বিজ্ঞাপন
default-image

মাস্টারমশাই জানিয়ে দিয়েছিলেন পীতাম্বরকে, তোর জন্ম মাঘী পূর্ণিমার রাতে হোক আর নাই হোক, সে রাতে শ্রমণ গৌতম করুণার পাত্র হাতে তোর দ্বারে আসুন আর নাই আসুন, সে রাতে তিনটা উল্কাপিণ্ড রামকানাইয়ের আখের ক্ষেতে আছড়ে পড়ুক আর নাই পড়ুক, সে রাতে চাঁদ-জ্বলা মাঠে জেসমিন আরা তিন দুষ্কৃতির হাতে পুষ্পহীনা হোক আর নাই হোক, তোকে ১.১.১৯৭৮-এ ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিল বলে দেখানো ছাড়া আমার আর গত্যন্তর নেই।

‘কেন স্যার?’ পীতাম্বর জিজ্ঞেস করেছিল।

‘তাতে হিসাবের সুবিধা।’

বটে। কিন্তু ১.১.১৯৭৮-এর রাতে পূর্ণিমা ছিল না, মাঘও ছিল না সময়টা। মাঘী পূর্ণিমাতে চাঁদটা পৃথিবীর বুক ছোঁয়ার জন্য নিচে নেমে আসে, পৃথিবীর বুকটা দুরুদুরু করে। তার কাঁপুনিটা কেউ টের পায়, কেউ পায় না। পীতাম্বর পেয়েছিল, কিন্তু কাঁপুনিটা তাকে ভয় ধরিয়েছিল। সে এ জন্য চিত্কার করতে পারেনি। জন্মের পর অনেক দিন পীতাম্বর কাঁদতেও পারেনি সে জন্য। তাতে তার বাবা-মায়ের কী যে মনোকষ্ট।

মাস্টারমশাইয়ের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু সারা জীবন মাস্টারমশাইয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সে নীরব প্রতিবাদ জানিয়েছে। সে দেখেছে, এসএসসি পরীক্ষায় রেজিস্ট্রেশনের সুবিধার জন্য তার এবং অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েদের এক বড় অংশের জন্মতারিখ দেখানো হয় ওই ১.১ কে। কেউ ১.১.১৯৭৮, কেউ ১.১.১৯৭৯। উনিশ আর বিশ। অন্যরা এই পরিবর্তিত জন্মতারিখ মেনে নিয়েছে। কিন্তু মেনে নিতে পারেনি পীতাম্বর। কীভাবে মেনে নেবে? সে তো মাঘী পূর্ণিমার জাতক।

সে রাতে শ্রমণ গৌতম করুণার পাত্র হাতে তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আর পীতাম্বরের বাবা হরিরাজ শ্রমণ গৌতমকে একটা মোড়ায় বসিয়ে নিজের হাতে পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন। খাদ্য ও অন্যান্য বস্তু দান তো ছিল প্রথাগত আচার। কিন্তু বিনিময়ে গৌতমও কিছু দিয়েছিলেন পীতাম্বরকে—আশীর্বাদ।

শ্রমণ গৌতম পশ্চিমপাড়ার উদয়ন বড়ুয়ার ছেলে। উদয়ন এক স্বপ্ন দেখে ছেলের নাম রেখেছিলেন রূপায়ণ। গোলগাল চেহারা, উদাস চোখের দৃষ্টি রূপায়ণের। ঢাকার কমলাপুরে বৌদ্ধমঠ থেকে ভিক্ষু হয়েছিলেন। তারপর কালসিন্ধু ফিরে গেছেন। কালসিন্ধুর বৌদ্ধরা তাকে স্নেহ এবং শ্রদ্ধার চোখে দেখত। তাদের মতো হরিরাজও, যদিও হরিরাজ বৌদ্ধ ছিলেন না। এক্ষেত্রে অবশ্য পীতাম্বরের আগ্রহ ছিল শুধু একটাই—শ্রমণ গৌতম তাকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে যে বলেছিলেন, এই সন্তান ভগবানের স্নেহপুষ্ট, এই সন্তানের ললাটে রাজটিকা, তার কদ্দুর কী হলো, জন্মের ২৭ বছর পরেও, তা জানতে।

রাজটিকা না ছাই। দারিদ্র্য নিত্যসঙ্গী। সামাজিক লাঞ্ছনা নিত্যসঙ্গী। পীতাম্বর এখন কালসিন্ধুর জীবনে হাস্যরস। লোকে তাকে দেখে আর হাসে। এর একটা কারণ অবশ্য তার চুলহীনতা। এগারো বছর বয়সে মাথায় প্রকাণ্ড টাক পড়েছে পীতাম্বরের। তার ধারণা, বাংলাদেশে অল্প বয়সে টাক পড়ার ক্ষেত্রে সে চ্যাম্পিয়ন।

তবুও, এই টেকো পীতাম্বরের কপালেও প্রেম জুটেছিল। তার প্রেমিকা আর কেউ না, পুষ্পহীনা জেসমিন আরার গর্ভজাত কন্যা চম্পা। চম্পা এখনো জানে না, মাকে যে তিন দুষ্কৃতি পুষ্পহীনা করেছিল, তাদের মধ্যে তার বাবা কোনটা।

পীতাম্বরকে সে প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা বলতো, একটি মেয়েকে যখন একাধিক লোক রেপ করে এবং পরিণামে তার গর্ভে সন্তান আসে, সেই সন্তানের পিতৃপরিচয় কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়?’

default-image

‘খুবই সহজ’, পীতাম্বর বলেছিল, ‘ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে।’ চম্পা স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে। সে কী বোঝে ডিএনএ টেস্টের? সে শুধু হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘সত্যি? পিতৃত্ব নিরূপণের সত্যি কোনো পন্থা আছে?’

পীতাম্বর বলেছিল, ‘এতক্ষণ কী বললাম?’

চম্পা যখন আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নটি করেছিল পীতাম্বরকে, তার মনজুড়ে ছিল এক অনুপস্থিত বাবার বায়োস্কোপ। বাবা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছে, বাবা তাকে ঘোড়ায় চড়াচ্ছে, সাঁতার শেখাচ্ছে, কাঁধে বসিয়ে মেলায় নিচ্ছে, জামা কিনে দিচ্ছে, আদর করছে, কালবৈশাখীর কামানগোলার মুখে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছে, তার হাতে তুলে দিচ্ছে এক রাজপুত্রের হাত।

কতবার এসব ভেবে চম্পা অশ্রুপাত করেছে। ভাবুন! সেই তিন দুষ্কৃতির একটির জন্য!

পীতাম্বর বলল, ‘কিন্তু চম্পা, লাভটা কী? ডিএনএ টেস্ট তো করবা, কিন্তু তার জন্য স্যাম্পল নিতে হবে কবর থেকে।’ পীতাম্বরের খারাপ লাগে কথাটা বলতে, কিন্তু ওই তিন দুষ্কৃতি তো সবাই এখন কবরে। সর্বহারারা তাদের কচুকাটা করেছে, কালসিন্ধু হাইস্কুল মাঠে, এক জ্যোত্স্নার রাতে।

কোনো মাঘী পূর্ণিমার রাতে অবশ্যই নয়।

চম্পা পীতাম্বরকে আনন্দ এবং তৃপ্তি দিয়েছে। চম্পাকে নিয়ে প্রথম যে রাত আখক্ষেতে কাটিয়েছে পীতাম্বর, সে রাতেই বুঝেছে, চম্পা কী জিনিস। শুধু রাতের আনন্দ কিছুটা মাটি হয়েছে পরের দিন আখক্ষেত থেকে মুহিবুল চম্পার ডোরাকাটা রুমাল এবং তার পাশে পড়ে থাকা দুটি জবুথবু ‘রাজা’ কুড়িয়ে পেলে। পীতাম্বর রাজায় বিশ্বাসী, যেহেতু চম্পা মায়ায় বিশ্বাসী নয়। আর মুহিবুল ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের ছেলে, চম্পার প্রাক্তন প্রেমিক। সে তো বিষয়টা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে মেলার বেলুন বানাবেই।

রামকানাইয়ের ১২ বিঘা জমি ছিল। সবই আখক্ষেত। অর্থকরী ফসল। আয়-ইনকাম ভালোই ছিল তার। তিন মাইল দূরে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির কাছে সব আখ বিক্রি করত সে, ভালো দামে।

তার জমিতে উল্কাপিণ্ড পড়ায় কাগজে তার ছবি ছাপা হয়েছিল। জনাব ফজলে লোহানী তার যদি কিছু মনে না করেন অনুষ্ঠানের জন্য রামকানাইয়ের সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন। সেটি বিটিভি আড়াই মিনিট দেখিয়েছিল। সেই রামকানাই ঝাড় থেকে বাঁশ কাটতে গিয়ে কিনা নিজের একটা হাতে কোপ মেরে বসল। সে হাত একসময় ফুলে-ফেঁপে হয়ে দাঁড়াল একটা ছোটখাটো হাতির পায়ের মতো। হাতে ইনফেকশন হয়েছিল, সেই ইনফেকশন-ব্যবস্থাপনার কোনো উপায় তার ছিল না। ইনফেকশন গুরুতর হলে একসময় অক্কা পায় রামকানাই।

ওম শান্তি।

আর তার অক্কা পাওয়ার এক বছরের মধ্যে তার ১২ বিঘা জমিতে মৌরসীপাট্টা বসায় আলফাজ জোয়ারদার। ভেড়ামারায় যার একটা বিরাট বিড়ি ফ্যাক্টরি আছে।

আলফাজ রাগী মানুষ। তার রাগের কাছে রামকানাইয়ের স্ত্রী নমিতা, ছেলে সুশান্ত ও মেয়ে মন্দিরা তো কিছুই না। তারা পালাল। রামকানাই ছিল পীতাম্বরের কাকা। পালাবার আগে মন্দিরা বলেছিল পীতাম্বরকে, ‘দাদা, স্বদেশ বলতে আর কিছুই রইল না।’

‘কেন, কালসিন্ধু তো হাওয়া হয়ে যাচ্ছে না।’

‘তা যাচ্ছে না বটে। কিন্তু আমরা যে হাওয়া হয়ে যাচ্ছি।’

মন্দিরা এত সুন্দরী ছিল, সেই ১৮ বছর বয়সেই, যে তাকে প্রচুর চুমু খেতে ইচ্ছা করত পীতাম্বরের এবং তাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করতেও। কিন্তু ধর্ম বাদ সেধেছিল। একবার এ রকমও ভেবেছিল পীতাম্বর যে, দুজনে তারা ধর্মান্তরিত হয়ে যাব, তাহলে পরস্পরকে বিবাহ করতে বাধা থাকবে না। ইচ্ছাটা মন্দিরাকে বলা সম্ভব ছিল না।

যদিও একসময় গোয়ার্তুমির বশে হয়তো বলেই ফেলত। কিন্তু তার আগেই মন্দিরা বাবা-মায়ের হাত ধরে হাওয়া হয়ে গেল চিরদিনের মতো, উদ্বাস্তু হয়ে।

পীতাম্বর পড়ে রইল কালসিন্ধুতে। আলফাজ তাদের ৩ বিঘা জমিতেও ভাগ বসিয়েছে। তাদের সাকুল্যে ৮ বিঘা জমি। তিন গেলে কত থাকে, বলুন?

সে জন্য সে চম্পাকে বলেছিল একদিন, ‘চল চম্পা, শহরে যাই।’

চম্পা প্রবল আপত্তি করেছে। কিছুতেই সে শহরে যাবে না। সন্ধ্যারাতেই চম্পা তাকে আখক্ষেতে নিয়ে গেছে। দুইটা রাজার পর পীতাম্বর যখন চম্পার কাঁধে মুখ রেখে ঘুমিয়েছে, তার মনে হয়েছে, স্বদেশটা ওই আখক্ষেত, স্বদেশটা ওই চম্পা।

কিন্তু দেশে নির্বাচন আসছে। নির্বাচনে টাকা উড়ছে। সেই টাকা ঘুড়ির মতো যারা ওড়াচ্ছে অলীক সব লাটাই হাতে, তাদের একজন, ইদ্রিস মেম্বার, তার চোখ ফেলেছে চম্পার ওপর। চম্পা জীবনে এত টাকা দেখেনি, যত টাকা এক সন্ধ্যায় ইদ্রিস তাকে দেখিয়েছে। ইদ্রিস মেম্বার তাকে মোটরসাইকেলে চড়িয়ে তারাবিলে নিয়ে গেছে। তারাবিলে দক্ষিণবঙ্গ ট্রাক মালিক সমিতির একটা অফিস আছে। সেই অফিসে একটা বিশ্রামঘরও আছে এবং তাতে একটা বিছানা ফেলা আছে। সেই বিছানায় জাজিম, তোশক আছে। টেবিলে খানাপিনা আছে।

ইদ্রিস মেম্বার বলেছে, নির্বাচনে আমরা জিতব না তো কি ফকিরের বাচ্চাগুলা জিতবে?

সত্যিই তারা জিতল। তারপর ইদ্রিস মেম্বার চম্পাকে ঢাকায় নিয়ে গেল।

শেষ বিদায়, চম্পা।

পীতাম্বরের তিন কাকার একজন মৃত, একজন জীবিত। সেই কাকা, পীতাম্বর, পীতাম্বরের প্রতিবেশী— নন্দলাল আর সুশীল, বড়জোর রজত এবং ধীমান, এই তো? এরাই তো ইদ্রিস মেম্বারদের ভোট দেয়নি, নাকি? কথাটা অবশ্য খুব ওপরের লেভেলের লোকজন বিশ্বাস করে, টিভিতে বলেছেও কেউ কেউ, ছবিও দেখিয়েছে। কাজেই পীতাম্বরের প্রাণ যায় যায় অবস্থা।

পীতাম্বরের এক প্রতিবেশী প্রৌঢ়া জ্ঞান হারিয়েছিলেন, যেদিন তার মেয়েটিকে কিছু লোকজন তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

তার জ্ঞান আর ফেরেনি। মেয়েটিও না।

পীতাম্বর জানে না, কিন্তু আমরা জানি, বাংলাদেশের একটি গ্রামে এই প্রৌঢ়ার কন্যার মতো একটি মেয়ের ভেতরে জনাদশেক বলশালী লোক প্রবেশের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছিল, তখন তার জননী কাতর কণ্ঠে অনুনয়-বিনয় করে বলছিল—‘বাবা, তোমরা একজন একজন করে যাও। আমার মেয়েটাকে মেরে ফেলো না।’

মেয়েটি, বলা বাহুল্য, বাঁচেনি। এ রকম ক্ষেত্রে একজন একজন করে যাওয়ার কথাটা কারও বলা উচিত নয়, তা সে মেয়ের মা হোক অথবা বান্ধবী। লোকগুলো শুধু শুধু তা নিয়ে হাসাহাসি করে।

পীতাম্বরকে অতএব পালাতে হলো।

সে এক অবাক ব্যাপার। পীতাম্বর কেন পালাবে? সেকি কোনো অপরাধ করেছে? সেকি কোনো দোষে দোষী? তার পুরো পরিবার শুধু প্রাণটুকু বাঁচাবার জন্য কেন এক ভোরে সব ছেড়ে-ছুড়ে শুধু রাস্তা দিয়ে দৌড়াবে?

প্রশ্ন করবেন না, প্রশ্ন করাটা মূর্খের কাজ। দেখেন না, মাস্টারমশাইকে প্রশ্ন করে কী কচু লাভ হয়েছিল পীতাম্বরের?

সাঁতার কাটতে কাটতে পীতাম্বর এসে উপস্থিত হলো ঢাকায়। ঢাকার ডেমরায়। ডেমরার ধলপুরের এক বস্তিতে। তার সঙ্গে তার বোন অঞ্জলি, বয়স ২৩, আর বৃদ্ধা কাকিমা। বয়স অজানা। ষাট থেকে অষ্ট-আশি।

অঞ্জলিকে এক রাত আখক্ষেতে কাটাতে হয়েছে। তবে সে ছিল সমূহ নিরাপদ, কেননা তার সঙ্গে ছিল দাদা, পীতাম্বর। পীতাম্বরের হঠাত্ ধারণা হয়েছে, বোনকে যেন কোনো উন্মাদ বনবিড়ালও একটা আঁচড় দিতে না পারে, সে সেটি দেখবে। সে সারা রাত একটা দা হাতে বসে ছিল। এক ফোঁটা ঘুমায়নি।

অঞ্জলির গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি। বস্তুত এই গল্পে অঞ্জলিই একমাত্র অক্ষত চরিত্র। অথবা অচরিত্র—সে জন্যই অক্ষত।

পীতাম্বর একদিন বলেছে অঞ্জলিকে, ‘তুই সবচেয়ে কী মিস করিস অঞ্জু?’

অঞ্জলি কঠিন চোখে চারদিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘এই নরকে মিস করা না-করার মতো কীইবা আছে?’

পীতাম্বর এ রকম কঠিন উত্তর শুনে বলেছে, ‘আমার কথাটা তুই বুঝতে পারিসনি। আমি তোকে সহজ করে বলছি। ধর, তোকে জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হলো। চিরতরে। নির্বাসনে। তুই কী কী জিনিস মিস করবি?’

অঞ্জলি উত্তর দিতে সময় নিল। সেই সময়টুকুতে পীতাম্বরের মনে হলো—অঞ্জলি বলবে, দিগন্ত ছোঁয়া ধানের নয়তো আখের ক্ষেত। শান্ত গৃহকোণ। কালসিন্ধু বালিকা বিদ্যালয়। অথবা তারাবিল মহাবিদ্যালয়। ঘোষের হাট সংগীত নিকেতন—যেহেতু অঞ্জলি ওই প্রতিষ্ঠানে গান শিখেছে ওস্তাদ কালু মুন্সীর কাছ থেকে। কপোতাক্ষের নীল জল। অথবা এ রকম হাজারটা কিছু।

কিন্তু পীতাম্বরকে চমকে দিয়ে অঞ্জলি বলছে, ‘আমি যদি কিছু মিস করে থাকি, দাদা, তাহলে তা হচ্ছে কালসিন্ধুর শ্মশানঘাটের শকুনগুলোকে।’ একবারই শ্মশানঘাটে গিয়েছিল অঞ্জলি এবং একটা গাছে শকুন বসে থাকতে দেখে অবাক হয়েছিল।

অঞ্জলির উত্তরটি এমনই হতবাক করা ছিল যে, পীতাম্বরের মুখে আর প্রত্যুত্তর জোটেনি।

কাজেই একদিন যখন পিতাম্বর এসে বলল, ‘অঞ্জলি, তোকে যে সংবাদ দিব, সেটি শুনে তোর হার্টফেল হবে’—অঞ্জলি শুধু বলেছিল, ‘কালসিন্ধুর শ্মশানঘাটের সব শকুনকে নিশ্চয় মেরে ফেলা হয়েছে। না, তাতে হার্টফেল করে আমার মরার কোনো উপায় নেই।’

পীতাম্বর বলেছে, ‘ধুর, সবটা না শুনেই কথা বলিস...আমরা তিনজন ডিভি লটারি জিতেছি।’

‘কত টাকা পাব, লটারি জিতে?’ আবারও নিস্পৃহ গলায় জিজ্ঞেস করেছে অঞ্জলি।

তখনি অঞ্জলির পাশে বসতে হয়েছে পীতাম্বরকে। বোঝাতে হয়েছে আমেরিকার ডিভি লটারির পুরো ব্যাপারটি। যখন সে ডিভির জন্য আবেদন করে, বিষয়টি কী, কারও মাথায় তেমন আসেনি। কাগজপত্রে কিছু সই দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো সংযুক্ততাও ছিল না। অঞ্জলি ভুলেই গিয়েছিল ব্যাপারটা।

পীতাম্বর যেভাবে ডিভির পুরো ছবিটা তুলে ধরল অঞ্জলি আর কাকিমাকে, যে সহজ ভাষায় সে বোধগম্য করল বিষয়টাকে, তাতে আমাদের মনে হলো, বৃথা মার্কিন ইমিগ্রেশন বিভাগে এতগুলো লোকের বেতন দিচ্ছে জর্জ বুশের সরকার। এক পীতাম্বরকে চাকরি দিলেই সব কাজ হয়ে যায়, অন্যদের বিদায় দিয়ে দেওয়া যায়।

সব শুনে অঞ্জলির চোখ চিকচিক করতে থাকল। সে আনন্দে হইচই শুরু করল। যদি আত্মহারা হওয়া বলতে কিছু বোঝায়—তাহলে অঞ্জলির হলো তাই। তারা আমেরিকা যাচ্ছে! সেখানে অঞ্জলি চাকরি করবে! গাড়ি কিনবে, গাড়ি চালাবে! জিন্স পরবে! টি-শার্ট পরবে! রাত ১২টায় রাস্তা দিয়ে একা হাঁটবে!

আর শহীদ স্যারের বাসায় গিয়ে স্যারের নিজের হাতে বানানো এক কাপ চা খেয়ে শুধু শুকনো গলায় ‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে ফিরে না এসে তার দুই হাত ধরে ধন্যবাদ জানানো যাবে এবং স্যারের দুই হাত তার গালে চেপে...ওমা!

যাকগে। সেটা যখন হচ্ছে না, আপাতত চাকরি করা আর গাড়ি চালানোর চিন্তাতেই মশগুল থাকা যায়।

অতএব কাকিমা আর অঞ্জলির হাতে ধরে একদিন প্লেনে চড়ে বসল পীতাম্বর।

প্লেনটা যখন আকাশে উড়ল, পীতাম্বরের হঠাত্ দারুণ কান্না পেল, সে সত্যি সত্যি হাঁপুস নয়নে কাঁদতে থাকল। কাকিমা আর অঞ্জলির মুখও গম্ভীর। কিন্তু তারা কাঁদছে না। অঞ্জলি যে দাদাকে জিজ্ঞেস করবে, দাদা তুমি কাঁদছ কেন? সে সাহসও সে হারিয়ে ফেলল। অঞ্জলি প্লেনের জানালা দিয়ে দেখল শহীদ স্যার হাত নাড়ছেন আর বলছেন, ‘অঞ্জলি, তুমি মুম্বাই-টুম্বাইয়ে জন্ম নিলে ঐশ্বরিয়া-রানী মুখার্জির সঙ্গে একই স্টেজে নাচতে।’ অথবা জানাচ্ছেন, ‘না, বিয়ে করার পরিকল্পনা নেই’ এবং কলেজের মেয়েরা তাকে ধরেছে ‘কেন নেই স্যার?’ এবং তিনি বলছেন, ‘সে উত্তর আমার কাছে নেই, যার কাছে আছে তাকে জিজ্ঞেস করো।’

‘সে কে স্যার?’

‘এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। এর উত্তর অন্তর্যামী জানেন।’ ইত্যাদি।

সেই নারীটি কে, অঞ্জলি জানে, গ্রামের সবাই জানে বস্তুত। তারপরও তার বুক দুরুদুরু করে। যখন সে ভাবে, সেই নারীর নাম অঞ্জলি।

বিদায় শহীদ স্যার।

পীতাম্বরের চোখের সামনে একটুখানি একটা গ্রাম, তার রাস্তাঘাট, ক্ষেতখামার, বাড়িঘর, নদী-জলা একশটা ছবির ফ্রেম হয়ে দুলতে থাকল। অথচ কালসিন্ধুতে পীতাম্বরের এখন আর একটি টুকরো জমিও নিজের বলে নেই। তাদের বাড়িটাও পুড়ে ছাই হয়েছে।

এখন কালসিন্ধুতে আমার যেটুকু অধিকার, ঠিক সেইটুকু পীতাম্বরের। অর্থাত্ আমরা দুজনই সমান আউটসাইডার। আর কিনা আমি জীবনে কালসিন্ধু যাইনি, অথচ পীতাম্বর পুরোটা জীবন কাটিয়ে দিল কালসিন্ধুতে!

পীতাম্বরের গল্পের এই জায়গাটিকে—নিউইয়র্কে তার প্লেন থেকে নামার পর এক বছর আড়াই মাসের মতো সময়কালটিকে—সংক্ষিপ্ত করতে হবে আমাদের। এ ছাড়া উপায় নেই। কেননা সময়টা এমনই ছন্নছাড়া যে, বর্ণনা করতে গেলে তা একেবারে এলিয়ে পড়বে। একটা বিশাল শহরে তিনজন একা মানুষ প্রবেশ করেছে—কোথায় যাবে তারা, কী করবে, কোথায় থাকবে, কী খাবে...এরকম শত শত প্রশ্ন জেগে ওঠে। কী করবে পীতাম্বর?

শ্রমণ গৌতমের এক পিসতুতো ভাই একটা ব্যাংকে চাকরি করে কুইন্সে। এইটুকু শুধু পীতাম্বর জানে। তার নাম প্রশান্ত। ব্যস।

প্রশান্তকে সে জীবনে দেখেনি, শুধু নাম শুনেছে। এখন এই লোককে কীভাবে আবিষ্কার করে পীতাম্বর? আর আবিষ্কার যে করবে, তাইবা কী প্রকারে? ইংরেজি ভাষায় তার জ্ঞান ইদ্রিস মেম্বার থেকে মোটেও বেশি কিছু নয়।

ইদ্রিস মেম্বার ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে, যদি জানতে চান।

অথচ অপ্রত্যাশিত ঘটনাটাই ঘটল। না, এ শুধু গল্পের খাতিরে নয়, সত্যি সত্যি ঘটল। প্রশান্তের সন্ধান সে পেল। ব্যাপারটা আর কিছুই না, যে দোভাষীকে বুশের লোকজন দায়িত্ব দিয়েছিল পীতাম্বরের সঙ্গে যোগাযোগ সৃষ্টির জন্য, সে প্রশান্তকে চেনে। জ্যাকশন হাইটসের আলাউদ্দিনের দোকানে ডেইলি সন্ধ্যায় প্রশান্তকে সে আড্ডা মারতে দেখেছে। সে—যার নাম মাসুদ—নিজেও আড্ডা মারে, তবে অন্য টেবিলে।

এক বছর আড়াই মাসের মাথায় দেখা গেল, অঞ্জলি চাকরি করছে পে-লেস শু স্টোরে। সে স্কার্ট আর টপস পরে দোকানে যায়, বেশ ঝরঝরে ইংরেজি বলে, দুপুরে দুই বন্ধু ফ্লোরেন্স আর ধাম্মিকার সঙ্গে লাঞ্চ করতে মেক্সিকান ফাস্টফুড দোকানে যায়।

ফ্লোরেন্স ফিলিপাইনের মেয়ে। ধাম্মিকা শ্রীলঙ্কার ছেলে। অঞ্জলির বস জানে আলম ফরিদপুরের ছেলে। সুপারভাইজার। তার দোষ একটাই, প্রতিদিন একটা-দুটো কবিতা লিখে নিয়ে আসে জানে আলম, এবং সেসব কবিতা বাসায় নিয়ে ভাষা, রূপকল্প, বাকপ্রতিমা, ছন্দ এবং অন্যান্য বিষয় ঠিক করে দিতে হয় অঞ্জলিকে।

জানে আলমের ইচ্ছা, একদিন চাকরি ছেড়ে ফুলটাইম কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করবে।

জানে আলমও এই গল্পে একজন অচরিত্র। কিন্তু তার একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা আছে পীতাম্বরের প্রবাসজীবনে। তার লেখা কবিতাগুলো যখন অঞ্জলি পড়ে শোনায়, পীতাম্বরের গভীর কান্না পায়। জানে আলমের সব কবিতা দেশ নিয়ে, ফরিদপুর নিয়ে—অর্থাত্ তার গ্রাম নিয়ে। গ্রামের নাম পাখিচর, অনেক রাতে অঞ্জলি শুয়ে পড়লে পীতাম্বর জানে আলমের কবিতা হাতে নিয়ে অনুচ্চ আবৃত্তিতে পড়ে। আর তার চোখ ভেসে যায়।

আরো সংবাদ: পীতাম্বর চাকরি পেয়েছে একটা ফিলিং স্টেশনে। চাকরিটা ভালোই, বসটাও ভালো। রেগুলার ইনকাম। ছুটিছাটা আছে। দুই কামরার একটা ফ্ল্যাটে, অঞ্জলি আর কাকিমা থাকে এক ঘরে, সে আরেকটিতে। অঞ্জলি গাড়ি কিনতে পারেনি—গাড়ি চালানোটাও শেখা হয়নি। তবে উভয় ক্ষেত্রে শিগগিরই অর্জনের ব্যাপারে অঞ্জলি আশাবাদী।

পীতাম্বরের কাকিমাকে নিয়ে আমরা যে কিছু বলব, কী করে? তিনি তো ওই ঘরে শুয়ে-বসেই দিন কাটান। টিভি দেখেন, রাঁধেন, পূজা-অর্চনা করেন, শূন্য চোখে জানালার পাশে বসে উল্টোদিকের বাচ্চাদের স্কুলের হইহল্লা শোনেন। তাকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই আসলে। তিনি থাকুন তার মতো।

নিউইয়র্কে নামার এক বছর আড়াই মাসের মাথায় জ্যাকসন হাইটসের আলাউদ্দিনের দোকানে প্রশান্তর সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে, পাশে মান্নান গ্রোসারি থেকে কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র কিনে রাস্তায় নেমেছিল পীতাম্বর। একটু তাড়া ছিল। সাবওয়ে ধরে কুড়ি মিনিটে বাড়ি পৌঁছে সেগুলো কাকিমাকে গছিয়ে, মুখে একটু কিছু গুঁজে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া। এ মাসে রাত দশটা থেকে তার শিফট। ফিলিং স্টেশনটা হাইওয়ের পাশে কিনা। সারা রাত খোলা থাকে।

কী যে ভাবছিল পীতাম্বর, একমাত্র অন্তর্যামী জানেন। কেন ভাবছিল, তা অনুধাবনের এখতিয়ারও তারই। আর একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন কেন এত আনমনার মতো রাস্তায় পা রেখেছিল পীতাম্বর—আগেপিছে না দেখে। এ রকম অসাবধান তো সে জীবনে ছিল না। হয়তো ছিল, যখন ছিল কালসিন্ধুতে। কিন্তু কালসিন্ধুর ধূলি ওড়ানো মেঠোপথে আনমনে পা ফেলা আর জ্যাকসন হাইটসের ব্যস্ত রাস্তায় আনমনে পা ফেলা, ভাই, এক জিনিস না। বিশেষ করে ট্রাফিক লাইট যেখানে সবুজ।

ফলে যা হওয়ার তাই হলো।

আবারও সেই প্রশান্ত। সে-ই হাল ধরল। একটা স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেলের ধাক্কায় পীতাম্বর পড়ে ছিল রাস্তার মাঝখানে। সেখানে তার ওপর দিয়ে চলে যায়—চলে যাওয়া ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না—দুই মোটরকার।

ডাক্তার-হাসপাতাল প্রশান্তই করেছে এবং পীতাম্বর মারা গেলে কোথায় তার সত্কার হবে, সে নিয়েও সে কথা বলেছে অঞ্জলির সঙ্গে। অঞ্জলি তার প্রবল শোক ও সর্বনাশের মধ্য দিয়েই প্রশান্তকে বলেছে, ‘দাদা খুব খুশি হতো যদি তাকে কালসিন্ধুতে দাহ করা যেত।’

প্রশান্ত প্রমাদ গুনল। সর্বনাশ! দেশে লাশ পাঠানো আর চাঁদে মানুষ পাঠানো যে একই কথা! প্রায় অসম্ভব এক চিন্তা। বাস্তব সমস্যাগুলো বাদেও প্রশ্ন থাকে, এত পয়সা কোথায়? কার আছে?

দৃশ্যে এবার প্রবেশ করল জানে আলম। জানে আলমের মনে হয়েছে, কালসিন্ধুতে দাদাকে দাহ করার প্রস্তাব রেখে অঞ্জলি তার কবিতার স্বপ্নগুলোকেই যেন ভাষা দিয়েছে।

পীতাম্বরের জন্য চাঁদা উঠল। ফিলিং স্টেশনের বস বাড়ি এসে সমবেদনা জানালেন। টাকাও দিলেন। অথচ সে লোকের বাড়ি পোর্টো রিকো। কালসিন্ধুতে লাশ দাহ হবে শুনে তার চোখে দু-এক ফোঁটা অশ্রু এসেছে। অবাক!

আবারও কিছুটা দ্রুতগতিতে এগোতে হবে আমাদের। গল্পের প্রধান চরিত্র যদি মরে যায়, তাহলে গল্পটা দ্রুত শেষ করে ফেলাই ভালো। শুধু শুধু বিকল ইঞ্জিন গাড়ির মতো ঠেলে কী লাভ? অনেক ক্লেশে একবার স্টার্ট নিলেও যে গাড়িটা ঝামেলাহীন চলবে, সে গ্যারান্টি কোথায়?

ঢাকায় পীতাম্বরের লাশ গ্রহণ করল তার ছোটবেলার দুই বন্ধু। দুজনই ঢাকায় ব্যবসা করে। এদের সঙ্গে পীতাম্বরের যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধলপুরে থাকার সময়। তারা একটা মাইক্রোবাসযোগে গেল কালসিন্ধু, ব্যবসাপাতি দুদিনের জন্য ফেলে রেখে। আশ্চর্য!

কালসিন্ধুতে শ্মশানঘাট বলতে এক চিলতে একটি জমি। একসময় বিঘা দুয়েক ছিল, এখন নেই। মানুষের ঘরবাড়ি উঠেছে। দোকানপাটও। নেহাত দেবোত্তর সম্পত্তি, পুরোটা তো গ্রাস করে দেওয়া যায় না। আর শ্মশানে চিতা জ্বলে কালেভদ্রে। সে জন্য কারও কোনো মাথাব্যথাও নেই। শুধু লাশ যখন পোড়ে, উত্সাহী মানুষ ভিড় জমায়।

পীতাম্বরের দাহকাজে ভিড় হলো বেশি। একে তো ঢাকা থেকে লোকজন এসেছে, গাড়ি এসেছে, তার ওপর লাশটা এসেছে দারুণ এক কাঠের বাক্সে। বাক্সটার কী হবে, কে নেবে, এ রকমও কথা হচ্ছিল, কিন্তু পীতাম্বরের বন্ধু আমু বলল, এটিও চিতায় পুড়বে।

যাঃ। এত সুন্দর একটা বাক্স, কত কাজে লাগানো যেত। কী পালিশ করা কাঠ!

আমু দাঁড়িয়ে থাকল, অন্য বন্ধু রফিকও দাঁড়িয়ে থাকল, বৌদ্ধপাড়া থেকে দু-একজন এসেছিল, আর এসেছিল পীতাম্বরের পাড়ার কয়েকজন। আর অনেক এমনি মানুষ দাঁড়িয়ে থাকল। চিতা জ্বলল। ঘণ্টা দুই পরে মনে হলো বৃষ্টি হতে পারে। তাতে মানুষজনের উত্সাহে ভাটা পড়ল। আমু আর রফিক গাড়িতে উঠল, এখন রওনা হলে রাত ১২টার মধ্যে ঢাকা পৌঁছানো যাবে।

সন্ধ্যা ঘন হয়ে এল। দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। জ্যৈষ্ঠের শেষ, আষাঢ়ের জানান দেওয়া অগ্রিম বৃৃষ্টি, তবে জুতসই নয়। আর জুতসই হলেও সমস্যা ছিল না। লাশটা দাহ হয়েছে সঠিক। শব্দ করে মাথার খুলি আর হাড়গোড় পুড়েছে। শিখাটা লাল-কমলা রং নিয়েছে, অর্থাত্ পীতাম্বরের চর্বি পুড়েছে। আমেরিকায় সে ফাস্টফুডের ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ম্যাকডোনাল্ডের বার্গার খেত সুযোগ পেলেই, আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। তাতে তার একটা নোয়াপাতি ভুঁড়ি হয়েছিল।

চিতার আগুন নিভছে। অথবা নিভতে বসেছে। কিন্তু একটু যে ঝলক দিয়ে আবার খানিকটা জ্বলল, যদিও স্তিমিত হলো আবার, তা কেন?

তাকিয়ে দেখা গেল, শ্মশানঘাটের পাশে, চিতাটা যেখানে জ্বালানো হয়েছিল, তার থেকে সামান্য দূরে, বুড়ো আমড়াগাছের ডালটিতে উড়ে এসে দুটি শকুন বসেছে। তাদের ডানার বাতাসে চিতাটায় ওই সাময়িক ঝিলিক দেখা দিয়েছিল।

শকুন দুটিও বুড়ো হয়েছে। থাকে আমড়াগাছটিতেই। চোখে তেমন দেখতে পায় না। এমনকি ডালে বসতে গিয়েও পা ফস্কায়।

শকুন দুটি বার দুই ডানা ঝাপ্টালো, তারপর চুপচাপ বসে রইল, ছানিপড়া চোখে দূরের দিকে দৃষ্টি মেলে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত