বিজ্ঞাপন

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বৃহস্পতিবার

default-image

এইমাত্র শুনলাম, নিয়াজি পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণ করেছেন, যুদ্ধ শেষ হয়েছে ও ভারতীয় সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করছে। ঢাকাকে কব্জায় আনতে মর্টার ও অন্যান্য গোলা ব্যবহার করে মুক্তিবাহিনী সক্রিয় তত্পরতা চালিয়েছে। তারা এখন জামায়াতে ইসলামী মার্কা জাতীয়তাবাদীদের কতল করায় ব্যস্ত। ভারতের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ায় এর সরকার আজই শপথ নেবে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, তাঁদের লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় তাঁরা আগামীকাল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবেন। আমার বিশ্বাস, তাদের লক্ষ বিশ্ব-জনমতকে তাদের পরিবর্তিত শান্তিপূর্ণ অভিপ্রায় দেখিয়ে বিভ্রান্ত করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশে সময় অর্জন করা; যদিও এমন কিছু প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে বাংলা থেকে ভারতীয়রা তাদের সৈন্য চীন সীমান্তে নিয়ে গেছে। বাস্তবে চীনাদের তেমন কিছু করতে হবে না। হিমালয়ের সীমান্তে চীন কিছু সেনা জড়ো করলেই ভারত তেড়েফুঁড়ে সেনাসমাবেশ করবে; এতে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপও কমবে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এটা ছিল এক কালো দিন। শুধু একটি প্রদেশ হারানো এবং সাড়ে ছয় কোটি মুসলমানের ভারতের অধীনে চলে যাওয়া নয়, এতে আমরা চমত্কার একটি বিভাগ এবং কিছু বিমান ও নৌঘাঁটিও হারালাম। আমরা কীভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসব, তা সত্যিই এক বিশাল সমস্যা। ভারত এই জিম্মিদেও মুক্তির বিনিময়ে অনেক কিছু দাবি করে বসবে।

বাংলার এই বিভাজন অবশ্যম্ভাবী ছিল, যদিও তা ছিল খুব বেদনাদায়ক। অধিকাংশ মানুষের মনে এই প্রত্যয় সৃষ্টি করা হয়েছিল যে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের শত্রু। আমাদের শাসকদের এ সম্পর্কে সময় থাকতেই সচেতন হওয়া উচিত ছিল; এতে ভারত অন্তত ছুরি-কাঁচি চালিয়ে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারত না।

ধারণা করি, হিন্দুদের নৈতিক অবস্থা এখন বেশ উঁচুতেই। মুসলমানদের বিরুদ্ধে গত কয়েক শতকে এটাই হচ্ছে তাদের একমাত্র জয়। এটা প্রশমন করতে আমাদের বেশ সময় লেগে যাবে। কিন্তু ভারতের এই ফুর্তি খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। তারা অচিরেই খুব গুরুতর কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্তত চারটি বিভাগের প্রয়োজন হবে।

যোগাযোগব্যবস্থা: যেসব রেল, সড়ক ও নৌপথ ভেঙে পড়েছে, সেগুলো আবার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শরণার্থীদের পুনর্বাসন করতে হবে। খাদ্যের সংকটকে মোকাবিলা করতে হবে। অন্তত ৩০ লাখ টন খাদ্যের সংস্থান করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি তবে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মালামাল ও সম্পদের ক্ষতি এবং ভেঙে পড়া শিল্প পুনর্বাসন করতে হবে। এতে বিপুল পরিমাণ খরচ হবে। আমার মনে হয় না, ভারত তা কুলিয়ে উঠতে পারবে। পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে আসার মূল্য বাঙালিরা অচিরেই টের পাবে।

আমাদের সেনারা আরও কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু ভারতীয়রা একবারে এক ব্রিগেড সেনা নামানোর মতো সক্ষমতা অর্জন করায় তারা দ্রুতই ঢাকাকে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়। ধারণা করা হচ্ছিল, মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ বেশিদিন নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারবে না। কমিউনিস্টরা দ্রুতই তাদের স্থান দখল করে নেবে এবং পরে নকশাল ও পশ্চিমবঙ্গের অন্য কমিউনিস্টদের সঙ্গেও হাত মেলাবে।

ডায়েরিজ অব ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান: ১৯৬৬-১৯৭২, সম্পাদনা: ক্রেইগ ব্যাক্সটার

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত