বিজ্ঞাপন
default-image

জাতিসংঘের তত্কালীন মহাসচিব উ থান্ট মুক্তিযুদ্ধকালে দীর্ঘ সময় তাঁর ভূমিকা সুস্থির করতে পারেননি। এই ভাষ্যটিতে পাওয়া যাচ্ছে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত মনের পরিচয়।

জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ সালের মার্চে যে অভ্যন্তরীণ সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। এই সংকট পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তবে এখান থেকে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। পাকিস্তানের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহে বহু মানুষ ও জানমালের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে, বিশেষত ১৯৭০ সালের নভেম্বরের সাইক্লোনের পর। জনগণের অবস্থা সঙ্গিন। লাখ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে পালিয়ে গেছে। এতে ভারতীয় সরকার মারাত্মকভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও ত্রাণ প্রদানের সমস্যায় পড়েছে, যা ভারতের সীমিত সম্পদের ওপর অসহনীয় চাপ সৃষ্টি করেছে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যাজর্জরিত মানুষ ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার, এর পরিমাণ আগের সব নজিরকে ছাড়িয়ে যাবে।

আমি ১৯৭১ সালের মার্চের এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের কাছে আমার উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারত ও পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি ও অন্যান্য মাধ্যমে আমি উভয় দেশের সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। আমি জাতিসংঘের দ্বৈত ভূমিকার বিষয়ে খুব ভালোভাবে অবগত আছি। মহাসচিব হিসেবে আমি আর্টিকেল-২-এর প্যারাগ্রাফ-৭ মান্য করতে বাধ্য, আবার আন্তর্জাতিক অথনৈতিক ও সামাজিক সহযোগিতার কাঠামোর আওতায় মানুষের মঙ্গলসাধন ও মানবতাবাদী নীতিকগুলোকে নিশ্চিত করা এবং সেগুলো অগ্রসর করাও আমার দায়িত্ব।

শেষোক্ত নীতির আওতায় আমি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য সহযোগিতার আবেদন করেছি। আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত সহযোগিতা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি জাতিসংঘের শরণার্থীসংক্রান্ত হাইকমিশনারকে প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে নিযুক্ত করেছি। তাঁর কাজ ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের নিকট এসব সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়া। আর পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ঢাকায় একজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেছি, যাঁর কাজ হবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য প্রেরিত আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা। উল্লেখিত দুটি জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম ব্যতীত হাইকমিশনার আমার পূর্ণ সম্মতিতে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের নিজ গৃহে ফেরত আসার প্রক্রিয়া সহজতর করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের ১৯৭১ সালের ১৬ জুলাই অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। হাইকমিশনার ও আন্ত এজেন্সি-বিষয়ক সহকারী মহাসচিবের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আলোচনা শেষে কাউন্সিলের সভাপতি মহাসচিব কর্তৃক গৃহীত উদ্যোগের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন।

আমার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সহযোগিতা আসে; যদিও সেই অর্থ ও সরবরাহ প্রয়োজনীয় পরিমাণের ধারে-কাছেও ছিল না। আর এখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কাঁধে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য লাখ লাখ শরণার্থীর ভরণপোষণের এক আতঙ্ক-জাগানো দায়িত্ব ভর করে আছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে রিলিফের জন্য আমার আবেদনের প্রতি যে সাড়া পাওয়া যায়, তা প্রয়োজনের ধারে-কাছে ছিল না। আমি অবশ্যই বলব, দাতাদেশগুলোকে এই ত্রাণ যথাস্থানে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা যে আমাকে দিতে হবে, পাকিস্তান সরকার বা যেসব সংস্থা পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সরবরাহে নিয়োজিত ছিল, তাদের বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে যথেষ্ট বেগ পোয়াতে হয়েছে। তাদের সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতা এ প্রত্যয়েরই জন্ম দেয়।

শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়াও শুরু হয়নি। ইয়াহিয়া খান সম্মত হয়েছিলেন, ২৫ মে শরণার্থীদের ফিরে আসতে হবে। এতে খুব কমসংখ্যক শরণার্থীই সাড়া দেয়। ভারত ও অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, ভারতে শরণার্থীদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক আপস-রফায় কোনো বিশেষ অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ায় এবং এর ফলে আইনশৃঙ্খলা ও জনপ্রশাসনব্যবস্থার ক্রমাবনতিতে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি ও আন্তর্জাতিক তত্পরতা ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ত্রাণ কার্যক্রমকে সম্প্রসারণ করার মতো পরিস্থিতির উন্নতি না হলে খাদ্যের স্বল্পতা, এমনকি দুর্ভিক্ষও সৃষ্টি হতে পারে। একই সঙ্গে ভারত আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের দেশে ফেরত আসার অন্যতম শর্ত হচ্ছে রাজনৈতিক আপস-রফা, উন্নত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ত্রাণ কার্যক্রমের সফলতা। পরিস্থিতি এমন যে এখানে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রভাবকের কারণে এমন এক দুষ্টচক্রের সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হতাশ হওয়া ব্যতীত গত্যন্তর নেই। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও এই ব্যাপক মানবতাবাদী সমস্যাকে মোকাবিলা করতে পারছে না।

এসব মানবিক বিপর্যয়ের গভীর তাত্পর্য রয়েছে। যে ধ্বংসাত্মক মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে, তা পুরো উপমহাদেশের ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ভারত ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যকার সম্পর্কও এই সমস্যার একটি বিশেষ দিক। রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের অখণ্ডতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার—এ দুইয়ের মধ্যকার বিরোধে সাম্প্রতিক ইতিহাসে বহু ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবেগপ্রবণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে একটি অতিরিক্ত বিপদের দিক যুক্ত হয়েছে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে রয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা ও সমাধানহীন এক সমস্যা। যে কারণে দুই দেশের মধ্যে মাত্র ছয় বছর আগে এক যুদ্ধ লেগে যায়। শান্তির প্রতি উভয় দেশের আনুগত্যই প্রশ্নাতীত, তবে উভয়ের মধ্যকার উত্তেজনা থেকে বোঝা যায়, কারও দিক থেকেই পিছিয়ে আসার কোনো ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা নেই। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সীমান্ত সংঘাত, গুপ্ত আক্রমণ, অন্তর্ঘাতমূলক তত্পরতা প্রভৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরণার্থীরা এই সমস্যাসংকুল সীমান্ত অতিক্রম করায় এ সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর আমাদের জাতিসংঘের কাউকে ভুললে চলবে না, উপমহাদেশের এই সংকটের পরিসর আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

এ রকম বিয়োগান্তক পরিস্থিতিতে নৈতিক মূল্যায়ন দাঁড় করানো খুবই সহজ। পরিস্থিতির রাজনৈতিক ও মানবিক বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া আরও কঠিন বা মানুষকে এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে সাহায্য করা। আমার মনে হয়, জাতিসংঘের এই শেষোক্ত পথেই হাঁটা উচিত।...

সেপ্টেম্বর ১৯৭১

পূর্ব বাংলার পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সংগঠনসমূহের তত্পরতাবিষয়ক জাতিসংঘের বার্ষিক প্রতিবেদনে মহাসচিবের মুখবন্ধের অংশবিশেষ

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০১৪ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত