূটনৈতিক প্রতিনিধিত্ব বা ২১ নভেম্বর ভারতকে অর্থনৈতিক সহায়তা দান বন্ধের ঘোষণা কোনোটাতেই কিছু হলো না। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক সংবাদ সম্মেলনে জোর দিয়ে বললেন, ‘বিশ্ব মতামত যা-ই হোক’, ভারত তার জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে এবং এক কথায় ভারত তা-ই করেছিল।

অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্টের মতে, ভারতের মত পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়ে কিসিঞ্জারের অগ্নিশর্মা হওয়ার ব্যাপারটিও ছিল আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ বিষয়ে আরো বিশদ জানা যায় সুপরিচিত লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার জ্যাক এন্ডারসনের বর্ণনায়। তিনি বলেন, অ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানঘেঁষা নীতিকে প্রশ্ন করেছিলেন, যা মার্কিন প্রশাসনকে আরো ক্রুদ্ধ করে। নৌবাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করেই ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট আদেশে গঠিত হয় টাস্কফোর্স ৭৪। এতে পারমাণবিক বিমানবাহী জাহাজ এন্টারপ্রাইজ এবং অন্যান্য সাঁজোয়া বহর অন্তর্ভুক্ত করে তাকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েনের আদেশ দেওয়া হয়।

১২ ডিসেম্বর এন্টারপ্রাইজ গ্রুপকে মালাক্কা প্রণালী ধরে এগোনোর নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে পরদিনই আদেশটি পরিবর্তন করা হয়- বিশেষ নির্দেশ আসে বহরটি যেন একদিন সামনে অগ্রসর হয়, যাতে আরো বেশি দৃশ্যমানতা অর্জিত হয়। এর চেয়েও আরো বেশি বিভ্রান্তিকর দাবি হচ্ছে এই যে, নৌবহর পাঠানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ঢাকা থেকে মার্কিনিদের অপসারণ। এটি ছিল প্রতারণা, কারণ থেকে যাওয়া কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যেই সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

একেবারেই ঘটনাক্রমে দুটো বিমানবাহী জাহাজসহ একটি বিশাল ব্রিটিশ বাহিনীও ভারত মহাসাগরে ছিল। দিল্লিতে নিযুক্ত ব্রিটিশ নৌ এটাশে আমার অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ব্রিটিশ নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ায় সহায়তা করতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে অবস্থানরত ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজগুলোকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হচ্ছে। আমি তাকে উপদেশ দিলাম, যেহেতু সব ব্রিটিশ নাগরিককে এরই মধ্যে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এবং যেহেতু ব্রিটেন এই বিবাদ থেকে এখনো দূরে রয়েছে এবং কদিন বাদে পাকিস্তানকেও আত্মসমর্পণ করতে হবে। এই অবস্থায় যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে খামাখা নিজেদের সুনাম নষ্ট করার মানে হয় না।

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একটি সোভিয়েত ডেস্ট্রয়ার এবং মাইন সুইপারও মালাক্কা প্রণালী দিয়ে এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। এ ছাড়া সোভিয়েত প্রশান্তমহাসাগরীয় নৌবহর থেকেও বাড়তি রণসরঞ্জাম আনা হয়। সব মিলে নৌপরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।

জুমওয়াল্টের উপদেশ অনুসারে এন্টারপ্রাইজকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে দূরে থাকার এবং শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে অবস্থান নেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়।

সোভিয়েত নৌবাহিনী দ্বিতীয় দফা শক্তি বৃদ্ধির পর মার্কিন টাস্ক গ্রুপ নিষঙ্রভ হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে মার্কিন টাস্ক গ্রুপের চলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এ অবস্থা বজায় ছিল। তবে জুমওয়াল্ট দাবি করেন, এন্টারপ্রাইজের উদ্দেশ্য তার কাছে ঠিক সঙ্ষ্ট ছিল না । তিনি শুধু এটুকু জানতেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ববাসীকে দেখাতে চেয়েছিল সংকটকালে তারা মিত্রদের পাশে দাঁড়ায়।

জুমওয়াল্ট ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে ইউএসআইয়ে (ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউট) ভাষণ দিতে ভারতে আসেন। অনুষ্ঠানে তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর উদ্দেশ্য কী ছিল?’ জুমওয়াল্ট জবাব দেন, কিসিঞ্জার তাকে জানিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্টের (রিচার্ড নিক্সন) ইচ্ছা যুক্তরাষ্ট্র যেন পাকিস্তানকে সহায়তা করে। ১০ ডিসেম্বর পরমাণু বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজ এবং আরো কিছু প্রয়োজনীয় জাহাজ ও সরঞ্জাম সহযোগে একটি টাস্ক গ্রুপ সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে যাত্রা করে। এই টাস্ক গ্রুপের উদ্দেশ্য সঙ্ষ্ট ছিল না। জুমওয়াল্ট কিসিঞ্জারকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখোমুখি হলে তারা কী করবেন। কিসিঞ্জার জবাব দেন, ‘এটি আপনার সমস্যা।’ ১৯৭১-এর ১৩ ডিসেম্বর জুমওয়াল্টকে ভারত মহাসাগরে একটি যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে বলা হয়। সঙ্গে এই নির্দেশ, জাহাজটি যেন দিনের বেলা মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে, যাতে বিশ্ববাসী তা সঙ্ষ্টভাবে দেখতে পায়। নির্দেশটি ছিল অসঙ্ষ্ট ও বিভ্রান্তিকর।

ইউএসআইয়ের ভাষণের পর আমি জুমওয়াল্টকে আমার বাড়িতে দাওয়াত দিলাম। বাড়িতে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা হলো। তিনি জানতে চাইলেন, সেদিন খবরটি শোনার পর আমার প্রতিক্রিয়া ও পরিকল্পনা কী ছিল। আমি জবাব দিলাম, খবরটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান এবং নৌবাহিনী কী করতে যাচ্ছে জানতে চান। সব শুনে জুমওয়াল্ট হাসেন এবং যুক্তরাষ্ট্র ফিরে গিয়ে একটি নিবন্ধ লেখেন। তার আত্মজীবনী ওন ওয়াচ-এর সঙ্গে এই নিবন্ধেরও একটি কপি পাঠিয়ে জুমওয়াল্ট তাতে মন্তব্য করেন : ‘অ্যাডমিরাল এস এম নন্দকে, ১৯৭১ সালে বড় ধরনের একটি দুর্ঘটনা এড়ানোর কৌশল যার জানা ছিল, শ্রদ্ধার সঙ্গে-ই আর জুমওয়াল্ট।’

যুদ্ধের দিনগুলোতে আমাদের তিন বাহিনীর মধ্যে চমত্কার সমন্বয় ছিল। কর্মকর্তারা প্রতিদিন বৈঠকে মিলিত হতেন এবং সুনির্দিষ্ট অপারেশনগুলোর বিষয়ে পুরোপুরি মতৈক্য হতো। কিছু অনৈক্যের ঘটনার কথাও আমার মনে পড়ে, যা না ঘটাই ছিল অস্বাভাবিক। তবে এমন একটি ঘটনাও মনে করতে পারছি না, আন্তরিক আবহে যার মিটমাট হয়নি। মাঝে মাঝে জেনারেল মানেকশ আমার বন্ধু বিমানবাহিনী প্রধান প্রতাপলালের ওপর চোটপাট করতেন। সেক্ষেত্রে আমাকেই মীমাংসা করতে হতো।

১৯৭১-এর যুদ্ধে নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীরই বড় ভূমিকা ছিল এবং এজন্য জেনারেল মানেকশকে বাড়তি প্রশংসা করতে আমার ঈর্ষা হবে না। মাঝে মাঝে আমি প্রতাপ লালকেও স্মরণ করিয়ে দিতাম, আমাদের সবাইকে আলাদা দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া আছে। সেনাবাহিনীর আধিপত্য নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমাদের উচিত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করা।

সব অপারেশন তিন বাহিনীর মধ্যে ভাগ করা ছিল। বিমান বাহিনীর কাজ ছিল পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নামে আবির্ভূত হওয়া অঞ্চলটিতে পাকিস্তানের বিমানশক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া। বিমান বাহিনীর আওতাবহির্ভূত অঞ্চলে অভিযান চালানোর দায়িত্ব ছিল নৌবাহিনীর এবং অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনে দেওয়া হয়েছিল। আমরা চাইনি আমাদের বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী ভুল করে পরসেরর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ুক বা একে অন্যের ওপর হামলা চালাক।

সীমারেখা টানার ফলে একটিও ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটেনি। আমাদের বিমান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের হুমকি নিরসন করতে পেরেছিল। আমরা এ খবর জানতাম এবং বিষয়টি আমাদের খুব ভালো লেগেছিল। এর ফলে আমরা বিক্রান্তকে উপকূলের আরো কাছে মোতায়েন করতে সক্ষম হই। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানিরা পিছু হটার কাজে ব্যবহার করতে পারে এমন সব নৌযানকে অচল করে দেওয়া।

এমওডিরা প্রতিটি বাহিনীর সমস্যাকে পৃথকভাবে দেখে থাকেন এবং সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। ’৭১-এর যুদ্ধে এমওডিদের ইতিবাচক ও সহযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আন্তঃবাহিনী সমর্ঙ্ক ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লাল নিজে ভূমিকা রেখে এটি সম্ভব করে তুলেছিলেন। এর ফলে তিন বাহিনীর সদর দপ্তরের সব স্টাফ ও এমওডিরা একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে সক্ষম হন। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অপারেশনের সীমারেখাকে নিখুঁত করায় সহায়ক হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে চমত্কার সহযোগিতা ও টিমওয়ার্ক নিশ্চিত করে।

সংকটকালে কে বি লালের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের নজির হিসেবে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যুদ্ধ চলছে এমন অঞ্চলে জেলেদের উপস্থিতি সব সময়ই জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ‘ইউনিয়ন ওয়ার বুক’-এ এরকম একটি বিধান রয়েছে, লড়াইয়ের সময় উপকূল এলাকায় মাছ ধরা অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি ঘটনা থেকে এ নিয়ম করা হয়। ওই সময় কিছু ইউ-বোটে পাল লাগানো হলে সেগুলো জেলেনৌকার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। সেই থেকে পূর্বসতর্কতা হিসেবে জেলেদের সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ায় বাধা দেওয়া হয়।

এরকম একটি বিধানের কথা আমিও দীর্ঘদিন ধরে ভাবছিলাম। আসলে ১৯৬৫ সালে আমরা আমাদের নিজেদের জেলেদের তাড়িয়ে এলাকা নিষ্কণ্টক করতে অনেক শ্রম ও সময় ব্যয় করি। আমি ভাবছিলাম এ ধরনের কোনো নিয়ম আমাদের পরিবেশে প্রয়োজনীয় কি না। কারণ আমাদের নিজেদের জেলেদের দুর্দশা বাড়ানো এবং জীবিকা আহরণ থেকে বঞ্চিত করা ছাড়া বেশি কিছু এ থেকে অর্জিত হয় না। একদিকে আমরা যদি তাদের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সমুদ্রে যেতে বলি তারা আমাদের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতে পারে এবং আমাদের জলভাগে সন্দেহজনক কিছু দেখলেই খবর পাঠাতে পারে। তাদের অতি কষ্টে পাকড়াও করে সময় অপচয় করার বদলে উপকূলে নজরদারির কাজে লাগানো যায়।

আমি কে বি লালের সঙ্গে দেখা করে এই ভাবনাটি তার সঙ্গে বিনিময় করি এবং ইউনিয়ন ওয়ার বুক সংশোধন করার প্রস্তাব দিই। প্রতিরক্ষা সচিব তাত্ক্ষণিকভাবে আমার প্রস্তাবের গুণগত মান উপলব্ধি করেন এবং আমাকে স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। বিস্তারিত আলোচনার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারি করে, যুদ্ধের সময় জেলেরা যেন কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে একটি টিম হিসেবে কাজ করে এবং কোনো অপরিচিত নৌকা দেখলে আমাদের খবর দেয়। এর ফলে অনেক কষ্টসাধ্য কাজের সহজ সমাধান মিলে যায় এবং যুদ্ধ-গোয়েন্দা তত্পরতায় যোগ হয় অনবদ্য এক সহায়তার। জেলে সমঙ্রদায় তাদের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই খুশি হয়েছিল। তবে যুদ্ধে শরিক হওয়া এবং নজরদারির জন্য অর্থ পাওয়ার বিষয়টি তাদের খুব আগ্রহী করে তুলে।

৩-৪ ডিসেম্বর রাতে ভিজাগ বন্দরের প্রবেশপথে একটি অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক শব্দের সূত্র ধরে গাজিকে শনাক্ত ও ধ্বংস করা হয়েছিল। সেদিন ওই শব্দ শুনে যুদ্ধ-নজরদারি সংগঠনকে খবরটি দিয়েছিল জেলেরাই। এভাবেই একটি সরল সংশোধনীর ফলে শত শত জেলেকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করা সম্ভব হয়। এই ভেবে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি যে, আমার শৈশব কেটেছিল সমুদ্রের ধারে আর ওইসব মানুষের সান্নিধ্যে, যাদের জীবন-জীবিকা একান্তই সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। জেলেদের নৌবাহিনীর প্রতিবন্ধক হিসেবে নয়, সহায়ক হিসেবে দেখার এই দৃষ্টিভঙ্গিটি সম্ভবত আমি আমার শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকেই অর্জন করেছিলাম।

যুদ্ধের পর আমি পশ্চিম নৌকমান্ড পরিদর্শনে গিয়ে ডকইয়ার্ড পরীক্ষা করছিলাম। এ সময় আমাকে ফোনে ডেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে আমার জন্য একটি জরুরি বার্তা রয়েছে। ফোন লাইনে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পি এন হাকসার। তিনি আমাকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে প্রমোশন দেওয়ার কথা বিবেচনা করছেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আমার মতামত জানতে আগ্রহী। হাকসার আমাকে আরো জানান, প্রতাপ লাল চাইছেন প্রমোশন যেন না দেওয়া হয়। আমি জবাব দিলাম, ‘আমার একটা পদবি ছিনিয়ে নিয়ে যতক্ষণ না তাকে দেওয়া হয়, ততক্ষণ আমি এর বিরোধিতা করব না। এমনকি আমাকে ‘নৌবহরের অ্যাডমিরাল’ করার চিন্তাও যেন ঘুণাক্ষরে না করা হয়, এতে আমার পদমর্যাদার হানিই ঘটবে’। আসলে আমাদের সেনাবাহিনীর কলেবর ছিল বিশাল এবং ’৭১-এর যুদ্ধে এটি দ্ব্যর্থহীন ভূমিকা পালন করে। তাই সব বাহিনীর প্রধানদের পদমর্যাদা সমান হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী মানেকশকে ফিল্ড মার্শাল পদে ভূষিত করতে চাইলে আমার আপত্তি করার কিছু ছিল না।

পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এবং ১৬ ডিসেম্বর লে. জেনারেল এ কে নিয়াজী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিলেন। তবে ভারতের একতরফা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাকিস্তানের গ্রহণের মধ্য দিয়ে দুই ফ্রন্টেই লড়াই বন্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয় ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার আন্তর্জাতিক সময় রাত ৮টায়।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত