১৯৭১ সালে আমি পুলিশের কনস্টেবল (নম্বর ৪৮৭১) ছিলাম। তখন স্পেশাল আর্মস ফোর্সে (এসএএফ) কর্মরত। কিন্তু ডেপুটেশনে কাজ করতাম রাজারবাগের রিজার্ভ অফিসে। সে সময় ঢাকা শহরের অবস্থা ছিল থমথমে। সাধারণ মানুষ আইনকানুনের হিসাব করত না। কেউ বাধাও দিত না। কখন কী যে হয়, এমন একটা পরিস্থিতি। আমরা সব সময় সতর্ক থাকতাম।
২৫ মার্চ রাত আনুমানিক ১০টার দিকে একটা বেবিট্যাক্সি করে কয়েকজন লোক রাজারবাগের ২ নম্বর গেটে আসে। তারা সেখানে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের বলে যায়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আজ আপনাদের ওপর হামলা করবে। আপনারা সজাগ হোন, সতর্ক হোন। এই সংবাদ রাজারবাগসহ আশপাশের সব দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রাজারবাগকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষ মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর বিভিন্ন জায়গায় গাছ দিয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এই ব্যারিকেড আর্মিদের জন্য কিছুই না। রাজারবাগ পুলিশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য প্রত্যেকেই যার যার মতো পোশাক পরে তড়িঘড়ি প্রস্তুতি নেয়।
অস্ত্র নেওয়ার জন্য সবাই অস্ত্রাগারের দিকে যায়। অস্ত্রাগারের চাবি থাকত এক সুবেদারের কাছে। আর থাকত ‘আরএ’ এবং এসপি হেডকোয়ার্টারের কাছে। সবাইকে দেখে সুবেদার চাবি নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর আরএ মফিজ সাবের বাসায় গিয়ে আমরা চাবি নিয়ে আসি। অস্ত্রাগার খুলে অস্ত্র নেই। পুলিশের হাতিয়ার তখন ছিলই থ্রি নট থ্রি আর মার্ক ফোর রাইফেল। দুই অস্ত্রের একই ফাংশন। একই গুলিতে চলে। এই রাইফেল নিয়ে যার যার মতো বিভিন্ন জায়গায় আমরা অবস্থান নিই।
রাজারবাগে তখন চারতলা একটা বিল্ডিং ছিল। সেটাতে ছিল এসএএফ ব্যারাক। আমি থাকতাম চারতলা এ বিল্ডিংয়ের চারতলার ১৬ নম্বর ব্যারাকে। উত্তর পাশে ছিল টিনশেড ঘর। মানে ওপরে টিন, নিচে দুই ফুট দেয়াল দেওয়া। তার ওপর মুলি বাঁশের বেড়া। আরআরএফ ব্যারাক ছিল পূর্ব পশ্চিমে লম্বা। চারটা-পাঁচটা ঘর ছিল। আমি রাইফেল নিয়ে অবস্থান নিই এই ব্যারাকের উত্তর পাশে শাহজাহানপুরের দিকে মুখ করে।
রাত আনুমানিক সাড়ে ১১টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মালিবাগ, শান্তিনগরসহ তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। চারদিক থেকে গুলি আর বিস্ফোরকের শব্দ। এমন সব শব্দ যেগুলো আগে কখনো শুনিনি। পরে শুনেছি, ট্যাংক, মর্টার, রকেট লঞ্চার, হেভি মেশিনগান ছিল। তারা ফ্ল্যাশ লাইট মারছিল আর হামলা চালাচ্ছিল। তাদের আক্রমণটা ছিল অতর্কিত। আমাদের যে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এটা দিয়ে আমরা সবাই প্রতিহত করার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের এই ভারী অস্ত্রের মধ্যে আমাদের গুলি লাগানো ছিল খুব কষ্টকর। তারা অনেক প্রটেকশন নিয়ে আসছিল। আমাদের গুলিতে কোনো অ্যাকশন হয়েছে কি না, তাদের গায়ে লেগেছে কি না, কে জানে।
রাত আনুমানিক আড়াইটার সময় প্রথমে আরআরএফ ব্যারাকের পশ্চিম পাশে আগুন ধরে যায়। এর কিছুক্ষণ পরে আগুন লাগে চারতলা ভবনেও। দুই জায়গাতেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনে পুড়ে মরা ছাড়া উপায় নেই। আগুনের মাঝখান দিয়ে বেরোতে পারলে হয়তো বেঁচে যেতে পারি। তখন পরনের বুট খুললাম, শার্ট খুললাম। খাকি প্যান্ট পরে, গেঞ্জি গায়। আমরা অনেকেই তখন আল্লাহর ওপর ভরসা করে ব্যারাকের উত্তর পাশের বাঁশের বেড়া ভেঙে দিলাম দৌড়। পাকিস্তানি বাহিনী গুলি ছোড়ে, মাঝ দিয়ে আমরা দৌড় দিই। দৌড়ে সামনে গিয়ে দেখি একটা বাড়ির দেয়াল। লাফ দিয়ে ওয়াল ধরে পার হয়ে অপর পাশে জঙ্গলে পড়ি। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ব্যারাকে লাগা আগুনের আলোয় যতটুক দেখা যায়।
কোন দিকে রাস্তা, কূল কিনার পাচ্ছিলাম না। কিছু দূর গিয়ে একটা কচুরিপানা ভর্তি পুকুর পাই। এই পুকুর দিয়েই দিলাম সাঁতার। ওপারে উঠে গিয়ে দেখি, পিছে পিছে আরও অনেকে আসছে। কাউকে দেখা যায় না। শব্দ শুনে টের পাওয়া যায়। শাহজাহানপুরে গিয়ে রাজারবাগের কী অবস্থা বোঝার জন্য একটু দাঁড়াই। ফেরার আর কোনো উপায় নাই টের পেয়ে উত্তর দিকে দৌড়াতে থাকি। প্যান্ট ভেজা হওয়ায় কষ্ট হচ্ছিল। তখন একটা বাড়িতে গিয়ে লুঙ্গি নিই। প্যান্টটা খুলে ফেলে দিই। একটা লুঙ্গি পরা, গেঞ্জি গায়। দেখি পাবলিক, পুলিশ—সবাই দৌড়াচ্ছে। তাদের সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে রূপগঞ্জ ইসাপুরায় নদীর পাড়ে গিয়ে থামি। সেখানে রাজারবাগ থেকে পালিয়ে আসা আরও আট পুলিশ সদস্য আমার সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর সবাই মিলে হেঁটে নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওনা করি। মাঝে দুই রাত দুটি গ্রামে থাকি। ২৮ মার্চ রাত সাড়ে ১০টায় টাঙ্গাইলের বাসাইলে নিজ বাড়িতে পৌঁছাই। পরে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ শুরু করি। কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।
মো. মজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে পুলিশের কনস্টেবল।