বিজ্ঞাপন
default-image

২৫ মার্চ। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি বিশেষ দিন। ২৫ মার্চ আমরা আশা করেছিলাম, ইয়াহিয়া খান বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে আপস করবে; আমরা আশা করেছিলাম, ইয়াহিয়া খান আমাদের একটি সুযোগ দেবে, যেহেতু আমরা বিশ্বাস করতাম যে আমরা বঞ্চিত হয়েছিলাম; কিন্তু ইয়াহিয়া খান আমাদের সে আশা নষ্ট করে দিল। ২৫ মার্চের রাতে বর্বর ইয়াহিয়া বাহিনী ঢাকার বুকে নিষ্ঠুরভাবে বাংলার নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করতে লাগল। বাংলার নয়নমণি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে গেল। এর আগে বঙ্গবন্ধু বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিকে দিকে যে বার্তা প্রেরণ করেছিলেন, সেই বার্তার একটি কপি আমিও পেয়েছিলাম। রাত প্রায় চারটার সময় আমার ঘরে শব্দ হলো, পিয়ন এসে আমাকে একটা টেলিগ্রাম দিয়ে গেল। যে টেলিগ্রাম দিয়ে গেল, সে টেলিগ্রামটি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এসেছে বার্তা নিয়ে বাংলার স্বাধীনতার।

তিনি ঘোষণা করছেন, বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন এবং শত্রুসেনাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। এটাই আমাদের প্রথম সংবাদ। এই সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকুল হয়ে বেরিয়ে গেলাম গাড়ি নিয়ে। আমি তখন হবিগঞ্জে ছিলাম। হবিগঞ্জে আমার সহকর্মীরাও ছিলেন—কর্নেল রব, মোস্তাফা আলী, মোস্তফা শহীদ ছিলেন—আরও যাঁরা ছিলেন, সবার কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিলাম। যতটুকু খবর পেলাম, চারদিকে স্বাধীনতাসংগ্রাম আরম্ভ হয়ে গেছে। বিদেশি পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী চারদিক থেকে ছুটে আসছে বাংলাকে গ্রাস করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট থেকে। আমরাও সিদ্ধান্ত নিলাম, সিলেটের এই অংশে আমরা শত্রুসেনার মোকাবিলা করব। আমরা বেরিয়ে গেলাম তাদের প্রতিরোধ করার জন্য। অবশ্য এ ব্যাপারে একটি কথা বলতে হয়—৭ মার্চ শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, ‘যাও মানিক, দেশে গিয়ে যুদ্ধের, সংগ্রামের জন্য প্রস্ত্তত হও।’ আমি এসেই হবিগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে শেষ সংগ্রামের জন্য প্রস্ত্ততি নিয়েছিলাম। চারদিকে ভলান্টিয়ার সংগঠন করেছিলাম—তির-ধনুক নিয়ে প্রস্ত্তত হয়েছিলাম, চা-বাগানের শ্রমিকদের প্রস্ত্তত করেছিলাম এবং এই প্রস্ত্ততির কারণে ২৬ মার্চের ডাকে আমরা ত্বরিত সাড়া দিতে পেরেছিলাম।

default-image

হবিগঞ্জ থেকে ছুটে গেলাম মাত্র তিনটি বন্দুক ও একটি রিভলবার নিয়ে। আমরা মনে করেছিলাম, শত্রুসেনা কুমিল্লা থেকে আসবে। তাই ভেবেছিলাম সিলেটকে রক্ষা করতে হলে সিলেটের সীমান্ত মাধবপুরে আমাদের বূ্যহ রচনা করতে হবে। তাই মাধবপুরের দিকে এগিয়ে গেলাম। পথে পথে বূ্যহ সৃষ্টি করে গেলাম, ব্যারিকেড সৃষ্টি করে গেলাম, যাতে শত্রুসেনা আর এদিকে আসতে না পারে। মাধবপুরে গিয়ে সেখানে পুলিশের সাহাঘ্যে (এখানে বলতে হয়, মাধবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার আমাকে সাহাঘ্য করেছিলেন। তাঁর হাতে যত অস্ত্র, যত পুলিশ ছিল, সম্পূর্ণভাবে আমার হাতে অর্পণ করে দিয়ে, আমার নির্দেশে পরিচালিত হবে এই নির্দেশে যে ১২ জন কনস্টেবল ছিল আর ১২টি রাইফেল ছিল তা নিয়ে মাধবপুর প্রথম বূ্যহ রচনা করলাম।) বূ্যহ রচনা শেষ করে আমি আবার ফিরে আসছি; আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমি চুনারুঘাটে রাতে থাকলাম। সেখানে থেকে সেই এলাকার চা-বাগানের প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক নিয়ে তির-ধনুকসহ প্রস্ত্তত করে ওই পাহাড়ে আমরা বূ্যহ রচনা করলাম। আমাদের চিন্তা ছিল শত্রুসেনা যদি আসে, আমরা এই পাহাড়ের ভেতরে ঘেরাও করে তির-ধনুক দিয়ে সাবাড় করে দেব। রাত তো চলে গেল। ভোর পাঁচটায় আমার এক সহকর্মী এসে সংবাদ দিল শত্রুসেনা সিলেট থেকে আসছে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। পরমুহূর্তে সংবাদ পেলাম, এরা শত্রুসেনা নয়, এরা ছিল আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি দল, যারা সিলেটে ছিল। এই দলের দলপতি ছিলেন মেজর খালেদ মোশাররফ। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে কয়েকটি আন্তজেলা ট্রাকে করে এসব দলচ্যুত পলাতক সেনা কুমিল্লার দিকে রওনা হয়েছেন। পথিমধ্যে আমাদের লোক তাঁদের বাধা দিয়েছিল। এ জন্য আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিরূপণের ব্যবস্থা করবেন বলে তিনি খবর পাঠালেন।

এই খবর পেয়ে আমি গেলাম। ইতিমধ্যে পথে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তিনি বললেন, যেমন করেই হোক পাঞ্জাবি সেনাদের আটকাতে হবে। তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারলাম, সিলেটে প্রায় এক হাজার পাঞ্জাবি সেনা রয়েছে। তারা পেছন থেকে ধাওয়া করছে খালেদ মোশাররফের সেনাবাহিনীকে ধরার জন্য। আমি তাঁকে আশ্বাস দিলাম, আমরা যেকোনোভাবেই হোক না কেন এই পাঞ্জাবি সেনাদলকে প্রতিহত করবই। তিনি আমাকে বললেন, তিনি কুমিল্লা হয়ে ঢাকা যাবেন—ঢাকায় যুদ্ধ চলছে, সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করবেন, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে মুক্ত করবেন। আমি তাঁকে পথে ছেড়ে দিলাম—একটি গোপন পথ দিয়ে তাঁকে পার করে দিলাম। তিনি তেলিয়াপাড়া হয়ে মাধবপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে রওনা হয়ে গেলেন। তখন থেকেই সত্যিকারভাবে আমাদের যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিতে হলো। মাথায় অনেক চিন্তা। কীভাবে কী করা যায়। কিছুই নেই। কয়েক হাজার তিরন্দাজ আছে, একটি সুশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে এরা কীভাবে যুদ্ধ করবে, তা ভাবনার বিষয়। তা ছাড়া নিরস্ত্র জনতা শাবল আর বল্লম নিয়ে তো যুদ্ধ করতে পারে না। এই পর্যায়ে আমি হবিগঞ্জে খবর দিলাম। সেখানে কর্নেল রব ছিলেন। তাঁকে জানালাম মেজর মোশাররফের কথা ও বার্তা এবং তাঁকে বললাম, যেকোনো উপায়ে হবিগঞ্জ অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে সেখানকার অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হাত করতে হবে এবং এই অস্ত্র নিয়ে আমরা রশীদপুর গিয়ে বূ্যহ রচনা করব, যাতে পাঞ্জাবিরা শ্রীমঙ্গল পার হয়ে আর ধাওয়া করতে না পারে। কর্নেল রব আমাকে আশ্বাস দিলেন, এই অস্ত্র নেওয়ার চেষ্টা তিনি করবেন। আমি তাঁকে বললাম, যেকোনো উপায়ে আজকের দিনের মধ্যেই এ ব্যবস্থা করতে হবে।

এই খবর দিয়ে আমি চুনারুঘাট থেকে রশীদপুরে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে সব চা-শ্রমিককে জড়ো করে তির-ধনুক নিয়ে আমরা রশীদপুর পাহাড়ে বূ্যহ রচনা করলাম। কয়েক হাজার তিরন্দাজ সেখানে ছিল এবং ওদের নিয়ে আমরা প্রথম বূ্যহ গড়লাম, যাতে পাকিস্তানি সেনারা রশীদপুর পাড়ি দিয়ে আসতে না পারে। তার পরের ঘটনা, সে আরেক কাহিনি।

[সৌজন্যে: যুগভের ী, সিলেট]

কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী: আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলারঅন্যতম আসামি।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১২ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত