বিজ্ঞাপন
default-image

ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে কি একটি জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে?

ভারতবর্ষের অধিকাংশ মুসলিম চিন্তাবিদ মনে করেছিলেন, পারে।

যেমন সার্ সৈয়দ আহমদ খান। তিনি যে ভারতীয় মুসলমানের স্বতন্ত্র স্বার্থের কথা চিন্তা করেছিলেন, সেকথা আমরা জানি। একসময়ে তিনি কিন্তু ধর্মীয় পার্থক্যের চেয়ে এক দেশে বসবাস করাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন এবং তাই ধর্মমতনির্বিশেষে হিন্দুস্তানের অধিবাসীমাত্রকে তিনি হিন্দু বলারও পক্ষপাতী ছিলেন। যেমন মওলানা মোহাম্মদ আলী। ভারতবর্ষের জন্য তিনি একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার পক্ষপাতী ছিলেন; সে-যুক্তরাষ্ট্র কেবল রাজনৈতিক নয়, ধর্মীয় যুক্তরাষ্ট্রও। নিজের মুসলমান পরিচয় এবং ভারতীয় পরিচয় কোনোটাই তিনি ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যেমন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর মদিনা-চুক্তিকে তিনি আদর্শ বলে গণ্য করেছিলেন। এই চুক্তিতে মুসলমান-অমুসলমান নির্বিশেষে সকল মদিনাবাসীকে উম্মা ওয়াহিদা বা একটিমাত্র সম্প্রদায় বলে অভিহিত করা হয়। মওলানা আজাদ ওই দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে মুসলমান-অমুসলমানের একটি মিলিত দেশের কথাই বলে যান।

ইকবাল মনে করতেন, মুসলমানের পক্ষে ধর্ম ও রাজনীতিকে পৃথক করা যায় না। তাই তাঁর পক্ষে ইসলামি সংহতির ধারণার পরিবর্তে জাতীয়তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভবপর নয়। এই বক্তব্য খণ্ডন করে ইকবালকে পত্র লিখেছিলেন মওলানা হুসেন আহমদ মদনি—জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সভাপতি। তিনি বলেন, কওম ও মিল্লাত এক নয়। নৃজাতি, ধর্ম, বর্ণ, পেশা কিংবা বসতিভিত্তিক যেকোনো জনগোষ্ঠী হলো কওম, আর মিল্লাত হলো একই দীন বা শরিয়াভুক্ত জনসমাজ। ধর্মে ভিন্ন হলেও অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানেরা একই জাতীয়তার অংশীদার। তাঁর মতে, জাতি এখন দেশভিত্তিক।

ধর্মের অনুশাসন নিয়ে জিন্নাহ ভাবিত হননি। তিনি দাবি করেন যে, যে-কোনো মানদণ্ডে ভারতীয় মুসলমানেরা এক জাতি এবং তাদের আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে হলে প্রয়োজন নিজস্ব এলাকা, বাসভূমি ও রাষ্ট্রের। পাকিস্তান ইসলামি রাষ্ট্র হবে, এ-কথা জিন্নাহ বলেননি, বরঞ্চ বলেছিলেন যে তাঁর বিবেচনায় পাকিস্তান হবে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই কারণে জামায়াতে ইসলামির আমির সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী পাকিস্তানকে আখ্যা দিয়েছিলেন না-পাকিস্তান। জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র—উভয় ধারণাই পাশ্চাত্য সংস্কৃতিজাত বলে মওদুদী তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের অস্তিত্বও স্বীকার করেননি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতে যেসব মুসলমান রয়ে যাবে, তাদের পরিচয় কী হবে কিংবা পাকিস্তানে যেসব অমুসলমান নাগরিক রয়ে যাবে, তাদেরই বা কী পরিচয় হবে, সে-সম্পর্কে জিন্নাহ আগে থেকে কিছু বলেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি অবশ্য বলেন যে, ধর্ম ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়—তার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই। পাকিস্তানের সূচনা হতে যাচ্ছে এই মূলনীতি নিয়ে যে, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সকলে রাষ্ট্রের সমান নাগরিক। তিনি এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে, কালক্রমে—ধর্মীয় অর্থে নয়, রাজনৈতিক অর্থে—হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমানও আর মুসলমান থাকবে না। তবে মাস চারেকের মধ্যেই, করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সর্বশেষ কাউন্সিল-অধিবেশনে, জিন্নাহ বলেছিলেন যে, পাকিস্তান হতে যাচ্ছে ইসলামি আদর্শভিত্তিক একটি মুসলিম রাষ্ট্র। তবে এটি ধর্মীয় রাষ্ট্র হতে যাচ্ছে না। ইসলামে নাগরিকতার ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত বিরোধ খুবই স্পষ্ট। ওই সভায় সোহরাওয়ার্দী যখন প্রস্তাব করেন যে, যেহেতু পাকিস্তান অর্জিত হয়ে গেছে, এখন মুসলিম লীগকে এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করা উচিত, যাতে জাতীয় ভিত্তিতে গঠিত দলে সংখ্যালঘুরাও প্রবেশাধিকারের সুযোগ পায়, তখন সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়।

দুই.

পাকিস্তান যে মুসলমান-অমুসলমান নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য করেছিল, তার একটা পরিচয় পাওয়া যায় দেশটির সংবিধান-রচনার বিভিন্ন উদ্যোগে। ১৯৪৯ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে প্রধানমন্ত্রীর উত্থাপিত অবজেকটিভ রেজোল্যুশন, ১৯৫০ সালের মূলনীতি কমিটির রিপোর্ট, ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধান, ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় সংবিধান এবং ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্টের জারি-করা আইনগত কাঠামো আদেশ—সবগুলোতেই দেশটির ইসলামিকরণের যে-প্রক্রিয়া দেখা দেয়, সেখানে অমুসলমানের কথা ভাবা হয়নি। তবে এই ইসলামিকরণ যতটা বাহ্য ছিল, ততটা অভ্যন্তরীণ ছিল না। রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান হবেন, নাগরিকেরা ইসলামি আদর্শে জীবনগঠনের সুযোগ পাবেন, কোরআন ও সুন্নাহর পরিপন্থী কোনো আইন প্রণীত হবে না এবং সে-বিষয়ে আলেমদের দিয়ে গঠিত ইসলামি উপদেষ্টা পরিষদ লক্ষ রাখবেন—এমনসব বিধান সত্ত্বেও প্রচলিত আইনের তেমন সংস্কারের উদ্যোগ দেখা যায়নি। তবু এসব বিধান অমুসলমানদের পরিণত করেছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে।

তবে রাষ্ট্রের এসব উদ্যোগের সমান্তরালে নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতার লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়ার এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব বিস্তৃত হয়েছিল—সবটাই অবশ্য দেশের পূর্বাঞ্চলে। ১৯৪৭ সালেই যে গণ-আজাদী লীগ নামে একটি স্বল্পায়ু অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং গণতান্ত্রিক যুবলীগের মতো অসাম্প্রদায়িক অরাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়, তা বিস্ময়কর বই কী! পরে গণতান্ত্রিক যুবলীগের উত্তরাধিকার বহন করে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ। পূর্ব বাংলায় অবজেকটিভ রেজোল্যুশনের তীব্র সমালোচনা হয়, মূলনীতি কমিটির রিপোর্টও প্রত্যাখ্যাত হয়। ১৯৫০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত শাসনতান্ত্রিক সম্মেলনে প্রস্তাব করা হয় যে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র হবে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।

তবে ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনই একদিকে বাঙালিত্বের এবং অপরদিকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাপ্তি দেয়। এরপরই অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রী দলের আত্মপ্রকাশ। আরো কিছুকাল পরে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বর্জিত হয়। ১৯৫৬ সালে গণপরিষদে দেশের ইসলামি প্রজাতন্ত্র নামকরণের বিরোধিতা করেন আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যেরা। অন্যদিকে পূর্ব বাংলার জন্য যুক্ত নির্বাচন প্রথা গৃহীত হয়। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার শীর্ষে যদিও কোরআন ও সুন্নাহর বরখেলাফ আইন প্রণয়ন না করার প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু তা কোনো দফার মর্যাদা পায়নি। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক হামলা দেখা দিলে রাজনৈতিক নেতারা, যুব ও ছাত্র কর্মীরা এবং প্রভাবশালী সংবাদপত্র-সম্পাদকেরা যেভাবে তা প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন, তা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা।

পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িকতার নির্মম প্রকাশ ঘটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কালে হিন্দু নিধনযজ্ঞে। আর মুক্তিযুদ্ধের কালেই বাংলাদেশ সরকার যে-তিনটি মূলনীতি ঘোষণা করেন তা ছিল, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। পরে এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদ যোগ করে রচিত হয় বাংলাদেশ সংবিধানের চার মূলনীতি। সেইসঙ্গে সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ হয়।

তবে, মনে হয়, অল্পসংখ্যক মানুষই ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথককরণ বুঝেছিলেন। বেশির ভাগই ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে বুঝেছিলেন ধর্মীয় সহনশীলতা বা সকল ধর্মের সমান অধিকার। তাই আগে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যেখানে কেবল কোরআন তেলাওয়াত হতো, সেখানে এখন চার ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের ব্যবস্থা হলো।

তিন.

বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে-ব্যাপক পরিবর্তন হয়, আমাদের সংবিধানও তার থেকে রক্ষা পায়নি। সামরিক ফরমানবলে সংবিধান সংশোধন করে একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটে, অন্যদিকে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের সুপরিচিত বিরোধীরা এবং মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবীদের ঘাতকেরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধানকে একটা ইসলামি চরিত্র দেওয়া হয় এবং আরো পরে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। এখন অবশ্য আদি সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হয়েছে, তবে রাষ্ট্রধর্ম রয়ে গেছে এবং সরকারের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে সুসম্পর্ক আছে, এমন ধর্মীয় সংগঠন দাবি জানাচ্ছে যে, ইসলামিকরণের যেসব বস্তু বাদ পড়েছে, তা ফিরিয়ে আনা হোক।

গভীর উদ্বেগের বিষয়, গত কয়েক বছরে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানদের ওপর দেশের নানাস্থানে হামলা হয়েছে, তাদের উপাসনালয় ও বাসগৃহ আক্রান্ত হয়েছে এবং বিষয়সম্পত্তি বেদখল হয়েছে। ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে, যারা স্বাধীন মত প্রকাশ করেন, তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে অথবা হত্যার চেষ্টা হয়েছে। পির ও খাদেমও একইভাবে নিহত হয়েছেন।

কী করে এমন হলো? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা যখন আদর্শিক সংগ্রামে জয়যুক্ত হয়েছি ভেবে আত্মতুষ্ট থেকেছি, বাংলাদেশবিরোধীরা তখন ধর্মকে আশ্রয় করে—ওয়াজ মাহফিলে, ওরশ শরিফে, জুম্মার খোৎবায়, মিলাদ মাহফিলে—সাম্প্রদায়িকতা ছড়াবার সুযোগ নিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক জাল। এই মুহূর্তে সরকার জঙ্গিদমনে সক্রিয় এবং অনেকাংশে সফল, তবে আদর্শিক সংগ্রামে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, তা সামাজিক ব্যাধি। সামাজিকভাবে তাকে মোকাবেলা করতে হবে। মনে হয়, পাকিস্তান-আমলে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বা অসাম্প্রদায়িক চেতনাপ্রসারে যেভাবে আমরা কাজ করেছিলাম, আবার নতুন করে তেমনই করতে হবে। নিম্নশিক্ষার পাঠ্যবই যেন কোনোভাবে সাম্প্রদায়িকতার বাহন না হতে পারে, সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি।

মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা কেবল মাটি আর পতাকার জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়েছিল মূল্যবোধের সংগ্রাম। সেই মূল্যবোধ আমরা হারাতে দিতে পারি না। শহীদ ভাইয়ের নিথর দুটি চোখ কি মনে পড়ে? সম্ভ্রমহারা বোনের নীরব অশ্রুপাত? তাঁদের কাছে অনেক ঋণ, তা আমাদের শোধ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের যে-ভাবমূর্তি ছিল আমাদের কল্পনায়, তা বাস্তবায়নের দায় আমাদের।

আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৮ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত