বিজ্ঞাপন
default-image

‘বিপর্যয়ের কাছাকাছি’ যে পরিস্থিতিতে দেশ পৌঁছেছে সেখান থেকে ফিরে আসতে হলে অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে বলে এয়ার মার্শাল আসগর খান (অব.) জানিয়ে দেন।

করাচি প্রেসক্লাবে তাড়াহুড়ো করে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে আসগর খান বলেন, জাতীয় অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উচিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শেখ মুজিবুর রহমানকে ডেকে তার হাতে প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

আসগর খান বলেন, সংবিধান প্রণয়নের কাজে অপেক্ষা করা যেতে পারে। এখন সর্বাগ্রে করণীয় ক্ষমতা যেখানে যাওয়ার কথা, জাতীয় পরিষদের সেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা।

ঢাকার পথে রাওয়ালপিন্ডি থেকে তিনি করাচিতে আসেন, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর একটি বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু তিনি বলেন, ভুট্টো সাহেবের পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি থাকায় বৈঠকটি হতে পারেনি। তিনি আজ (শুক্রবার) সকালে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য ঢাকায় রওনা হবেন। তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইচ্ছাকৃতভাবে ছয় দফা নিয়ে বিকার সৃষ্টি করা হয়েছে। নেতা কিবা রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসেবে নয়, নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব এই বিকারগ্রস্ততা কাটিয়ে দেওয়া। তিনি মনে করেন এই বিকারগ্রস্ততা কাটাতে আমূল শৈল্য চিকিৎসার প্রয়োগ প্রয়োজন—গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে উত্তরণে দেরি করিয়ে দেওয়ার এই প্রক্রিয়াটি ক্লাসিক্যাল।

পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তাতে তিনি যেভাবে আঘাত পেয়েছেন তা প্রকাশ করেন ‘পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের উপর এই আক্রমণ চালালে যেমন লাগত, পূর্ব পাকিস্তানের ভাইদের জন্য আমারও সেই অনুভূতি।’

আসগর খান জোর দিয়ে বলেন, প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও কতৃ‌র্ত্ব দিয়ে এখনই শেখ মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করার জন্য ডাকা উচিত। আমার পূর্ব পাকিস্তানি ভাইদের সঙ্গে এ আচরণ আমি আর দেখতে চাই না; পাকিস্তান ভেঙে টুকরো হয়ে যাক আমি তাও চাই না। তিনি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণকে বুঝতে হবে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ও হতাশায় পূর্ব পাকিস্তান এখন ধিকি ধিকি জ্বলছে। এখন ক্ষমতা তাদের বৈধ অধিকারে—সেই ক্ষমতা তাদের উপভোগ করতে এবং প্রয়োগ করতে দিতে হবে।

এয়ার মার্শাল আসগর খান (অব.) বলেন, যদিও ছয় দফার পেছনের দর্শন তাঁর পছন্দনীয় নয় এবং আওয়ামী লীগের অনমনীয় অবস্থানের প্রয়োজন ছিল না তবুও বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় স্বার্থে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হতো।

এ বিষয়ে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলবেন কি না জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, আমি তাঁর মন বুঝতে চেষ্টা করব এবং দেখব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সবচেয়ে ভালো কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়।

গত তিন মাসে দেশের রাজনীতি পরিস্থিতির যে দ্রুত অবনতি ঘটেছে তার জন্য তিনি আমলাতন্ত্র, কায়েমি স্বার্থবাদী মহল, ব্যবসায়ী ও কিছুসংখ্যক রাজনীতিবিদের গণতন্ত্র ঠেকানোর মানসিকতাকে দায়ী করেন।

এক প্রশ্নের জবাবে আসগর খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক স্বার্থে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে চাচ্ছে।

আসগর খান বলেন, যদি পাকিস্তানের অর্ধেক ‘শেষ’ হয়ে যায় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানও একতাবদ্ধ ও অখণ্ড থাকবে না।

ক্ষমতা দ্রুত হস্তান্তরের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান তো ২৩ বছর শাসন করেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান প্রচণ্ড ভুগেছে। এখন পূর্ব পাকিস্তান শাসন করবে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবে—তাতে পশ্চিম পাকিস্তানকে যদি একটু ভুগতে হয় ভুগবে।

আসগর খান বিশ্বাস করেন, একমাত্র ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্যেই সমগ্র জাতির পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মঙ্গল নিশ্চিত। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে খুন-খারাবির বিরুদ্ধে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের যেকোনো ধরনের আত্মত্যাগের জন্য তিনি সম্মত। তিনি বলেন, ‘বেশি বাড়াবাড়ি’ করা হয়ে গেছে। যদি এখনই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনে নতুন আন্দোলন শুরু করবেন। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, তারা হতাশ। তিনি ঢাকার পথে রওনা হয়েছেন মানুষের ভোগান্তি সচক্ষে দেখতে।

‘দেশের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষায় একমাত্র উপায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পুনরুদ্ধার’—পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো নেতার মনোভাব ও আচরণের নিন্দা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নেতার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার বদলে তারা চাইছে সামরিক আইনই চালু থাকুক। সামরিক আইন তাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার নিন্দা করে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতাদের নিয়ে যে গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন, মনে হয় না তা অনুষ্ঠিত হতে পারবে।

আইয়ুব খানের ডাকা গোলটেবিল বৈঠকে ভুট্টো যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর এবার সবার আগে তিনি যোগ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেই তো শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলে ডাকা হলো, তখন ছয় দফা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি।

‘পাকিস্তানের তিন শক্তি আওয়ামী লীগ, পিপিপি ও সেনাবাহিনী’-ভুট্টোর এ মন্তব্যকে তিনি দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেন। আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হলেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করতে হবে—সে জন্যই দরকার দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত