বিজ্ঞাপন
default-image

মহোদয়,

সবচেয়ে ভালো খবরের পেছনে ছুটতে থাকা সময়-স্বল্প প্রতিবেদক আমরা নই। আমরা দুজন ২০ বছর ধরে কলকাতায় আছি। ত্রাণ তৎপরতা চালাতে গিয়ে আমরা কোনো বিশেষভাবে বাছাই না করে শত শত সাধারণ শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে, তা আমাদের কাছে স্পষ্ট, সন্দেহের সামান্য ছায়াও নেই।

ফায়ারিং স্কোয়াডে লাইনে দাঁড়ানো কিন্তু দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া অনেকেই আছেন। রাজনৈতিক নেতা, অধ্যাপক, চিকিৎসক, শিক্ষক ও ছাত্রদের মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করতে দেখেছেন—এমন অনেক সাক্ষী রয়েছেন।

দিনে বা রাতে যেকোনো সময় গ্রাম ঘেরাও করা হয়েছে—সন্ত্রস্ত গ্রামবাসী যেখানে সম্ভব পালিয়েছে অথবা যেখানে তাদের পাওয়া গেছে, সেখানেই হত্যা করা হয়েছে। অথবা তাদের প্রলুব্ধ করে মাঠে এনে রীতিমতো কচুকাটা করা হয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, বালিকাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে ব্যারাকে, নিরস্ত্র কৃষককে হাজারজন লাঠিপেটা করেছে, বেয়নেটে খুঁচিয়ে মেরেছে।

সাত সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও প্রক্রিয়া এমনই রয়ে গেছে। এমনকি সবচেয়ে অবিশ্বাস্য গল্প—শিশুকে উপরে ছুড়ে বেয়নেট দিয়ে ধরে ফেলা কিংবা নারীকে নগ্ন করে বেয়নেট দিয়ে লম্বালম্বি চিঁড়ে ফেলা কিংবা শিশুদের মাংসের মতো কেটে টুকরো করা—আসলেই সত্য; অনেকেই এসব ঘটনা বলেছে সে কারণে নয়, কারণ যারা বলেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গল্প বানানোর মতো পর্যাপ্ত পরিশীলন তাদের নেই।

আমরা হাতকাটা মা এবং পা-কাটা শিশু দেখেছি। এসব ঘটনা ঘটেছে সীমান্ত থেকে অনেক দূরে। বুলেটের ক্ষতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে, অনেকেই চোখের সামনে নিজের মেয়েকে ধর্ষিত হতে দেখেছেন এবং তাঁদের শিশুদের মাথা গুঁড়িয়ে যেতেও দেখেছেন। কেউ দেখেছেন স্বামী, সন্তান ও নাতিকে কবজিতে বেঁধে গুলি করতে—বেছে বেছে পুরুষ মানুষ শেষ করে দেওয়ার প্রক্রিয়ায়।

কোনো ঘুমের ওষুধই বনগাঁ হাসপাতালের মেয়েটিকে শান্ত করতে পারবে না—এক স্থায়ী প্রলাপের ঘোরে সে চিৎকার করে কাঁদছে—ওরা ‘আমাদের সবাইকে হত্যা করবে, আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।’ তার পাশেই কাঁপছে আরেকটি মেয়ে—দিনভর ধর্ষণের শিকার হয়েছে, তারপর তারা তার গোপনাঙ্গ বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়েছে।

ভারতে আসার পথে প্রায় ৪০০ জন নিহত হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়—তাদের ঘেরাও করে হত্যা করা হয়েছে। কেন? পাছে তারা নির্যাতনের কাহিনী ভারতে নিয়ে যায়? নাকি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নেওয়ার মানে, সে দেশে বসবাস করার অধিকার বাজেয়াপ্ত হওয়া?

সবচেয়ে ভয়ংকর উদ্যোগটি সম্ভবত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। ফার্স্ট ব্যাটালিয়নে কজন গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসতে পেরেছে—গুলি করেছে তারাই, যারা আগের দিন তাদের সাথে এক মেসের বাসিন্দা ছিল। সমগ্র পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার একেকটি প্রতীক।

এই ক্রোধ বছরের পর বছরের সঞ্চিত ঘৃণার ফসল। শোষণ হয়ে উঠেছিল তাদের মজ্জাগত চর্চা। যে দামে পশ্চিমকে চাল দিত, তার দ্বিগুণ দামে কিনতে হতো পূর্বাঞ্চলে। মুজিবের অনুসারীরা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য তৈরি ছিল। ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে ১৬৯টি আসনের ১৬৭টিতেই ম্যান্ডেট দিয়েছে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো এই ফলাফলের অপমানটা হজম করতে পারলেন না।

এটাকে কি ভারতের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে? অন্য যেকোনো দেশের জন্য সমস্যাটা যেমন, ভারতের জন্য তার চেয়ে বেশি হওয়ার কথা নয়। পশ্চিম কী করছে? আসল খেলা তো খতম হয়ে গেছে। পাকিস্তানের ভারী অংশ চলে গেছে—ট্যাজেডি এখন বাসি বিষয়; ত্রাণ-সাহাঘ্য চালিয়ে যাওয়ার তহবিল কে দেবে? আর এর জন্য প্রচারণা কে চালাবে?

রাজনৈতিক জটিলতা কি মুখে গজ ঢুকিয়ে দিয়েছে? কোন সরকার বা ব্যক্তির কি সেই কণ্ঠস্বর নেই, যা এই ভিকটিমদের জন্য উচ্চারিত হবে? এমন কোনো বিবেক কি নেই, যা শোনাবে একটি সৃষ্টিশীল জবাব?

(রেভ) জন হ্যাস্টিংস

(রেভ) জন ক্ল্যাপহ্যাম

সদর স্ট্রিট, মেথোডিস্ট চার্চ, কলকাতা।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত