জন্মলগ্নে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্রের বিকাশ। দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে গণতন্ত্র হবে প্রধান চালিকাশক্তি, সেদিন যারা দেশকে স্বাধীন করেছিলেন তারা এই বিশ্বাসেই তা করেছিলেন। তারা ক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বত্সর। তাদের সামনে ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের হাজার সমস্যা। এই সমস্যার বেড়াজাল থেকে তারা দেশকে মুক্ত করে আনছিলেন,—এমন সময়ে ঘটল বিনা মেঘে বজ্রপাত। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ড দেশের দৃশ্যপট রাতারাতি বদলে দিল। সংবিধানসম্মতভাবে ক্ষমতার হস্তান্তর হলো না। একটি সামরিক উত্থানের সুযোগ গ্রহণ করে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেন, উত্থানের নায়ক মেজর-গোষ্ঠী বঙ্গভবনে তাদের নির্দেশমতো চলতে বাধ্য করলেন প্রথম উত্থানউত্তর রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাককে। মোশতাক ছিলেন ওদের পুতুল রাষ্ট্রপতি। মোশতাককে সরিয়ে দিয়ে বিচারপতি সায়েমকেও এরাই বসালো রাষ্ট্রপতির আসনে। প্রকৃত ক্ষমতা হাতে নিয়ে জিয়াউর রহমান কিছুদিন নিজেকে রাখলেন আড়ালে, তারপর সময় বুঝে সামনে চলে এলেন। বিচারপতি আবু সাদাত সায়েমের পুতুল-রাজত্ব ততোদিনই ছিল যতোদিন এই কূটনৈতিক ভাণের প্রয়োজন ছিল। সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ক্ষমতাগ্রহণের জন্য মিলিটারি পন্থায় এটাকে বৈধতা দেয়ার পথও বােল দিয়েছিলেন জেনারেল আইয়ুব। সে-পথই বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করলেন এ-দেশের সামরিক ছাউনি থেকে আগত শাসকেরা। স্বৈরশাসক হিসেবে আইয়ুবের অনেক অর্জন ছিল, যদিও শেষ রক্ষা করতে পারেননি তিনি। সামরিক শাসনে গণতন্ত্রের বিকাশ হয়নি, হওয়ার কথা নয়। গণতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়েছিল, সেই সমাধি থেকে এখনও বেরিয়ে আসতে পারেনি পাকিস্তান। বাংলাদেশেও গণতন্ত্রকে অল্পমাত্রায় বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে, ধীরে ধীরে। নব্বুইয়ের উত্থানের পরও আমরা দেখতে পাচ্ছি সেই বিষক্রিয়ার ফল ভোগ করতে হচ্ছে দেশকে।
সামরিক শাসনের ফলে গণতন্ত্রবিরোধী দূষিত চিন্তায় আক্রান্ত হয়েছে দেশের রাজনীতি। রাজনীতি যে বর্তমানে আখের গোছানোর রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে, এর সূচনা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। তিনি এক অপূর্ব অভিনয় করে গেলেন। দুর্নীতিতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে মাঝখানে তিনি রইলেন এক নিষ্কলঙ্ক রাজা—কোনো মালিন্য তাকে স্পর্শ করে না। তার শাসনামলে দুর্নীতির জন্য কোন মন্ত্রীকে শাস্তি পেতে হয়নি। শাস্তি পেতে হয়েছে অযোগ্যতার জন্য, বা আনুগত্যের প্রশ্নে সন্দেহভাজন হওয়ার কারণে। মন্ত্রিত্বে বরণ ও মন্ত্রিত্ব থেকে অপসারণ তার সময়ে তার স্বৈরশাসনের এক নিয়মিত দৃশ্য ছিল। সকল ক্ষমতা তার মুষ্টিগত, এটা তিনি প্রমাণ করেছেন এভাবেই। তার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের খোলাদরোজার পথে জামায়াতে ইসলামীর গৃহপ্রবেশ হলো। গণতন্ত্রের মাথায় ধর্মের টুপি চড়ল। সারা দেশকে নির্বোধ মনে করে বোঝানো হলো, বাংলাদেশে তারা বিপন্ন ইসলামকে বিপন্মুক্ত করেছেন। সরকার ধর্মের অভিভাবক হয়ে বসলো। পাশাপাশি রাজনীতির অঙ্গনে ব্যবসায়-বুদ্ধির জন্য এক অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হলো। যারাই এখানে প্রবেশাধিকার পান তারাই রাতারাতি বিত্তবান হয়ে যান। রাষ্ট্র পরিণত হলো এক কামধেনুতে, রাজনীতিকের কাজ তাকে দোহন করে নিজের ভাগ্যোন্নয়ন। পাকিস্তানের তেইশ কোটিপতির মধ্যে বাঙালি একজনও ছিল কিনা সন্দেহ। বাংলাদেশ, সামরিক শাসনের স্বর্ণযুগে পরিণত হ’ল সহস্র কোটিপতির দেশে।
বর্তমান বাংলাদেশে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা কতো কেউ বলতে পারে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলতে পারে না, আয়কর কর্তারা বলতে পারে না, কারণ বাংলাদেশের বিলিয়ন কোনো হিসাবের খাতায় নেই। অথচ বিলিয়নের মালিক বিলিয়নেয়ারেরা যে আছেন, তা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। প্রতিদিন নতুন নতুন বেসরকারি ব্যাংক জন্মগ্রহণ করছে, প্রতিদিন নতুন নতুন টিভি চ্যানেল আসছে, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি গজাচ্ছে, শপিং মল সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের দারিদ্রকে উপহাস করে রাজনীতির বরপুত্ররা এমন সব দামী গাড়ি হাঁকিয়ে চলছে ঢাকার রাস্তায় যে দেখে সবার তাক লাগে। খবরের কাগজে লিখছে, ইনকামট্যাক্সের তালিকায় নেই এইসব নব্যধনীদের উপর নাকি নজরদারি করা হচ্ছে। এই ঘোষণায় কেউ ভুলবে না। সরকারি ও বিরোধীদলীয় নেতাদের সম্পদের হিসাব নিক একটি সংসদীয় কমিটি, বা বিচার বিভাগীয় কমিটি, সংসদে এই প্রস্তাব পেশ করেছিলেন বিরোধী দলের উপনেতা। জবাবে প্রধানমন্ত্রী, বা স্পিকার একটি কথাও বলেননি। অর্থাত্ প্রস্তাবটি পছন্দ হয়নি। এর আগের প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সংসদ-সদস্যদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের কী হলো। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, তারা দাখিল করেছেন তার কাছে। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী জানেন, এদেশবাসী এটা জেনে খুশি থাকতে পারে।
একটা সত্য এতদিনে সবাই উপলব্ধি করেছে। দেশের এই সামূহিক পতনের জন্য দায়ী দেশের রাজনীতি। সিভিল সোসাইটির নেতৃবৃন্দ জোর আওয়াজ তুলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলিকে বাধ্য করতে হবে আগামী নির্বাচনে তারা যেন দুর্নীতিপরায়ণ, অযোগ্য, কালোটাকার মালিক কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দেয়। রাজনৈতিক দলগুলির একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বিগত তিরিশ বত্সরে। নীতিবান সিভিল সোসাইটির উপদেশে এরা তওবা করে ধর্মের পথে ফিরে আসবে, আশা করা এক অমার্জনীয় সরলতা। হিতোপদেশে কাজ হবে না, এরা সবাই পোড়-খাওয়া রাজনীতিক। রাজনীতির মধ্যে এরা যে রসের সন্ধান পেয়েছেন, তা থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত করবেন কিছু নীতিবাগীশের কথায়, আমি বিশ্বাস করি না। আমি কিছুটা বিশ্বাস রাখি নতুন প্রজন্মের উপর। আর বিশ্বাস রাখি জাগ্রত ও সোচ্চার জনমতের উপর। জনমত সংগঠনের উপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার আগামী নির্বাচনসংক্রান্ত জটিল কর্মসূচির মধ্যে এই অংশটি মূল্যবান ও বাস্তবসম্মত।
দেশের রাজনীতি শুধু অশুদ্ধ নয়, স্লো পয়জনিংয়ের ফলে মৃত্যুপথযাত্রী। একে পূর্ণ স্বাস্থ্যে ফিরিয়ে আনা অতো সহজ নয়। মানুষের চিন্তা ও অভ্যাস একটা মজ্জাগত ব্যাপার—মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও প্রাথমিক শুদ্ধতা ধরে রাখতে পারেনি। ক্ষমতার আসনে এসে কংগ্রেসের নেতারা সবাই নির্লোভ রাজনীতির চর্চা করেননি। একচ্ছত্র ক্ষমতায় দীর্ঘকাল থাকা সোভিয়েত য়ুনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টিও কিভাবে ভিতর থেকে ক্ষয়রোগের শিকার হলো, ও প্রথম ধাক্কাতেই ধরাশায়ী হলো, আমরা দেখলাম। আমাদের একমাত্র ভরসা, গণতন্ত্রকে একটা সুযোগ দিতে পারলে গণতন্ত্র নিজেই নিজেকে সংস্কার করবে। সেই সুযোগ দিতে পারে একটি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন, ও একদল নবীন রাজনীতিকের অভ্যুদয়। দেশের দুটি প্রধান দলেই আছে সম্ভাবনাময় আদর্শবাদী তরুণ। দলের কাজ হবে তাদের শনাক্ত করা ও তাদের জন্য জায়গা করে দেওয়া। প্রথম কাজ হবে পচন রোধ করা, তারপর স্বাস্থোদ্ধার করা, ধীরে ধীরে। আমরা সেই প্রক্রিয়ার সূচনা দেখতে চাই।
সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৬ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত