বিজ্ঞাপন
default-image

কেঁদো না।

বুকটা ভেঙে যখন গুঁড়িয়ে যায়—ক্রমাগত জল পড়ার শব্দ শুনি, ভেতরে কাঁপুনি অনুভব করি, তখন শব্দটা নির্দেশের মতো এসে কঠিন হয়ে সামনে দাঁড়ায়।

আকস্মিক বিমূঢ়তায় কান্নার রেশ যখন কমে আসে, সেই কণ্ঠস্বর নরম স্বরে বলে, প্রতিদিনই তো বলি কেঁদো না। আমি তো তোমার ভেতরেই আছি, শুধু দেখতে পাও না।

মনে হয় কেউ যেন নূপুর পায়ে চলে গেল—কী অপূর্ব সুন্দর সেই চলার ছন্দ—মৃদু মূর্ছনা ধ্বনিতরঙ্গ তুলে বাতাসের সঙ্গে ছুটে যায়।

কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই।

আবার সেই কঠিন নির্দেশ, বলেছি না কবরের কাছে এসে দাঁড়াবে না।

চোখের জল সামলাতে কষ্ট হয়। তোলপাড় করে ওঠে বুকের ভেতরের সবটুকু। সেই সঙ্গে কবরস্থানের যাবতীয় সবুজ বৃক্ষ।

আহ্, আবার তুমি কাঁদছ। বলেছি না কেঁদো না।

তুমি ফুল ভালোবাসতে। আমি তোমার জন্য ফুল নিয়ে আসি।

বলেছি না, আমি এখানে নেই।

হাঃ-হাঃ হাসির শব্দ আমার দুকান ভরে বাজে। আমি কথা বলতে পারি না। আমার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ। কথা বের হয় না। আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকি। তারপরও স্তব্ধতার ভেতর থেকে মাথা তুলে বলি, তোমাকে খোঁজার জন্য এটাই তো আমার ঠিকানা।

আমি তো জানি তুমি সবখানে আমাকে দেখতে পাও। তারপরও তোমার ঠিকানার দরকার হয় কেন?

আমি চুপ করে থাকি। বলতে পারি না যে ঠিকই বলেছ। সর্বত্র তোমার অস্তিত্ব বিরাজমান আমার প্রতিদিনের অনুভবে। সত্যিই তো, আমি কেন তোমাকে এক জায়গায় খুঁজব?

বলো দরকার হয় কেন?

সে তুমি বুঝবে না। তোমার জীবনে আমি নেই হয়ে গেলে তুমি বুঝতে পারতে।

ভাগ্যিস আমার জীবনে তেমন অন্ধকার নামেনি।

তাহলে বোঝ—

তুমি এখন যাও। আর দাঁড়িয়ে থেকো না।

আমি যাব না।

কেন আসো? আর আসবে না।

তুমি ফুল ভালোবাসতে। আমি ফুল নিয়ে আসি।

তুমি আমার ঘরে ফুল রেখে দিয়ো। তাহলেই হবে।

আমার কাছে তা হয় না।

আহ্, কেন যে এমন করো বুঝি না।

তুমি মোমবাতি ভালোবাসতে। আমি মোমবাতি জ্বালাতে আসি।

নিস্তব্ধ হয়ে থাকে কবরস্থান। শুধু শোনা যায় দোয়া পড়ার মৃদু সুরেলা কণ্ঠ কিংবা কোথাও ছেলেমেয়েরা হইচই করে খেলছে। আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি, ও বাড়ি থেকে বের হলো কখন? জানতেই পারলাম না। কোথায় গেল? আমাকে তো একবার বলে যাবে? নাকি ওর সময় ছিল না আমাকে বলার? এমনই করে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে মা-বাবাকে ফাঁকি দেওয়ার নানা কৌশল নিজেরাই খুঁজে বের করে। আমি ফিরে আসতে থাকি দুপাশে সারি সারি কবরের মাঝের সরু রাস্তা দিয়ে। প্রিয়জনেরা কত যত্নে কবরগুলো বাঁধিয়েছে—কত সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছে—নাম-জন্ম-মৃত্যু তারিখ—লাগিয়েছে ফুলগাছ। মাথার ওপরের শিরীষ গাছটায় একঝাঁক চড়ুই আকস্মিকভাবে কিচকিচ করে উঠলে আমি চমকে উঠি। মনে হয় ও বুঝি ওর ছোটবেলার মতো দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে আমাকে চমকে দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপরে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে গাছের দিকে তাকাই।

বলেছি না, আমি তো আছি তোমার ভেতরে। তুমি শুধু দেখতে পাও না।

আমি তো দেখতে চাই।

সব আকাঙ্ক্ষা কি মানুষের পূরণ হয়? তোমার অভিজ্ঞতা কি তাই বলে?

আমি একটু ছুঁতে চাই তোমাকে।

হাঃ-হাঃ ধ্বনিতে ভেসে যায় চারপাশ। দেখতে পাই পাখা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে চড়ুইয়ের ঝাঁক। আমার মাথাটা কেমন জানি করে। আমি একটি গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। চোখ বুজে আসে। না, আমি এখন আর কাঁদতে পারি না। ছোট্ট একটি মেয়ে আমার আঁচল ধরে টানে।

খালা আম্মা।

আমি ওর দিকে তাকাই। ওর কণ্ঠটি ভীষণ মিষ্টি। আমার হূদয় ছুঁয়ে যায় ওর ডাক। ও আবার ডাকে, খালা আম্মা।

কি রে।

একটা টাকা দেন।

কী খাবি?

মুড়ি।

সকালে কী খেয়েছিস?

কিছু না।

বাড়ি কোথায়?

বাড়ি? মেয়েটির চোখ বস্ফািরিত হয়।

আমি কথা ঘুরিয়ে বলি, থাকিস কোথায়?

যেখানে জায়গা পাই সেখানে।

মা নেই?

মাকে বাবা মেরে ফেলেছে।

মেরে ফেলেছে?

হ্যাঁ, আমি নিজের চোখে দেখেছি।

আচ্ছা থাক, আর বলতে হবে না।

মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয় ভাঙা কবরের ভেতরে মাদুর বিছিয়ে ঘুমাব।

রোজ রোজ জায়গা খুঁজতে ভালো লাগে না। এখানে আপনার কে আছে?

আমি চমকে ওর দিকে তাকাই। ও কত সহজভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করছে। কবরস্থানে ঘুরে ঘুরে ও দুঃখ ভুলে গেছে। নাকি দুঃখ ওর বুকের অতলে ডুবেছে।

খালা আম্মা বললেন না এখানে আপনার কে আছে?

মেয়ে। তোর নাম কি রে?

লতা। মা ডাকত পুতলি বলে।

আমিও তোকে পুতলি ডাকব। তুই আমার সঙ্গে যাবি? থাকবি আমার বাসায়?

ও জোরে জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, না। আপনি আমারে একটা টাকা দেন।

আমি ওর হাতে ১০টা টাকা দেই। ও প্রথমে নিতে চায় না। বলে, এত টাকা লাগবে না। আচ্ছা, ঠিক আছে দেন, টাকার জন্য আমি আপনার মেয়ের কবরের গাছে পানি দিয়ে দেব।

তোকে পানি দিতে হবে না। পানি তো ইউসুফ দেয়।

তাহলে থাক।

ও টাকাটা আমার হাতে গুঁজে দিয়ে ছুটে চলে যায়। আমি পেছন থেকে পুতলি, পুতলি করে ডাকি। ও তাকায় না। গাড়িতে ওঠার সময় অন্য একটি এসে বলে, আপনি আবার যখন আসবেন তখন লতা আপনার সঙ্গে যাবে বলেছে। ও আমাকে পাঠিয়েছে আপনার মেয়ের কবরটা দেখিয়ে দিতে। ও দেখাশোনা করবে। ও যেখানে যায় ওর সঙ্গে পাখি থাকে। ও বলেছে, আপনার মেয়েকে পাখির গান শোনাবে।

পাখির গান শোনাবে? আমি ভুরু কুঁচকে তাকালে ও খিলখিল করে হাসে। বলে, লতা আসলে একটু—মানে একটু পাগলি। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে। ওর খুব কষ্ট।

কষ্ট! আমার বুকের ভেতর শব্দটা কবরস্থানের নিস্তব্ধতার মতো ভারী হয়ে বুকের সমতল চেপে রাখে। ওখানে আর কোনো দিন ঘাস গজাবে না, তৃণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে না। বেগুনি রঙের ক্ষুদ্র ফুলটির ফোটার আর সময় নেই। আমার চোখ ভিজে যায়। আমি প্রবল কান্নায় দুহাতে মুখ ঢাকি।

কেঁদো না। বলেছি না, কেঁদো না। বাড়ি যাও।

কঠিন নির্দেশ হাঃ হাঃ ফিরে। আমি গাড়িতে উঠি।

২.

দেখো আকাশে কত নক্ষত্র।

কোনটা তুমি?

তোমার মেয়েকে তুমি চিনতে পারো না?

আমি তো সব তারায় তোমার মুখ দেখি।

তাহলে বোঝ যে ওই মাটির তলার ছোট্ট জায়গাটি আমাকে ধর রাখতে পারেনি। তুমি রোজ এই সিঁড়িতে বসে আকাশ দেখলে আমাকে পাবে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি।

আবার মন খারাপ করছ?

তুমি নেই কেন? আমি কোথায় আমার মনটাকে আটকে রাখব?

আটকে রাখবে কেন? ছেড়ে দাও। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলো, হূদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে।

তুমি রবীন্দ্রসংগীত ভালোবাসতে। তোমার আনন্দের সময়টিতে রবীন্দ্রসংগীত বাজাতে। যে লাইনটি আমাকে শোনালে তার পরের লাইনটি বললে না কেন? আমি বলি?

বলো। বললে তোমার মন হালকা হবে।

হূদয় আমার প্রকাশ হলো অনন্ত আকাশে/বেদন বাঁশি উঠল বেজে আকাশে-বাতাসে।

পরের লাইনটি আমার। তোমার জন্য ওটা রবীন্দ্রনাথ লেখেননি।

হাঃ-হাঃ হাসিতে ভরে যায় চারদিক। আমি দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তারাভরা আকাশ দেখি। মনে হয় আকাশে কী চমত্কার গাঢ় নীল বর্ণের বিচ্ছুরণ শুধু অন্ধকারের জন্য বর্ণহীন হয়ে আছে। নাকি নক্ষত্ররাজির অপরূপ সৌন্দর্যই বর্ণহীন আকাশের বর্ণ। আকাশ দেখা আমার প্রিয় অভ্যাস। এভাবে সময় কাটাতে আমি ভালোবাসি। আমার মেয়েটিরও এটি একটি প্রিয় অভ্যাস ছিল। একদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছিলাম ও বারান্দার সিঁড়িতে বসে আছে। বলেছিলাম, জেগে আছ যে? ঘুম আসছে না?

না, তা নয়। তোমার মতো আমারও ঘুম ভেঙে গেল। ভাবলাম, মধ্যরাতের আকাশ দেখি। এত সুন্দর লাগছে যে ঘরে ঢুকতে আর ভালো লাগছে না। আমি ঠিক করেছি, বাকি রাতটুকু বসে থাকব। কীভাবে দিনের আলো ফোটে দেখব। তুমি ঘুমুতে যাও।

তুমিও চলো

আমাকে ডেকো না। আমি যাব না।

সেদিন ওর ওপর আমার খুব রাগ হয়েছিল। মনে মনে বেয়াদব বলে গালি দিয়েছিলাম। রাগ ঝাড়ার জন্য চোখে-মুখে জোরে জোরে পানি দিয়েছিলাম। বাকি রাতটুকু আমার ঘুমিয়ে না-ঘুমিয়ে কেটেছিল। কখনো এমনই হয়। আমার সবটুকু ও কেড়ে রাখে। আজও এ ভাবনায় আমি দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে রাখি। রাত পোহানোর আগেই উঠে দেখি ও তখনো বসে আছে। কানে ওয়াকম্যান, গান শুনছে। তখনো ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নয়, বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, দেখো কি অপরূপ সাদা আলো জগত্-সংসারকে ভরিয়ে দিয়েছে, যেদিন আমি থাকব না, এই আলোর দিকে তাকিয়ে দেখলে বুঝবে আমি আছি।

আহ্। আমি কথা শেষ করতে পারি না। কান থেকে ওয়াকম্যান খুলে বলে, থামো থামো, তোমার কোনো কথা নাই। আমিই কথা। যখন জাগবে প্রথম আলোর শান্ত ভোরে আমি হব উড়ে যাওয়া দলছুট পাখি—ঘুরে ঘুরে ফিরে আসি। দেখে যাই তোমার রুপালি চুলের ঝিলিক, মুখের বলিরেখা, ক্লান্ত দৃষ্টি এবং দুহাত তুলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা।

তুমি এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছ কেন?

কষ্টই তো জীবনের গভীর আনন্দ। কঠিন সত্য এবং মধুরতম—

আমি থামো থামো বলার সঙ্গে সঙ্গে ও হো হো করে হেসেছিল। হাসতে হাসতে দৌড়ে গিয়ে ঢুকেছিল নিজের ঘরে। আমারই সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দরজা। এভাবেই ও আমাকে ভুলিয়েছে, ভুগিয়েছে এবং ভাবিয়েছে।

খালা আম্মা। চা খাবেন?

হ্যাঁ, খাব।

আমি আনছি।

কলমি চলে যায়। আমি ওকে কলমিলতা ডাকি। আমি ওকে এতিমখানা থেকে এনেছিলাম। স্কুলে ভর্তি করেছি। তবে বয়সের তুলনায় পড়ালেখায় পিছিয়ে আছে। ভালো রেজাল্ট করতে পারছে না। দুবার এসএসসিতে ফেল করেছে। ওকে সেলাইয়ের কাজ শেখাচ্ছি। ইচ্ছে আছে ভালো করে শিখতে পারলে একটা সেলাই মেশিন কিনে দেব। ভীষণ চঞ্চল। কোনো কিছু ভালো করে শিখতে চায় না। অল্পতেই অস্থির হয়ে যায়। আমি ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করি। ভাবি, শেষ পর্যন্ত মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে তো? কলমিলতা ফিরে আসে চা আর পুডিং নিয়ে।

খালা আম্মা।

বোস কলমিলতা।

আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবেন?

আমি পুডিং খেয়ে শেষ করি। বুঝিনি যে আমার ভীষণ খিদে পেয়েছিল। চায়ের কাপ হাতে নিলে কলমিলতা বলে, কালকে বাশার আমাকে বাজে কথা বলেছে খালা আম্মা।

বাশার! আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই। বাশার আমার ড্রাইভার। নিশ্চয় ওকে প্রেমের কথা বলেছে। ওর দিকে তাকালে ও মাথা নিচু করে।

কী হয়েছে বল?

ও আমাকে জারজ মেয়ে বলেছে।

জারজ মেয়ে?

হ্যাঁ খালা আম্মা, আমার বাবা-মায়ের তো পরিচয় নেই।

তাতে কী হয়েছে? ওর কী। তুই তোর পরিচয়ে বড় হবি। ও আপনাকে নিয়েও কথা বলেছে।

মানে?

বলেছে আপনি পাগল না হলে আমার মতো একটা নাম-পরিচয়হীন মেয়েকে বাসায় নিয়ে আসেন।

আরে ও তো দেখছি বাড়াবাড়ি করছে। তোমাকে নিয়ে ওর কী? ও কি তোকে ভালোবাসার কথা বলেছিল?

ভালোবাসা, বিয়েটিয়ে না, শুধু বিছানায় চায়।

বুঝেছি এ জন্য ওর গা জ্বলছে। দু-এক দিনের মধ্যে ওকে ভাগাব। আর একটা ড্রাইভার দেখেনি।

দুদিনের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটল। কলমিলতাকে এসিডে পুড়িয়ে পালিয়ে গেল বাশার। পুড়ে গেছে ওর মুখ। একটি চোখ গেছে। ঘাড়-গলাও। আমি মর্মাহত হয়ে তাকিয়ে থাকি। হাসপাতালের বিছানায় কলমিলতা তড়পায়। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি না। হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। কলমির দায়িত্ব নিয়ে আমি ওকে আমার কাছে এনেছিলাম। কিন্তু আমি ওকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি। আমারই বাড়িতে ও এভাবে পুড়ে যাবে? একটি অমানুষ ছেলেকে আমি চিনতেই পারিনি। আমি কি মানুষ?

দুঃখ পেয়ো না।

এত বড় ঘটনার পরও আমি দুঃখ পাব না। কী বলছ তুমি?

কথা বলতে গিয়ে আমার চোখে জল এসে যায়। নার্স এসে বলে, মেয়েটি মা, মা বলে চিত্কার করছে। আপনি আসুন।

আমি তো ওর মা না। আমি জানি না ওর মা কে? আমি কোথায় ওর মাকে খুঁজব?

আপনি এত কথা বলছেন কেন? আপনি আসুন না।

আমার চমক ভাঙে। তাই তো আমি পাগলের মতো প্রলাপ বকছি। কী হয়েছে আমার? আসলে আমি ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে চাইছি না। আমার ভয় করছে। লজ্জা করছে। আমার শরমে মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

কী হলো আপনার? আসুন না। মেয়েটা আপনাকে ডাকছে।

তুমি যাও মা। আমি আসছি। এক্ষুনি আসব।

নার্স আমার দিকে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে চলে যায়।

আমি বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার ইন্দ্রিয় বলে যে আমি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শুনতে পাব। নিজেকে সামলাতে না পারার জন্য ওর বকুনি শুনতে হবে। পরক্ষণে আমার মনে হয় কলমিলতার এ ঘটনার জন্য আমি দায়ী। ওকে যদি আমার কাছে নিয়ে না আসতাম, তাহলে হয়তো ওর এমন মরণদশা হতো না। সারা জীবনের জন্য ওকে এই দায় বয়ে বেড়াতে হবে। কী হবে ওর? কেউ তো নেই?

হাঃ-হাঃ হাসির শব্দ শুনতে পাই।

নিজেকে এমন করে দোষারোপ কোরো না।

ভুলটা কি আমার না?

না। তুমি তো ওর ভালোই চেয়েছিলে।

কিন্তু ওর জন্য কিছুই তো করতে পারিনি।

তাহলে দেখো মেয়েরা কত অরক্ষিত। তোমায় একার সাধ্য নেই এই অবস্থা থেকে মেয়েদের বাঁচানোর। এটা তো শুধু একটা ঘটনা। আর কতভাবেই তো মেয়েরা মরছে। দেখো আমাকে, তোমার কি সাধ্য ছিল আমাকে বাঁচানোর? তোমার কলমিলতা একভাবে পুড়েছে, আমি অন্যভাবে। তুমি ওর কাছে যাও।

আমি দ্রুতপায়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুকি। আমার বুক তোলপাড় করে। কলমিলতা সমানে বলে যাচ্ছে—মা, মাগো। আমি বলতে চাই, কলমিলতা আমি তোমার মাকে খুঁজব।

কিন্তু বলতে পারি না। আমি জানি, বললে মিথ্যে বলা হবে। সারা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ভেতর থেকে কীভাবে খুঁজব ওর মাকে। ও নিজেও তো জানে না কে ওর মা। আমি বেডের পাশে দাঁড়ালে ও একটি চোখ দিয়ে আমাকে দেখে। হাত ধরে বলে, মা, তুমিই আমার মা। কারও গর্ভে জন্ম নিলেই সে শুধু মা হয় না। তুমি আমার আপন মা। আর কেউ না, আর কেউ নেই আমার। মাগো, আমি সুন্দর পৃথিবীতে বাঁচতে চাই। তোমার মেয়ের ছবির মতো সুন্দর হতে চাই। মা আমি তোমার মেয়ের মতো ছবি আঁকতে চাই। গান শুনতে চাই। তুমি দেখো এখন থেকে আমি ঠিকমতো পড়াশোনা করব। আমি আর পরীক্ষায় ফেল করব না। আমি আপনার বুকের ভেতর ঘুমুতে চাই।

আমি কাঁদতে থাকি। এ মুহূর্তে আমি এক অসহায় মানুষ। ওর যন্ত্রণা কমাতে পারি না। ওর জীবনটাকে পূর্ণ করার সাধ্য আমার নেই। তবু ওকে বলি, কলমিলতা তুই বাড়ি ফিরলে তোকে আমি বুকে নিয়ে ঘুমাব।

নার্স এসে বলে, সরুন। ওকে একটা ঘুমের ইনজেকশন দেব।

নার্স আমাকে মৃদু ধাক্কা দেয়। মনে হয়, ও বলতে চায় অনেক আদিখ্যেতা দেখিয়েছেন। আর দেখাবেন না।

আমার মনে হয় নার্সের ধাক্কাটা আমার বুকে লেগেছে। আমি চোখে আঁচল চাপা দিই।

কেঁদো না।

তুমি আমাকে উপদেশ দিয়ো না।

উপদেশ নয়, তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি। কলমিলতার চিকিত্সা থেকে একটুও পেছাবে না। আর বাশারের বিচারের জন্য লড়ে যাবে। ও যেন ছাড়া না পায়।

আমি চুপ করে থাকি। ভাবি, হ্যাঁ এ দুটো কাজ আমাকে অবশ্যই করতে হবে। আমি তো এই সমাজের অরক্ষিত মানুষ নই। লড়াই করার সামর্থ্য আমার আছে।

আমি হাসপাতালের বারান্দা দিয়ে হেঁটে আসি। আশ্চর্য স্নিগ্ধ বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায়। আমি ভালো লাগার প্রবল অনুভূতিতে দাঁড়িয়ে পড়ি।

বলেছি না তোমাকে যে আমিই সহস্রমুখী বাতাস। অনবরত বয়ে যাই দিগন্ত থেকে দিগন্তে। ছুঁয়ে যাই তোমাকে ভালোবাসার যত্নে। তুমি মিছেই আমার জন্য ঠিকানা খোঁজ।

আমি নির্দিষ্ট ঠিকানায় থাকি না।

তুমি এভাবে থাকলে আমার মন ভরে না।

চারদিকে হাঃ-হাঃ হাসি।

বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসা ডাক্তার আমাকে বলেন, আপনি এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে?

কলমিলতা ভালো হবে তো ডাক্তার? আবার আগের মতো? সুন্দর, স্নিগ্ধ?

আশ্চর্য, একটা পালক মেয়ের জন্য—

না, না ও আমার মেয়ে। আমিই ওর মা।

চেনা ডাক্তার অবাক হয়। তারপর হাত ধরে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসে বলে, আপনি বাড়ি যান। একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবেন। আপনি ভীষণ ভেঙে পড়েছেন।

ওকে আবার আগের মতো করে দিতে হবে ডাক্তার।

আমি আমার মেয়ের বয়সী ডাক্তারের দুহাত চেপে ধরি। ডাক্তার বলে, আপনাকে কথা দিলাম ওকে আমি বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করব। আপনি সুস্থ থাকার চেষ্টা করুন। যান, বাড়ি যান।

আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকি। আমার হাঁটুতে ব্যথা আছে। নামতে কষ্ট হয়। কিন্তু ডাক্তারের কথা শুনে মনে হয় আমি অনেক সুস্থ। নামতে কষ্ট হচ্ছে না। মনে হচ্ছে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমি বাড়ি ফিরছি।

বলেছি না আমি বর্ষার তুমুল বৃষ্টিপাত। ঘনকালো মেঘের আড়াল ফুটো করে ছুটে আসি তোমার কাছে।

আমি আর পারি না, আর পারি না।

কেঁদো না। বাড়ি যাও।

আমি একটা রিকশায় উঠি।

কোথায় যাব খালা আম্মা?

শ্যামলীতে।

৩.

কদিন ধরে শরীর খারাপ। জ্বর-ঠান্ডায় কাবু হয়ে পড়েছি। ভালো লাগে কড়া দুপুর—বারান্দায় গিয়ে বসলে স্বস্তি পাই। বারান্দার রেলিংয়ে উড়ে আসে প্রজাপতি। চমত্কার দেখতে—ডানায় ভরা বিচিত্র রং।

আজ তোমাকে বেশ দেখাচ্ছে। কদিন খুব খারাপ গেল না?

হ্যাঁ, খুব খারাপ। কাশতে কাশতে মনে হতো দম বুঝি বের হয়ে যাবে।

খবরদার—না, আমার কাছে তোমার আসতে হবে না।

আমি তো যেতেই চাই।

চাইলেই হবে। আমি দরজায় পাহারা থাকব। ঢুকতেই পারবে না।

খিলখিল হাসি। রাস্তায় গাড়ির শব্দ, মানুষের কথা আমার কানে ঢোকে না। আমি শুধু হাসির অতলে তলাতে থাকি। এই কি আমার পাওনা ছিল? এমন লুকোচুরি, এমন আড়াল-আবডাল—এমন নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া, ক্লান্ত হওয়া।

মনে আছে তোমার—

কোনটা?

এমন চৈত্র দিনের মাস। ভীষণ গরম, ধু-ধু ধুলো উড়েছিল চারদিকে। ভেসে আসছিল গুলির শব্দ।

তুমি যুদ্ধদিনের কথা বলছ?

হ্যাঁ, আমরা সবাই পালাচ্ছিলাম।

শেষ পর্যন্ত আমরা নিরাপদেই ছিলাম।

কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা ছিল শারীরিক, মানসিক। আমরা যে আতঙ্কে ছিলাম, কোনো নিরাপদ মানুষ তেমন আতঙ্কে থাকে না।

ঠিক বলছ। আমি তোমার মতো ভাবিনি।

তুমি বোধ হয় অনেক দিন জোহরাকে দেখোনি।

হ্যাঁ, ও অনেক দিন ঢাকায় আসেনি।

আমি জানি ও ভালো আছে। চমত্কার দুটো ছেলেমেয়ে। মেধাবীও। ভালো রেজাল্ট করে।

স্বামীর সঙ্গে ওর কেমন কাটছে?

মোটামুটি ভালো। মাঝেমধ্যে লোকটা বিগড়ায়। পাকিস্তান সেনাদের বাংকার থেকে তুলে আনা জোহরাকে ও মাঝেমধ্যে খুব মানসিক কষ্ট দেয়। খোঁটা দেয়।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, তারপরও জোহরা একটি থাকার জায়গা পেয়েছে। অনেকে সেটাও পায়নি। তারাবন তো পাগল হয়ে রাস্তায় ঘুরছে।

ওদের বাড়িতে আমরা আশ্রয় পেয়েছিলাম। গাছগাছালিতে ভরা কী সুন্দর বাড়ি ছিল ওদের। আমরা বাড়ি ছাড়ার দুদিন পরই পাকসেনারা ওদের বাড়ি পুড়িয়ে দিল। তারাবন আপাকে ধরে নিয়ে গেল। ওর ভাই তো গত মাসেও তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেল।

মানিকটা খুব পাজি। বোনটাকে ঠিকমতো দেখাশোনা করে না।

তোমার দেওয়া টাকাটাও তারা আপার জন্য ব্যয় করে না।

তারপরও আমি দিয়ে যাই। টাকা নিতে এলে ওকে বোঝাই। ওকেও তো খারাপ ছেলে মনে হয় না। টাকাটা নেওয়ার সময় ও কেঁদে ফেলে। বলে, আপাকে আমি কথা শোনাতে পারি না। পাগলের সঙ্গে যুদ্ধ করা খুব কঠিন খালা আম্মা।

ওরা দুই ভাই ছাড়া ওর তো আর কেউ নাইরে মানিক। সোনা আমার ওকে একটু দেখিস। পাবনা মানসিক হাসপাতালে দিয়েছিলাম, ওখানেও ওকে বেশি দিন রাখল না। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য ও সব দিয়েছে, এখন গাঁয়ের গাছতলা, নদীর ধার, খেয়াঘাট, হাট-বাজার, পথ-প্রান্তর ওর আশ্রয়ের জায়গা।

ও দেশের স্বাধীনতার গন্ধ শোঁকে ঘুরে ঘুরে। হাঃ-হাঃ হাসিতে ভরে যায় আমার চারপাশ। নিজেকে বলি, তারাবনই সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা। ওর বুক থেকে স্বাধীনতার স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়নি। ওর কথা ভেবে আমার বুক তোলপাড় করে ওঠে। বলি, তুমি মাঝেমধ্যে আমার ভেতরটায় এত প্রবল ঝাঁকুনি দাও যে আমার সামলাতে কষ্ট হয়।

আবার হাঃ-হাঃ হাসি। হাসি থামতেই চায় না।

অনেকক্ষণ পরে বলে, কষ্ট না থাকলে জীবনের অর্থ পূর্ণ হয় না। কষ্টহীন মানুষ পরিপূর্ণ মানুষ না।

আমার শরীর কাঁপে। আমি অবসন্ন বোধ করি। দুঃখ আমাকে তার জলে ডুবিয়ে রেখেছে। দুঃখের অবগাহনে আমি কি পূর্ণ মানুষ হয়েছি?

সাত দিনের মধ্যে শরীরটা ঝরঝরে লাগে। বেশ স্বস্তি পাচ্ছি, বাইরে বের হচ্ছি। ঘরের কাজেও ক্লান্তি নেই। কাজের বুয়াদের তিনটে ছেলেমেয়েকে পড়াই। ওরাও আসছে। সেদিন যখন ওদের ছবির বই দেখিয়ে বললাম, ওই যে রেলিংয়ের ওপর প্রজাপতিটা বসে আছে ওটাকে দেখো, তখন ওরা অবাক হয়ে বলল, কেন ওটাকে দেখব?

ওটাকে দেখে শিখবে। এটাই লেখাপড়া।

ওরা তিনটি শিশু হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। আমিও মজা পাই। ওদের সঙ্গে হাসতে থাকি।

অদৃশ্য কণ্ঠের হাসি আমাদের সঙ্গে যোগ হয়।

দেখেছ, দুঃখের মধ্যে আনন্দ কত নির্মল। দুঃখ না থাকলে এই নির্মল আনন্দটুকু তুমি উপভোগ করতে পারতে না।

অনেকের জীবনে কোনো দুঃখ নাই।

ওদের আনন্দ উপভোগে ঘাটতি থাকে।

আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই। বাচ্চাদের বিস্কুট আর পেয়ারা খেতে দিই। ওরা আমাকে বলে, প্রজাপতিটা উড়ে গেছে। ওরা উচ্ছ্বসিত স্বরে প্রজাপতি বিষয়ে নানা কথা বলে, আমি মুগ্ধ হয়ে ওদের কথা শুনি। আমার জন্য একটি বিশাল সময় তৈরি হয়।

দুদিন পরে মানিক আসে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তারা আপার খুব অসুখ। বোধ হয় বাঁচবে না। আপনাকে দেখতে চায়। খালা আম্মা আমি আপনাকে নিতে এসেছি। যুদ্ধের সময় আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে যেই ঘরে ছিলেন, সেই ঘরটা গোছগাছ করে রেখে এসেছি। আপনি এক দিনের জন্য আমাদের সঙ্গে থাকবেন।

আমার খুব মন খারাপ হয়। মানিকের সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। জিজ্ঞেস করি, তারা কী খেতে চায় রে?

কিচ্ছু খেতে চায় না। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।

তুই বোস মানিক। আমরা বিকেলের বাসে যাব। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি।

বাসে বসে মানিক বলে, তারা আপা বোধ হয় পাগল হয়নি। এতদিন পাগল হওয়ার ভান করেছিল বোধ হয় খালা আম্মা।

বিস্ময়ে চমকে উঠে বলি, কী বলছিস তুই?

হ্যাঁ, খালা আম্মা, এটা আমার মনে হয়েছে।

কেন মনে হয়েছে?

যখন আমাকে ডেকে আপনাকে নিয়ে আসতে বলল, তখন দেখেছি তারা আপার দুই চোখ জ্বলে উঠেছে। একজন যোদ্ধার মতো জ্বলজ্বলে চোখ। খালা আম্মা পাগল মানুষের এমন দৃষ্টি আমি দেখিনি। আপনি দেখেছেন খালা আম্মা?

আমি চুপ করে থাকি। মানিক আমাকে জীবনবোধের গভীর বোধে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমি এই রহস্যের জট খুলতে পারব না। একমাত্র তারাবনই পারবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে।

আমি গিয়ে তারাবনকে জীবিত পাই না। আমরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণ আগে তারাবন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। মানিকের বউ জামিলা কোরআন শরিফ পড়ছে। পাড়া-প্রতিবেশীরা আশপাশে জড়ো হয়েছে। কেউ কেউ আমাকে বলে, আহারে আর একটু আগে যদি আসতেন। পাগলিটা আপনাকে কিছু একটা কথা বলতে চেয়েছিল। বলতে পারল না।

আমি সবার দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে বলি, উনি পাগলি এটা আপনাদেরকে কে বলল?

পাগলি না হলে কেউ রাস্তাঘাটে থাকে!

সবাই মিলেই তো তাকে রাস্তাঘাটে থাকার জন্য বের করে দিলেন। ঘর দিলেন না।

নিস্তব্ধ হয়ে থাকে সবাই। আমি উত্তেজিত কণ্ঠে বলি, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্পে থাকেননি, মুক্তিবাহিনীদের সাহায্যও করেছিলেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তাকে পতাকা দিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে হবে।

উপস্থিত সবার মাঝে গুঞ্জন ওঠে।

পতাকা! তারাবনের শরীরের ওপর পতাকা দেওয়া হবে।

মানুষের মাঝে গুঞ্জন গুমরে মরে।

আমি মানিককে বলি, মানিক চল উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে যাই। দেখি তিনি কী বলেন।

চেয়ারম্যান সাহেব মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন। বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকতে হলো বাইরে। একসময় তিনি ডাকলেন। তাকে বললাম, একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন আজ সকালে।

মুক্তিযোদ্ধা? কে?

চেয়ারম্যানের নির্বিকার কণ্ঠ।

মুক্তিযোদ্ধা তারাবন, আমি বলি।

আমার এলাকায় এই নামে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আছে বলে তো শুনিনি। তা ছাড়া কবে কোন কালে কে যুদ্ধ করেছিল তা মনে রাখা সম্ভব নাকি!

আমি তার কথা উপেক্ষা করে বলি, যিনি মারা গেছেন তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করতে হবে। জেলা শহরে তো যাওয়া সম্ভব না, দায়িত্বটা আপনাকে নিতে হবে।

দেখতে পাই ভুরু কুঁচকে থাকে চেয়ারম্যানের। স্পষ্টত বিরক্তি প্রকাশ করলেন। মানিক বলে, খালা আম্মা চলেন। আমি নড়ি না। চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, মেয়ে মানুষ, তাও আবার মুক্তিযোদ্ধা। বলেন নির্যাতিত নারী।

স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব দিয়েছেন।

আমার রাগ ওঠে। তিনি আমার ক্রুদ্ধ কণ্ঠ বুঝতে পারেন। তারপর কণ্ঠস্বর দ্বিগুণ করে বলেন, নির্যাতিত নারীদের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নাই। আপনি আসুন।

আমি উঠতে উঠতে ক্রুদ্ধ স্বরে বলি, আপনার বাবা বোধ হয় যুদ্ধের সময় রাজাকার ছিলেন।

হ্যাঁ, ছিলেন। শান্তি বাহিনীর চেয়ারম্যান ছিলেন।

আমি তার ঔদ্ধত্যে বিস্মিত হই না। এখন সময়টা এমনই চলছে। আকাশে শকুন ওড়ে।

উপজেলা অফিস থেকে বেরিয়ে পথে নামলে আমার বুক ভেঙে যায়। দুহাতে চোখ মুছি।

কেঁদো না।

অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আমাকে শাসন করে।

দেখো গ্রামের চারদিক থেকে মানুষজন মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে যাচ্ছে। দেখো আকাশ কত নীল। বুকভরে শ্বাস নিয়ে দেখো বাতাসে ফুলের গন্ধ ভাসছে। যাও নিজ হাতে তাঁকে ধোয়ানোর ব্যবস্থা করো।

আমি চোখভরা জল নিয়ে পা ফেলতে গেলে হোঁচট খাই।

কঠিন স্বর আমাকে শাসন করে, বলেছি না কেঁদো না

সূত্র: ২৬ মার্চ ২০০৭ প্রথম আলোর "স্বাধীনতা দিবস" বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত