বিজ্ঞাপন
default-image

প্রতীক ছাড়া মানুষের চলে না। সচেতনভাবে প্রতীক সৃষ্টির ক্ষমতা একমাত্র মানুষেরই আছে, অন্য কোনো প্রাণীর নেই। মানুষের ব্যবহূত সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হচ্ছে তার ভাষা। ভাষাই মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে পৃথক করেছে—এমন বললেও খুব ভুল বলা হয় না। ভাষার প্রতীক দিয়েই মানুষ তার অন্তরে সমস্ত বিশ্বজগেক ধারণ করেছে। ভাষার সব শব্দই কোনো না কোনো বস্তু বা ভাবের প্রতীক, সেই প্রতীকের মাধ্যমেই এক মানুষ অন্য মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, সেই সংযোগের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে তার সমাজ। সামাজিক মানুষ ভাষা-প্রতীকের সাহায্যেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তার চিন্তা ও কর্মকে প্রসারিত করে দেয় এবং তার ফলেই ঘটে সমাজের বিবর্তন। কেবল ভাষা-প্রতীক নিয়েই মানুষ সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, সেই প্রতীকেরও প্রতীক সৃষ্টি করে নেয় সে। ভাষার মূল উপাদান যে ধ্বনি, সেই ধ্বনির যে প্রতীক মানুষ উদ্ভাবন করেছে, তার নাম বর্ণ। সেই বর্ণের মাধ্যমেই শ্রুতিগ্রাহ্য ভাষা হয়ে উঠেছে দৃষ্টিগ্রাহ্য।

পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বিভিন্ন ভাষা-প্রতীক ব্যবহার করে। যে গোষ্ঠী যে ভাষা-প্রতীকটির ব্যবহার অভ্যাস করে নেয়, সে প্রতীকটি তার সমস্ত সত্তার সঙ্গে জড়িত-মিশ্রিত হয়ে যায়। অভ্যাস যে দ্বিতীয় প্রকৃতি, সেটি মানুষের ওই ভাষা-প্রতীকের প্রয়োগ থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়। এ প্রতীককে মানুষের প্রকৃতি থেকে কোনো মতেই বিচ্ছিন্ন করা চলে না। প্রতীক আর প্রকৃতি এখানে এক হয়ে গেছে। মানুষের জীবনে এই ভাষা-প্রতীকের গুরুত্ব একান্তই অপরিসীম।

তবু, অপরিসীম গুরুত্বসম্পন্ন এই ভাষা-প্রতীককে নিয়েও মানুষকে কম সমস্যা-সংকটে পড়তে হয় না। বিশেষ ভাষা-প্রতীককে নিয়ে গড়ে ওঠা বিশেষ ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সংহতি ও একাত্মবোধের বিকাশ সব সময় মসৃণভাবে ঘটে না। বলা উচিত, ঘটতে দেওয়া হয় না। এ রকম না ঘটার ও ঘটতে না দেওয়ার ব্যাপারটি বাঙালির ভাষা-প্রতীকের জন্মলগ্ন থেকেই ঘটে এসেছে।

ইতিহাসবিদরা দেখিয়েছেন, এখন থেকে হাজার বছরেরও আগে বাঙালির নিজস্ব ভাষা-প্রতীকটির জন্ম হয়েছিল, অর্থাত্ মধ্যভারতীয় আর্যভাষার খোলস ভেদ করে নব্যভারতীয় আর্যভাষার উদ্ভব ঘটেছিল। কিন্তু জন্মলগ্নেই এই নতুন প্রতীক বা ভাষাটি প্রবলের রুদ্ররোষের শিকার হয়ে পড়ে। বিভাষী শাসকরা নতুন জন্ম নেওয়া এই প্রতীকটিকে আঁতুড়েই মেরে ফেলতে চেয়েছিল।

দাক্ষিণাত্যের ব্রাহ্মণ্যবাদী সেনরাজাদের শাসনে নবজাত বাংলা ভাষা প্রতীকটি প্রচণ্ডভাবে নিষ্পিষ্ট হয়েও যে মরে যায়নি, সেটি এর প্রবল প্রাণশক্তিরই প্রমাণ বহন করে। এই প্রবল প্রাণশক্তিকে সম্বল করেই বাংলা ভাষা সব প্রতিকূলতা জয় করেছে। শত্রুরা তাদের নিজেদের বিভিন্ন প্রতীক বাংলাভাষী মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বহুবারই করেছে, কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, উর্দু ইত্যাদি ভাষা-প্রতীকের অনুসারীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই বাংলাভাষীরা তাদের নিজস্ব ভাষা-প্রতীকটিকে রক্ষা করেছে ও এর সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এই প্রতীকটির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতিসত্তা। সেই জাতি আরও অনেক অনেক জাতীয় প্রতীক তার সত্তার অন্তর্গত করে নিয়েছে। এসব প্রতীকের অনেকটাই সৃষ্ট হয়েছে শত শত বছরের স্বাভাবিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। এভাবেই সৃষ্ট হয়েছে বাঙালির ভাষার বর্ণমালা, তার সম্বোধন-রীতি ও শিষ্টাচারের পদ্ধতি, তার লৌকিক আচার-আচরণ, তার জাতীয় উত্সব-অনুষ্ঠান পালা-পার্বণ। এগুলো সবই প্রতীক এবং ধর্মসম্প্রদায়-নিরপেক্ষ জাতীয় প্রতীক। এ রকম সব স্বাভাবিক বিবর্তনজাত জাতীয় প্রতীকের পাশাপাশিই জাতি অনেক প্রতীকের উদ্ভাবন ঘটিয়েছে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তার ভাষা-প্রতীককে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বাঙালি শহীদ হয়েছে এবং তারই প্রতীক রূপে সৃষ্টি করেছে শহীদমিনার। ভাষার সংগ্রামই পরিণত হয়েছে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে এবং তারই পরিণতিতে স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি পেয়েছে জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা, অনির্বাণ অগ্নিশিখা ও বিজয়স্তম্ভের মতো নানা প্রতীক।

দেশে এসব অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় প্রতীক যেমন আছে, তেমনই আছে নানা ধর্মীয় প্রতীক। সম্প্রদায়ভেদে সে সব ধর্মীয় প্রতীকেও আছে বিভিন্নতা ও বিচিত্রতা। মোটা দাগে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্ট ধর্মের বিশিষ্টতা-নির্দেশক কতিপয় প্রতীক তো আছেই। তা ছাড়া এসব ধর্মসম্প্রদায়ের নানা শাখা-প্রশাখায়ও সৃষ্টি হয়েছে নানা প্রতীক। আবার ধ্রুপদী ধর্মের বাইরে লৌকিক ধর্মগুলোর অথবা ধ্রুপদী ধর্মের লৌকিক ভাষ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অনেক বাস্তব ও কাল্পনিক পীরের দরগা বা মাজার, সাধুবাবার থান বা বোষ্টমের আখড়াকে কেন্দ্র করেও দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা জাতের অজস্র প্রতীক। এসব ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক প্রতীকের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক জাতীয় প্রতীকগুলোর কোনো মৌলিক বিরোধ নেই, থাকার কথাও নয়। আপন আপন স্থানে অবস্থান করেই এই দুই ধারার প্রতীক মান্যতা পেতে পারে, এগুলোর ভেতর সংঘাত বাধাটা অপরিহার্য নয় মোটেই।

অথচ, পরিতাপের বিষয় এই, একান্ত কৃত্রিমভাবেই এই দুই ধরনের প্রতীককে সংঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়। এমন অপকর্মের কারকরা নিজেদের ধার্মিক ও ধর্মের রক্ষক বলে পরিচয় দেন। কিন্তু আসলে এরা কেউই ধার্মিক নন, ধর্মকে এরা ব্যবহার করে বদ মতলব উদ্ধারের কাজে।

দুই

ব্রিটিশ শাসনাধীন বাংলাতেই যদিও আমরা ওইসব বকধার্মিকদের উত্পাত খুব বিশ্রী রকমে প্রকট হয়ে উঠতে দেখেছি, তবুও আমরা জানি, এ রকম উত্পাত শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। বাঙালির নিজস্ব ভাষা-প্রতীকটির সৃষ্টির ঊষালগ্নেই বিভাষী সেনরাজাদের নিযুক্ত পুরোহিতরা সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে ধর্মের দোহাই দিয়েই। প্রাকৃতজনকে তারা ধমক দিয়ে বলেছে যে ‘দেবভাষা’ সংস্কৃতের বদলে অন্য কোনো ‘মানবভাষা’য় কেউ যদি ধর্মকথা শ্রবণ করে, তবে সে রৌরব নরকে পতিত হবে। এরপর মুঘল আমলের বাংলায় দেখি: ইসলামের পতাকা আন্দোলন করে একদল ধর্মধ্বজী উচ্চকণ্ঠে আরবি ভাষার গৌরব ঘোষণা ও বাংলা ভাষাকে গালমন্দ করে চলছে, বাংলা ভাষায় নবী-রসুলদের কথা প্রচারকারীদের প্রতি রক্তচক্ষু প্রদর্শন করছে, তাদের গায়ে ‘কাফের’ ও ‘মোনাফেক’ ছাপ মেরে দিচ্ছে। আমাদের সৌভাগ্য, পুরুত-মোল্লাদের এমন ধমক বা গালাগালিতে খাঁটি বাঙালি তাদের আপন ভাষা-প্রতীকটিকে পরিত্যাগ করেনি, কৃত্তিবাস-কাশীদাস-মালাধর বসুদের মতো কবিরা যেমন রৌরব নরকের ভীতিকে পরোয়া না করেই বাংলায় রামায়ণ মহাভারত-ভাগবত রচনা করে গেছেন, তেমনই সাবিরিদ খান-জৈনউদ্দিন-সৈয়দ সুলতানরা কাফের বা মোনাফেক হওয়ার অপবাদ মাথায় নিয়েই বাংলায় নবী-রসুলদের জীবনকথা ও বাণী প্রচারে নিরত থেকেছেন। এভাবেই বাংলাবিরোধী প্রতীকের বিরুদ্ধে নিজস্ব প্রতীকের অস্ত্র দিয়ে লড়াই করেই বাঙালির জাতি-চেতনা আস্তে আস্তে দল মেলেছে, এবং প্রতিনিয়তই সে-লড়াই তাকে করে যেতে হয়েছে এবং এখনো করতে হচ্ছে।

প্রতীকের অস্ত্র দিয়েই বাঙালির আপন প্রতীক সংরক্ষণের লড়াই তুঙ্গে উঠেছে পাকিস্তানি শাসন মোকাবিলায়। শুধু ভাষা-প্রতীকই নয়। মুখের ভাষার প্রতীক যে লিখিত বর্ণ, বাঙালির সেই বর্ণ প্রতীকও শত্রুদের আক্রমণে হয়ে উঠেছে ‘দুখিনী বর্ণমালা’। এই দুখিনী বর্ণমালাকেই আরবি হরফ বা রোমান হরফের আক্রমণ যেমন প্রতিহত করতে হয়েছে, তেমনই বর্ণমালার সংস্কারের নামে সংহারের অপপ্রয়াসকেও প্রতিরোধ করতে হয়েছে।

বাঙালির ভাষা-প্রতীকের মতোই তার উত্সব-অনুষ্ঠান ও আচার-আচরণসহ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সব প্রতীকের ওপরও নানা দিক থেকে আক্রমণ এসেছে। সে সব আক্রমণ প্রতিরোধ করতে করতেই বাঙালি যে স্বাধীন রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করেছে, সে রাষ্ট্রে তার সমস্ত প্রতীকই নিরাপদ থাকবে—এমনটিই আমরা ভেবেছিলাম। কিন্তু দুঃখ এই, আমাদের সেই ভাবনাটি সত্য হয়নি।

অপরিমেয় রক্তের মূল্যে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশেও আত্মবিসর্জনকারী মুক্তিসৈনিকদের স্মৃতির প্রতীক রূপে-নির্মিত শহীদমিনার বা স্মৃতিস্তম্ভগুলোর অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হলো ধর্মের প্রশ্ন উত্থাপন করে। বলা হলো, ওই সব প্রতীক স্থাপন ও প্রতীকের প্রতি শ্রদ্ধানিবেদন করা আসলে প্রতীকপূজা, আর প্রতীকপূজা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে নিষিদ্ধ। শুধু মিনার বা স্মৃতিস্তম্ভ বা অনির্বাণ অগ্নিশিখার মতো প্রতীকগুলোই নয়, ধর্মসম্প্রদায়-নির্বিশেষে এ দেশের লোকসাধারণ দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও উত্সব-অনুষ্ঠানের আধারে যে সব প্রতীককে ধারণ করে সে-সবকেও, এবং নববর্ষ বা নবান্ন বা বিভিন্ন ঋতুবরণের উত্সবগুলোকেও ইসলামবিরোধী বলে চিহ্নিত ও নিন্দিত করা হলো। উনিশ শ পঁচাত্তরের আগস্টে চরম অবাঞ্ছিত পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতার মঞ্চটিকে দখল করে বসল যারা, তারা কয়েকটি বাংলা শব্দ-প্রতীককেও প্রতিস্থাপন করল পাক-আমলে ব্যবহূত শব্দ-প্রতীক দিয়ে। ‘জয়’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত হলো ‘জিন্দাবাদ’ দিয়ে, ‘রেডিও’ দিয়ে ‘বেতার’, ‘জয়বাংলা’ হলো ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’-এর প্রতিরূপ ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ বেতার’-ও এ রকমই ‘রেডিও বাংলাদেশ’। আপাতশ্রুতিতে এমন শাব্দিক পরিবর্তনকে মনে হতে পারে নিতান্তই তুচ্ছ। অথচ এই তুচ্ছ পরিবর্তনকেই উচ্চে তুলে ধরে ওই প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানপন্থী চক্রটি পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলতে চাইল, অন্তত প্রতীকী বিজয় তো অর্জন করলই।ক

তিন

সুস্থ ও সেক্যুলার সংস্কৃতির বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র এ রকমটি চিরকালই করে এসেছে যদিও, তবু এ দেশের মাটি থেকে পাক শাসন উত্খাত হয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন ওরা চুপ করে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর স্বাধীন দেশেও যখন দেশের মানুষের সংকটের অবসান ঘটে না, বরং নতুন নতুন সংকটে মানুষ পর্যুদস্ত হতে থাকে, তখনই মওকা বুঝে ওই পাকিস্তানপন্থী কুচক্রীরা গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে। স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়া প্রতীকগুলো দিয়েই বাংলা ও বাঙালিত্বের প্রতীকগুলোকে হঠিয়ে দিতে চায়। তারা, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধেও বিষোদগার করতে শুরু করে দেয়। ‘হিন্দু’ ও ‘ভারতীয়’ কবির লেখা জাতীয় সংগীত সম্পর্কে নানা ধরনের কুত্সা রটায়, ‘চাঁদ তারা নিশান চাই’ বলে হাঁক ছাড়ে। এ রকম করে করে ওরা ক্রমেই নিজেদের শক্তিকে সংহত করে তোলে। এক সময় পাকিস্তানের আইয়ুব-ইয়াহিয়াদের ঐতিহ্য অনুসরণ করেই এক জঙ্গ বাহাদুর ক্ষমতার মঞ্চে বসে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্মে’র সংযোজন করে বসলে বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থীদের শক্তি অনেক গুণ বেড়ে যায়। ওই বহুগুণিত শক্তিতে শক্তিমান হয়েই ওরা বাংলাদেশের বাঙালিসহ অন্য সব জাতির প্রতীকগুলোকে উচ্ছেদ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়ে।

প্রতীক-বিরোধিতার কর্মকাণ্ডে ওরা পাকিস্তান আমলকেও ছাড়িয়ে যায়। পাকিস্তান আমলের মতো ওরা এখন কেবল ভাষার অস্ত্র দিয়ে হুমকি-ধমকি দেয় না, অস্ত্রের ভাষা নিয়ে প্রতীকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের ভাষার অস্ত্র ও অস্ত্রের ভাষার আক্রমণের শিকার হয় শহীদের স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য কিংবা অনির্বাণ অগ্নিশিখা যেমন, তেমনই ওলি-আউলিয়াদের মাজারের গজার মাছ বা কচ্ছপ বা কুমিরগুলোও। কারণ এই প্রাণীগুলোও শত শত বছর ধরে লোকসাধারণের কাছে প্রতীক রূপেই গ্রাহ্য ও মান্য হয়ে এসেছে। আর ওইসব প্রতীক যেহেতু লৌকিক ধর্ম বা ধ্রুপদী ধর্মের লৌকিক ভাষ্যকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে, তাই ধর্মতন্দ্রের মৌলবাদী ভাষ্যের অনুসারী প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে এসব একেবারেই অসহ্য। বাঙালি ছেলেমেয়েরা যেসব পশু বা প্রাণীর মুখোশ পরে নববর্ষের শোভাযাত্রায় সামিল হয় সেগুলোও ওদের বুকে জ্বালা ধরিয়ে দেয়, রাস্তায় আলপনা আঁকা দেখলে ওদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, একুশের ভোরের নগ্নপদ মিছিল যেন ওদের বুখে-মুখে পদাঘাত করে। মুক্তি ও প্রগতির ঐতিহ্যের সব প্রতীকের প্রদর্শনী দেখে-শুনেই ক্ষেপে গিয়ে ওরা এলোপাতাড়ি আক্রমণ চালায় পীরের মাজারের ওরসে কিংবা লৌকিক মেলায় যেমন, তেমনই বটমূলের নববর্ষের উত্সবে কিংবা গণশিল্পীদের সংগঠন ‘উদীচী’র অনুষ্ঠানেও। মিনারের স্তম্ভের ওরসের উত্সবের শিল্পের সংগীতের মধ্য দিয়ে বিধৃত এসব প্রতীককে সহ্য করতে পারছে না বলেই তো এ সবের বিরুদ্ধে ওদের এমন মরীয়া আক্রমণ। প্রতীকের বিরুদ্ধে আক্রমণের মধ্য দিয়ে যে যুদ্ধ ওরা শুরু করেছে, তা আসলে সুস্থ সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই যুদ্ধ। অর্থাত্ প্রতীক নিয়ে লড়াই প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতিরই লড়াই।

এ লড়াইয়ে অসুস্থ ও প্রগতিবিরোধী সংস্কৃতিকে পরাজিত করতে হলে সুস্থ ও প্রগতিশীল সংস্কৃতির সব প্রতীককেই বাঁচিয়ে রাখতে হবে। প্রগতির শত্রুরা যদি ওই প্রতীকগুলোকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে, তবে পুরো জাতিটাই তার ইতিহাস বিস্মৃত হয়ে যাবে। ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি কখনো নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে না।

প্রতিটি দেশ ও জাতির ইতিহাসেরই যেমন একটি ঐক্যসূত্র থাকে, তেমনই তাতে থাকে বৈচিত্র্যও। বাংলাদেশের ইতিহাসেও তেমনটি আছে। সন্দেহ নেই, এ দেশে বাঙালি জাতির মানুষই সংখ্যায় গরিষ্ঠ। কিন্তু সংখ্যায় গরিষ্ঠ হলেও এরাই সব নয়। বাঙালি ছাড়াও আরও অনেকগুলো জাতি এ দেশটিতে আছে, এবং তাদেরও ভাষা-প্রতীকসহ আপন আপন পরিচয়-জ্ঞাপক অন্যান্য প্রতীক আছে। অথচ আমরা সেই প্রতীকগুলোসহ তাদের জাতি পরিচয়কেই অস্বীকার ও উপেক্ষা করে বসলাম এবং তাদের বাঙালি হয়ে যাওয়ার উপদেশ দিলাম। এমনটি করে মোটেই সংগত কাজ করিনি।

ওইসব জাতি ও তাদের প্রতীকসমূহের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায়ও আমাদের অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে। বিভিন্ন জাতি-উপজাতির প্রতীকগুলো যাতে আপন আপন স্থানে অবস্থিত ও সম্মানিত থাকতে পারে, সবারই সেদিকে নজর দেওয়া বিধেয়। তেমনই বিধেয় বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় ও উপসম্প্রদায়ের সব প্রতীকের শান্তিপূর্ণ ও সম্মানজনক সহাবস্থানের নিশ্চয়তা বিধান করা। এ রকম সহাবস্থানেই নিশ্চিত হতে পারে বিবেকের স্বাধীনতা। অন্য সবার বিবেকের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করে যারা কেবল নিজেদের প্রতীককেই প্রতিষ্ঠিত রাখতে চায় ও অন্যদের প্রতীকের ওপর হামলা চালায়, নিজেদের ধর্মভাষ্যকেই একমাত্র সত্য বলে প্রচার করে অন্য সবার ধর্মচিন্তা ও ধর্মীয় প্রতীকের পবিত্রতা যারা মানে না, এ রকম সব অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই সুস্থ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার জন্য একান্তই অপরিহার্য। তাই ধর্মধ্বজীদের হাত থেকে ধর্মনিরপেক্ষ উত্সব-অনুষ্ঠান কিংবা শিল্প-সংস্কৃতিকে বাঁচানোর লড়াইয়ের মতোই আহমদিয়া বা অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মসজিদ-মন্দির কিংবা পীর-ফকিরের মাজারগুলোকে রক্ষার লড়াই ও প্রতীক রক্ষার লড়াই—সংস্কৃতির লড়াই।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত