বিজ্ঞাপন
default-image

সে খেতে থাকে, খুব গোগ্রাসে, সশব্দে, একাগ্রচিত্তে, সশব্যস্তে এবং নত মস্তকে। তাকে খুব ক্ষুধার্ত মনে হয়, যেন অনেক দিন খায়নি অথবা অর্ধভুক্ত থেকেছে। তার মা মাটির মেঝেতে ছেঁড়া মাদুরে তাকে বসিয়ে নিজে একটা ভাঙা ইটের ওপর কুঁজো হয়ে বসে হাতে ধরে রাখা শাড়ির আঁচল দিয়ে বাতাস করার চেষ্টা করে। বাতাস ওঠে না, কেবল ভেজা, পুরোনো কাপড়ের গন্ধ ছড়ায় আর ভেজা মাটিতে সরীসৃপ হেঁটে চলে যাওয়ার মতো শব্দ হয়। একটু পরপর সেই মৃদুমন্দ শব্দ ছাপিয়ে জেগে ওঠে ফুঁপিয়ে কান্নার আর্তনাদ। এত গভীর থেকে উত্থিত হয় সেই কান্নার সুর আর এমন হাহাকারে সিক্ত যে, ঘরের ভেতর উত্তরের শীতের বাতাসের প্রবেশের সঙ্গে তার তেমন তফাত্ থাকে না।

মজিদ মুখ না তুলে ডাল আর ভাতের দলা গলাঃধকরণের পর খুব নিস্পৃহ হয়ে বলে, কান্দ ক্যান? কী হইছে? কাঁদ ক্যানে?

তার মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলে, কদ্দিন পরে আইলি। শুধু ডাল আর ভাত। আর কিছু নাই। বলে সে ফোঁপাতে থাকে।

মজিদ শব্দ করে খায়। তার হাত দ্রুত ওঠানামা করে। মাথা নিচু করে রেখেই সে এক হাত দিয়ে গায়ের চাদরটা টেনে নেয় ভালো করে। বাঁশের তর্জার দেয়ালের ফাঁকফোকর দিয়ে হঠাত্ হঠাত্ বাতাস ঢুকে শরীরে কাঁপুনি ধরায়। তার বেশ শীত লাগে, যেন খোলা আকাশের নিচে রয়েছে।

বাইরে কিছু মানুষের পদশব্দ ওঠে, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা যায়। এই প্রথম মজিদ মাথা তোলে এবং সতর্ক হয়ে বাইরের শব্দ শুনতে থাকে। শব্দটা গভীর হয় না, কাছে আসে না। আস্তে আস্তে দূরে চলে যায়। মজিদ উত্কর্ণ হয়ে থেকে আবার মুখ নিচু করে। আগের মতো একাগ্র হয়ে খেতে থাকে।

তার মা বলে, হাটে যায় মানুষ। আইজ হাটবার। কালামডা হেই হকালে গেছে, তুই আওনের আগে। আড়তে মাল টাননের কাজ পাইছে। তোর আসার খবর পায় নাই। পাইলে যাইত না।

ক্যান? যাইত না ক্যান? মজিদের স্বর ফ্যাসফেসে শোনায়। যেন গলায় খাবার আটকে গেছে।

তুই কত দিন পর আইলি। তোরে ফালায়া যাইত ক্যামনে? কত দিন তোরে দ্যাখে নাই। তার মা বলে।

মজিদ মুখের কাছে হাত নিয়ে চেটেপুটে বলে, দেখা-না দেখায় কী আসে-যায়। আল্লাহর বান্দা তার ইচ্ছামতো থাকে, বাস করে। কহন কোনহানে থাকন লাগে, তা কেউ আগে থাকতে কইতে পারে না। তারপর সে টিনের তোবড়ানো গ্লাস তুলে ঢক ঢক করে পানি খায়। গলার ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় পানি বাধা পাওয়া স্রোতের মতো শব্দ হয়। খাওয়া শেষে সে বেশ আয়েশের সঙ্গে ঢেঁকুর তোলার শব্দ তোলে। তারপর বলে, যার যা কাজ তারে হেইডা করা লাগব। ঘরে বইসা থাকলে চলব না। যহন কারো লগে দেহা হওনের তহন দেহা হইব। হ, দেহা হওনের হুকুম হইলেই দেহা হইব। কেউ ঠেকায়া রাখতে পারব না। আর যদি দেহা না হয়, সেইডাও আল্লাহর ইচ্ছা। বুঝলা? বলে সে বিজবিজে দাড়ির ভেতর ভেজা হাত দিয়ে চুলকাতে থাকে। তারপর মাদুর থেকে উঠে গ্লাস নিয়ে হাত ধোয়ার জন্য ঘরের বাইরে যায়। সেখানে একটা কুকুর লাল জিভ বের করে লালা ফেলছিল আর কয়েকটা কাক তারস্বরে চিত্কার করছিল। মজিদ গলা খ্যাঁকারি দেয় এবং চারদিকে সন্তর্পণে তাকায়। কুকুরটা ভয় পেয়ে দূরে সরে গিয়ে লেজ আর জিভ নাড়তে থাকে। কাকগুলো সজনে গাছের ডাল থেকে উড়ে চলে যায়। তাদের কর্কশ স্বর হঠাত্ বিস্ফোরণের মতো শোনায়।

মজিদের মা তার পেছনে দাঁড়িয়ে বলে, তোরে চিনবার পারি না। ক্যামুন য্যান হয়া গেছস।

ক্যান দাড়ি রাখছি, মাথার চুল লম্বা হইছে, এর লাইগা? মজিদ হাত ধুতে ধুতে বলে।

তার মা বলে, ক্যামনে কথা কস। কী সব কথা কস। কিছু বুঝি না। তুই অ্যামন আছিলি না।

মজিদ ঘরের ভেতর এসে মাদুরটাকে লম্বা করে বিছিয়ে বসে হাই তোলে। তারপর হেসে বলে, কী কই? ক্যামনে কই? তাজ্জব হওয়ার মতো নাহি? কি যে কও? মানুষ কি সব সময় এক থাহে? বদলাইতে হয়। সবই আল্লাহর হুকুম। ওস্তাদের অর্ডার। শেষের কথাটা সে জোর দিয়ে বলে।

ওস্তাদ? কোন ওস্তাদের কথা কস তুই বাপজান? মাদ্রাসার?

না। হেই ওস্তাদের লগে কবেই কাম শেষ। তিনি যা করনের করছেন। ভালা মানুষ। অনেক কিছু শিখাইছেন। আরও পোলাপানরে শিখাইব। মারধর করেন একটু বেশি। তা, ক্যান করব না কও? লেখাপড়া, ছবক নিতে গেলে কান মলা, বেত মারা না দিলে হয় না। বলে সে হাই তোলে। মনে হয় তার ঘুম পাচ্ছে। কব্জি উল্টিয়ে সস্তা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে। ঘরের কোণে রাখা ঝোলাটা দেখে নেয় ভালো করে। তারপর আরেকটা হাই তোলে।

তার মা বলে, ঘুমাইয়া নে। বালিশটা ওপরের মাচান থে নামাইয়া দিই। বলে উঠে দাঁড়িয়ে বাঁশের ওপর রাখা বালিশ আর ছেঁড়া কাঁথা নামিয়ে দেয়।

মজিদ মাদুরে শুয়ে তেল চিটচিটে বালিশে মাথা রেখে চাদর টেনে নিয়ে বুক পর্যন্ত ঢাকে। তারপর বলে, কাউরে কইও না আমি আইছি।

ক্যান? কমু না ক্যান? কত দিন পর আইলি। কত লোকে জিগায় কই গ্যাল, কী করে। কইতাম পারি না। অ্যাহন কমু না তয় কহন কমু? মজিদ ঘুম জড়ানো গলায় বলে, কইবা। সময় হইলেই কইবা। ক্যান কইবা না। চোর-ডাকাত না তোমার পোলা। মাথা উঁচা কইরাই কইবা আমার কথা। ক্যা...ন...। বলতে বলতে কথা শেষ না করে সে ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে খুব ক্লান্ত মনে হয়। হঠাত্ তাকালে একজন মানুষ না, এক খণ্ড কাঠের মতো দেখায়। তার মা পাশে বসে শাড়ির আঁচল লম্বা করে ধরে মশা তাড়ায়।

বাইরে হঠাত্ লোকজনের কথার শব্দ শোনা যায়। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে মজিদ। দিশেহারার মতো তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। স্বর নিচু করে বলে, কারা আইল মনে হয়?

তার মা কান খাড়া করে শুনে নিয়ে বলে, হাটের মানুষ। বাড়ি যাইতাছে। তারপর একটু থেমে বলে, মাইনষের কথা শুনলে তুই অমুন কইরা ডরাইয়া যাছ ক্যান? কী হইছে তোর?

মজিদ উঠে বসে ব্যাগ খুলে দেখে খুব সতর্ক হয়ে। শরীরের কাপড় ঠিকঠাক করতে করতে বলে, কী হইব আবার? কিছুই না। আর মানুষরে ডরামু ক্যান? ডরানের কী আছে? কী যে কও তুমি?

তার মা গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বলে, তুই খুব বদলাইয়া গেছস। এই এক বছরে খুব বদলাইছস। কেমুন য্যান মনে হয়।

মজিদ হাসে। তারপর মায়ের কাছে এসে বলে, কেমুন মনে হয়? ভালা না খারাপ?

তার মা বলে, ভালা-খারাপের কথা কইতাছি না। কেমুন অচেনা লাগে। য্যান অন্য কেউ।

মজিদ মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মানুষ কী সারা জীবন এক রকমই থাকব? বদলাইতে হইব না? দুনিয়া বদলাইতেছে, মানুষ না বদলাইলে দুনিয়াডা তারে ছাড়াইয়া যাইব। হারাইয়া দিব।

তার মা এবার মজিদকে জড়িয়ে ধরে বলে, তুই কয়দিন থাক এহানে।

ক্যান? মজিদ তাকায়।

তোর বিয়া দিয়া দিই। অ্যাহন তো বেকার না তুই। রোজগারপাতি করতাছস। সংসার করনের সময় হইছে।

বাইরে পাখির ডাকাডাকি শোনা যায়। মজিদ দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে বিকেলের রোদ সরে গিয়ে ছায়া পড়ছে। আস্তে অস্তে ছড়িয়ে পড়ছে সেই ছায়া। মাটির উঠান কালো আর শক্ত দেখাচ্ছে, যেন সিমেন্টের তৈরি। কয়েকটা কাক এসে সজনে গাছে বসে কর্কশ স্বরে ডাকাডাকি করছে। বাঁশঝাড়ের গোড়া দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতর থেকে। সেখানে জমাট অন্ধকার। একটা তক্ষক ডেকে উঠল তখেকা তখেকা শব্দ তুলে। দূরে মানুষের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।

তার মা মজিদকে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী, কথা কস না ক্যান? বিয়া কইরা যা এইবার। এক বছর পর আইলি। আবার কহন আসিস ঠিক কী? বউ থাকলে বাড়ির টান থাকব।

শুনে মজিদ হাসে। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলে, আচ্ছা, হইব, হইব। অহন যাওন লাগে।

যাইবি? কই যাইবি? তার মা অবাক।

মজিদ সাবধানে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বলে, শহরে। বলে সেই পকেট থেকে একটা কাগজের বান্ডিল বের করে বলে, রাহ এইডা।

কী? এর মধ্যে কী আছে? তার মা তাকায় তার দিকে।

টাকা। ১০ হাজার টাকা। অ্যাহন আর মাসে মাসে ৫০০ টাকা পাঠামু না। এই টাকা থাকল। বুইঝা-শুইনা খরচ কইর।

তার মা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে। একবার সে কাগজে বাঁধা বান্ডিলের দিকে তাকায় আরেকবার মজিদের দিকে। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বলে, কী কাম করস তুই বাপ? এত ট্যাকা একসঙ্গে দিলি? কী কাম করস?

হেইডা শুইনা কাম কী তোমার? শুধু মনে রাইখ, চুরি-ডাকাতি করি না। হাইজ্যাক করি না। সত্ পথেই আছি। হারাম খাই না। যারা খায় তাদের কাছেও যাই না। কথা বলা শেষ করে সে নিচু হয়ে মায়ের পা ধরে সালাম করে। তার মা তখন ডুকরে কেঁদে ওঠে। মজিদকে জড়িয়ে কাঁদতে থাকে হাপুস চোখে। তার হাতের বাঁধুনি ক্রমেই শক্ত হয়ে আসে। ভাঙা গলায় সে বলতে থাকে, তুই যাইস না বাপ। তুই এই হানে থাক। তোর চাকরি করনের কাম নাই। আমার লগে থাক। আমার য্যান ক্যামুন লাগতাছে।

মজিদ তার মায়ের মাথায় হাত রেখে আস্তে আস্তে আঙুল বুলাতে থাকে। তারপর বলে, মন খারাপ কইর না। মন শক্ত করো। আল্লাহ তার বান্দার কান্নাকাটি পছন্দ করে না। আমারে অহন যাইতে দাও। দেরি হইয়া যাইতাছে। আমার অহন যাওন লাগে। টাইম হইছে।

বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে হারিয়ে যায় মজিদ। তার মা উঠানে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখার চেষ্টা করে। ছায়ার ভেতর মজিদকে কখনো দেখা যায়, কখনো তাকে ছায়ার অংশ মনে হয়। তার হাতে ধরে রাখা কাগজের বান্ডিলটা হঠাত্ পড়ে যায়। উঠানের মাটিতে একটা ভোঁতা শব্দ ওঠে। মজিদের মায়ের সেদিকে খেয়াল থাকে না। সে সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসা ছায়া-অন্ধকারে মজিদকে খুঁজতে থাকে। তার ভেতর থেকে কান্না ফেটে পড়তে চায়। সেই সময় গাবগাছের ঘন ডালপালা আর অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া পাতার আড়ালে লুকিয়ে ডেকে ওঠে পেঁচাটা। পেঁচার ডাক শুনে মজিদের মা চমকে ওঠে। সন্ধ্যায় সে পেঁচার ডাক শোনেনি আগে। শুনে থাকলেও এখন সে কথা মনে পড়ে না। সে মুখ নিচু করে নিজের গায়ে থুথু দেয়।

তিনি আসামির দিকে তাকান। গত দুই বছরে বেশ কয়েকবার দেখেছেন এবং কাছে থেকেই। বিচারক হিসেবে তার আসন একটু উঁচুতে। চারদিকে কাঠের ঘের দেওয়া, তার ওপাশে লাল সালু দিয়ে ঢাকা। আসামি এক পাশে কাঠের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটাকে দেখতে দেখতে তার চেহারা মুখস্থ হয়ে গেছে। কালো বিজবিজে দাড়িতে এখন মুখটা ঢাকা। প্রথম দিকে দাড়ি এত ঘন ছিল না। স্বাস্থ্যও ছিল অটুট, সবল। এখন যেন আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে দাঁড়াতেই সে বেশ বুড়িয়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়ে এসেছে ঘোলাটে, ম্লান। কপালে বলিরেখা স্পষ্ট হয়ে এসেছে। সোজা হয়ে দাঁড়ালেও মনে হয় যেন একটু কুঁজো।

এই দুই বছরে প্রায় সব কিছুই জানা হয়ে গেছে তার। বিচারক হওয়ার এই এক সুবিধা। দুই পক্ষের সওয়াল-জবাবে সব জানা হয়ে যায়। তার মধ্যে বানানো কিছু থাকে, অতিরঞ্জনের অংশও কম নয়। কিন্তু এর ভেতর থেকেই বাস্তব ঘটনা এবং যা সত্য তা বেরিয়ে আসে। বেশ বোঝা যায়, যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সত্যি কি না। সে সত্যিই অপরাধী কি না। অবশ্য সাক্ষী-সাবুদের ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর থেকে গেলে অপরাধী জানার পরও দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।

এ আসামি তেমন ভাগ্যবান নয়। দুই বছর ধরে মামলা চলার সময় এমন সব সাক্ষী এসেছে এবং প্রমাণ পাওয়া গেছে, যার ভিত্তিতে তার অপরাধ সন্দেহাতীতভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেছে। লোকটি যে ঠান্ডা মাথায় বেশ সুপরিকল্পিতভাবে খুন করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। লোকটিকে দেখে যত মায়াই হোক, তাকে সর্বোচ্চ শাস্তিই যে দিতে হবে, এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।

মানুষ অনেক কারণেই খুন করে। প্রেম, ঈর্ষা, ক্রোধ, সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার লোভ, এর যেকোনো একটির কারণেই একজন খুনি হতে পারে। হয় সে নিজে খুন করে অথবা ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করে। একমাত্র হঠাত্ রাগের মাথায় খুন করা ছাড়া কোনো খুনের আসামির প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখানোর সুযোগ থাকে না। এ লোকটি হঠাত্ রাগের মাথায় খুন করেনি। সে নিজেই খুন করেছে। একজনকে না, দুজনকে; যদিও তার লক্ষ্য ছিল একজনই। এই খুন করার জন্য সে খুব ঠান্ডা মাথায় সব পরিকল্পনা করেছে। দীর্ঘ সময় নিয়েছে এ পরিকল্পনার জন্য। এত নিখুঁত ছিল সেই পরিকল্পনা যে, ভিকটিমদের বেঁচে যাওয়া বা রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না।

প্রশ্ন হলো, লোকটি যে কারণে খুন করেছে, তা বেশ অসাধারণ। তার মোটিভ অবশ্যই ছিল, কিন্তু খুবই উদ্ভট। মনে হয় যেন সে অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তাকে পাগল বলা বা প্রমাণ করা যায়নি। সে আদালতে এসে খুব স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে। তার আচার-আচরণে কোনো অস্বাভাবিক ভাব ছিল না। কিন্তু তার মোটিভ, সেটা যে উদ্ভট এবং অস্বাভাবিক, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। এমন মোটিভ নিয়ে আর কাউকে খুন করতে শোনেননি তিনি। এ ধরনের আসামিকে তার এজলাসে বিচারের জন্য হাজির করা হয়নি।

তিনি তাকে মৃত্যুদণ্ডই দিলেন। সেই সময় আদালতে লোক উপচে পড়ছিল। এই খুনের মামলা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল প্রথম থেকেই। প্রতিটি শুনানির দিনই ভিড় জমত কোর্টের ভেতরে ও বাইরে। কড়া পুলিশি পাহারা দিয়েও ভিড় সামলানো যায়নি। সাংবাদিক থেকে শুরু করে মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকত শুনানির দিন। পরদিন সংবাদপত্রে বিশদভাবে ছাপা হতো শুনানির খবর।

হত্যা মামলার রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে জটলা বেড়ে যায়, কোলাহল তুঙ্গে ওঠে। পুলিশকে লাঠিচার্জ করতে হয়। বিশেষ প্রহরায় আসামিকে যখন প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়, সে সময় চারদিকে বেশ হইচই হয়েছিল। স্লোগান শোনা গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ভিড় ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশকে টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করতে হয়।

বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে তার কাছ থেকে মামলার রায় সম্বন্ধে শুনতে চায়। যদিও মামলার রায় তিনি বাড়িতে বসেই লিখেছেন, বিষয়টি খুব গোপনীয় বলে নিকটজনদেরও জানাননি। রায় ঘোষণা করে বাড়িতে ফেরার পর তিনি পরিবারের সবাইকে জানান। তারা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল। শুনে তারা সবাই চুপ করে যায়। তিনি তাদের চোখেমুখে বেশ আতঙ্কের ছাপ দেখতে পান। ভরসা দিয়ে বলেন, বিচারকদের এমন রায় দিতেই হয়। আইনত তারা এ শাস্তি দিতে বাধ্য। এখানে দয়ামায়া কিংবা ভীরুতার অবকাশ নেই। শুনে তার স্ত্রী চুপ করে থাকেন। আস্তে করে বলেন, এসো হাত-মুখ ধোবে। নাশতা করবে। সারা দিন খুব ধকল গেছে। স্কুলে পড়ে যে মেয়েটি, সে বলে, কাল কাগজে তোমার ছবি ছাপা হবে?

তিনি হেসে বলেন, আমার ছবি ছাপা হবে কেন? আসামির ছবি ছাপা হবে।

তার ছেলে বলে, আসামির কি এখনই ফাঁসি হবে?

তিনি বলেন, না। সে উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারে। তারপর সেখানে রায় বহাল থাকলে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারে। এসব নিয়ে বেশ সময় চলে যাবে। এখনই তার ফাঁসি হবে না।

কয়েকদিন পর তিনি আদালতে যাওয়ার জনা তৈরি হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সামনে গাড়ি অপেক্ষা করছে। ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন তিনি। ইঞ্জিনের শব্দে গাড়ির শরীর নড়ে উঠছে। পিয়নের হাতে কাপড়ে বাঁধা ফাইল। সেসব গাড়িতে ওঠানোর পর তিনি উঠলেন। গাড়ির দরজা বন্ধ করে রাস্তার পাশে তাকালেন। খুব একটা লোকজন নেই। কিন্তু তাকাতেই খুব অবাক হলেন এবং একটু চমকেও উঠলেন যেন। অবিকল সেই খুনের আসামির মতো লোকটি। সেই একই রকম কালো ঘন বিজবিজে দাড়ি। তীক্ষ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাত্ দৌড়ে এল কাছে। এক হাত দিয়ে তাকে থামতে বলছে যেন। অন্য হাতে কিছু একটা ধরে রাখা।

তিনি কিছু বলার আগেই লোকটা তার গাড়ির কাছে এসে জানালার কাচের ওপাশে দাঁড়িয়ে কী যেন বলতে থাকে। তিনি জানালর কাচ নামিয়ে দেন।

লোকটি উত্তেজিত হয়ে বলে, এই আইন কোনো আইনই না। কোত্থেকে পেলেন এ আইন? চুরি-ডাকাতি খুন-খারাবির জন্য শাস্তি দিয়ে যাচ্ছেন। আপনি নিজেই দোষী, অপরাধী। আইন মেনে চলছেন না আপনি। আপনাকে সঠিক আইন মানতে হবে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না।

কথা বলতে বলতে লোকটা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তার কণ্ঠস্বর চড়া হতে থাকে। মনে হয় যেন ধমক দিয়ে কথা বলছে। ক্রোধে তার চোখ দুটো বস্ফািরিত হয়ে আসে। তিনি তাড়াতাড়ি জানালার কাচ বন্ধ করতে যান। তার আগেই লোকটি তার হাতে ধরে রাখা বস্তুটি গাড়ির ভেতর নিক্ষেপ করে। তার চিত্কার বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে এক হয়ে যায়। তিনি লোকটার চেহারা দেখতে পান না। তার চোখের সামনে নানা রঙের বিস্ফোরণ হতে থাকে। একসময় তিনি শুধুই লাল রং দেখতে পান। তার খুব তৃষ্ণা পায়।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত