বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চের নওয়া-ই-ওয়াকত-এর সংখ্যাটি আমার মনে যে ছাপ ফেলেছিল, তা এখনো অক্ষত আছে। সেদিন এই পত্রিকায় তিনটি ছবি পাশাপাশি ছাপ হয়—মাঝখানের ছবিটি ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর। ক্যাপশন: ‘পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা’। সে ছবির এক পাশে শেখ মুজিবুর রহমান। সেটির ক্যাপশন: ‘পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতক’। তৃতীয় ছবিটি একজন সেনা কর্মকর্তার। তাঁর বুকে বিচিত্র পদক ও স্মারক। সে ছবির ক্যাপশন: ‘পাকিস্তানের রক্ষক’।

১৯৬০-এর দশকের শেষভাগে আমার মা রাওয়ালপিন্ডিতে ভাইয়ের বাসায় বেড়াতে যেতেন। আমার মামা ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদমর্যাদার একজন সেনা কর্মকর্তা। তেমন একটি সফরের পরপর আমার মা একটি কৌতূহলোদ্দীপক গল্প বললেন: একদিন আমার মামার বাসায় বেশ উত্তেজনা। বাসায় একজন ভিআইপি আসবেন, ফলে মাকে কয়েক ঘণ্টা নিজের ঘরে থাকার জন্য বলা হলো। অতিথিটি একজন নারী। তিনি কিছুক্ষণ মামার সঙ্গে সময় কাটান। আমার মামা তখন সামরিক আইনের অধীনে বেসামরিক কাজের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মা তাঁর হাফ ছেড়ে বেঁচে যাওয়া ভাইকে অতিথি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। চাপা কণ্ঠে মামা বললেন, ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাঁর কাছে কিছু আনুকূল্য চাইতে। নারীটির প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যাপক। তাঁকে উপেক্ষা করলে বিপদের সম্ভাবনা আছে। আশা করি, এই লেখা পড়তে পড়তে পাঠকেরা সেই নারীটিকে চিনে ফেলবেন।

ইয়াহিয়া খানের আরেকটি ছবি আছে, যা আমি ভুলতে পারব না: তিনি হাসিমুখে নূরজাহানের পাশে হাতে একটি গ্লাস নিয়ে বসে আছেন, গ্লাসে সম্ভবত সুরা। ছবিতে আরও কিছু মানুষ, সবাই বেশ উপভোগ করছেন। অনেক বছর পর নূরজাহান খালিদ হাসানের কাছে স্বীকার করেছিলেন, ইয়াহিয়া খান তাঁর সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি তাঁকে নূরি বলে ডাকতেন। আর আমাদের মালেকা-ই-তারান্নুম তাঁকে ডাকতেন সরকার। একটি গান প্রেসিডেন্টের খুব পছন্দ ছিল। তিনি তাঁর জন্য সেই গানটি গাইতেন। খালিদ হাসানকে তিনি বলেছিলেন, ‘অতুলনীয় লেখক সাদাত হাসান মান্টো গাঞ্জে ফারিশতে বইয়ে নূরির যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, প্রেমিক প্রেসিডেন্টের তা অবশ্যই পড়া উচিত ছিল।’

নূরজাহান যে পটভূমি থেকে এসেছিলেন, তার সব বৈশিষ্ট্যই তাঁর মধ্যে ছিল। তাঁর সবকিছুই ছিল বানানো। তিনি ছিলেন প্রেমবিলাসী, কিন্তু তাঁর মধ্যে পরিশীলন ছিল না। শওকতের মতো উত্তর প্রদেশের কেন্দ্র থেকে উঠে আসা একজন মানুষ কীভাবে তাঁর মতো ঘোর পাঞ্জাবি কৃষক মেয়ের সঙ্গে থাকল, তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে।

মান্টো এ কথা লেখার ২০ বছর পর ইয়াহিয়া খান যখন নূরির সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন, জেনারেল মানেক শ তখন অপেক্ষা করছেন, তুষার পড়ে হিমালয়ের পথ কখন বন্ধ হয়ে যাবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে দক্ষিণের দিকে চীন আর সৈন্য পাঠাতে পারবে না।

default-image

জেনারেল আতিক-উর-রহমানের অতিথি হয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আজহার লাহোরের গভর্নর হাউসে একটি রাত কাটান। জেনারেল আতিককে পাঞ্জাবের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরদিন সকালে দুজন প্রাতরাশ করতে বসলেন। আতিক অতিথিকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘুম ভালো হয়েছিল কি না। জেনারেল আজহারের ঘুম ভালো হয়নি। ওপর তলার ঘরে অনেক হইচই হয়েছে। তিনি জিজ্ঞেস করেন, ‘ওপরের ঘরে কারা ছিল?’ লজ্জিত হয়ে আতিক বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান। তিনি বান্ধবীদের সান্নিধ্য উপভোগ করছিলেন।’ সময়টা ১৯৭১ সাল। পূর্ব পাকিস্তানের তখন পতন ঘনিয়ে আসছে।

পরবর্তীকালে অনেকেই একটি ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন, কিন্তু ওই সময় তা চেপে গিয়েছিলেন। পারস্য সাম্রাজ্যের আড়াই হাজার বছর পূর্তি উৎসবে পারসেপোলিসে গিয়ে ইয়াহিয়া খান গাড়ি পার্কিংয়ে প্রস্রাব করেছিলেন। তিনি এত বেশি পান করে ফেলেছিলেন যে নিজেকে আর সামলাতে পারেননি। তাই ঝোপের আড়ালে গিয়ে নিজেকে খালি করে দেন।

ইয়াহিয়া খানের প্রথম ছবিটির কথা মনে পড়লে আমার জানতে ইচ্ছে করে, নওয়া-ই-ওয়াকত-এর মাজিদ নিজামি আসলে কী ভাবছিলেন? তিনি বহন করছিলেন তাঁর কিংবদন্তিতুল্য ভাই হামিদ নিজামির উত্তরাধিকার। এই পত্রিকাটি ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ উর্দু দৈনিক, যারা দাবি করত, স্বৈরাচারকে মুখের ওপর সত্য বলতে তারা ভয় পায় না। তিনি সম্ভবত স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।

নওয়া-ই-ওয়াকতই একমাত্র সংবাদপত্র নয়, আরও অনেকেই ওই সংক্ষুব্ধ সময়ে জাতিকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। পুরো জাতি জাতীয়তাবাদের মাতলামিতে ভেসে গিয়েছিল। সংবাদপত্র ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত রেডিও-টিভির তথ্যে বিভ্রান্ত হয়েছিল।

আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হলো, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের লেখা পড়লে দেখবেন, তাঁরা বলছেন, ইয়াহিয়া খান একজন অসাধারণ কর্মকর্তা। যদিও এ কথার সমর্থনে তাঁরা কোনো প্রমাণ দেননি।

ইয়াহিয়া খান মগ্ন ছিলেন নূরিদের মতো মানুষদের নিয়ে। মান্টো সরস মন্তব্য করে বলেছেন, পাকিস্তানের তরুণেরা যখন দেশের জন্য জীবন দিচ্ছে, প্রেমিক জেনারেল তখন ‘চাতাউরের দুর্গ দখলে’ ব্যস্ত। ঢাকার পতনের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের গল্পটিও রূপকথা। আসলে মংলা গ্যারিসনে অভ্যুত্থানের কথা শুনে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

ইয়াহিয়ার কার্যক্রমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বিবরণ দিয়েছেন পুলিশ বিভাগের রাওয়ালপিন্ডির বিশেষ শাখার সুপার সি এইচ সরদার। তিনি লিখেছেন:

প্রেসিডেন্ট ভবন ছিল তখন বেশ একটা জায়গা। নানা মানুষজন আসছে। প্রেসিডেন্ট নিজে মাতাল আর রমণীমোহন।...দেহজীবিনী আর তাদের দালালেরা তো বটেই, সমাজে মর্যাদাবান অনেকেও ছিলেন। আকলিম আখতার, মিসেস কে এন হোসেন ও লায়লা মোজাফ্ফর ছিলেন অন্যতম। বহু নিন্দিত কিন্তু আকর্ষণীয় নারীও আসত। তারা প্রেসিডেন্ট হাউসজুড়ে নাচত, গাইত, পান করত। প্রেসিডেন্ট হাউসকে ওখানকার নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনী বলত কঞ্জরখানা, আর সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর বলত ডাঙ্গরখানা।

একবার ইরানের শাহ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয় সফরে এলে গভর্নর হাউসে ওঠেন। প্রেসিডেন্টও তখন সেখানে। শাহের বাইরে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তখনো শয়নকক্ষ থেকে বেরোচ্ছেন না। প্রটোকল নিয়ে মারাত্মক সমস্যা দেখা দিল। কিন্তু কারও সেখানে যাওয়ার উপায় নেই। প্রেসিডেন্টের এম এস জেনারেল ইসহাক আকলিম আখতারকে বললেন, তিনি যেন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আসেন। আকলিম জেনারেল রানি হিসেবে পরিচিতি ছিলেন—প্রেসিডেন্টের রানি, আদতে বেশ্যার দালাল। ঘরে গিয়ে দেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান গায়িকার সঙ্গে প্রেসিডেন্টকে তিনি যে অবস্থায় দেখেন, তাতে তারই আক্কেল গুড়ুম। প্রেসিডেন্টকে তিনি নিজে কাপড় পরিয়ে নিচে নিয়ে আসেন।...ফুর্তি করার জন্য ইয়াহিয়ার বহু বান্ধবী ছিল।...এক সন্ধ্যায় তিনি চলে গেলেন মিসেস কে এন হোসেনের বাড়িতে, যাঁকে সবাই ‘কালো সুন্দরী’ বলে জানত...সবার অগোচরে প্রেসিডেন্ট সেখানে তিন দিন তিন রাত কাটিয়ে দেন। চতুর্থ দিন মিসেস হোসেনকে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় নিয়ে তিনি তাকে অভ্যন্তরীণ সজ্জাকরের স্থায়ী চাকরি দিয়ে দেন। তাঁর স্বামীকে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত করা হয়। প্রেসিডেন্ট কেন তিন দিন তাঁর বাড়িতে ছিলেন, এ নিয়ে পরে প্রশ্ন করা হলে মিসেস হোসেন বলেন, প্রেসিডেন্টকে তিনি বাংলা গান শিখিয়েছেন।

ঢাকার পতনের পর ইয়াহিয়া খান টিভিতে ঘোষণা দেন, ‘পূর্ব ফ্রন্টে সাময়িকভাবে পিছিয়ে এলেও’ পশ্চিম ফ্রন্টে যুদ্ধ চলবে। কিন্তু পরদিনই ভারতের এককভাবে ঘোষিত যুদ্ধবিরতি তিনি মেনে নেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে সরদার উইসুফ চানদিও আর ইয়াহিয়া খানের মধ্যে যে আলাপ হয়, তা নিচে তুলে দিচ্ছি। এ ঘটনার বর্ণনাও দিয়েছেন সি এইচ সরদার। দায়িত্বে নিয়োজিত এক ডিএসপির কাছে তিনি গল্পটি শুনেছিলেন। জায়গাটা ছিল করাচির কাছাকাছি একটি হ্রদ। উপলক্ষ ছিল হাঁস শিকার:

ইউসুফ: এখন কী হবে? নির্বাচনে তো একদিকে জিতেছে মুজিব (কটু কথা), আরেক দিকে ভুট্টো (কটু কথা)?

ইয়াহিয়া খান: বাচ্চু, চিন্তা কোরো না, তামাশা দ্যাখো। আমি এমন টোপ ফেলব যে তারা যেকোনো একজন আরেকজনকে মেরে ফেলবে।

ইয়াহিয়ার কিছু ঘোষণা শুনে মার্কিন গৃহযুদ্ধের এক কৌতূহলোদ্দীপক চরিত্রের কথা মনে পড়ে যায়। চ্যান্সেলর্সভিলের যুদ্ধের আগে জেনারেল হুকার উত্তরের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি তখন অমার্জিত মন্তব্য করে বলেন, ‘আমার পরিকল্পনা একদম নিখুঁত, আল্লাহ্ জেনারেল লিকে (প্রতিপক্ষ) দয়া করুন।’ কিন্তু পরদিন হুকার মারাত্মকভাবে পরাজিত হলেন। তার জায়গায় দায়িত্ব পেলেন লিঙ্কন। ইয়াহিয়া খান নাকি কোয়েটা স্টাফ কলেজের শিক্ষক ছিলেন। তিনি কি মার্কিন গৃহযুদ্ধের ওই অধ্যায়টি পড়েননি?

টিক্কা খান ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে অভিযান শুরু করলে লাখ লাখ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিম বাংলায় চলে যায়। পাকিস্তানের এই রক্ষক তখন কী করছিলেন, সি এইচ সরদারের বিবরণে পড়ুন:

ইয়াহিয়া খান মৌজ-ফুর্তিতে মেতে ছিলেন। পছন্দের কোনো মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে প্রতি রাতে তিনি রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদের রাস্তায় ঘুরতে বেরোতেন। পাহারাদারেরা তো যথারীতি থাকতই। কখনো কখনো গাড়ির ছাদ খুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই তিনি মৌজে মশগুল হয়ে যেতেন। রক্ষীরাও তা দেখতে পেত। ইসলামি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এমন অসংযমী আচরণে তাদের মন তেতো হতো। এ কথা জানানো হলে পুলিশের সুপার বলতেন, ‘প্রেসিডেন্ট তো গুরুতর সমস্যা নিয়ে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত থাকেন। তার একটু বিনোদনের দরকার।’ বিনোদন বটে!

ইয়াহিয়ার সহমর্মীরা কখনো কখনো বলেন, উপদেষ্টারা তাঁকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে। কিন্তু তাদের নিয়োগ দিয়েছে কে? অনেক ভালো উপদেশও ছিল, কিন্তু সব উপেক্ষিত হয়েছে। কিছু দৃঢ়চিত্ত মানুষ তাঁকে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করতে মানা করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জেনারেল ইয়াকুব খান ও অ্যাডমিরাল আহ্সান তাঁকে বলেন, অধিবেশন স্থগিত করা খুবই অবিবেচকের কাজ হবে। স্ট্যানলি উলপার্ট লিখেছেন, ‘এর কয়েক সপ্তাহ আগে এস এম আহসান খুবই সাহসের সঙ্গে হরতালরত বাঙালির ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করেন। তাঁর জায়গায় তখন জেনারেল ইয়াকুবকে বসানো হয়। তিনিও গণহত্যার আদেশ অগ্রাহ্য করেন।’

ইয়াহিয়া যখন মদ্যপ ইয়ারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের অনুরোধ দূরে ঠেলেন, তখন তারা হতভম্ব হয়ে যান। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগোর্নি রাজনৈতিক সমঝোতার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা বেকুবের মতো প্রত্যাখ্যান করেন। রক্ষকের খুব তাড়া ছিল, বাঙালিদের ‘ওপর বাঘ লেলিয়ে দিতে তার আর তর সইছিল না’, সে তাতে যা হয় হোক। ক্ষমতার দম্ভে উন্মত্ত এবং চাটুকারদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তিনি একবার গর্বভরে বলেছিলেন, তাঁর সমরাস্ত্র ভারতের চেয়ে উন্নত। ফলে জেনারেল ইয়াকুবকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে নিয়ে এসে পদাবনতি দেওয়া হয়, এমনকি অবসরেও পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্ট তাঁর জায়গায় জেনারেল নিয়াজিকে পাঠান। তাঁকে বরণ করতে বিমানবন্দরে এলে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার কাছে নিয়াজির প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আমার জন্য কয়টা মেয়ে ঠিক করে রেখেছ?’ কয়েক মাস পরই দেখা গেল, নিয়াজি লেজ গুটিয়ে তাঁর নিজ ব্যাচের জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করছেন। নিয়াজি আবার নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে সম্মানিত জেনারেল মনে করতেন। এই ছিল তার নমুনা।

এবার দ্রুত লয়ে ১৯৭২ সালে চলে যাই। ইয়াহিয়া খানকে রাখা হয়েছিল সুরক্ষিত বান্নি বাংলোয়। হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল শিয়ালা রেস্টহাউসে। সি এইচ সদর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তার বিবরণ রেখে গেছেন:

ইয়াহিয়া হেলিকপ্টারের বদলে সড়কপথে ফিরতে চাইলেন। ব্যাপারটাতে ঝুঁকি ছিল বলে আমি সে জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সড়কপথে ঝুঁকি কেন, ইয়াহিয়া তা জানার জন্য পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন। আমি বললাম, ‘কারণ লোকে আপনাকে হেনস্তা করতে পারে।’ ‘মানুষ আমার বিপক্ষে যাবে কেন?’ ‘কারণ পূর্ব পাকিস্তানে আপনি হেরে গেছেন।’ ইয়াহিয়া দেখালেন চিরাচরিত প্রতিক্রিয়া, ‘কেন, আমি কি অস্পৃশ্য? আমি কারও স্পর্শকাতর অঙ্গ কি ছুঁয়ে ফেলেছি?’

পাঞ্জাবি ভাষায় তাঁর কথা আরও রংদার শোনাল। সড়কপথে যাত্রা শুরু হলো। সিহালা রেলসড়কের গাড়ি থেমে গেল। কারণ, লোকে তাঁকে চিনতে পেরে পাথর ছুড়তে শুরু করেছে।

ইয়াহিয়ার মুখ শুকিয়ে এল। যেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। অবস্থা দেখে আমি বললাম, রাজাবাজার যাওয়া যাক। তিনি তখন কাঁপছেন। অনুনয়-বিনয় করে তিনি বললেন, তাঁকে যেন বান্নি রেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছে আরেক আবদার, তাঁকে অ্যাবোটাবাদে নিয়ে যাওয়া হোক। ‘কেন?’ তাঁর জবাব, ‘এ জায়গাটা আমার পছন্দ নয়। এখানে অনেক শেয়াল। রাতে খুবই চেঁচামেচি করে।’ আমি বললাম, ‘সঙ্গী হিসেবে তারা খারাপ কী?’

ঢাকা পতনের পর পাকিস্তান টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রোয়েদাদ খান তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট নূরুল আমিনের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন:

নূরুল আমিনের মতো খাঁটি দেশপ্রেমিককে কখনোই এতটা রাগান্বিত দেখিনি। দুদিন ধরে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ইয়াহিয়ার সঙ্গে সবুজ ফোনে সেদিন সন্ধ্যায় সাক্ষাতের সময় নিলাম। ইয়াহিয়া আমাকে প্রেসিডেন্ট হাউস পর্যন্ত নূরুল আমিনকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য বললেন। আমরা যখন গেলাম, জেনারেল হামিদও তখন সেখানে। তাঁরা সবাই—ভেবে দেখুন—পান করছেন। নূরুল আমিন বিস্ফোরিত হয়ে বললেন, ‘ঢাকার পতন হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়ে গেছে। আর আপনি হুইস্কি খাচ্ছেন?’...ইয়াহিয়া সব দোষ মুজিবের ওপর দিলেন। আমি জীবনে যত বৈঠক করেছি, সেটি ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক।

পাকিস্তানের এই রক্ষকের আরও একটি ছবি অনেকের মনে পড়বে: ভুট্টোর সামনে ইয়াহিয়া বসে আছেন। তাঁর স্বাক্ষরের জন্য টেবিলের ওপর একটি কাগজ মেলে ধরা। ইয়াহিয়ার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি বিমর্ষ ও অপমানিত। কারও পতন আর কতটা হতে পারে! তিনি কি নিরোর আধুনিক রূপ?

অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন

ড. আসিফ জাভেদ: যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়ামসপোর্টে কর্মরত পাকিস্তানি চিকিৎসক।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত