বিজ্ঞাপন
default-image

১৯৭১-এর ১ মার্চ থেকে ২০ বেলুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাকে আমার দুই কোম্পানি নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা (আইএস ডিউটি) রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয়। ৪ মার্চ ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, পিএসসি, উপ-আঞ্চলিক সামরিক প্রশাসক, ইস্টার্ন কমান্ডার সাহেবজাদা ইয়াকুবের টেলিফোনে দেওয়া অনুমোদনক্রমে চট্টগ্রাম শহরের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নেন। ক্যাপ্টেন মহসীন সার্কিট হাউসের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পান। আমাকে আমার দায়িত্বের অতিরিক্ত (আমার অফিস তখন নিয়াজ স্টেডিয়ামে, বর্তমানে এম এ আজিজ স্টেডিয়াম) উপ-আঞ্চলিক প্রশাসকের অফিস পালাক্রমে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। আমাদের দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলাম।

২৪ ও ২৫ মার্চ

রাজনীতিতে যেমন, তেমনি সেনাবাহিনীতে আমরা যারা বাঙালি ছিলাম আমাদের মধ্যেও, মার্চের শুরু থেকেই দিনগুলো ছিল খুবই ঘটনাবহুল। আমি এখানে ২৪ ও ২৫ মার্চের কথাই বলব।

২৪ মার্চ ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঢাকায় মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্টার বানানো হবে। দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রুপসকে শান্ত করার লক্ষ্যে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে দরবার নেওয়ার জন্য ঢাকায় নিয়ে যেতে দু-দুটি হেলিকপ্টারে করে ১৭ জন সিনিয়র অফিসার সকাল নয়টায় চট্টগ্রামে উপস্থিত হয়। কনফারেন্সের নামে তারা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে ঘিরে রাখল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার বাথরুমে যাওয়ার নাম করে বাইরে এসে হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আমাকে তারা ঢাকায় নিয়ে যেতে এসেছে—যদি হুকুম তামিল না করি, তাহলে তা হবে রিভোল্ট। বঙ্গবন্ধুকে নিজে আমাকে হুকুম দিতে হবে—তাড়াতাড়ি যাও শহরে গিয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করো।’ বলে উনি বাথরুমে চলে গেলেন। ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টার থেকে কর্নেল তাজ (জি-১ আই) টেলিফোনে বললেন, ক্যাপ্টেন আমীন যেন ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন। তাকে আর্মি এভিয়েশনে সিলেক্ট করা হয়েছে এবং করাচিতে পাঠানো হবে।

এদিকে মেজর বেগ নাকি হুকুম জারি করেছেন গাড়ির চাবিগুলো তার কাছে জমা করতে হবে। ধমক দেওয়াতে সিভিল ড্রাইভার সিভিল জিপ গাড়িটি নিয়ে এল। তাকে নিয়ে দ্রুত রেলওয়ে কলোনিতে ডিএস মুকবুল আহমেদের বাসায় গেলাম। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় আছেন। টেলিফোনে কর্নেল ওসমানীকে না পেয়ে মেসেজ রেখে (হুকুম তামিল করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকায় যাবেন কি যাবেন না) দ্রুত সেনানিবাসে ফিরে এলাম। মুকবুল ভাবি বললেন ‘কেন যাচ্ছেন?’ বললাম, “ঠিক জানি না। এখন অনেক তাড়া, তাই আর বসতে পারছি না। যদি মেসেজ আসে আমাকে টেলিফোনে শুধু ‘এসেছে’ বলবেন। আমি মেসেজ সংগ্রহ করিয়ে নেব। আম্মা পারলে বাবাকে খবরটা পাঠাবেন যে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে।” রুহে আফজার শরবত খেয়ে চলে এলাম।

ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিকের কাছেও মেসেজ পাঠালাম—আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অষ্টম বেঙ্গলে মেজর জিয়াকে খবর দিলাম, তিনি যেন হোল্ডিং কোম্পানিতে এসে আমাকে খবর দেন। বিষয়টি জরুরি। তিনি এসেছিলেন এবং ক্যাপ্টেন এনামের মাধ্যমে খবর দিয়েছিলেন। এনাম লাঞ্চের পর বলল, আমীন, মেজর জিয়া বেলা ১১টায় হোল্ডিং কোম্পানিতে তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে গেছেন। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আমাদের যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। সকালবেলায় শহরে যাওয়ার আগে দৌড়ে সিএমএইচে অসুস্থ কর্নেল এম আর চৌধুরীর কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছে। আপনি অসুস্থ, তবু তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পরে থাকুন।’ তিনি বললেন, ‘দুই কোম্পানি তৈরি করে রাখো, প্রয়োজনে রেইড করে হলেও ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে তাদের খপ্পর থেকে বের করে আনতে হবে।’ পোর্টে তখন জেনারেল মিঠ্ঠা ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে (সঙ্গে ক্যাপ্টেন মহসীন) সামনে বসিয়ে টেবিল থাবড়িয়ে বলছেন, ‘আনলোড সোয়াত।’

লাঞ্চের সময় কর্নেল জানজুয়া বললেন, ‘আমীন, ডু ইউ সি মাই টুআইসি?’ উত্তরে বললাম, এখানে ইউনিট অধিনায়ক এবং লে. কর্নেল পদবি ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। টুআইসির আসার কথা নয়। কর্নেল জানজুয়ার সঙ্গে ১৯৬৭/৬৮ সালে জয়দেবপুর ও লাহোরে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে একসঙ্গে চাকরি করেছি। সে সুবাদে যথেষ্ট হূদ্যতা ছিল। দেখি, ডিসি মোস্তাফিজুর রহমানও এসেছেন। নায়েক ক্লার্ক মিজান এবং অন্যরা মেসের বাইরে অপেক্ষা করছে। কাঁদো কাঁদো স্বরে ওরা বলল, ‘স্যার, আপনারা যাবেন না। এদেরকে বিশ্বাস করবেন না। ট্রুপস-কোথ (অস্ত্রাগার) থেকে হাতিয়ার বের করে পাহাড়ে পাহাড়ে অবস্থান নিয়ে ফেলেছি। হেলিকপ্টার দুটি মুহূর্তের মধ্যে উড়িয়ে দেওয়া যাবে।’ মেসে তখন সেন্টারের ব্যান্ড মিউজিক বাজছিল। ওরা বলল, ‘ব্যান্ডের সব সৈনিক পোশাকের ভেতর লোডেড অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছে—হুকুম দিলে এখান থেকে একজনও জীবিত যেতে পারবে না।’

সংবিত ফিরে যখন ওপরে পাহাড়ের দিকে তাকালাম, তাকিয়ে চমকে উঠলাম। সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল প্রায়। সে সময় মেসে লাঞ্চ করার জন্য জেনারেল জানজুয়া, খোদদাদ, খাদিম হুসেন রাজা, কমান্ডার মোমতাজ, ব্রিগেডিয়ার আনসারী বাবর, যুদ্ধজাহাজের কমান্ডার আজিমসহ প্রায় ১৭ জন সিনিয়র অফিসার উপস্থিত। বস্তুত জেনারেল টিক্কা খানসহ হাতেগোনা চার-পাঁচজন সিনিয়র অফিসার বাদ দিলে ইস্টার্ন কমান্ডের সংশ্লিষ্ট কমান্ডার তখন চট্টগ্রামে কর্মরত সব সিনিয়র অফিসারসহ (বাঙালি/অবাঙালি) আমাদের সঙ্গে লাঞ্চ করছিলেন। ঢাকা থেকে আগত হেলিকপ্টার দুটি প্যারেড-গ্রাউন্ডে পার্ক করে আছে। অবশ্য দুটি ট্যাঙ্ক ইবিআরসির মেইন রাস্তা ও প্যারেড গ্রাউন্ডের পাশে অবস্থান নিয়ে মোটামুটি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাড়ি ও মেসের দিকে ব্যারেল তাক করে আছে। পূর্বাহ্নে ট্যাঙ্কের বাঙালি ড্রাইভাররা ট্যাঙ্কের ইঞ্জিনের ভেতর বালি ফেলে দিলে ট্যাঙ্ক অকেজো হয়ে যাবে বলে আমাদেরকে জানিয়েছিল। সেনানিবাসে তখন মোট তিনটি ট্যাঙ্ক ছিল ক্যাপ্টেন কেয়ানির অধীনে (ইবিআরসি মেসে কেয়ানি আমার পাশের রুমেই থাকত। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে কেয়ানি ক্যাপ্টেন এনাম আহম্মদ চৌধুরীকে তার ট্যাঙ্কে পুরে শেরশাহ কলোনি পর্যন্ত এনে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘স্যার ভাগো।’ প্রাণে বেঁচে যায় এনাম)।

কিন্তু কী করব, খুব দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছিলাম। আমাদের হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত যদি জাতির অন্য বিপদ বয়ে আনে? এদিকে এমন মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। দুই কূল রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। বড় অসহায় মনে হলো নিজেকে। ট্রুপস মনে করছে, আমরা ভীরু-কাপুরুষ। আর ট্রুপসের প্রচণ্ড গোসসার কারণ—তাদের সামনে দিয়ে তাদের কমান্ডারকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। একটা ঘোরের মধ্যে সময় কাটছিল। একসময় দৌড়ে আবার সিএমএইচে কর্নেল চৌধুরীর কাছে গেলাম। দেখি, তিনি হাতের ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। বললেন ‘যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?’ বললাম, ‘ঢাকায় মেসেজ পাঠিয়েছি, এখনো কোনো উত্তর আসেনি।’ তাঁকে বললাম, ঢাকায় পৌঁছে যদি সরাসরি অ্যারেস্ট না হই, মি. মুকবুলের বাসায় মেসেজ পাঠাব। গুলশানে মামা শাহ আলম চৌধুরীর বাসার টেলিফোন নম্বরও দিলাম তাঁকে। রাতে শহর থেকে যেন টেলিফোনে আমাদের খবর নিতে পারেন।

হেলিকপ্টারে ওঠার সময় সুবেদার সিরাজ ও সুবেদার মেজর রুহুল আমীন এলেন। সুবেদার সিরাজ বললেন, ‘স্যার, আপনাদের মতো বুদ্ধি আমাদের নেই। কিন্তু হলফ করে বলছি, এই হারামজাদারা আমাদের বলির পাঁঠার মতো ব্যবহার করবে। কেন যাচ্ছেন? ’৬৫ সালের যুদ্ধে প্রথম বেঙ্গল খেমকারানে অগ্রসরমাণ ভারতীয় ট্যাঙ্ককে ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে খেমকারান শহর দখল করেছিল। আজ নিজের ঘরে আমরা আমাদের কমান্ডারকে রক্ষা করতে পারব না? আপনারা যাবেন না, হুকুম দিন, এখনি ট্যাঙ্ক-হেলিকপ্টারে যা-কিছু আছে সব উড়িয়ে দেব।’ দূরে এমজিও জেনারেল জানজুয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে দেখছিল। বললাম, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্য এর সঙ্গে জড়িত। আমাদের একা কিছু করা ঠিক হবে না।’

ওরা প্রায় কেঁদে ফেলল। বলল, ‘খোদা না খাস্তা, ওরা যদি আপনাদেরকে হেলিকপ্টার থেকে ফেলে দেয়?’ হেলিকপ্টারে উঠে দেখি, প্রায় এক সেকশন আর্মড গার্ড। ওরা বাইরে আসেনি। বেচারারা গরমে প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে। হেলিকপ্টার কেউ হাউজ্যাক করতে চেষ্টা করলে সে অন্য কথা, তা না হলে বাইরে থেকে বাজুকা দিয়ে বা অয়েল ট্যাঙ্কে সরাসরি গুলি করলে হেলিকপ্টারসহ এসব গার্ড মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যেত। হেলিকপ্টার উড্ডয়নকালে জেনারেল জানজুয়া ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে একটু ধাক্কা মারলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার চমকে উঠলেন। মনে হলো জেনারেল জানজুয়া মুচকি হাসছিলেন।

ঢাকায় আমাদের ব্রিগেডিয়ার জাহাঞ্জেব আরবাবের বাসায় (স্টাফ রোড, বর্তমানে বাশার রোডের ৫৬ নম্বর বাড়ি, পরবর্তী সময়ে এজি হিসেবে উক্ত বাসায় প্রায় তিন বছর ছিলাম) নিয়ে যাওয়া হলো। বাসার ভেতরে লনে টেন্ট লাগিয়ে বহু অবাঙালি বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ অবস্থান করে ছিল। আমি মামার বাসায় যেতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার আরবাব বললেন, ‘বাচ্চু, সিটি ইজ নট সেইফ রেদার স্টে উইথ মি।’ এর ভেতর মামা ইঞ্জিনিয়ার শাহ আলম চৌধুরী গাড়ি নিয়ে এলে আমি জোর করে চলে আসি। কথাবার্তার একপর্যায়ে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার যখন বললেন, ‘আরবাব, আই হোপ কান্ট্রি ডাজন্ট নিড থার্ড ফ্ল্যাগ (ব্ল্যাক, পাক ও বাংলাদেশ)’, উত্তরে আরবাব বললেন, ‘গিভ মি টু কোম্পানি, আই ক্যান স্ট্রেইটেন আপ এভরিবডি ইনক্লুডিং ইউর বঙ্গবন্ধু।’

ব্রিগেডিয়ার মজুমদার পরে আস্তে আস্তে আমাকে বললেন, ‘আহাম্মকরা দুই কোম্পানি দিয়ে বাংলাদেশ জয়ের স্বপ্ন দেখছে।’ দুঃখ হলো পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডার কোম্পানি কমান্ডারের ওপরে উঠতে পারছিলেন না। পুরোপুরিভাবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জেনারেল নিয়াজিও কোম্পানি কমান্ডারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারছিলেন না। সমস্যা সমাধানের জন্য গভীর কোনো চিন্তাভাবনা তাদের ছিল বলে মনে হয়নি। তারা প্রচণ্ড সামরিক শক্তি প্রয়োগই এই জটিল রাজনৈতিক সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে মনে করছিল। ভেবেছিল তাতে অবাধ্য বাঙালিদের সমুচিত শাস্তিও দেওয়া হবে। যুদ্ধ চলাকালে লুট করার অপরাধে ব্রিগেডিয়ার আরবাবের কোর্ট মার্শাল হওয়ার কথা ছিল। পরে দেখা গেল, লুটেরা আরবাব লে. জেনারেল পদে পদোন্নতি পায়।

২৪ তারিখ রাতে মেজর জিয়া ও কর্নেল চৌধুরী মি. মুকবুলের বাসা হয়ে মি. শফীর (রেলওয়ের প্ল্যানিং অফিসার। পরে তাঁকে পাকবাহিনী ভীষণ অত্যাচার করে হত্যা করে) বাসা থেকে টেলিফোন করলেন। বললাম, এখনো আমাদের সরাসরি অ্যারেস্ট করেনি। তারা যদি একান্তই অ্যাকশনে যায়, তা কবে নাগাদ হতে পারে আগামীকাল বোঝা যাবে। বললাম, ক্যাপ্টেন রফিক একেবারে প্রাইম হয়ে আছেন এবং যেকোনো মুহূর্তে পাঞ্জাবিদের ওপর চড়াও হতে পারেন। এখন তাঁকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে বলা শ্রেয়ঃ। তা না হলে সবার অজান্তে উনি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। কর্নেল চৌধুরী তাঁর ভক্সওয়াগন গাড়ি করে মেজর জিয়াসহ ক্যাপ্টেন রফিকের কাছে গিয়ে তাঁকে স্টেন্ড ডাউন করে ফেলেন প্রায়। পরবর্তী সময়ে মনে হয়েছে, আগ বাড়িয়ে এই মেসেজটা দেওয়া আমার ঠিক হয়নি। মেজর জিয়া ও কর্নেল চৌধুরীর জ্ঞানবুদ্ধির ওপর সন্দেহ প্রকাশ করলেন ক্যাপ্টেন রফিক। স্বাধীনতার পরপরই মেজর রফিক মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি বই লেখেন (লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে)। তাঁর বইতে তিনি মেজর জিয়া ও কর্নেল চৌধুরীকে সেভাবে চিত্রিত করেছেন।

অন্যদিকে যুদ্ধের শুরুতে আমি আগরতলায় পৌঁছালে মেজর জিয়া আমাকে পাকিস্তানি চর সন্দেহে ভারতীয়দের ফায়ারিং স্কোয়াডে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মেজর জিয়া আমার প্রেরিত বার্তাটিকে একটি সুপরিকল্পিত স্যাবোটাজ বলে ধরে নিয়েছিলেন, তা না হলে ব্রিগেডিয়ার মজুমদার যেখানে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন সেখানে আমি কী করে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে পারলাম? নিশ্চয়ই পাকিস্তানিরা আমাকে প্ল্যান করে পাঠিয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান বহু বছর পাক গোয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করেছিলেন (ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও কর্নেল মুস্তাফিজের অধীনে)। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলে কোনোমতে ভারতীয়দের বদান্যতায় প্রাণে বেঁচে মেজর জিয়ার অধীনেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলাম।

২৫ মার্চ আটটার দিকে কর্নেল মুঈদের বাসায় ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও মামা শাহ আলম চৌধুরীসহ নাশতা খেলাম। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার জয়দেবপুরে দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন, ‘তুমি চট্টগ্রাম চলে যাও, কর্নেল চৌধুরীকে মেসেজ পাঠাও লাল ফিতা উড়িয়ে দিতে।’ অর্থাত্ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দেওয়া—এটা বললেন তিনি সকাল সাড়ে আটটার দিকে। বলেই তিনি গাড়িতে চেপে জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা দেন। আমি কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। মামার ভক্সভল ভিভা গাড়ি ও মামার বহু পুরোনো ও বিশ্বস্ত ড্রাইভার আহমেদ আলীকে (সে যে অবাঙালি, খেয়াল করিনি) নিয়ে প্রথমে গিয়ে রিপোর্ট করলাম এয়ার ফোর্সের মেডিকেল ইউনিটে। তারা ২৭ মার্চ রিপোর্ট করতে বললেন। জানতে চাইলাম, এই দুদিন কী করব?’ উত্তরে বললেন, ‘আয়েশ করো।’

মতিঝিলের হক ম্যানসনে মামার অফিস থেকে টেলিফোনে মিসেস মুকবুলকে সরাসরি বললাম, কর্নেল চৌধুরী এলে লাল ফিতা উড়িয়ে দিতে বলবেন। উনি বুঝতে পারেননি। একটু উঁচু স্বরে বললাম, ‘আমি যা বলছি হুবহু লিখুন—লাল ফিতা উড়িয়ে দাও।’ অন্য টেবিলে কর্মরত মামা শাহ আলম চৌধুরী চমকে আমার দিকে তাকালেন। সেনানিবাসে টেলিফোনে কাউকে পেলাম না। শহরে ক্যাপ্টেন এনামের আত্মীয় জয়নাল আবেদীন সাহেবের শ্যালক শহীদকে টেলিফোন করলাম। শহীদ বলল, শহরের চারদিকে জনতা ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রেখেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করে সেনানিবাসে যাওয়া যাবে না, তবে সে জানাল, হাজি ক্যাম্পের পাশের কাঁচা রাস্তা দিয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তার ভেসপাটি চালিয়ে নতুনপাড়ার আশপাশে আমাকে পৌঁছাতে পারবে। বললাম, রওনা দেওয়ার আগে আবার টেলিফোনে মেসেজ পাঠাব।

সেনানিবাসে আবার ফোন করে প্রথমে ক্যাপ্টেন মহসীনকে পেলাম। উনি কর্নেল চৌধুরীকে টেলিফোন দিলেন। কর্নেল বললেন, ষোলশহরে ট্রেনের বগি দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করে জনতা সেনানিবাসের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলেছে। এমনকি গত রাতে তিনি তাঁর ভক্সওয়াগন গাড়িটি রেখে হেঁটে সেনানিবাসে ফেরত আসেন। বললাম, বস লাল ফিতা উড়িয়ে দিতে বলছেন। উত্তরে তিনি বললেন, এ ধরনের কাজের কথা বস সরাসরি বললে ভালো হয়। বললাম, বিকেলের মধ্যে তাঁকে দিয়ে বলানো যাবে।

এরপর আমি কর্নেল ওসমানীর কাছে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে সম্ভবত ৭ নম্বর রোডের ৬০ নম্বর এক বাড়িতে গেলাম। বললাম, গাড়ি নিয়ে এসেছি এখনই চট্টগ্রামে শিফট করতে হবে। উনি ওপরে-নিচে অনেক ছোটাছুটি করলেন। তখন সকাল সাড়ে ১০টার মতো বাজে। বললেন, ইয়াহিয়া খান একটা অ্যানাউন্সম্যান্ট দেবেন আজ রাত আটটা অথবা কাল দুপুর একটার মধ্যে। একটু ধৈর্য ধরতে বললেন, সঠিক মনোভাবটা জানার পরই এ ধরনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে সোজা গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে আ স ম আবদুর রব এবং অন্যরা ছিলেন। বললাম, ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে কেন ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে, কেন অগণিত মানুষের ব্যারিকেড উপেক্ষা করে সোয়াত আনলোড করার জন্য পাক আর্মি মরিয়া হয়ে উঠেছে, বৈঠকের ফলাফল কী হলো ইত্যাদি। তাঁরা নাকি বিকেলে একটি ইমার্জেন্সি বুলেটিন বের করেছিলেন।

বিকেল চারটার দিকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সঙ্গে দেখা করি ধানমন্ডিতে তাঁর বড় ভাইয়ের বাড়িতে। আমি কেন চট্টগ্রাম যাইনি, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ভীষণ রাগ করলেন। বললাম, কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেছি, গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম, তাঁকে নিয়ে চট্টগ্রাম চলে যাব। উনি ধৈর্য ধরতে বললেন। তাই এখন পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের অপেক্ষা করে আছি পরবর্তী আদেশের জন্য। এও বললাম, কর্নেল চৌধুরী সরাসরি ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের মুখ থেকে/টেলিফোনে আদেশের প্রত্যাশী। আমি এখন চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দিতে পারি। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার আমাকে সন্ধ্যায় কর্নেল মুঈদের বাসায় যেতে বললেন। সেখান থেকে কর্নেল চৌধুরীর সঙ্গে উনি কথা বললেন। কর্নেল মুঈদের বাসা থেকে উনি ওনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারলেও কর্নেল চৌধুরীর সঙ্গে পারলেন না। তাঁর নাম্বার (থ্রি থ্রি) চাইলে বলা হলো—লাইন ডাউন।

রাত নয়টার দিকে সেনানিবাস ছেড়ে শহরের দিকে যেতে চাইলাম। ড্রাইভার আহম্মদ বলল, ‘সাব, সামনে রাস্তার পর পাবলিক নে ব্যারিকেড দে রাহা হ্যায়। আজ রাত ম্যায় শহর ম্যায় বহুত গরবর হো সেক্তা—ঘর অপাস চলে।’ সে গাড়ি ঘুরিয়ে আমাকে গুলশানে মামার বাসায় পৌঁছে দেয়। সেনানিবাস থেকে বের হওয়ার সময় মনে হলো, চারদিক বেশ অন্ধকার।

মধ্যরাতে গোলাগুলির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসলাম। মামা-মামিসহ সবাই জেগে ওঠে। রাতটি কাটে সন্ত্রস্ত অবস্থায়। সমস্ত শহরে মিলিটারি অপারেশন চলছে। বাইরে, বহুদূরে সারা আকাশ থেকে থেকে লাল হয়ে উঠছে।

এর পরের ঘটনা আর এক দিন, অন্য কোনো সময়ে।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত