১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ সকালে আমাদের পৌরসভার সুইপার ইন্সপেক্টর ইদ্রিস সাহেব আমাকে লাশ ওঠানোর জন্য ডেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিতে নিয়ে যান। সেখান থেকে আমাকে, বদলু ডোম, রঞ্জিত লাল বাহাদুর, গণেশ ডোম ও কানাইকে একটি ট্রাকে করে প্রথম শাঁখারীবাজারের কোর্টের প্রবেশপথের সম্মুখে নামিয়ে দেয়। আমরা ওই পাঁচজন দেখলাম ঢাকা জজকোর্টের দক্ষিণ দিকের প্রবেশপথে যে রাজপথ শাঁখারীবাজারের দিকে চলে গেছে, সেই রাস্তার দুই ধারে ড্রেনের পাশে যুবক-যুবতীর, নারী-পুরুষের, কিশোর-শিশুর বহু পচা লাশ।
দেখতে পেলাম, বহু লাশ পচে ফুলে বীভৎস হয়ে আছে, দেখলাম শাঁখারীবাজারের দুই দিকের ঘরবাড়িতে আগুন জ্বলছে, অনেক লোকের অর্ধপোড়া লাশ পড়ে থাকতে দেখলাম, দুই পাশে অদূরে সশস্ত্র পাঞ্জাবি সৈন্যদের পাহারায় মোতায়েন দেখলাম। প্রতিটি ঘরে দেখলাম মানুষ, আসবাবপত্র জ্বলছে। একটি ঘরে প্রবেশ করে একজন মেয়ে, একজন শিশুসহ ১২ জন যুবকের দগ্ধ লাশ উঠিয়েছি। শাঁখারীবাজারের প্রতিটি ঘর থেকে যুবক-যুবতী, বালক-বালিকা, কিশোর-শিশু ও বৃদ্ধের লাশ তুলেছি।
পাঞ্জাবিরা পাহারায় থাকাকালে সেই মানুষের অসংখ্য লাশের ওপর বিহারিদের উচ্ছৃঙ্খল উল্লাসে ফেটে পড়ে লুট করতে দেখলাম। প্রতিটি ঘর থেকে বিহারি জনতাকে মূল্যবান সামগ্রী, দরজা, জানালা, সোনাদানা সবকিছু লুটে নিয়ে যেতে দেখলাম।
আমরা ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ শাঁখারীবাজার থেকে প্রতিবারে ১০০ লাশ উঠিয়ে তৃতীয়বার ট্রাক বোঝাই করে ৩০০ লাশ ধলপুর ময়লা ডিপোতে ফেলেছি। ২৯ মার্চ সকাল থেকে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর ও প্রবেশপথের দুই পাশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিববাড়ি, রমনা কালীবাড়ি, রোকেয়া হল, মুসলিম হল, ঢাকা হল থেকে লাশ উঠিয়েছি। ২৯ মার্চ আমাদের ট্রাক প্রথম ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রবেশপথে যায়। আমরা ওই পাঁচজন ডোম হাসপাতালের প্রবেশপথে নেমে একটি বাঙালি যুবকের পচা, ফুলা, বিকৃত লাশ দেখতে পেলাম। লাশ গলে যাওয়ায় লোহার কাঁটার সঙ্গে গেঁথে লাশ ট্রাকে তুলেছি। আমাদের ইন্সপেক্টর পঞ্চম আমাদের সঙ্গে ছিলেন। এরপর আমরা লাশঘরে প্রবেশ করে বহু যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-কিশোর ও শিশুর স্তূপীকৃত লাশ দেখলাম। আমি এবং বদলু ডোম লাশঘর থেকে লাশের পা ধরে টেনে ট্রাকের সামনে জমা করেছি, আর গণেশ, রঞ্জিত (লাল বাহাদুর) এবং কানাই লোহার কাঁটা দিয়ে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে পচা, গলিত লাশ ট্রাকে তুলেছে। প্রতিটি লাশ গুলিতে ঝাঁঝরা দেখেছি।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত)
চুন্নু ডোম: পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ঢাকা পৌরসভা (বর্তমানে সিটি করপোরেশন), রেলওয়ে সুইপার কলোনি, ২২৩ নং ব্লক, ৩ নং রেলগেট, ফুলবাড়িয়া, ঢাকা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড, (তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার) থেকে।