ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিয়েছিলেন পার্লামেন্ট বসবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউয়ে দেশ উত্তাল। সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। অফিস–আদালতও অচল। বঙ্গবন্ধু যা বলছেন, সেটাই হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসও তখন বন্ধ। হল থেকে সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী চলে গেছে। আমি ইকবাল হলের আবাসিক (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র। নিচতলায় ১১৬ নম্বর কক্ষটি আমার। আমি সাবসিডিয়ারি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমরা কেউই আঁচ করতে পারিনি, কী ভয়াবহ একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে।
প্রতিদিনের মতো ২৫ মার্চ বিকেলেও নিউ মার্কেটে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হলে এসে গোসল করলাম। খুব গরম পড়েছিল। হলগুলোতে তখন মিল বন্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির মাঝামাঝি পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্ট ছিল। খাবার সস্তা। আট আনা–দশ আনায় খাওয়া হয়ে যেত। এই এলাকার ছাত্রছাত্রীরা এখানেই খেত। আমি লুঙ্গির ওপর হাফশার্ট গায়ে দিয়ে পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেল গলিয়ে পপুলারে খেতে বের হলাম।
বেরিয়ে দেখি, পথে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন চলছে। ভাত খেয়ে বের হয়ে পানের দোকানে গিয়েছি। দেখি, চারদিকে হইচই। সবাই বলছে, গাছ কাটো, ইট–পাথর ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দাও। দেখি একটা রিকশা দ্রুতগতিতে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলছে, ‘সবাই বাড়ি চলে যান, বাড়ি চলে যান। শহরে আর্মি ঢুকতেছে।’
আমি ওকে থামালাম। কেন যেন হঠাৎ আমার মনে হলো, ফজলুল হক হলে থাকে আমার স্কুলজীবনের বন্ধু হাবিবুল্লাহ। আজ ওর ওখানে যাই। রিকশাওয়ালাকে বললাম, আমাকে ফজলুল হক হলে নামিয়ে দাও। তখন ঠিক রাত সাড়ে নয়টা। হাবিবুল্লাহ আর ওর রুমমেট তখন পড়ছে। আমরা গল্প করলাম। রাত সোয়া ১০টার দিকে শুরু হলো গোলাগুলি। এরপর ক্রমেই বাড়তে থাকল। চারপাশে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ।
টিভি নেই, রেডিও নেই। বুঝতেই পারছি না, কী হচ্ছে। ফজলুল হক হলে আমরা প্রায় ৩০–৩৫ জনের মতো ছাত্র ছিলাম। একপর্যায়ে সবাই এক রুমে এসে জড়ো হলো। সবার মধ্যে প্রবল উৎকণ্ঠা। রাত সাড়ে ১১টার দিকে আমরা ২০–২৫ জন হলের ছাদে উঠলাম। সামনেই কার্জন হল। তার পাশ দিয়ে দেখছি ইকবাল হল, অর্থাৎ নিউ মার্কেটের দিকে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আর প্রচণ্ড গোলাগুলি। মনে হলো, পাকিস্তানি সেনারা পুরো নিউমার্কেট জ্বালিয়ে দিয়েছে। আসলে ওরা নীলক্ষেতের বস্তিতে আগুন দিয়েছিল।
ইকবাল হলের সামনে পুকুরের পাশ থেকে আকাশের দিকে আগুনের ফোয়ারা উঠছিল। চারপাশ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সেই আলো দেখে দেখে সেনারা ইকবাল হলের দিকে প্রচণ্ড গুলি ছুড়ছে। মাঠ থেকে গুলি করতে করতে হলের দিকে যাচ্ছে। গুলির আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা। ছাদ থেকে আমরা রাত ১টার দিকে নেমে এলাম।
নেমে আসার সময় ঘর্ঘর শব্দ করে কার্জন হলের সামনে দিয়ে দুটো ট্যাংক চলে গেল প্রেসক্লাবের দিকে। একটি ট্যাংক থেকে প্রেসক্লাবে গুলি করা হয়েছিল।
আমরা আবার রুমে ফিরলাম। ভয়ে সবার ঘুম পালিয়েছে। ল্যান্ড ফোনের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। একটানা গোলাগুলির মধ্যে রাত আড়াইটা–তিনটার দিকে আমরা কয়েকজন আবার হলের ছাদে উঠলাম। দেখি আগুন আরও বেড়ে গেছে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান টার্গেট ছিল বলে এই দুই দিক থেকেই গুলির আওয়াজ আসছিল বেশি।
রুমে এসে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ঘুম হলো না। শুয়ে থেকে রাত পার করলাম। সকালে উঠে হলের সামনে এসেছি। দেখি, একজন–দুজন করে লোক যেতে যেতে বলছে, ‘কারফিউ দিয়েছে, কেউ বের হবেন না।’ রেডিও ছিল না বলে কোনো খবরই পাইনি। কিছুক্ষণ পর ফজলুল হক হলের একজন হাউস টিউটর এসে জানালেন, শহরে কারফিউ দিয়েছে।
হাউস টিউটর দুপুরে দারোয়ানদের দিয়ে একটু রান্নার ব্যবস্থা করালেন। নাকে–মুখে কিছু খেয়ে হলের রুমেই থেকে গেলাম। রাতে জাউভাত হলো। ডাইনিং হলের মালপত্র রাখা ও ছাদের মাঝখানে গুদামের মতো একটা জায়গায় সবাই রাতে কাটাল।
পরদিন ২৭ মার্চ সকালে শুনলাম কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে। সে রাতে পাকিস্তানি সেনারা ফজলুল হক হলে কেন হামলা করেনি, তার একটা বিস্ময়কর কারণ আছে। হলের দারোয়ান ছিল বিহারি। পাকিস্তানি সেনারা ঢাকা হলে (এখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ঢুকে একজন হাউস টিউটর ও কয়েকজন ছাত্রকে হত্যা করে। এরপর পুকুর পাড় দিয়ে ফজলুল হক হলের গেটে এসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করা হলো কেউ আছে কি না। বিহারি দারোয়ান উর্দুতে বলে, না, কেউ নেই, সবাই বাড়িতে চলে গেছে। উর্দুভাষী বলে তার কথায় সেনারা বিশ্বাস করে হামলা না করে সেখান থেকে চলে যায়।
যা–ই হোক, হাবিবুল্লাহর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আমার হলের দিকে রওনা দিলাম। কার্জন হলের পেছন থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল আর এস এম হলের মাঝখান দিয়ে উঠলাম ইকবাল হলের মাঠে। যেতে যেতে পথের পাশে আর ফুটপাতে দেখি গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বেশ কয়েকটি লাশ পড়ে আছে। এই প্রথম ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার শিকার হওয়া হতভাগ্য বাঙালিদের লাশ আমার চোখে পড়ল। পরের দৃশ্য আরও বীভৎস ও মর্মান্তিক।
হলের সামনে বিশাল খোলা মাঠ। মাঠের কোনায় পা দিয়েই দেখি ৪০–৪৫টা মৃতদেহ পড়ে আছে। বেশির ভাগই চেনা। আমাদের ইকবাল হলের ছাত্র। কেউ কেউ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বোঝা গেল না। হলের আশপাশের কোয়ার্টারে কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের এবং তাঁদের বাসার কাজের লোকদেরও লাশ চোখে পড়ল। গুলিতে অনেকেরই দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। গেটের কাছে এসে দেখি আমাদের হলের দারোয়ান আর তাঁর ছেলের লাশ পড়ে আছে।
আমি দ্রুত আমার রুমের সামনে গেলাম। দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তাই ঘাতকেরা ধরে নিয়েছিল, ভেতরে কেউ নেই। দরজা ভাঙেনি। অন্য যে যে রুমে ছেলেদের পেয়েছে, তাদের মাঠে এনে সার বেঁধে গুলি করে মেরেছে। ইকবাল হলেই গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল বেশি।
রুমে ঢুকে দ্রুত স্যুটকেস গুছিয়ে বের হলাম। হলের গেটে এসে দেখি কবি নির্মলেন্দু গুণ পলাশীর দিক থেকে হেঁটে হেঁটে আমাদের হলের দিকে আসছেন।
আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগে দুজনের কান্না চলে এল। নির্মলেন্দু গুণ বললেন, ‘তুমি যে বেঁচে আছ, সেটা ভাবিনি। ভাবলাম, লাশটা দেখে যাই। ওর বাবাকে গিয়ে অন্তত বলতে পারব।’ আমরা তো দুজনই নেত্রকোনার। আমার আব্বা খোরশেদ আলী তালুকদার খুব নামকরা শিক্ষক।
তারপর নির্মলেন্দু গুণ আর আমি হাঁটতে লাগলাম। ভাবছি, কোথায় যাব। চারদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে লোক দ্রুত পালানোর চেষ্টা করছে। সঙ্গে ঘটি–বাটি, সামান্য জিনিস। অনেকেই যাচ্ছে কেরানীগঞ্জের দিকে। আমরাও সেই জনস্রোতে মিশে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে কেরানীগঞ্জের দিকে রওনা দিলাম। একসময় কেরানীগঞ্জ পেরিয়ে পৌঁছালাম জিঞ্জিরায়।
হেলাল হাফিজ কবি ও সাংবাদিক