বিজ্ঞাপন
default-image

বাংলাদেশ বাহিনীর প্রথম পদাতিক ব্রিগেড গঠনের পর ব্রিগেড কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমানের এক যৌথ নির্দেশ অনুযায়ী নকশি বিওপির ওপর আক্রমণের দায়িত্ব বর্তায় অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর। নকশি বিওপি জামালপুর মহকুমার ঝিনাইগাতি থানার অন্তর্গত। এলাকাটি শালবন আচ্ছাদিত এবং সমতলভূমি থেকে কিছুটা উঁচু টিলাসংবলিত। আশপাশে টিলার মাঝখানে কিছুটা নিচু ভূমিতে ছিল নকশি বিওপির অবস্থান।

পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত তিনটা ৪৫ মিনিটে আর্টিলারি ফায়ার শুরু করার সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠে। নিজেদের আর্টিলারির তিনটি গোলা ভুল করে আক্রমণ শুরুর স্থানে (এফইউপিতে) এসে পড়ায় আমাদের ছয়জন সেনা হতাহত হয়। ফলে ওই প্লাটুনে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এবং প্লাটুনের সদস্যরা আহত সেনাদের সেবার নামে এফইউপিতেই থেকে যাওয়ার চেষ্টা করে। প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে আমাদের আর্টিলারি গর্জে ওঠার মিনিট খানেকের ভেতর পাকিস্তানি আর্টিলারি গর্জে ওঠে। একবার মাটিতে শুয়ে পড়ে তারপর আবার দাঁড়িয়ে অগ্রসর হওয়া যথেষ্ট সাহসের কাজ বৈকি, বিশেষ করে আমার দুই কোম্পানির জন্য। কারণ, আমার দুই কোম্পানিতে (অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল) ৩০০ জনের মধ্যে শুধু ১০ জন সামরিক বাহিনীর লোক গোটা আটেক ইপিআর এবং দু-তিনজন পুলিশের লোক ছাড়া বাকি সবাই সাত দিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত গ্রাম বাংলার একান্ত সাধারণ মানুষ। এদিকে হালজাতি গ্রাম থেকে ইপিআরে দুটি প্লাটুন শত্রুকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে এবং আক্রমণব্যূহ রচনা করে শত্রুদের ঘাবড়ে দেয়। এই সুযোগে আক্রমণকারী দল ৫০০ গজ দূরে নালার কাছে পৌঁছালে আমি মর্টার গ্রুপকে নালার পাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে ৩০০ গজ দূরবর্তী শত্রুশিবিরে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দিই।

default-image

এই নির্দেশের সুযোগে স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় সব সেনাই নালার আড়ালে অবস্থান নিয়ে মাথা নিচু করে অনুমানের ভিত্তিতে ফায়ার করতে থাকে। নালায় আমার সেনাদের এমন কাণ্ড দেখে শত্রুশিবিরের নিকটবর্তী এসেও আমি চিত্কার না করে পারিনি। এমনকি কলার চেপে ধরে এবং জোর করে আগে পাঠাতে শুরু করি। আমার বাঁ দিকে হাবিলদার নাছির তাঁর সেকশন নিয়ে অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে ক্ষিপ্তগতিতে এগোতে থাকেন। এবং আমি নিজে নায়েক সিরাজকে সঙ্গে করে ডানে বাংকারের দিকে এগোতে থাকি। আমাদের এই মনোবল দেখে শত্রুরা তখন পলায়নরত। ইতিমধ্যে আমরা অ্যাসল্ট লাইন ফর্ম করে চার্জ বলে হুংকার দিতেই মুহূর্তে ‘ইয়া আলী’ বলে আমার সেনারা সঙ্গিন উঁচু করে বেয়নেট চার্জের জন্য রীতিমতো দৌড়াতে শুরু করে। তাদের উত্তেজনাকে বাড়ানোর জন্য নায়েব সুবেদার মুসলিম ‘নারায়ে তকবির’ ধ্বনি করলে সেনারা ঘন ঘন ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি করে পুরো যুদ্ধের ময়দানকে প্রকম্পিত করে তোলে। আমরা যখন শত্রুশিবিরের মাত্র ১০০ গজের মধ্যে পৌঁছে যাই, ঠিক তখনই শত্রুর নিক্ষিপ্ত একটি আর্টিলারি শেল এসে আমাদের ওপর বিস্ফোরিত হলে সঙ্গে সঙ্গে বেশ কয়েকজন ঢলে পড়ল, যার ভেতরে সম্ভবত হাবিলদার নাসিরও ছিল।

আমাদের সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, আমার ডান পায়ে এসে একটা শেল লাগল।

আঘাতটার গুরুত্ব উপলব্দি করার আগেই জোশের সঙ্গে আরও ৫০ গজ এগিয়ে যাই এবং ছত্রভঙ্গ অবস্থায় আমাদের ছেলেরাও এগিয়ে গিয়ে পলায়নরত শত্রুসেনাদের আঘাত করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষেও তখন হতাহতের ঘটনা ঘটছিল। কেউ মাইন বিস্ফোরণে, কেউ বা গুলিতে হতাহত হচ্ছিল। আমি আরও অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করি এবং হঠাত্ বাঁ পায়ে বাঁশের কঞ্চি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে যাই। একই সময়ে বাঁ দিক থেকে এক পাকিস্তানি সেনা সঙ্গিন উঁচু করে আমার দিকে বন্দুক তাক করে আসতে থাকে। এমন সময় অল্প বয়স্ক ছেলে সালাম (অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র এবং এক সুবেদার মেজরের ছেলে) সেই পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যা করে।

মাটিতে পড়ে গিয়ে আমি দুটি ধাবমান শত্রুকে গুলি করে ডান দিকের বাংকারে অবস্থানরত শত্রুসেনাকে গুলি করার জন্য বিহারি ছেলে হানিফকে ঘন ঘন নির্দেশ দিচ্ছিলাম। ওই একটি বাংকারে অবস্থিত শত্রুর নিখুঁত গুলিবর্ষণ আমাদের ভীষণভাবে ঘায়েল করছিল, অন্য বাংকারগুলো থেকে গুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। সম্ভবত কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছিল অথবা পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। হানিফ বারবার অনুরোধ করছিল, ‘স্যার, আব পিছে চলে যাইয়ে, ম্যায় কভারিং দে রাহাহু।’ হানিফকে দ্বিতীয়বার নির্দেশ দেওয়ার আগেই হিসিং শব্দ হলো। আমি হানিফকে মৃদু আঘাত করে ডাকলাম ‘হানিফ’— কোনো উত্তর এল না।

সঙ্গে সঙ্গেই শত্রুর গুলিতে আমার পাশের মাটি উড়ে গেল, শত্রু আমায় দেখে ফেলেছে বুঝতে পেরে সাইডরোল করে সরে যাওয়ার চেষ্টা করি। এমন সময় বাঁ দিক থেকে একটা গুলি এসে আমার ডান হাতের কনুইয়ে লাগে, ফলে হাতের স্টেন ছিটকে পড়ে, বাঁ হাতে তা কুড়িয়ে নিলাম। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। ফিল্ড ড্রেসিংটা বের করব, এক ঝাঁক গুলি এসে পাশের জমির আইলটা উড়িয়ে দিল। বুঝতে পারলাম শত্রুর এত কাছে থাকা সম্ভব না। আমাদের যে আট-দশজন লোক শত্রু বাংকারে ঢুকে পড়েছিল এয়ার ব্রাস্ট আর্টিলারি ফায়ারে তারা ধরাশায়ী হলো।

তার মধ্যে নায়েক সিরাজ এবং পুলিশের ল্যান্সনায়েক সুজা মিয়াও ছিল। ফিল্ড ড্রেসিং বের না করে সাইড রোল শুরু করার কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি আসলে ডানে না গিয়ে আমি কোনাকোনি শত্রুশিবিরের দিকেই যাচ্ছি। মাথাটা ঠান্ডা রেখে লক্ষ্য ঠিক করে নিলাম। উদ্দেশ্য হাজার গজ দূরে শালবন এলাকায় পৌঁছাতে হবে। ক্রল শুরু করব, এমন সময় দেখি বাচ্চা ছেলে সালাম হঠাত্ করে দৌড়ে এসে পড়ে থাকা একটি এলএমজি নিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে হুংকার দিয়ে শত্রুবেষ্টনীর দিকে ধাবিত হলো। চিত্কার করে বলছিল, ‘তোরা আমার মা-বাপ, ভাই-বোন সবাইকে মেরেছিস, আমি ছেড়ে দেব?’ কিছুক্ষণ আগে যে আমার জীবন রক্ষা করেছিল, সেই সালামকে আর ফিরিয়ে আনতে পারিনি। অথচ বাচ্চা বলে এবং তার সংসারে একমাত্র জীবিত ব্যক্তি বলে আমি তাকে যুদ্ধে শামিল করিনি, কিন্তু সে পালিয়ে এসে অ্যাসেম্বলি এরিয়ায় আমাদের সঙ্গে চুপি চুপি যোগ দেয়।

শালবনে অবস্থানরত আমাদের মেশিনগান তখন ঘন ঘন গর্জে উঠছে: সম্ভবত আমার পশ্চাদ অনুসরণ সেনাদের কাভারিং ফায়ার দিচ্ছিল। তাই আমি নিজেদের ফায়ার

থেকে বাঁচার জন্য ডানে অপেক্ষাকৃত নিচু ধানখেতের ভেতর দিয়ে এগোতে শুরু করি। নালার কাছে পৌঁছে সব শক্তি নিয়োগ করে খাড়া হয়ে টলতে টলতে কেমন করে জানি নালাটা পার হয়ে গেলাম। শরীরটা ক্রমেই ঠান্ডা হয়ে আসছিল। তাই বুঝি সমস্ত জোর দিয়ে খাড়া হয়ে দৌড় দিতে চেষ্টা করলাম। দু-এক কদম যাওয়ার আগেই এক ঝাঁক গুলি আমার পায়ের কাছের মাটি উড়িয়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে মাটির ওপর পড়ে গেলাম। শত্রুর আর গুলি আসছে না দেখে স্বস্তি বোধ করলাম। কিন্তু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার আগেই টের পেলাম ১০-১২ জন শত্রুসেনা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। বোধ হয় ঠেলে ঠেলে আসার ফলে কর্দমাক্ত মাটিতে রাস্তা হয়ে গিয়েছিল আমার পালানোর পথ। সঙ্গে হাতের ও পায়ের রক্ত বেশি করে চিহ্নিত করছিল সেই পথকে। পাশের ধানখেত থেকে একজন আহত সৈনিক বলছিল, ‘আই বাঁচতে চাই, আঁরে লই যা’—অগ্রসরমাণ শত্রু তাকে খতম করে দিল। প্রায় ৩০০ গজ আসার পর ধানখেত শেষ হয়ে গেল। এর পরের ২০০ গজ সম্পূর্ণ খোলা ময়দান। হাতে বাঁধা কর্দমাক্ত ঘড়ির দিকে তাকালাম সকাল আটটা ১০ মিনিট। শত্রু তখন ৫০ গজ দূরে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। শেষবারের মতো টেনেহিঁচড়ে নিজের বিক্ষত দেহটাকে আর্টিলারি শেলে সৃষ্ট একটি গর্তে নিয়ে গেলাম। শত্রু যাতে সহজে দেখতে না পায় সে জন্য গলা পর্যন্ত ধীরে ধীরে লেপে দিলাম। স্টিল হেলমেট মাথার নিচে দিয়ে চরম মুহূর্তের অপেক্ষায় রইলাম। ঠিক এমন সময় আমার কমান্ডিং অফিসার মেজর আমীনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল শালবন থেকে—‘আমীন, আস্তে আস্তে আসার চেষ্টা করো’ আহত হওয়ার তিন ঘণ্টা পর এই প্রথমবারের মতো সক্রিয় সাহায্য পেলাম।

স্টেনগানটিকে আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে স্ট্রেচারের মতো করে একটু ওপরের দিকে তুলে ধীরে ধীরে টানতে শুরু করলেন। ডান পায়ের ব্যথায় ঢুকরে উঠলেও দাঁত কামড়ে রইলাম। লেফটেন্যান্ট মোদাসেসর তখন চিত্কার করছে শালবন থেকে, ‘তাড়াতাড়ি করেন স্যার’। শত্রুরা তখন আমাদের ২০-২৫ গজ পেছনে একজন আহত জওয়ানকে হত্যা করে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে। আমাদের দুই এলএমজিওয়ালা কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘আপনাদের ধরে ফেলবে স্যার’। দাঁত খিঁচিয়ে মেজর আমিন বললেন, ‘বেটা ফায়ার কর’। আমাদের ওপর দিয়ে ফায়ার করতে হবে তাই আমাদের জওয়ানরা ইতস্তত করছিল। শত্রু তখন আমাদের ওপর চার্জ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে এলএমজি গর্জে উঠল। ছয়-সাতটি খানসেনা তত্ক্ষণাত্ লুটিয়ে পড়ল। মকবুল আর তার সাথি দালালকে আমরা হাতেনাতে ধরে ফেললাম। দুটি খানসেনা পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর আর্টিলারি ফায়ার এসে পড়তে লাগল। আর্টিলারি ফায়ারের মধ্যে মেজর আমীন আমায় কাঁধে নিতে চেষ্টা করলেন কিন্তু পরিশ্রান্ত থাকায় তিনি নিজেই আমায় নিয়ে নালায় পড়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত আমি জোর করে তাহেরের দিকে হাত বাড়ালাম এবং সে আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে বলল, ‘স্যার চিন্তা করবেন না, মরলে দুইজন একসঙ্গে মরব’ বলেই দিল ভোঁ এক দৌড়। দৌড়ে রেজিমেন্টাল এইড পোস্টে পৌঁছে যায়। আরওপি থেকে জিওসি গুর বক্স সিংহ গীল তাঁর হেলিকপ্টারে করে আমাকে গৌহাটি সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যান।

যুদ্ধে আমাদের পক্ষে ৩৫ জন হতাহত হয়, যার ভেতর যুদ্ধের ময়দানে ১২ জনের লাশ থেকে যায়, বাকি আহত সেনাদের গৌহাটি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।

 মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী

বীর বিক্রম: অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার (আগস্ট পর্যন্ত); সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সামরিক বিশ্লেষক

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৩ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত