যাঁরা অংশগ্রহণ করেন
নিশাত ফাতিমা, মার্কেটিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।
তাবাসসুম খানম নিশাদ, বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
মো. আবু আব্দুল্লাহ, তড়িত্ কৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
ফারজানা আক্তার, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ইডেন মহিলা কলেজ।
মো. আবদুল বাতেন সোহেল, গ্রাফিক ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনলজি।
সারা নাফিয়া অন্তরা, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।
মো. রেদুয়ানুর রহমান শামির, প্রাচ্যকলা বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সংগীতা আচার্য্য, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
সমন্বয়কারী: আনিসুল হক, উপসম্পাদক, প্রথম আলো
প্রথমেই জানতে চাই, স্বাধীনতা বলতে আপনারা কী বোঝেন?
নিশাত ফাতিমা: স্বাধীনতা মানে স্ব, অর্থাত্ নিজের অধীনতা। আমার এটা করা উচিত, আমি এটা করব, এমন একটা ফ্রেম বেঁধে নিয়ে তার অধীনে থাকা। কিন্তু অন্যের স্বাধীনতার অবমূল্যায়ন না করা।
সংগীতা আচার্য্য: স্বাধীনতা মানে অবশ্যই অন্যের অধীনে না থেকে নিজের অধীনে থাকা। নিজের অধীনে থাকা বলতে আমরা চাইলেই নিজের সব ইচ্ছাকে রূপায়ন করতে পারি না। আমাদের যেমন সামাজিক কিছু সীমাবদ্ধতা আছে তেমনি পারিবারিক ও শারীরিক কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে।
সারা নাফিয়া অন্তরা: আমার কাছেও স্বাধীনতা বলতে কারও অধীনে না থাকা। এখানে নিজস্ব সবকিছু থাকে। নিজস্ব জাতি, ভূখণ্ড সবকিছুই নিজের অধীনে, অন্যের অধীনে নয়। বাংলাদেশে আমার মনে হয় না সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা আছে। রাজনীতিবিদদের অনেক স্বাধীনতা আছে। যেমন দুর্নীতির ক্ষেত্রে তাঁদের অবাধ স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ হিসেবে যতটুকু স্বাধীনতা আমাদের পাওয়ার কথা, অতটুকু হয়তো আমাদের নেই।
আবু আব্দুল্লাহ: আমি স্বাধীনতাকে দুই ভাবে দেখি। এক, ব্যক্তিস্বাধীনতা। দুই, রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা।
ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি-নিজের ইচ্ছামতো কাজ করা। কিন্তু এই ইচ্ছামতো কাজ করতে গিয়ে যেন অন্যের কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে নজর রাখা। আর রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বলতে একটা রাষ্ট্র, স্বাধীন ভূখণ্ড—সেটাই শুধু নয়, সে রাষ্ট্রের মানুষের স্বাধীনতাও থাকতে হবে।
তাবাসসুম খানম নিশাদ: আমার কাছে স্বাধীনতা এ রকমই। অর্থাত্-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা। স্বাধীনতাকে এ দুভাবেই আমি দেখি। ব্যক্তিস্বাধীনতা পরে আসবে। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা বলতে আমি বলব—সেটা আমাদের নেই। আমরা নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়েছি। আমি ওই প্রজন্মে ছিলাম না। তবুও এখন কিছুটা হলেও অনুভব করি, যেই চেতনা নিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল, সে চেতনা এখন আর অবশিষ্ট নেই। আমাদের আগের প্রজন্ম যাঁরা, তাঁরাই এটা ধূলিস্যাত্ করে ফেলেছেন।
রেদুয়ানুর রহমান শামির: স্বাধীনতা বলতে আমি নিশাত ও আব্দুল্লাহর সঙ্গে অনেকটাই একমত। ব্যক্তিস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা এ দুটো বিষয়কে আমি দু রকম ভাবি। ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে অন্যের কোনো ক্ষতি না করে যাতে নিজের মতো করে চলতে পারি এটাকেই বলব। রাষ্টীয়ভাবে আমরা আসলে স্বাধীন একটা দেশ। কিন্তু স্বাধীন দেশ হলেও কতটুকু স্বাধীন?
ফারাজানা আক্তার: আমি বলব, স্বাধীনতা—যেটা রাষ্ট্রীয়, সেটা আমরা পাচ্ছি না। আমাদের স্বাধীনতাকে নানাভাবে দমিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমি যেটা বেশি অনুভব করি, সেটা হলো ব্যক্তিস্বাধীনতা। ব্যক্তিস্বাধীনতাকে যদি আমরা কুক্ষিগত করে রাখি, তাহলে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আমরা ভোগ করতে পারব না। ব্যক্তিগতভাবে যদি আমরা স্বাধীনতাকে ছড়িয়ে দিতে পারি, তাহলে আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে পারব।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: আমি স্বাধীনতাকে পূর্বের দিকে ফিরিয়ে নিতে চাই। আমরা যখন পাকিস্তানের অধীনে ছিলাম, তখন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হয়েছিল কিসের ভিত্তিতে? তার প্রেক্ষিতটা ছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি। এই মুক্তি শুধু এক স্তরের মানুষ চায়নি। ছাত্র-শিক্ষক, পেশাজীবী, কৃষক-শ্রমিক—সর্বস্তরের মানুষ চেয়েছিল। সবার ঐকান্তিক ইচ্ছা, আন্তরিকতা থেকে তখন আন্দোলন হয়েছিল। পরে আমরা নতুন বাংলাদেশ পেলাম। কথা হচ্ছে এখন কি আমরা স্বাধীন? স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দেখা গেল-স্বাধীনতা ও আমি। অর্থাত্ স্বাধীনতাকে সবাই কেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে নিয়ে আসছে। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু দু-একজন লোকের জন্য ছিল না। এখন সবাই স্বাধীনতাকে নিজের কাছ থেকে নিজের মতো করে দেখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে আমাদের দেশে নয় কোটি লোক কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এক কোটি লোক ভূমিহীন। দুই কোটি লোকের বাসযোগ্য সরকারি জায়গা এখনো পতিত ভূমি হিসেবে আছে। স্বাধীনতার পরে আমাদের সামাজিক- অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কী উন্নতি হয়েছে? অর্থনৈতিকভাবে গুটিকয়েক মানুষ উন্নতি লাভ করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কিন্তু যাঁরা আমাদের মূল, আমাদের কৃষক, যাঁদের নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছিল, তাঁদের জন্য আমরা কিন্তু কিছুই করিনি।
আবদুল বাতেন সোহেল: আমি ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বাধীনতা বলতে বুঝি আমার সিদ্ধান্ত আমি নেব। এখানে কিছু কথা আছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই আমার অভিভাবকদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে। তারা আমাকে অনেক পরামর্শ দিতে পারেন, পথ দেখাতে পারেন। কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, আমি নেব। দেশের ক্ষেত্রেও আমি সেটাই মনে করি। অর্থাত্ বিভিন্ন দেশ বা দাতা সংস্থা পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু আমার দেশের সিদ্ধান্ত আমার দেশের মানুষই নেবে। কিন্তু আমাদের জাতীয় জীবনে যা হচ্ছে, এখানে অনেকেই বলেছেন আমাদের রাজনীতিবিদেরা অনেক স্বাধীন। আমি তাঁদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। রাজনীতিবিদেরা আসলে স্বাধীন নন। দাতা সংস্থাদের কাছে, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কাছে তাঁরা আসলে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছেন স্বার্থের বিনিময়ে। যার ফলে নাগরিক হিসেবে একজন স্বাধীন মানুষ বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমি এটাই মনে করি।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা বলতে তো আমরা বুঝি ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের এই সময় নয় মাসের একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা গিয়েছি। সেটা গেল একটা মুক্তিযুদ্ধ এবং তারও আগে একটা স্বাধীনতা সংগ্রাম। কারণ, যুদ্ধ তো আর একদিনে শুরু হয়ে যায়নি। এ বিষয় নিয়ে আপনি কতটুকু জানেন বলে নিজে মনে করেন।
নিশাত ফাতিমা: প্রশ্নটা মনে হচ্ছে ইতিহাস বিষয়ে। মানে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমরা কতটুকু জানি, এই তো। এ ক্ষেত্রে আমি বলব না যে, আমি কিছুই জানি না। জানি, তবে সেটা কতটুকু সত্য, কতটুকু মিথ্যা, সেটা জানি না। অনেকে অনেক রকম বই লিখে গেছেন, সেখানে তাঁরা কতটুকু পক্ষপাতিত্ব করেছেন, কতটুকু সঠিক তথ্য দিয়ে গেছেন, সেটা আমরা জানি না।
সংগীতা আচার্য্য: আমার যেটা মনে হয়, বাংলাদশের স্বাধীনতার ইতিহাস আমরা সঠিকভাবে জানি না—এটা আমাদের দোষ নয়। আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম আমাদের সঠিক ইতিহাস দিয়ে যেতে পারেনি।
আপনারা কি মেনে নিচ্ছেন, স্বাধীনতার ইতিহাস জানেন না?
সংগীতা আচার্য্য: আমার মনে হয়, সাধারণ মানুষ সবাই জানে না। আমি যতটুকু জেনেছি অনেকটা আমার পারিবারিক কারণে। বাকিটা আমার আগ্রহের কারণে। চলমান শিক্ষাব্যবস্থা এ ব্যাপারে আমাকে খুব সহযোগিতা করেছে বলে মনে হয় না।
স্বাধীনতা দিবস, মুক্তিযুদ্ধ—এর আগের প্রেক্ষাপট নিয়ে আপনি পাঁচ লাইন বলেন, যেটুকু আপনি জানেন।
সংগীতা আচার্য্য: অর্থনৈতিক যে কারণটা, মানে শোষণ—এ রকম একটা জায়গা থেকে স্বাধীনতা এসেছে। সত্তরের নির্বাচনে যখন আমাদের পক্ষে রায় এল, তখন তো সেটা দেওয়া হয় নাই। তখন বলা হলো স্বাধীনতার কথা। স্বাধীনতা এলে আমরা সব কিছু পাব। তখন যে কৃষক, সে ভাবল স্বাধীনতা এলে আমি ন্যায্যমূল্য পাব। এ রকম চাকরির ক্ষেত্রে বাঙালিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতো না। তাঁদের কাছে মনে হলো স্বাধীনতা এলে আমাদের এমন হবে না। তো এ রকমভাবে যার যার অবস্থান থেকে ভেবেছে। যার যার অধিকারের জায়গা থেকে স্বাধীনতার প্রয়োজন বোধ করেছে। এ জন্যই যার লাঠি ছিল, সে লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
সারা নাফিয়া অন্তরা: আমার কাছে স্বাধীনতার পেছনের ইতিহাস বেশির ভাগ মুখে মুখে শোনা। যতটুকু শুনেছি, সেটুকুই জানি। বইয়ের মাধ্যমে ইয়াহিয়া কী করল, শেখ মুজিবুর রহমান কী করেছিলেন, সেটুকুই জানি। এর পেছনে যে প্রতিটি মানুষের এত অংশগ্রহণ ছিল, সে বিষয়ে আমি খুবই কম জানি। আমার মনে হয়, সেটুকু জানা উচিত।
আবু আব্দুল্লাহ: স্বাধীনতা সম্পর্কে আমি জানতে শুরু করেছি প্রথমত প্রাইমারি স্কুল ও হাইস্কুলে যে বই, সেখান থেকে। তারপর যখন নিজে কিছু বই পড়ার চেষ্টা করেছি, এসব পড়ে আমার যেটুকু ধারণা হয়েছে তাতে ভাষার কথা উঠলে আমার মাথায় আসে একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতার কথা আসলে ২৬ শে মার্চ, বিজয়ের কথা শুনলে ১৬ ডিসেম্বর।
প্রাচীনকাল থেকেই বাইরের লোকজন আমাদের শোষণ করত। যখন এটা চরম পর্যায়ে চলে যেত, তখন তারা আন্দোলন করে স্বাধীনতা নিয়ে আসত। এই অবস্থায় একবার এল ইংরেজরা। তখন তাদের শোষণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বাঙালিরা চেষ্টা করল পাকিস্তানিদের সঙ্গে এক হয়ে দেশ গঠন করার। তখন তাদের লক্ষ্য ছিল অনেক উঁচুতে। ধারণা ছিল, তারা একটা ভালো জীবন পাবে। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছ থেকে তারা সেটা পেল না। তখন তারা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেল।
তাবাসসুম খানম নিশাদ: দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে পটভূমি এ বিষয়ে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা একেবারেই নাই। কারও মুখে গল্প শোনাকে আমি বাস্তব জ্ঞান বলছি। বই পড়ে যতটুকু জেনেছি, তা খুবই কম। এখনো কম মনে হয়। আমার আশপাশের মানুষের কাছ থেকে যতটুকু জানার চেষ্টা করেছি তারা নিজেরাও অনেক সময় বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছে। বলেছে, কী বলব তোমাকে? এমনও দেখা গেছে, তারা যা জেনেছে এ বিষয়ে তারা নিজেরাও সন্দিহান। তারা নিজেরাও জানতে গিয়ে দুর্বিপাকে পড়েছে। দেখা গেছে, তারা নিজেরা যেটা জেনেছে, সেটা প্রথম জনের কাছ থেকে যা জেনেছিল পরের জনের অন্যরকম। আমার কাছের মানুষ যারা, তাদের কাছেও আমি এই জিনিসটা পেয়েছি। তারা নিজেরাও সংশয়ে আছেন। তারা বলতে পারেনি এর কাছে যাও, ওর কাছে যাও, সঠিকটা জানতে পারবে। এ বিষয়টি আমাদের পরিষ্কার করা দরকার।
রেদুয়ানুর রহমান শামির: আমি গত প্রশ্নের উত্তরেও বলেছিলাম, আমাদের এ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারছে না বা শিখতে পারছে না। যেহেতু তারা এ সম্পর্কে তথ্য পায় না, তাই প্রত্যেকের মা-বাবার উচিত সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান দেওয়া। আমি যতটুকু জানি আমার মায়ের কাছ থেকে। আমার মামা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা জয়ী হয়েছি এটুকু জানি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পেছনে অনেক কারণ ছিল, মানে যুদ্ধটা... আমি আসলে বলতে পারছি না....।
যুদ্ধের আগের যে ২৪ বছর পাকিস্তানের অধীনে আমরা ছিলাম, আপনাদের কাছে কি স্বাধীনতা বলতে শুধু একাত্তর সালকেই মনে হয়। নাকি একটা ক্রমাগত প্রচেষ্টা?
রেদুয়ানুর রহমান শামির:শুধু একাত্তর সালেই যে স্বাধীনতা এসেছে, সেটা নয়। আসলে এখনো অনেক ক্ষেত্রে আমরা স্বাধীনতাটা উপভোগ করতে পারি না। এখনো আমরা যা করতে চাই করতে পারি না।
আমার প্রশ্নটা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ বলতে কি সিনেমায় যেমন গুলি করে এতটুকুই নাকি আরও কিছু...নাকি এটার আরও কোনো প্রেক্ষাপট আছে?
সারা নাফিয়া অন্তরা: ’৪৭-এর পর, আপ-টু ৭১, ৬৯ এভাবে।
নিশাত ফাতিমা: আমার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা খুব জরুরি। কেননা এ ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে দেশপ্রেমের যে ঘাটতি আছে (আমার মনে হয় আমাদের কারও কারও মধ্যে দেশপ্রেমের ঘাটতি আছে) এ ঘাটতি কাটাতে সাহায্য করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা এই ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে পারব, ঐক্য না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন হতে পারব না।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: এখানে সবাই যা বলছে, আমার বলাটা ঠিক একই রকম। বলা হলো ২১, ১৬, ২৬ এটুকু বললে আমরা কী বুঝি?
আমরা বাবা-মায়ের কাছে শুনেছি ২১ মানে হচ্ছে ভাষা আন্দোলন। আমরা ভাষার জন্য যুদ্ধ করেছি। ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাক দেওয়া হয়েছে। আর ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করি যুদ্ধ করে। এটুকুই আমরা জানি। তারপর যখন বড় হয়েছি, কিছু বই পড়েছি ক্লাস সিক্স, নাইন-টেনে। তখন কিন্তু আমরা সামাজিক জ্ঞান খুব লাভ করিনি। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। এখন কথা হচ্ছে, যাঁরা যুদ্ধ করেছেন তাঁরা যদি না থাকেন, আমাদের প্রজন্মকে কেউ যদি প্রশ্ন করে, বাবা বা মা একুশে ফেব্রুয়ারি কী ছিল বা ছাব্বিশে মার্চ কী ছিল? তখন আমরা কী বলব আমাদের সন্তানদের?
তখন দেখা যাবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছুই জানে না। শুধু একটা তারিখ হয়ে থাকবে বিষয়টা।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তোমাদের মধ্যে কি কোনো আবেগ কাজ করে?
: হ্যাঁ করে, হ্যাঁ করে [সমস্বরে সবাই দিয়েছিল এই উত্তর]
সবাই এক বাক্যে বললে আবেগ কাজ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে-মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তোমরা যতটুকু জানো, সেটা কি তোমরা পর্যাপ্ত মনে কর?
: না [এ উত্তরটিও সবাই দিয়েছিল সমস্বরে]
এই নিয়ে কারও বিতর্ক নেই। আচ্ছা, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তোমরা যতটুকু জানো তার প্রাথমিক উত্স কী? মা-বাবা, স্কুলের বই?
সোহেল: মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার জানার প্রথম উত্স মা-বাবা, তারপর প্রাথমিক শিক্ষার বইগুলো, বিশেষ করে বাংলা বই। বাংলাদেশের সাতজন বীরশ্রেষ্ঠের কথা ধারাবাহিকভাবে আছে সেখানে। ওইটাই মূল উত্স। ওইখান থেকেই জানা।
ইতিহাসের বইয়ে সরাসরি একাত্তরের স্বাধীনতা সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি।
তার মানে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তোমরা তোমাদের বই থেকে তেমন কিছুই জানো না?
: না [প্রায় প্রত্যেকেই দিয়েছে এই উত্তর]।
তোমরা ওই চক্রের মধ্যে পড়ছিলে, হাসিনার আমলে এক ইতিহাস পড়ছ আর খালেদার আমলে আরেক ইতিহাস।
: আমরা পড়িনি, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম পড়েছে [এ কথাটিও বলেছে প্রায় প্রত্যেকেই]।
তোমরা কি পড়েছিলে?
ফারজানা আক্তার: আমরা জিয়াউর রহমানের ঘোষণাই পড়েছি। সেটা ছাব্বিশে মার্চ। আবার কোথাও কোথাও ২৭ মার্চ, সেটাও আমরা পেয়েছি। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রথম জেনেছি পরিবার থেকে। মা-বাবার কাছ থেকে। স্বাধীনতার ঘোষক কে? এটা নিয়ে তো এখন যথেষ্ট বিতর্ক হচ্ছে। বইয়ের মধ্যেও হচ্ছে। এখন আমার মা-বাবাকে যদি জিজ্ঞেস করি স্বাধীনতার ঘোষক কে? বাবা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলেন, আমার বাবা নিশ্চিত করে বলবেন, স্বাধীনতার ঘোষক মুজিব, তখন আমি ছিলাম, আমি শুনছি। কিন্তু আমার পরের প্রজন্ম, আমার মেয়ে যদি জিজ্ঞেস করে মা স্বাধীনতার ঘোষক কে? আমি কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারব না। কারণ, তখন আমি ছিলাম না। আমি জেনেছি স্বাধীনতার ঘোষক মুজিব। মা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি। কিন্তু বইগুলো যেহেতু আমাদের ভ্রান্ত করে ফেলছে, আমাদের পরের প্রজন্মে কী প্রভাবটা ফেলবে?
সারা নাফিয়া অন্তরা: এখানে স্বাধীনতাকে দলীয়করণ করে নিয়েছে। যখন এই দল আসে, তখন বলে এই ঘোষক। যখন আরেক দল আসে, তখন বলে এই ঘোষক। আসলে আমরা সঠিক তথ্য পাচ্ছি না।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: অন্তরা যে কথাটা বলল, দলীয়করণ, শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছিলেন, সারা দেশের একজন অভিভাবক ছিলেন। পরে তাঁকে বানানো হলো দলের অভিভাবক। ছাব্বিশে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন, ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান তাঁর পক্ষ হয়ে ঘোষণাটি প্রচার করেছেন। এখানে কিন্তু দুজনেই ঘোষণা দিয়েছেন। একজন জনসমক্ষে বলেননি, একজন বলেছেন। এখানে দুজনেরই অংশগ্রহণ আছে।
আবদুল বাতেন সোহেল: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জিয়াউর রহমানকে বলেছিলেন কি না এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। তবে আমি মনে করি এটা একটা প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার কারণেই জিয়াউর রহমান ঘোষণা দিয়েছেন। হয়তো শেখ মুজিব তাঁকে সরাসরি বলেননি যে জিয়া তুমি ঘোষণা দাও। প্রক্রিয়াটাই ছিল ঘোষণা দেওয়ার। অবস্থাটাই ছিল এমন। তবে এটার নেতৃত্বে ছিলেন নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তাবাসসুম খানম নিশাদ: আমি একটা কথা বলতে চাই। স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছে? এটা কেন গুরুত্ব পাচ্ছে। এটা তো এড়িয়ে চলা যায়। যেহেতু এই নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়ে গেছে। রেদুয়ানুর রহমান শামির: আমি বলব, এটা একটা ইতিহাস। এবং ইতিহাসটা পুরো দেশের জন্যই সংরক্ষণ করা উচিত।
সংগীতা আচার্য্য: আমি যেটা জানি, ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। এরপর একসময়ে ঘোষণা তো জিয়াউর রহমান দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। এ ক্ষেত্রে তো সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না।
ফারজানা আক্তার: নিশাদ যে কথাটা বলেছে স্বাধীনতার ঘোষক কে? বিতর্কিত এ বিষয়টিকে আমরা পাস কেটে যাব। কিছু কিছু বিষয় আছে পাস কেটে যাওয়া যায় না । আমার বাবাকে তো আমি অস্বীকার কারতে পারব না। এ রকম কিছু কিছু বিষয় আছে, যা কখনো পাশ কেটে যাওয়া যায় না।
সারা নাফিয়া অন্তরা: আমি যে স্বাধীনতা দলীয়করণ বলেছি, এটা কেন বলেছি? আমাদের প্রশ্নটা ছিল স্বাধীনতা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? যা জানি তা সঠিক কি না? আমাদের কাছে এখনো অনেক তথ্যইা স্বচ্ছ নয়। সঠিক তথ্য আমরা জানতে পারছি না। এটা আমাদের মূল কথা। আমরা যেকোনো একটা ইতিহাস চাই।
নিশাত ফাতিমা: স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে সংশয় সবারই আছে। যে জানে তারও আছে, যে জানে না, তার তো আছেই। যে জানে, শুনতে শুনতে সে সংশয়ে পড়েছে। সংশয়ী হওয়ার অনেক রকম পথও আছে। আমাদের দেশের যে ইতিহাস, তা সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে এটা অবশ্যই সঠিকভাবে লেখা দরকার। পূর্ণাঙ্গ একটা ইতিহাস থাকা দরকার।
তোমরা মূল বইয়ের বাইরে যেমন উপন্যাস, গল্প, টেলিভিশনের নাটক-সিনেমা থেকে উপকৃত হও কি?
তাবাসসুম খানম নিশাদ: জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি একটা জলজ্যান্ত দলিল আমার মনে হয়। এই বইটা যে পড়বে, সে ওই সময়টায় চলে যাবে। প্রত্যেকটা ছবি তার চোখের সামনে ভেসে ওঠবে। আমার মনে হয় এমন আরও কিছু বই আমাদের দরকার। এ ছাড়া কবিতা, গল্প, উপন্যাস একটু হলেও আমাদের ভাবায়, আমাদের হূদয়ে নাড়া দেয়। ইদানীং যেমন শুরু হয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাণ, এখানে কিন্তু খুব বেশি কাজ হয়নি। একদম হাতেগোনা কয়েকটা কাজের কথা আমরা বলতে পারব। আগে কিন্তু খুব বেশি কাজ হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে ইতিহাস নয়, এখন কথা হচ্ছে চেতনা বলতে তোমরা কী বোঝো?
তাবাসসুম খানম নিশাদ: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমার কাছে দারুণ একটা জিনিস মনে হয়। আমরা কোনো কিছু ভালো করার যে মানসিকতা—এটা আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সমকক্ষ একটা চেতনা মনে হয়।
নিশাত ফাতিমা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ব্যাপারটা অনেক গভীর। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটা বলব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা একটা মানুষকে অনেক বেশি উদ্দীপ্ত করতে পারে। তার দেশপ্রেম অনেক বেশি জাগাতে পারে। তার যে দায়িত্ব, তা পালনে অনেক বেশি ব্রতী করতে পারে। আমি যদি একজন চাকরিজীবী হয়ে থাকি, আমার যে কর্তব্য তা পুরোপুরি পালন করব, শিক্ষার্থী হলে, আমি নকল করব না, এমন।
সারা নাফিয়া অন্তরা: মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে গেলে প্রথমেই দেশপ্রেমের কথা আসে। আর দেশপ্রেমের কথা বলতে গেলে প্রথমে কীভাবে দেশের সঙ্গে আচরণ করছে, সেটা আসে। এখানে সততাও থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি। যদি আমার ভেতরে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা থাকে, আমি তা পরিত্যাগ করলাম। আমি নিজের সুবিধার জন্য দেশের বাইরে না-গিয়ে দেশের ভেতরে থেকে গেলাম। আমি কলা খেয়ে খোসাটা যদি এদিক-সেদিক না-ফেলে ডাস্টবিনে ফেলি, এটাও কিন্তু একটা দেশপ্রেম। আমি বলব, মুক্তিযুদ্ধকে নিজের একটা অংশ। চেতনা তো দেশপ্রেমের ভেতর থেকে আসে।
সংগীতা আচার্য্য: আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মনে হয় আমাদের সামগ্রিকতাকে নিজের মধ্যে ধারণ করা।
আবু আব্দুল্লাহ: স্বাধীনতার চেতনা বলতে আমি আসলে একসঙ্গে চারটা জিনিস বুঝি। প্রথমত, দেশপ্রেম, তারপর দায়িত্ববোধ, ত্যাগ ও একতা।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: আসলে আমরা সবাই একত্রে যুদ্ধ করেছি। ঐক্য ছিল সবার মধ্যে। এখন আর এ সংঘবদ্ধ বিষয়টি নেই। এটাকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যতদিন আনা যাবে না, ততদিন চেতনা চেতনা বলে ‘চিল্লাইয়া’ কোনো লাভ হবে না। আমার কাছে মনে হয়, চেতনা ব্যাপারটা জেগে ওঠা। যেই চেতনার কারণে আমরা স্বাধীন হয়েছি।
নিশাত ফাতিমা: এখানে অনেক রকম কথা হলো, রাজনীতিকীকরণ, দলীয়করণ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এখানে আসল ব্যাপারটা থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। সেটা হচ্ছে চেতনা। এই যে এত বছর ইংরেজ শাসন আমল থেকে শুরু করে নিপীড়নের শিকার হয়ে থেকেছি, আমরা অন্যের অধীনে থেকেছি। এখন আমাদের যে নিজের কিছু বলার আছে বা করার আছে এ ব্যাপারটা সম্পর্কে আমরা সজাগ নই। মোট কথা, ব্যক্তিত্ব বলে যে ব্যাপারটা—সেটাই আমাদের নেই। আমরা সব সময় অন্যের অধীনে থাকতে পছন্দ করি। আমরা চাই, আমাদের একজন অভিভাবক থাকবে— আমাদের দিকনির্দেশনা দেবে। এটা করো, ওটা করো—আমাদের নিজেরও যে কিছু করার আছে, এ বোধ লুপ্ত হয়ে গেছে।
স্বাধীনতার কথা এলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা এলে তোমরা কি বিরক্তবোধ করো বা ব্যাপারটা তোমাদের কাছে কচকচানি মনে হয়?
নিশাত ফাতিমা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বা এসংক্রান্ত কোনো কথা শুনলে তখনই কচকচানি মনে হয়, যখন একই ভাঙা হাঁড়ি বাজতে থাকে। সাত মার্চ ভাষণ হলো, তারপর সব যুদ্ধে গেল, এরপর দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। এই তিনটি তারিখের মধ্যেই তো সীমাবদ্ধ। এর পরে কি হলো, না হলো? এই নিয়ে কোনো কথা নেই। সিনেমা, নাটক, গল্প কোনোটায়ই কিন্তু আমরা এর বেশি কিছু পাই না। আমার মনে হয় এটা এই জন্যই নেই যে জিয়াউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারই তো এখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আসলে তাঁদের পরিবারের লোকদের দ্বারা আমরা প্রতারণার স্বীকার হয়েছি।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: কচকচানি কখনোই মনে হতো না, যদি আমি সঠিক ইতিহাসটা জানতাম। একই ইতিহাস যদি আরেকজন জানত। স্বাধীনতা নিয়ে আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস যদি থাকত, তবে কচকচানি মনে হতো না।
সংগীতা আচার্য্য: আমি যখন কলেজে পড়ি, আমার এক বন্ধু বলেছিল কথাটি। ‘যে রিকশা চালাত, সে মুক্তিযুদ্ধ করেও রিকশা চালায়। যে সুবিধাভোগী ছিল, সে এখনো সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।’ মুক্তিযুদ্ধ আমাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ফলে এই চেতনার কথা বারবার বলে লাভ কী? আসল উন্নতিটা তো দেখা যাচ্ছে না। একদিন আমার বন্ধুদের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুনেছিলাম ‘শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে মিশে ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তান থেকে ভাগ করেছে দেশকে। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে অনেক ভালো থাকতাম।’ যে এই কথাটি বলেছিল, তার পরিবারের একজন একাত্তরের রাজাকার ছিল, এটা আমাদের এলাকার সবাই জানে। আমার যেটা মনে হয়, যারা রাজাকার, তারা তাদের পরিবারের মধ্যেও বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। যুদ্ধের পরে ভঙ্গুর দেশে সব অর্জন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সেই হতাশা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছেন।
ফারজানা আক্তার: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কচকচানি বলা হয় কারণ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন বিকৃত করে ফেলা হচ্ছে। ফলে এখনকার প্রজন্ম এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। আমি আমার এক বান্ধবীর কথা বলতে পারি। এই লেখাটা যখন পত্রিকায় ছাপা হবে, তখন আমি নিশ্চিত যে সে এই লেখা না-পড়ে পড়বে বিনোদন পাতার লেখাটা। এই অস্থিরতা আমাদের প্রজন্মের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করছে এখন। এ অস্থিরতা কেন কাজ করছে? সেটা কী ভেজাল খাবার খাওয়ার কারণে, নাকি বায়ুদূষণের কারণে? এই নিয়ে আমি সন্দেহমুক্ত নই।
আবু আব্দুল্লাহ: স্বাধীনতার ইতিহাস আমার কাছে কখনো কচকচানি মনে হয়নি। উপস্থাপন করার ভঙ্গিটা ছিল বিরক্তিকর। যখন আমাদের বিনোদনের নির্ধারিত সময়, তখন কেউ একজন যদি মোটা গলায়, গম্ভীরভাবে কিছু বলতে চায়, সেটা আমাদের কাছে ভালো লাগবে না। রেদুয়ানুর রহমান শামির: মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে আমার মনে একটা আনন্দ কাজ করে সব সময়। একটা কৌতূহলও কাজ করে। কচকচানি মনে হয় তখনই, যখন বিকৃতভাবে আমরা বিষয়টি শুনি। তাবাসসুম খানম নিশাদ: ব্যক্তিগতভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গকে বিরক্তিকর মনে করি না। এটা নির্ভর করে কে বলছে, তার ওপর। যাকে আমি এভাবে চিনি যে তারা ভুল তথ্য দেবে না, তারা যখন বলে তখন আমি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনি।
আবদুল বাতেন সোহেল: মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে আমার কোনো কচকচানি নেই। মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী যে কার্যক্রম, সে ব্যাপারে আমার কচকাচানি আছে। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে টানাটানি করছেন। যে কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সে কাজ তাঁরা করছেন না। বাণিজ্যিকীকরণ করছেন। তাও যদি দেশের কোনো কাজে লাগত, আমরা উত্সাহ পেতাম। আমাদের কাছে এখন মনে হচ্ছে আমরা শোষিত হচ্ছি। যার কারণে ব্যাপারটিকে কচকচানি মনে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারদের ভূমিকা আর তাদের এখনকার কার্যক্রম তোমরা কীভাবে নিচ্ছ?
নিশাত ফাতিমা: মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারদের যে ভূমিকা, সেটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের মনে হয়, একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত ছিল। সাধারণ ক্ষমা করার ব্যাপারটি আমি এখনো মানতে পারি না। সেটা কেন করা হয়েছে, আমি এখনো জানিও না। আমার মনে হয়, পরে তাদের সামাজিকভাবে হেয় করেও এ কাজটি আমরা করতে পারতাম। আমাদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত বিষয়টি। এখন যারা দুর্নীতি করে—তারাও কিন্তু এক অর্থে রাজাকার। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে আমরা এ বিষয়টি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারতাম।
সংগীতা আচার্য্য: আমি আগেই বলেছি, রাজাকার হচ্ছে তখন যারা সুবিধাভোগী ছিল। তারা যুদ্ধের আগে একভাবে সুবিধা নিয়েছে। যুদ্ধের পরে আরেকভাবে সুবিধা নিচ্ছে। সাধারণ ক্ষমা আমি এখনো সমর্থন করতে পারি না। এখন তাদের আর কিছু করা যাক বা না-যাক, তাদের রাজনৈতিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা উচিত। যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়ই রাজাকার ঢুকে গেছে, এখন কীভাবে রাজাকার চিহ্নিত করা হবে? তারপরও বলব, যতদূর পারা যায় তাদের ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা উচিত।
অন্তত নিজামীকে শনাক্ত করা যায়। এ রকম যাদের শনাক্ত করা যায়, তাদের শাস্তি দিয়ে প্রতীকী অর্থেও বলা যাবে— হ্যাঁ, তাদের শাস্তি দেওয়া গেছে। রাজাকারেরা কিন্তু একচুলও তাদের জায়গা থেকে সরে আসেনি।
ফারজানা আক্তার: শত্রু দুই রকম। একটা ঘরের শত্রু, একটা বাইরের শত্রু। পাকিস্তান বাইরের শত্রু। তাদের আমরা দেখতে পেরেছি, শনাক্ত করতে পেরেছি। রাজাকার যারা, তারা আমাদের ভেতরের শত্রু। তারা আমাদের দেশের ভেতরে থেকে দেশের ক্ষতি করেছে। তাদের তখনই শাস্তি দেওয়া যেত। এখন তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে কি না বলা যাচ্ছে না। আমি আশা করব, এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি পারে, তবে যেন সেটা করে।
আবু আব্দুল্লাহ: রাজাকারদের ভালো বলার কোনো প্রশ্নই আসে না। তারা তখনো খারাপ কাজ করেছে, এখনো করে যাচ্ছে। আমার প্রশ্ন হলো, তারা কী করে একটা এলাকার প্রতিনিধি হলো? এদের এতটা সাহস হওয়ার কারণ তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। এখনো সময় আছে, যারা চিহ্নিত রাজাকার, তাদের আমরা শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারি। আইনগতভাবে না-হোক, সামাজিকভাবে আমরা এ কাজটি করতে পারি।
রেদুয়ানুর রহমান শামির: রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা করে দেওয়াই ছিল তখনকার বড় ভুল। একজন দেশদ্রোহী কী করে গাড়িতে জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরে? সেটা আমি কখনোই মেনে নিতে পারি না। আমার মনে হয় এখনো সরকারের সময় আছে, প্রত্যেক রাজাকারকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া উচিত। শুধু তা-ই নয়, রাজাকারদের যারা সহযোগিতা করছে, যাদের সহযোগিতায় রাজাকারেরা এতদূর আসতে পারছে, যাদের ছত্রছায়ায় ছিল, তাদেরও শাস্তি হওয়া উচিত।
আবদুল বাতেন সোহেল: রাজাকার শব্দটাই এখন আমাদের দেশে গালি হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থা দেখে সন্দিহান হয়ে যাই। পুলিশ কাস্টডিতে ইয়াসমীনের মতো মেয়েরা ধর্ষিত হয়। যা রাজাকারেরা অনেক আগেই করে ফেলেছে। আমি রাজাকার আর এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। তাদের অবশ্যই শাস্তি দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশে এখন রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহাবস্থান। অর্থাত্ একই মঞ্চে বসে রাজাকার মুক্তিযোদ্ধার ভোটের রাজনীতিকে আমি আদর্শগত ব্যাপার বলে মনে করি। রাজাকারেরা তাদের আদর্শে ঠিকই অটুট, মুক্তিযোদ্ধারা সরে এসেছেন তাঁদের আদর্শ থেকে।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: এক দাঁতে ব্যথা হলে পাশের দাঁতেও ব্যথা লাগে। ওরা আমাদের বাসার চারপাশে বাসা বেঁধে রেখেছে। ব্যথা করা দাঁত যদি উঠিয়ে আনতে না-পারি, তাহলে আমরা আমাদের দেশকে উদ্ধার করতে পারব না। এখন কথা হচ্ছে-সাধারণ ক্ষমা নয়, আমরা স্বাধীন দেশে বলিষ্ঠ হাতে তাদের দমন করতে পারি। তাদের ধরে চোখ বন্ধ করে ফায়ার করা উচিত।
আবদুল বাতেন সোহেল: আমার মনে হয়, সব রাজাকারকে ধরে শাস্তি দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, তাই ১০০ জন না-হোক ১০ জনকে শাস্তি দিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করা উচিত। যাতে অন্যরা মাথাচাড়া দিতে না-পারে।
পেছনে আমরা এতকিছু দেখে এলাম। আমাদের এখনকার প্রশ্ন হচ্ছে-তোমরা কী চাও তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে।
নিশাত ফাতিমা: এখন একটা জিনিস খুব বেশি দরকার, সেটা হচ্ছে স্বনির্ভরতা। রাষ্ট্রীয়ভাবে আর্থিক অসচ্ছলতা আছে, এটা সত্য। তারপরেও যদি স্বনির্ভরতা অর্জন করা যায়, স্বাধীনতার মূল ব্যাপারটা আমরা পাব।
সংগীতা আচার্য্য: যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত। সেটা যতটুকু পারা যায়। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিষয়ক লেখা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে আরও থাকা উচিত। বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস থাকা দরকার। আমাদের যেন আগ্রহ জন্মে, এমন গল্প, কবিতা, উপন্যাস পাঠ্যপুস্তকে থাকা উচিত।
ফারজানা আক্তার: রাজাকারদের অবশ্যই দূর করতে হবে। দুর্নীতি, সন্ত্রাস এগুলোও দূর করতে হবে। সবচেয়ে বেশি দরকার হাতে হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া।
সারা নাফিয়া অন্তরা: দেশের যে গুরু দায়িত্ব, তা অবশ্যই ভালোভাবে পালন করে যাওয়া উচিত। এ জন্য শিক্ষাবিদেরা উপযুক্ত ব্যক্তি। আমাদের মনে যে আদর্শ বা দেশপ্রেম, তা তো তাঁরাই জন্মিয়ে থাকেন।
আবু আব্দুল্লাহ: সবারই দেশকে নিজের মনে করে কাজ করা উচিত। এই কাজটা আরেকজন করবে, এটা তার ওপর ছেড়ে দিলাম—এ রকম করলে হবে না। এবং প্রত্যেকের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশের উন্নতি করা ।
তাবাসসুম খানম নিশাদ: এ প্রশ্নটি নিয়ে আমি একটু সংশয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি আসলে এত হতাশ, ভেবে পাচ্ছি না কী চাচ্ছি তাদের কাছে। তবুও চিন্তাভাবনা করে এটুকু বলতে পারব, তারা যেন আমাদের বিভ্রান্ত করতে না-পারে। সত্য বলতে না-পারুক, মিথ্যা যেন না বলেন। আর আমাদের একটু স্বাধীনতা দেওয়া হোক। মানে এই বাধা যেন না-থাকে যে আমরা কিছু জানতে চাইছি, বাধা পেয়ে ফিরে আসছি।
আবদুল বাতেন সোহেল: আমরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করব, আমি ওসব চাচ্ছি না। আমি রুট লেভেলে কিছু চাচ্ছি। সত্, দক্ষ ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাচ্ছি। আমাদের স্বাধীন, শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন থাকবে, স্বাধীন, শক্তিশালী বিচারব্যবস্থা থাকবে। আর সুন্দর নির্বাচনের একটা প্রক্রিয়া চাই।
অন্য কোনোকিছুই আশা করি না। সাময়িকভাবে এ কাজটি কারলে হবে না। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছেই চাচ্ছি, আপনার দীর্ঘমেয়াদি একটা সমাধান দিয়ে যান।
নিশাত ফাতিমা: সোহেলের সঙ্গে আমি একমত। আমার মনে হচ্ছে, একটা কথা ও এখানে বাদ দিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে যখন সত্ ব্যক্তিদের আমরা শাসনের জায়গার বসাতে পারব।
আসিফ নেওয়াজ সৈকত: স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর চলে গেছে। এই মুহূর্তে যদি আমরা স্বাধীনতার আসল ইতিহাস সংরক্ষণ করতে না-পারি, তাহলে স্বাধীনতার আসল ইতিহাস ধরে রাখার সময় আমাদের থাকবে না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিছুই জানবে না। তারা শুধু জানবে, স্বাধীনতা শুধু তারিখের বিষয়। স্বাধীনতা দিবস তখন শুধু তারিখ হয়ে যাবে।
সংগীতা আচার্য্য: বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর মনে হচ্ছে দেশে একটা বিপ্লব হয়ে গেছে। দুর্নীতিবাজেরা ধরা পড়ছে। আমি মনে করি, দেশ এ রকমভাবেই চলবে—তবে সেটা কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, কোনো সামরিক সরকারও নয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার এ কাজটি করবে—এটাই আমার প্রত্যাশা।
নিশাত ফাতিমা: সব শেষে একটা কথায় আমার মনে হয় সবার একমত হওয়া উচিত। সেটা হচ্ছে, আমরা কোনো ধর্ম, কোনো বর্ণ বা কোনো গোষ্ঠী কিংবা কোনো গোত্র, এ রকমভাবে বিভক্ত না-হয়ে, আমরা একজন সুনাগরিক হতে চেষ্টা করব। মনে হয়, দেশপ্রেমের যে চেতনা, সে ব্যাপারটি আমাদের সাহায্য করবে।
তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ।
: এই আয়োজনের জন্য প্রথম আলোকে ধন্যবাদ, আপনাকেও।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত