বিজ্ঞাপন
default-image

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ‘মুক্তিযুদ্ধ কর্নার’ নামের একটি জায়গা আমরা আলাদা করেছি। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ওপর বইপত্র, দলিল, আলোকচিত্র, পোস্টার, ভিডিও—সবকিছু সংরক্ষণ করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কৌতূহলী ছাত্রছাত্রী সেখানে ঢুঁ মেরে যেতে পারবে। কেউ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো গবেষণা করতে চাইলেও তিনি যেন হাতের কাছে সবকিছু পেয়ে যান সে রকম একটি উদ্যোগ নেওয়া হবে। এটা নিয়ে আমাদের উত্সাহের শেষ নেই—বইপত্র, পোস্টার, ভিডিও খুঁজে আনা হচ্ছে, ওয়েবসাইট তৈরি হচ্ছে, বইয়ের তালিকা করা হচ্ছে। বইগুলো হাতে নিয়ে কৌতূহলী হয়ে খুলে দেখার সময় হঠাত্ করে সিদ্দিক সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটি হাতে উঠে এল। একাত্তর সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পাবলিক রিলেশনস অফিসার হিসেবে তিনি বাংলাদেশে ছিলেন, গণহত্যা থেকে যুদ্ধ এবং পরাজয়—সবকিছু খুব কাছে থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছেন। বইটি পুরোপুরি পাকিস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা। তার পরও সেখান থেকে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। বইটি খুলতেই ২৫ মার্চের রাতের সেই বিভীষিকার বর্ণনাটি চোখে পড়ল। ইংরেজিতে লেখা বই; বাংলায় অনুবাদ করলে সিদ্দিক সালিকের স্মৃতিচারণাটুকু হয় এ রকম: ‘আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে টানা চার ঘণ্টা সেই বীভত্স দৃশ্য দেখলাম।

এই ভয়ঙ্কর রাতের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দৃশ্য ছিল আকাশছোঁয়া আগুনের লেলিহান শিখা। ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাঝে মাঝে ওপরে উঠে আসে, কিন্তু পরের মুহূর্তে আগুনের শিখা সেটা ছাপিয়ে ওপরে উঠে প্রায় আকাশের নক্ষত্রকে স্পর্শ করতে চায়। সে রাতের চাঁদের জোছনা আর নক্ষত্রের আলোর আভা মানুষের তৈরি গনগনে চুলোর আগুনের কাছে ম্লান হয়ে গিয়েছিল। সবচেয়ে বড় আগুনের শিখাটি এসেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে...।’

তিন যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে, তার পরও মনে হয়, মাত্র সেদিনের ঘটনা। একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর রাগ বুঝি সবচেয়ে বেশি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ওপর। সেখানে আক্রমণ করার পর বাধা পেয়ে একজন ক্যাপ্টেন ওয়্যারলেসে যোগাযোগ করেছে, উচ্চপদস্থ একজন মিলিটারি খেপে গিয়ে সেই ক্যাপ্টেনকে কী বলেছে, সিদ্দিক সালিক সেটাও লিখেছেন। লেখাটি এ রকম: ‘পুরো এলাকাটা ধ্বংস করতে কতক্ষণ লাগবে?...চার ঘণ্টা?...ননসেন্স! তোমার কাছে কী অস্ত্র আছে? রকেট লঞ্চার? রিকয়েললেস রাইফেল? মর্টার? আর...ঠিক আছে! এগুলো ব্যবহার করে দুই ঘণ্টার মধ্যে এলাকাটা দখল করো।’

সেই ক্যাপ্টেন দুই ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখল করেছিল। সিদ্দিক সালিক পরদিন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গিয়ে তিনটি গণকবর দেখতে পেয়েছিলেন বলে লিখেছেন, বড়টি প্রায় ৫০ ফুট দীর্ঘ। ৫০ ফুট দীর্ঘ একেকটি গণকবরে কতজন ছাত্রকে পুঁতে রাখা যায় সেটি তিনি লেখেননি। পাকিস্তানি লেখকেরা এ ব্যাপারে অসম্ভব সংযমী!

২৫ মার্চের গণহত্যার হূদয়হীন অংশটুকু সিদ্দিক সালিক নিপুণভাবে লিখেছেন। রাতের বেলা গণহত্যা করে পরদিন দুপুরে সব মিলিটারি অফিসারের মনে ফুরফুরে আনন্দ, খানাফিনা হচ্ছে। তখন ক্যাপ্টেন চৌধুরী নামের একজন কমলা ছিলে খেতে খেতে বলল, ‘বাঙালিদের আচ্ছামতো একটা শিক্ষা দেওয়া গেছে। এখন কম করে হলেও একটা প্রজন্ম সিধে হয়ে থাকবে।’ কথার উত্তরে মেজর মালিক নামে একজন বলল, ‘ঠিকই বলেছ! বাঙালিরা তো এই একটা ভাষাই বোঝে—শক্ত পিটুনি। ইতিহাস তো তা-ই বলে!’

দেখাই যাচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইতিহাসজ্ঞান খুব ভালো নয়। নয় মাসের মধ্যে তাদের নতুন ইতিহাস শিখতে হয়েছিল। আমার ধারণা, সেই ইতিহাসের কথা তারা এই জন্মে আর ভুলবে না!

সিদ্দিক সালিকের বইয়ের কথাটি হঠাত্ করে তুলে আনার একটি কারণ আছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে তাদের সহযোগী কারা ছিল, সেটি সবচেয়ে ভালো করে কে বলতে পারবে? বলার অপেক্ষা রাখে না, সেটিও নিশ্চয়ই হবেন সিদ্দিক সালিক কিংবা তাঁর মতো কোনো মিলিটারি অফিসার! কাজেই সেই ব্যাপারগুলো নিয়ে সিদ্দিক সালিক কী বলেছেন, সেটা নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকতেই পারে। বাংলায় অনুবাদ করলে সেটি দাঁড়ায় এ রকম: ‘পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারির সম্পূরক শক্তি হিসেবে রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল। একই সঙ্গে সেটি স্থানীয় মানুষদের অংশগ্রহণের একটি ভাব এনে দিত। টার্গেট ছিল এক লাখ—শেষ পর্যন্ত ৫০ হাজারের মতো দাঁড় করানো গিয়েছিল।

সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি রাজনৈতিক ডেলিগেশন এসে জেনারেল নিয়াজির কাছে অভিযোগ করে বলল, (রাজাকার বাহিনী নয়) এ দেশে আসলে জামায়াতে ইসলামীদেরই একটি বাহিনী দাঁড় করানো হয়েছে! জেনারেল নিয়াজি তখন সিদ্দিক সালিককে ডেকে বলেছিল, ‘এখন থেকে রাজাকারদের আলবদর আর আলশামস বলে ডেকো, যেন কেউ বুঝতে না পারে যে তারা আসলে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল (জামায়াতে ইসলামী) থেকে এসেছে!’ সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, জেনারেল নিয়াজির নির্দেশ পাওয়ার পর তিনি ঠিক সেভাবেই কাজ করেছেন!

সবার নিশ্চয়ই মনে আছে, যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের কথাটি খুব জোরেশোরে আসতে শুরু করেছে, তখন জামায়াতে ইসলামী বলতে শুরু করল, একাত্তরে তারা হয়তো বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছিল, কিন্তু সেটি ছিল পুরোপুরি ‘রাজনৈতিক’ বিরোধিতা! তারা মোটেও অস্ত্র হাতে বিরোধিতা করেনি। একাত্তর সালে তারা যে পাকিস্তানি প্রভুদের আজ্ঞাবহ হয়ে এ দেশে নৃশংস হত্যাযজ্ঞে সহযোগিতা করেছিল, সেই পাকিস্তানি প্রভুরা কিন্তু সে কথা বলে না! তারা বলে, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বা আলশামস বাহিনী আসলে ছিল পুরোপুরি জামায়াতে ইসলামের সশস্ত্র বাহিনী।

বঙ্গবন্ধুর নামে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি এ রকম: তিনি সব যুদ্ধাপরাধীকে মাফ করে দিয়েছেন, সে জন্য যুদ্ধাপরাধীদের কোনো দিন বিচার করা যাবে না। এটি একটি মিথ্যা অপপ্রচার, খুন-জখম-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগ—এ ধরনের বড় বড় অপরাধ করেনি এ রকম ২৬ হাজার মানুষকে শর্তসাপেক্ষে ক্ষমা করা হয়েছিল। (সেই সময়ে কেন তাদের ক্ষমা করা হয়েছিল, এর পেছনে সম্ভবত নানা রকম কারণ ছিল। কিন্তু এখন আমাদের মনে হয়, তাদেরও ক্ষমা করা উচিত হয়নি।) ১১ হাজার ঘাগু যুদ্ধাপরাধীকে মোটেও ক্ষমা করা হয়নি। তারা বিচারের অপেক্ষায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলখানায় অপেক্ষা করছিল। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে দেশের শাসনভার নিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনটিই বাতিল করে রাতারাতি ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে মুক্ত করে দিলেন। এরা নতুন উদ্যমে তাদের ষড়যন্ত্রে ঝাঁপিয়ে পড়ল—যেসব যুদ্ধাপরাধী দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, তারাও বুক ফুলিয়ে দেশে ফিরে আসতে শুরু করল। আমাদের দেশের জন্য সেটি ছিল অন্ধকার জগতের শুরু।

আমাদের জন্য এটি বিশাল এক সৌভাগ্য যে আমরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পেরেছি। জাতীয় সংসদে সেটি নিয়ে একটি প্রস্তাব পর্যন্ত পাস করা হয়েছে—যুদ্ধাপরাধীরা যেন আবার একাত্তরের মতো দেশ থেকে পালিয়ে না যেতে পারে সে জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মাঝেমধ্যে গায়ে চিমটি কেটে দেখি, এটি সত্যিই ঘটছে, নাকি স্বপ্ন দেখছি!

যুদ্ধাপরাধীদের কোন আইনে বিচার করবেন, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করছেন। আমরা বিশেষজ্ঞ নই, সোজা ব্যাপার সোজা করে বুঝি। রাষ্ট্র যদি চায়, খুন-জখম-ধর্ষণ-অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধের বিচার ১০০ বছর পরও করতে পারে। পঁচাত্তর সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইনটি বাতিল করা হলেও The International Crimes Tribunals Act 1973 বাতিল করা হয়নি। (যুদ্ধাপরাধীদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের চোখ কেমন করে এটি এড়িয়ে গেল কে জানে!) এই আইনে বিচার করতে হলে অপরাধীদের কোনো সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে—সিদ্দিক সালিক তাঁর বইয়ে পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন, রাজাকার, আলবদর ও আলশামস পুরোটিই ছিল জামায়াতে ইসলামীর বাহিনী! দেশের বড় বড় কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীরা ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘ আর বদরবাহিনীর সদস্য। আমার স্বল্প বুদ্ধি বলে, কোনো নতুন আইন না করে এ আইনেই ঝটপট যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে ফেলা সম্ভব। এতে সুবিধা হচ্ছে, এটি ব্যবহার করে এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল তৈরি করা যাবে। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ হিসেবে খবরের কাগজের প্রতিবেদন, ছবি, দলিল, গণকবর—এগুলোই ব্যবহার করা যাবে। তদন্তের ব্যাপারটিও প্রচলিত আইন থেকে অনেক সহজ।

সরকার এখন পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশ্রুতিটুকু রক্ষা করে এর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একাত্তর সালে যেসব দেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল, তারা নিশ্চয়ই আবার এর বিরোধিতা করবে। কিন্তু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ। পৃথিবীর অনেক বড় বড় দেশের ভ্রূকুটিকে তোয়াক্কা না করে এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল—প্রায় তিন যুগ পর আবার নিশ্চয়ই সত্যিকার স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের মতো মাথা উঁচু করে এই বিচারকাজ শেষ করে আমাদের কলঙ্কের কালিটুকু মুছে ফেলবে!

এ বিচারপ্রক্রিয়ায় আমার যেটুকু আগ্রহ তার থেকে আমার অনেক বেশি আগ্রহ এর ভেতর থেকে যে সত্য বের হয়ে আসবে সেই সত্যটুকুতে। পৃথিবীর ইতিহাসে আমরা সেই সত্যটুকু খোদাই করে লিখে দেব। অনন্তকাল পরও পৃথিবীর মানুষ জানবে, যে কুলাঙ্গারেরা মাতৃভূমির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, বাংলাদেশের মানুষ তাদের ক্ষমা করেনি।

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৯ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত