বিজ্ঞাপন
default-image

শক্তসমর্থ শরীর দেখে বয়স পঞ্চাশের বেশি বলে মনে হয় না, অথচ তিনি জানাচ্ছেন কয়েক মাস আগেই ৬৫ হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যবান, গোঁফ, পরনে কাবলি—এমনই টিপিক্যাল পাকিস্তানি চেহারা যে, অন্তত পাকিস্তানের রাস্তায় দেখা হলে দ্বিতীয়বার তাকানোর কোনো কারণই নেই। অথচ নিজের হোটেল রুমে আমন্ত্রণ জানিয়ে চা-টা দিয়ে আপ্যায়ন করে এই যে এমন আগ্রহভরে তার কথা শুনছি, তার কারণ একটাই। এই ভদ্রলোকের দাবি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনিই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।

ভদ্রলোকের নাম? না, অনেক পীড়াপীড়ির পরও নাম বলতে রাজি নন। যতবারই জিজ্ঞেস করি, রেকর্ড করা কথার মতো একই উত্তর: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বিভাগে নাম লেখানোর সময় কোরআন ছুঁয়ে নাম-পরিচয় না জানানোর শপথ করানো হয়েছে। সেই শপথ তিনি ভাঙতে পারবেন না। মিনিট পঁয়ত্রিশের আলাপচারিতায় বারবারই বললেন, ‘এই যে আপনার কাছে শেখ মুজিবকে ধরে আনার গল্প বলছি, এটাও অন্যায় হচ্ছে।’ সেই ‘অন্যায়’ কেন করছেন, সেটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন শুরুতেই। পাশে বসে থাকা বছর পঁয়তাল্লিশের সঙ্গীর দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘ও অনেক দিনের পরিচিত, ওর পীড়াপীড়িতেই আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছি।’

সঙ্গীর নাম মোহাম্মদ তারিক, ফয়সালাবাদে আমাদের আবাস হোটেল প্রাইমের একটু দূরেই তার ফুলের দোকান। একদিন কীভাবে যেন রুমমেট এনটিভির ক্রীড়া সম্পাদক সাইফুর রহমান খোকনের তার সঙ্গে পরিচয়। বাংলাদেশের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তারিকই খোকনকে জানান, প্রতিদিন সকালে তাকে ফুল সাপ্লাই দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কমান্ডো, সুযোগ পেলেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে ধরে আনার গল্প শোনান। দু-তিন দিন ওই ফুলওয়ালার পেছনে লেগে থেকে ওই কমান্ডোকে প্রাইম হোটেলে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করার কৃতিত্বও খোকনেরই। এটা গত জানুয়ারির কথা, ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর কভার করতে আমরা তখন লাহোর হয়ে ফয়সালাবাদে।

কমান্ডো ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের পর সৌজন্য বিনিময় হলো, বাংলাদেশি পেলেই যেকোনো পাকিস্তানির অবধারিত প্রথম প্রশ্ন ‘আপ মুসলমান হ্যায়’ও হয়ে গেল। তাকে আমন্ত্রণ জানানো দুজনের একজন মুসলমান নন জেনে একটু হতাশাও যেন খেলা করে গেল তার চোখে-মুখে। সেই একজনকেই খাতা-কলম খুলে বসতে দেখে কমান্ডোকে এমন সংকুচিত দেখাল যে, ভয় হলো, প্রথমেই ২৫ মার্চের রাতে চলে গেলে পুরো আয়োজনই না ভেস্তে যায়! এই আশঙ্কাতেই কোথায় থাকেন, ছেলেমেয়ে কয়জন, সেনাবাহিনীতে কবে যোগ দিলেন, ফুলের বাগানে কি শুধু গোলাপই চাষ করেন—এমন সব নিরাপদ বিষয় দিয়ে কথা শুরু করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো। গভীর মনোযোগে সেসবের নোটও নিলাম। তাতেই জানলাম, বাপ-দাদার আদি বাড়ি ছিল ভারতের জলন্ধরে, দেশভাগের পর ফয়সালাবাদে চলে আসে তার পরিবার। এসে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। কারণ জলন্ধরে যে জমিজমা ছিল, ফয়সালাবাদে জুটেছিল তার চার ভাগের এক ভাগ। সংসারের অভাবের তাড়নায় ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেই তাই যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ’৬৭ সালে নির্বাচিত হন কমান্ডো হিসেবে। সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থাতেই গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। সেটি প্রমাণ করতেই কিনা, এতক্ষণ উর্দুতে কথা বলতে বলতে এই তথ্যটা জানালেন পরিষ্কার ইংরেজিতে! ১৯৭৬ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছেন, ফয়সালাবাদ শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ফুলের বাগানের বাণিজ্যিক ব্যবহারই এখন তার জীবিকা।

খুব গর্বভরে জানালেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো বিভাগের প্রধান মেজর জেনারেল মিট্ঠা খান তাকে খুব স্নেহ করতেন। তার নির্দেশেই ১৯৭০ সালের জুলাইয়ে প্রথম বাংলাদেশে আসেন, পাঠানোর আগে তাকে বলা হয়েছিল, ‘ওখানে খুব গণ্ডগোল চলছে। তোমাদের হাতে অনেক কাজ।’ সেবার সাত দিন থাকাকালীন ‘গণ্ডগোল’-এর প্রমাণ ভালোই পেয়েছিলেন, তবে সেটি উত্তপ্ত থেকে উত্তপ্ততর হয়ে উঠতে উঠতেই পেশোয়ারে কমান্ডো হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ পান। আবার আসেন একাত্তরে, উত্তপ্ত ঢাকার একটা বর্ণনাও (‘অনেক লাশ দেখেছি’, ‘রাস্তায় গাড়ি পুড়তেও দেখেছি অনেক’) শোনা গেল তার মুখ থেকে। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে ততক্ষণে শপথ-টপথ ভুলে কথা বলার দারুণ মুডে পেয়ে বসেছে কমান্ডোকে। মোক্ষম সময় বুঝে জিজ্ঞেস করলাম—এবার ২৫ মার্চ রাতের কথা বলুন, বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে গ্রেপ্তার করলেন? একটা সিগারেট ধরানোর জন্য যখন বিরতি নিলেন, ভয় হলো, আবার না তার শপথের কথা মনে পড়ে যায়! তা অবশ্য হলো না, সিগারেটে একটা টান দিয়ে ‘তাহলে শুনুন’ বলে তিনি সেই রাতের বর্ণনা শুরু করলেন। তার মুখেই শুনুন:

‘ঢাকায় আমরা ছিলাম তেজগাঁও এয়ার বেসে। ২৫ মার্চ রাত ১১টা-সাড়ে ১১টার দিকে সেখানেই হঠাত্ নির্দেশ এল শেখ মুজিবকে ধরতে যেতে হবে। নির্দেশ দিয়ে আমাদের কমান্ডার ক্যাপ্টেন বেলাল বললেন, ‘যদি ঢাকা ধ্বংসও হয়ে যায়, তাও শেখ মুজিবকে জীবিত ধরতে হবে’। নির্দেশ পেয়ে আমরা জিপে করে ধানমন্ডিতে ‘দাখিল হো গিয়া’। এ কাজের জন্য ১০ জন কমান্ডোই যথেষ্ট ছিল, অথচ যেতে বলা হলো ২০০ কমান্ডোকে। এটা বোধহয় একটা রেকর্ডই, একজন লোককে ধরার জন্য কখনো কোথাও এতজন কমান্ডো পাঠানো হয়েছে বলে আমার মনে হয় না!

‘জিপে করে শেখ মুজিবের বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। অনেকের হাতেই অস্ত্র। আমরা অটোমেটিক মেশিনগান চালিয়ে দিলাম, কতজন মরল তা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। বাড়ির ভেতরে ঢুকে শেখ মুজিবকে ধরার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বাড়িতে ঢুকে তো আর তাকে খুঁজে পাই না। এ-রুম থেকে ও-রুমে ঘুরতে ঘুরতে এক রুমে একটা মেয়েকে পেলাম, কাজের মেয়ে-টেয়ে হবে, নামটা এখনো মনে আছে—শকুন্তলা। ও প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিল না, চুলের মুঠি ধরে অস্ত্র ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করার পর কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমাকে মেরো না, শেখ মুজিব কোথায়, বলছি।’ ওই ‘লাড়কি’ই একটা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আন্ডারগ্রাউন্ডের একটা রুমে নিয়ে গেল। শেখ মুজিব সেখানে একাই ছিলেন। তার পরনে ছিল কোট-প্যান্ট-টাই। উনি আমাদের দেখেই বাংলায় গালাগালি দিতে শুরু করলেন। শকুন্তলাই আমাদের বলে যে, উনি গালি দিচ্ছেন। এরপরই শেখ মুজিব চিত্কার করে বলে ওঠেন, আমাকে কেউ ধরতে পারবে না। তবে মুখে তা বললেও হয়তো আমাদের হাতে অস্ত্র-টস্ত্র দেখেই খুব একটা বাধা দেননি। আমরা তাকে ধরে ছাদে নিয়ে আসি, সেখানে আগেই একটা হেলিকপ্টার নেমেছিল। হেলিকপ্টারে তুলে আমিই তাকে সিটের সঙ্গে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলি। উনি রাগে রীতিমতো ফুঁসছিলেন, লাথি মারারও চেষ্টা করছিলেন। হেলিকপ্টারে করে শেখ মুজিবকে তেজগাঁও এয়ার বেসে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে প্লেনে সরাসরি লায়ালপুরে (ফয়সালাবাদের তখনকার নাম) নিয়ে আসা হয়। প্লেনে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলাম আমরা দুজন—আমি আর জেনারেল আবদুল আলী। শেখ মুজিবকে লায়ালপুর জেলে পৌঁছে দেওয়ার পর আমার কাজ শেষ হয়ে যায়। আমি পেশোয়ারে আমাদের হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাই। বাংলাদেশের যুদ্ধের সঙ্গে আমার আর কোনো সংশ্রব ছিল না।’

‘কমান্ডো’ আর ‘তিনি’ করে লিখতে আর ভালো লাগছে না। এখন থেকে তাকে হাকিম মোহাম্মদ শরিফ নামেই ডাকা যাক। নামটা কীভাবে জানলাম? না, এত কথার পরও ওই কমান্ডো শপথ ভেঙে নিজের নাম বলেননি। পরে তার বন্ধু ওই ফুলওয়ালার কাছ থেকেই জেনেছি নামটা। তার তো আর শপথ-টপথের ঝামেলা নেই!

ইতিহাসবিদরা আরও ভালো বলতে পারবেন, তবে নিজে যত্সামান্য যা জানি, তাতেই মনে হলো, হাকিম মোহাম্মদ শরিফ বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার যে বর্ণনা দিলেন, তাতে বেশ কয়েকটা খটকার জায়গা আছে। সবচেয়ে বড় খটকা হেলিকপ্টারের অংশটুকু। ৩২ নম্বরের ছাদে হেলিকপ্টার নামিয়ে তাতে করে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল—এটা আগে কখনো শুনিনি। ৩২ নম্বরে আন্ডারগ্রাউন্ড-রুম আছে, এটাও না। বঙ্গবন্ধুকে যেখানে পাজামা-পাঞ্জাবির বাইরে বলতে গেলে দেখাই যেত না, তিনি নিজের বাড়িতে কোট-প্যান্ট-টাই পরে বসে থাকবেন, এটাই বা কেমন? ৩২ নম্বর থেকে সরাসরি এয়ার বেসে নিয়ে গিয়ে সে রাতেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়—এটিও কি ঠিক? বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) জেড এ খান তার ওয়ে ইট ওয়াজ বইয়ে লিখেছেন,

‘২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করার পর প্রথমে তাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাকে ১৪ ডিভিশন অফিসার্স মেসের একটি কক্ষে স্থানান্তর করা হয়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করার পরও শেখ মুজিবকে এখানেই রাখা হয়েছিল। সেটিকেও নিরাপদ মনে না হওয়ায় তাকে একটা স্কুল বিল্ডিংয়ের তিনতলায় নিয়ে রাখা হয়।’ জেড এ খানের বর্ণনা অনুযায়ী পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার আগে ঢাকায় তিনবার বঙ্গবন্ধুর জায়গা বদল করা হয়েছিল। অথচ হাকিম মোহাম্মদ শরিফের দাবি, ৩২ নম্বরের ছাদে হেলিকপ্টার, সেখান থেকে এয়ার বেস, এয়ার বেস থেকে সরাসরি লায়ালপুর!

প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা, স্মৃতি তো একটু প্রতারণা করতেই পারে। এমনও হতে পারে, শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে যাওয়া তার কাছে এমনই বীরত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, হেলিকপ্টার-টপ্টার যোগ করে তাতে আরও কিছু বীররস যোগ করতে চেয়েছেন হাকিম মোহাম্মদ শরিফ। কিন্তু সেই সংশয়ের কথা তুলতেই তিনি অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলে দিয়েছেন, ‘আরে, আমি নিজে শেখ মুজিবকে ধরে এনেছি, আর আমি জানি না!’

বঙ্গবন্ধুকে যে লায়ালপুরের জেলেই রাখা হয়েছিল, এটা অবশ্য ঐতিহাসিক সত্য। জেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলেন, এমন একজনেরও খোঁজ পেয়েছিলাম। তবে একটু দেরিতে, আমরা ফয়সালাবাদ থাকার সময়ই ওই লোকের চেহলাম হলো। করাচি-লাহোরে না নিয়ে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কেন ফয়সালাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাখ্যা হাকিম মোহাম্মদ শরিফের কাছ থেকেই জেনেছি। অন্য শহরগুলোতে এয়ারপোর্ট আর জেলের দূরত্ব অনেক। একমাত্র ফয়সালাবাদেই এয়ারপোর্টের ঠিক পাশে জেল, এয়ারপোর্ট থেকে বঙ্গবন্ধুকে জেলে নিয়ে যাওয়ার রাস্তাটুকু সেখানেই তাই সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। শুনে একটু অবাকই হলাম। বাংলাদেশে, মানে সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে না হয় ওসব ঝুঁকি-টুকির কথা ভাবার ব্যাপার ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পর আর কিসের ঝুঁকি? মোহাম্মদ শরিফ জানালেন, পশ্চিম পাকিস্তানেও আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক ছিল, শেখ মুজিবকে ধরে আনা হচ্ছে জানলে তারা কিছু করার চেষ্টা করতেও পারে—এমন ভয় নাকি ছিল!

পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ায় হাকিম মোহাম্মদ শরিফের দুঃখের শেষ নেই। সেই দুঃখটা বোঝালেন উপমা দিয়ে, ‘দুই ভাই যখন যুদ্ধ করে, দুই ভাইয়েরই দুঃখ হয়।’ এ জন্য কে দায়ী, সে ব্যাপারেও তার মনে কোনো সংশয় নেই। ‘ইয়াহিয়া-ভুট্টো বা শেখ মুজিব নয়। এমনকি কোনো জেনারেলও নয়। পাকিস্তান ভাঙার জন্য দায়ী ভারত ও আমেরিকা’—এ কথা শুনে যখন প্রশ্ন করলাম, ‘ভারত না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমেরিকা কেন? আমেরিকা তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষেই ছিল’, মোহাম্মদ শরিফ বললেন, ‘ওরা আমাদের সঙ্গে বেইমানি করেছে। সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েও কথা রাখেনি।’ কারণটা সম্পর্কে যেমন তিনি নিঃসন্দেহ (‘মুসলমানদের বিপক্ষে ওরা সবাই একজোট’), একই রকম নিঃসন্দেহ এই বিশ্বের ভবিষ্যত্ সম্পর্কেও (‘একটা সময় পুরো দুনিয়াই মুসলমানের রাজত্ব হবে’)।

পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় হাকিম মোহাম্মদ শরিফের যখন এত দুঃখ, শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর নিশ্চয়ই তার খুব রাগ! বিরূপ কোনো মন্তব্য করবেন বলে ভেবেছিলাম বলেই বেশি চমকে দিল উত্তরটা: ‘বিলকুল নেহি। ও ঠিক আদমি থা। মরদ থা।’

২.

সেই ১৯৯৬ সালে প্রথম। মাঝখানে আরও দুবার ক্রিকেটের সৌজন্যে যাওয়া হয়েছে পাকিস্তানে। আগের তিনবারও অনেক পাকিস্তানির সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ এসব প্রসঙ্গ এসেছে। বেশ কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ২০০৩ সালে মুলতানে বছর চল্লিশের এক লোকের সঙ্গে তো রীতিমতো কলহই বেধে গিয়েছিল। বাংলাদেশ থেকে—এই পরিচয় জানার পরই অদ্ভুত একটা হাসি, ‘ও, ইস্ট পাকিস্তান!’ পাকিস্তানে গেলে এটা শোনা অভ্যাস হয়ে যায়, তাই ভদ্রভাবেই বললাম, ‘ছিল’। জবাবে ওই লোকটি যখন হেসে বলল, ‘এখনো তা-ই আছে’, হঠাত্ করেই মাথায় রক্ত চড়ে গেল। ইংরেজি-উর্দু মিলিয়ে এমনই ঝড় বইয়ে দিলাম যে, হোটেল রিসিপশনে লোকজন জমে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড!

আরেকবার ইসলামাবাদে এক দাওয়াতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানে স্থায়ী এবং এর পরও সেখানেই থেকে যাওয়া এক বাঙালির মুখে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে বিষোদগার শুনে এমনই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, দাওয়াতের পরিবেশই নষ্ট হয়ে যাওয়ার উপক্রম।

তবে আগের তিনটি পাকিস্তান সফরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, এমন কারো দেখা পাইনি। আর এবার আমার এমনই সৌভাগ্য—যেখানেই যাই, এমন কারো না কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! হাকিম মোহাম্মদ শরিফের কথা তো শুনলেনই, এর আগেই লাহোরে পরিচয় হয়েছে ইয়াকুব মাসিহর সঙ্গে।

এবার পাকিস্তান সফরটা আরেক দিক থেকেও ব্যতিক্রম। ক্রিকেট এমনই সময় খেয়ে নেওয়া খেলা যে, এটি কভার করতে বাইরে গেলে বিদেশ-দর্শন হোটেল আর মাঠেই সীমাবদ্ধ থাকে। আগে চার-পাঁচবার লাহোরে গিয়েছি, প্রায় প্রতিবারই ছয়-সাত দিন করে কাটানোর পরও এই শহরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মোগল ঐতিহ্যের কিছুই দেখা হয়নি। এবার লাহোরে পৌঁছেছি ঈদুল আজহার আগের রাতে। পরের দুই দিন ছুটি, ঈদের কারণে পত্রিকাও বন্ধ। এমন সুযোগ আর পাইনি কখনো। ঈদের দিন এনটিভির খোকন, চ্যানেল আইর অঘোর মণ্ডল আর আমি—বাংলাদেশের তিন সাংবাদিক মিলে তাই ছুটির ফুরফুরে মেজাজে শালামার গার্ডেন দেখতে বেরোলাম। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি পরা বছর পঞ্চাশের এক ট্যাক্সিচালক আমাদের গাইড, নাম সরফরাজ খান। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে গেল, বেশি পড়াশোনা না করলেও এই লোকটি টিপিক্যাল ধর্মান্ধ গোঁড়া পাকিস্তানিদের প্রতিনিধি নন। শালামার গার্ডেন শের শাহ নির্মিত সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের পাশে। যেতে যেতে সরফরাজ জানালেন, এই রাস্তার শেষ মাথাতেই পাঞ্জাবকে ভাগ করা বিখ্যাত ওয়াগা সীমান্ত। ওয়াগা সীমান্তের কথা এলে ভারতও আসতে বাধ্য এবং পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে এরপর বেশ কিছুক্ষণ ‘হিন্দুস্থান’ সম্পর্কে বিষোদগার শোনার মানসিক প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছি। অথচ সরফরাজ খান রীতিমতো চমকে দিয়ে বললেন, ‘এসব সীমান্ত-টীমান্ত তুলে দেওয়া উচিত। এসব থাকবে কেন? আমরা যখন ইচ্ছে ইন্ডিয়ায় যাব, ইন্ডিয়ানরা এখানে আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্য হবে। যুদ্ধ করে কার লাভ?’

সঙ্গে সঙ্গেই লোকটিকে খুব ভালো লেগে গেল। বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি জেনে সরফরাজই বললেন, তার এক বন্ধু একাত্তরে বাংলাদেশে যুদ্ধ করেছে। তার মুখে সব সময়ই ওই যুদ্ধ আর বাঙালিদের গল্প। আমাদের সঙ্গে দেখা হলে সে খুব খুশি হবে। একাত্তরে বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছে! এর আগে এমন কারো সঙ্গে কথা হয়নি, আমরাও তাই খুব আগ্রহী। সেই আগ্রহ মেটাতে খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না, হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে একটু দূরে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে ইঙ্গিত করে সরফরাজ খান বললেন, ‘দেখি, ও আছে কি না! সেও আমার মতো ট্যাক্সি চালায়।’ তার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম আমরাও, দেখা হলো ইয়াকুব মাসিহর সঙ্গে।

পরনে কফি রং কাবলি, গোবেচারা চেহারা, দেখে মনে হলো বয়স পঞ্চান্ন-টঞ্চান্ন হবে। ‘দেখো, কাদের নিয়ে এসেছি’ বলে সরফরাজ খান পরিচয় করে দিতেই সে কী উচ্ছ্বাস! আমাদের সঙ্গে হাত মেলাতে মেলাতে হলদেটে দাঁত বের করে হাসছেন আর শুধু বলে যাচ্ছেন: ‘বাঙালি’, ‘বাঙালি’, ‘জয় বাংলা’!

আপনি নাকি আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছেন—জিজ্ঞেস করতেই দু হাত জোড় করে বললেন, ‘করেছি। এখন কি আমাকে মারবে না কি?’ বলেই নিষ্পাপ হাসি। ‘আমি কি আর যুদ্ধ-টুদ্ধ করতে জানতাম নাকি, বাধ্য হয়ে করতে হয়েছে।’ সেটা কেমন? এটাই ইয়াকুব মাসিহর গল্প।

ইয়াকুব মাসিহরা খ্রিষ্টান, সেটি নিয়ে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা ছিল একটাই—জাতি-ধর্ম ভেদবিচার না করা দারিদ্র্য। বাবা ছিলেন এক দোকানের সাধারণ কর্মচারী। অভাবের সংসারে পড়াশোনার সুযোগও তেমন হয়নি। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে দুই বন্ধুকে নিয়ে কাজের খোঁজে করাচি থেকে জাহাজে চেপে চলে এলেন চট্টগ্রামে। সেখান থেকে আজ এখানে, কাল ওখানে। টুকটাক নানা কাজ করেছেন, এর মধ্যে রিকশা চালানোর কথা ভেবে এখনো মজা পান। ঘুরতে ঘুরতে যখন কুমিল্লায়, তখনই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। প্রাণের ভয়ে ইয়াকুব মাসিহ পাকিস্তান আর্মির ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিলেন। আশ্রয় মিলল, তবে বিনা শর্তে নয়। খাতায় নাম লিখিয়ে সেনাবাহিনীর লোকজন বলল—তোমাকে যুদ্ধ করতে হবে।

না করে ইয়াকুব মাসিহর উপায় ছিল না। কোথায়-কোথায় যুদ্ধ করেছেন, সব মনে নেই। তবে কুমিল্লা-ঢাকা-খুলনার কথা মনে আছে। আর মনে আছে ওই নয় মাসের দুঃস্বপ্নের কথা। সাদাসিধে নিরীহ এক যুবক, যুদ্ধ-টুদ্ধের মতো পাশবিক ব্যাপার তার ভালো লাগবে কেন? ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করার পর যখন ভারতে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, ইয়াকুব মাসিহ তখন যুদ্ধে পরাজয়ের জ্বালায় একটুও কাতর নন। বরং আর যুদ্ধ করতে হবে না জেনে মহা খুশি।

ওই ৯ মাসের যুদ্ধ আর একটা কাজ করেছে, বাঙালিদের নতুন করে চিনেছেন। সে চেনা এমনই যে, বাঙালির শৌর্য-বীর্যের রীতিমতো ভক্ত হয়ে গেছেন। ‘আমরা জানতাম, বাঙালিরা খুব ডরপোক, শুধু মাছ খায় আর পড়াশোনায় ভালো। ওরা যে এমন যুদ্ধ করতে পারে, সেটা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না’—বলেই এমন একটা ভঙ্গি করলেন যার অর্থ হতে পারে, বড় বাঁচা বেঁচে এসেছি। কী একটা জিজ্ঞেস করতে যাব, ‘মুক্তিবাহিনী’ শব্দটা দিয়ে প্রশ্নটা শুরু করতে যেতেই ইয়াকুব মাসিহ আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললেন, ‘বাপরে বাপ, মুক্তিবাহিনী! মুক্তিবাহিনীর কথা শুনলেই আমাদের কাঁপুনি শুরু হয়ে যেত।’ পাশে ছোট্ট একটা গাছে ঝাঁকি দিয়ে বললেন, ‘রাতের বেলায় গাছের পাতা নড়লেও আমরা মুক্তিবাহিনী ভেবে ভয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করে দিতাম।’

যুদ্ধের ৯ মাস যখন বাংলাদেশেই কাটিয়েছেন, পাকবাহিনীর অপকর্ম তো নিজের চোখেই দেখেছেন; কে জানে, ধর্ষণ-হত্যা-গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া এসবে হয়তো তারও অংশগ্রহণ ছিল। কথাটা বলতেই ইয়াকুব মাসিহ জিভে কামড় দিলেন, পরনের পাঞ্জাবিটা ওপরে তুলে ধরে বললেন, ‘এসব নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। নিজের কাপড় তুললে নিজেকেই ন্যাংটা হয়ে যেতে হয়।’ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বে এমনই মুগ্ধ যে, তাদেরকে বিশ্বের সব স্বাধীনতাকামী মানুষের আদর্শ বানিয়ে ফেলেছেন ইয়াকুব মাসিহ। ‘কাশ্মীরিরা যখন আজাদি নিয়ে চেঁচামেচি করে, আমি বলি, পারলে বাঙালিদের মতো হয় আজাদি নয় মৃত্যু—এমন সোজা হয়ে দাঁড়াও। আজাদি এত সহজ নয়।’

কথা বলছেন আর একটু পরপরই পীড়াপীড়ি করছেন, একটা কিছু খাওয়ার জন্য। যতই না করি, ততই অনুযোগ, ‘আমার ওপর রাগ আছে বলে খাবেন না?’ এর পরেও আরও দুই দিন দেখা হলো তার সঙ্গে। গাদ্দাফি স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে এলাম তার ট্যাক্সিতে। কিছুতেই ভাড়া নেবেন না, একটা কথাই বলে যাচ্ছেন বারবার, ‘আপ মেরা মেহমান হ্যায়!’ অনেক যুদ্ধ করে ভাড়া দিতে হলো।

এটা তো প্রীতিকর যুদ্ধ। ইয়াকুব মাসিহর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভাবছিলাম, আসল যে যুদ্ধ, সেটি আসলে কার সঙ্গে কার হয়! এই যে লোকটি, সব কিছু ছাপিয়ে যার সারল্যটাই মন ছুঁয়ে যাচ্ছে, তাকে যে অনেক চেষ্টা করেও শত্রু ভাবতে পারছি না। অথচ একাত্তরে তার সঙ্গে কোনো বাঙালির দেখা হওয়ার অর্থই হতো যেকোনো একজনের মৃত্যু!

যুদ্ধ এমনই! মানুষকে তা আর মানুষ বলে চিনতে দেয় না, শুধুই সংখ্যা বানিয়ে দেয়। বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে যাওয়া ওই কমান্ডো হাকিম মোহাম্মদ শরিফের কথাবার্তা একদমই ভালো লাগেনি। অথচ তারই একটা কথা রীতিমতো মনে গেঁথে আছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাই-ভাই ছিল, এখনো তা-ই আছে, দুই ভাইয়ের পৃথকান্ন হয়ে যাওয়ার কারণ একটাই, ভারতের ষড়যন্ত্র—এই প্যাঁচাল শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে মাত্রই একাত্তরে পাকিস্তানিদের অপকর্মের কথা বলতে শুরু করেছি, থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, ‘ওসব বলে কী লাভ! যুদ্ধ তো এ রকমই। গুলির কোনো চোখ নেই, মুখ নেই। গুলি দেখতে পায় না, কথা বলতে পারে না। সেটি যাকে সামনে পায়, তাকেই মারে।’

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত